বাইবেল জীবনকে পরিবর্তন করে
বাইবেল জীবনকে পরিবর্তন করে
কী একজন ব্যক্তিকে অন্যদের ভালোবাসতে এবং সাহায্য করার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পরিচালিত করেছিল, যিনি পূর্বে কারো সঙ্গে মেলামেশা করা পছন্দ করতেন না এবং পাঙ্ক রক ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? কীভাবে মেক্সিকোর একজন ব্যক্তি অনৈতিক জীবনযাপন পরিত্যাগ করেছিলেন? জাপানের একজন বিখ্যাত বাইসাইকেল রেসার ঈশ্বরকে সেবা করার জন্য কেন তার কেরিয়ার ছেড়ে দিয়েছিলেন? এই ব্যক্তিরা কী বলতে চায়, তা জানুন।
“আমি একজন কঠোর, উদ্ধত ও রাগী ব্যক্তি ছিলাম।”—ডেনিস ওবেরিন
জন্ম: ১৯৫৮ সাল
দেশ: ইংল্যান্ড
আগে আমি কারো সঙ্গে মেলামেশা করা পছন্দ করতাম না এবং পাঙ্ক রক ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম
আমার অতীত: আমার বাবা এবং তার পরিবার আয়ারল্যান্ডের বাসিন্দা ছিল আর আমি একজন আইরিশ ক্যাথলিক হিসেবে বড়ো হয়ে উঠি। আমাকে সাধারণত একা একাই গির্জায় যেতে হত, যদিও আমি সেখানে যেতে পছন্দ করতাম না। তবে, আমার মধ্যে ঈশ্বরকে জানার আগ্রহ ছিল। আমি নিয়মিত প্রভুর প্রার্থনা করতাম আর আমার এখনও মনে আছে, রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি সেই প্রার্থনার অর্থ বোঝার চেষ্টা করতাম। আমি প্রভুর প্রার্থনাকে ছোটা ছোটা অংশে ভাগ করতাম আর প্রত্যেকটা অংশের অর্থ বোঝার চেষ্টা করতাম।
কিশোর বয়সে আমি রাস্তাফারিয়ান আন্দোলনে যোগ দিই। এ ছাড়া, আমার বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় যেমন নাতসি-বিরোধী দলের প্রতি আগ্রহ ছিল। কিন্তু আমি পাঙ্ক রক ব্যান্ডের বিদ্রোহী কাজকর্মের সঙ্গেই বেশি জড়িত ছিলাম। আমি মাদকদ্রব্য সেবন করতাম, বিশেষ করে প্রায় প্রতিদিনই গাঁজা খেতাম। আমি কারো তোয়াক্কা করতাম না, প্রচুর পরিমাণে মদ খেতাম, নিজের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলতাম আর অন্যদের ব্যাপারে আমার কোনো চিন্তাই ছিল না। আমি কারো সঙ্গে মেলামেশা করতাম না আর যতক্ষণ না কারো সঙ্গে কথা বলা আমার জন্য আগ্রহজনক বলে মনে হত, ততক্ষণ আমি তার সঙ্গে কথা বলতাম না। আমি এমনকী কারো সঙ্গে ফোটো তুলতে পছন্দ করতাম না। আমার মনে পড়ে, সেই সময় আমি খুবই কঠোর, উদ্ধত ও রাগী ব্যক্তি ছিলাম। শুধুমাত্র যারা আমার ঘনিষ্ঠ ছিল, তাদের সঙ্গেই আমি সদয় মনোভাব ও উদারতা দেখাতাম।
প্রায় ২০ বছর বয়সে আমি বাইবেলের প্রতি আগ্রহী হই। আমার এক মাদক বিক্রয়কারী বন্ধু জেলে থাকার সময় বাইবেল পড়তে শুরু করে আর আমাদের মধ্যে প্রায়ই ধর্ম, গির্জা ও এই পৃথিবীতে শয়তানের ভূমিকা নিয়ে লম্বা আলোচনা চলত। আমিও একটা বাইবেল কিনি আর নিজে নিজে পড়তে শুরু করি। আমি ও আমার বন্ধু বাইবেলের একেকটা অংশ পড়তাম আর তারপর সেখান থেকে কী শিখেছি, তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য একত্র হতাম। এরপর আমরা একটা উপসংহারে পৌঁছাতাম। এভাবে প্রায় কয়েক মাস কেটে যায়।
বাইবেল পড়ার মাধ্যমে আমরা কিছু বিষয় বুঝতে পারি, যেমন আমরা এই জগতের শেষকালে বাস করছি, খ্রিস্টানরা যেন ঈশ্বরের রাজ্যে সুসমাচার প্রচার করে, তারা যেন এই জগতের বিভিন্ন বিষয়ে অংশ না নেয়, যেটার মধ্যে রয়েছে রাজনীতি আর বাইবেলই আমাদের সঠিক নৈতিক নির্দেশনা প্রদান করে। আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি, বাইবেলই হল সত্য আর অবশ্যই একটা সত্য ধর্ম রয়েছে। কিন্তু কোনটা সেই সত্য ধর্ম? আমরা প্রধান প্রধান গির্জার কথা চিন্তা করি কিন্তু তাদের মধ্যে রয়েছে শুধু জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি। এ ছাড়া, তারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকে। আমরা বুঝতে পারি, যিশু কখনোই এ-রকম ছিলেন না। আমরা এই সিদ্ধান্তে আসি যে, এই ধর্মগুলোর উপর ঈশ্বরের অনুমোদন নেই আর তাই আমরা কম জনপ্রিয় ধর্মগুলো কী শিক্ষা দেয়, সেই বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করি।
আমরা এই ধরনের ধর্মীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করি এবং তাদের অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি। আমরা জানতাম, বাইবেল প্রতিটা প্রশ্নের উত্তরে কী জানায় কিন্তু আমরা আসলে শুনতে চেয়েছিলাম, সেই ব্যক্তিরা ঈশ্বরের বাক্য অনুযায়ী উত্তর দেয় কি না। এই ধরনের সাক্ষাতের পর আমি সবসময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম। আমি তাঁকে বলতাম, ‘এই ব্যক্তিরা যদি সত্য ধর্ম পালন করে থাকে, তা হলে আমার মনের মধ্যে তাদের সঙ্গে পুনরায় দেখা করার ইচ্ছা দাও।’ বেশ কয়েক মাস কেটে যাওয়ার পরও আমি এমন কোনো দলের দেখা পাইনি, যারা বাইবেল অনুযায়ী আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল। এ ছাড়া, তাদের সঙ্গে পুনরায় দেখা করার কোনো আকাঙ্ক্ষাও আমার মনের মধ্যে আসেনি।
শেষপর্যন্ত যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। আমরা তাদের একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি, কিন্তু তারা বাইবেল থেকে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়। আমরা ইতিমধ্যেই যা জানতাম, সেগুলোর সঙ্গে তাদের উত্তর একেবারে মিলে যায়। তাই, আমরা তাদের সেই প্রশ্নগুলোও করি, যেগুলো আমরা বাইবেল থেকে খুঁজে পাইনি, যেমন ধূমপান ও মাদকসেবনের বিষয়ে ঈশ্বর কী মনে করেন? আবারও তারা ঈশ্বরের বাক্য ব্যবহার করে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেয় আর তাই আমরা কিংডম হলে তাদের সঙ্গে সভায় যোগ দেওয়ার জন্য রাজি হই।
সভায় যোগ দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন ছিল কারণ আমি লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করা পছন্দ করতাম না। তাই, সেই বন্ধুত্বপরায়ণ ও মার্জিত পোশাক-আশাক পরা ব্যক্তিরা যখন আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে আসে, তখন আমি তাদের পছন্দ করিনি। আমি এমনকী সন্দেহ করেছিলাম, তাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। আর তাই আমি তাদের কোনো সভাতে আর যেতে চাইনি। কিন্তু, প্রত্যেক বারের মতো এবারও আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, যদি এই ব্যক্তিরা সত্য ধর্ম সম্বন্ধে শিক্ষা দিয়ে থাকে, তা হলে আমার মনের মধ্যে যেন এই ব্যক্তিদের সঙ্গে আবারও দেখা করার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। আমি বুঝতে পারি, যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমার মনের মধ্যে গড়ে উঠেছে।
বাইবেল যেভাবে আমার জীবনকে পরিবর্তন করেছে: আমি জানি, আমাকে মাদকদ্রব্য সেবন করা বন্ধ করতে হবে আর খুব তাড়াতাড়ি আমি সেটা বন্ধ করে দিই। কিন্তু, সিগারেট ছাড়া আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর ছিল। আমি বেশ কয়েক বার ধূমপান ছাড়ার চেষ্টা করি, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। আমি যখন কোনো কোনো ব্যক্তিদের সম্বন্ধে জানতে পারি যে, তারা সহজেই সিগারেটের নেশা ছেড়ে দিয়েছে, তখন আমি যিহোবার কাছে এই বিষয় নিয়ে কথা বলি। শেষপর্যন্ত আমি যিহোবার সাহায্যে ধূমপানের নেশা ছাড়তে সমর্থ হই। আমি একটা মূল্যবান সত্য সম্বন্ধে বুঝতে পারি আর সেটা হল প্রার্থনায় যিহোবার কাছে সৎ ও খোলাখুলিভাবে কথা বলা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
আরেকটা যে-বড়ো পরিবর্তন আমাকে করতে হয়েছিল, সেটা ছিল আমার বেশভূষার ক্ষেত্রে। আমি প্রথম যে-দিন কিংডম হলে যাই, আমার চুলে চকচকে নীল রঙের স্পাইক ছিল। পরে, আমি উজ্জ্বল কমলা রং দিয়ে আমার চুল ডাই করি। আমি জিন্স ও চামড়ার জ্যাকেট পরতাম, যেগুলোতে বিভিন্ন স্লোগান লেখা ছিল। সাক্ষিরা আমার সঙ্গে যুক্তি করেছিল, কিন্তু আমি মনে করেছিলাম, এই বিষয়ে আমার পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। তবে শেষপর্যন্ত আমি ১ যোহন ২:১৫-১৭ পদের কথাগুলো নিয়ে চিন্তা করি, যেখানে বলে, “জগৎকে কিংবা জগতের বিষয়গুলোকে ভালোবেসো না। কেউ যদি জগৎকে ভালোবাসে, তা হলে পিতার প্রতি তার ভালোবাসা নেই।” আমি বুঝতে পারি যে, আমি আমার বেশভূষার দ্বারা দেখাচ্ছি, আমি জগৎকে ভালোবাসি। আমি যদি ঈশ্বরকে ভালোবাসতে চাই, তা হলে আমাকে এই ক্ষেত্রে পরিবর্তন করতে হবে আর আমি তা-ই করি।
একসময় আমি বুঝতে পারি, আমি যে খ্রিস্টীয় সভাগুলোতে যোগ দিই, তা কেবল সাক্ষিরা নয় কিন্তু ঈশ্বরও চান। ইব্রীয় ১০:২৪, ২৫ পদ থেকে আমি সেই সম্পর্কে জানতে পারি। এরপর, আমি প্রত্যেকটা সভায় যোগ দিতে শুরু করি এবং লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলি। যিহোবার কাছে বাপ্তিস্ম নেওয়ার মাধ্যমে আমি নিজেকে উৎসর্গ করি।
আমি যেভাবে উপকৃত হয়েছি: যিহোবা যে আমাকে তাঁর সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করেছেন, এই বিষয়টা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। যিহোবা আমার প্রতি সমবেদনা দেখিয়েছেন এবং আমার যত্ন নিয়েছেন আর এই বিষয়টা তাঁকে অনুকরণ করার ক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করেছে। সেইসঙ্গে আমি তাঁর পুত্র, যিশু খ্রিস্টকেও আমার জীবনের আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করতে পেরেছি। (১ পিতর ২:২১) আমি শিখেছি, খ্রিস্টীয় ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা করার সময়, আমি নিজের পরিচয়ও বজায় রাখতে পারি। আমি নিজের মধ্যে অন্যকে ভালোবাসা ও যত্ন নেওয়ার মনোভাব গড়ে তুলেছি। আমার স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে আচরণ করার সময় আমি খ্রিস্টকে অনুসরণ করার চেষ্টা করি। আমি মণ্ডলীর ভাই-বোনদের বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করি। খ্রিস্টকে অনুসরণ করার মাধ্যমে আমি মর্যাদা ও আত্মসম্মান লাভ করেছি আর অন্যদের প্রতি প্রেম দেখাতে সক্ষম হয়েছি।
“তারা আমাকে সম্মান করেছিল।”—গুয়াডালুপে বিলারিয়েল
জন্ম: ১৯৬৪ সাল
দেশ: মেক্সিকো
আগে আমি অনৈতিক জীবনযাপন করতাম
আমার অতীত: আমি মেক্সিকোর সোনোরা জেলার হারমোশিলো শহরের এক গরিব এলাকায় বড়ো হয়ে উঠি। আমরা মোট সাত জন ভাই-বোন ছিলাম। খুব ছোটোবেলায় আমার বাবা মারা যান আর তাই আমাদের ভরণ-পোষণ জোগানোর জন্য আমার মাকে কাজ করতে হত। আমি সাধারণত খালি পায়েই থাকতাম কারণ আমাদের জুতো কেনার মত যথেষ্ট পয়সা ছিল না। পরিবারের খরচ মেটানোর জন্য ছোটা থেকেই আমাকে কাজ করতে হত। অন্যান্য পরিবারের মতো আমরাও একটা ঘরেই একসঙ্গে অনেকে থাকতাম।
বেশিরভাগ সময়ই আমার মাকে বাড়ির বাইরে থাকতে হত আর তাই তিনি আমাদের সুরক্ষা দিতে পারতেন না। আমার বয়স যখন ৬ বছর, তখন ১৫ বছর বয়সি একজন ছেলে আমাকে যৌননিপীড়ন করতে শুরু করে। এটা বেশ অনেক সময় ধরে চলতে থাকে। এর ফলে আমি যৌনতার বিষয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। আমি চিন্তা করতে শুরু করি, পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। যখন আমি ডাক্তার কিংবা পাদরিদের কাছে সাহায্যের জন্য যাই, তারা আমাকে নিশ্চয়তা দেয়, এতে কোনো সমস্যা নেই আর আমার অনুভূতি একেবারে স্বাভাবিক।
১৪ বছর বয়সে আমি নিজেকে সমকামী ব্যক্তি হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরি। পরবর্তী ১১ বছর আমি এই ধরনের জীবনযাপন করি। এমনকী বেশ কিছু পুরুষের সঙ্গে সেই সময় আমার সম্পর্ক ছিল। পরে, আমি একজন হেয়ার স্টাইলিস্ট হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিই এবং নিজের একটা দোকান খুলি। কিন্তু আমি সুখী ছিলাম না। আমার জীবনে অনেক কষ্ট ছিল এবং অন্যরাও আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করত। আমি বুঝতে পারি, আমি সঠিক কাজ করছি না। আমি নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করি, এমন কোনো ব্যক্তি কি নেই, যে ভালো ও সাহায্যকারী?
আমি আমার দিদির কথা চিন্তা করি। সে যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করে এবং পরিশেষে বাপ্তিস্ম নেয়। সে আমাকে বলত, সে কী শিখছে কিন্তু আমি তাতে কোনো কান দিতাম না। তবে, তার ব্যক্তিগত ও বিবাহিত জীবন দেখে আমার খুব ভালো লাগত। আমি দেখতাম, সে ও তার স্বামী একে অপরকে কতটা ভালোবাসে এবং সম্মান দেখায়। তারা একে অন্যের সঙ্গে সদয়ভাবে আচরণ করে। একসময় একজন যিহোবার সাক্ষি আমার সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করে। প্রথম প্রথম আমি গতানুগতিকভাবে বাইবেল অধ্যয়ন করতাম কিন্তু পরে পরিস্থিতি পালটে যায়।
বাইবেল যেভাবে আমার জীবনকে পরিবর্তন করেছে: সাক্ষিরা আমাকে তাদের সভায় আমন্ত্রণ জানায় আর আমি সেখানে যাই। এটা আমার জন্য একটা নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। সাধারণত লোকেরা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করত কিন্তু সাক্ষিরা এমনটা করেনি। তারা আমাকে সদয়ভাবে অভ্যর্থনা জানায় এবং আমার সঙ্গে সম্মানপূর্বক আচরণ করে আর এটা আমার হৃদয় স্পর্শ করে।
আমি যখন প্রথম বার সম্মেলনে যোগ দিই, তখন যিহোবার সাক্ষিদের বিষয়ে আমার যে-ধারণা ছিল, সেটা আরও গভীর হয়। আমি এমনকী লক্ষ করি, তারা দলগতভাবেও আমার দিদির মতো সৎ ও ভালো ব্যক্তি। আমি চিন্তা করতে শুরু করি, এরাই কি সেই ভালো ও সাহায্যকারী ব্যক্তি, যাদের আমি এতদিন ধরে খুঁজছি? তাদের মধ্যে প্রেম ও একতা আর সেইসঙ্গে একটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তারা যেভাবে বাইবেল ব্যবহার করে, তা দেখে আমি খুবই অভিভূত হয়ে যাই। আমি উপলব্ধি করি, বাইবেলই তাদের জীবনকে ভালো করে তুলতে সাহায্য করেছে আর আমি বুঝতে পারি, তাদের মতো হওয়ার জন্য আমাকে নিজের জীবনে অনেক পরিবর্তন করতে হবে।
সত্যি বলতে কী, আমাকে নিজেকে পুরোপুরি পালটাতে হত কারণ একজন পুরুষ হয়েও আমি একজন মেয়ের মতো জীবনযাপন করছিলাম। আমাকে অনেক কিছু পরিবর্তন করতে হত, যেমন আমার কথা বলার ধরন, পোশাক-আশাক, বন্ধুবান্ধব, আচার-আচরণ এবং চুলের স্টাইল। আমার আগেকার বন্ধুরা আমাকে ঠাট্টা করে বলত: “কেন তুমি নিজেকে পরিবর্তন করছ? তুমি যেমন আছ, ঠিকই আছ। বাইবেল অধ্যয়ন করার কোনো দরকার নেই। তোমার তো কোনো কিছুরই অভাব নেই।” তবে, সবচেয়ে কঠিন যে-পরিবর্তন আমাকে করতে হয়েছিল, সেটা ছিল আমার অনৈতিক জীবনযাপন।
প্রথম করিন্থীয় ৬:৯-১১ পদের কথাগুলো আমার হৃদয় স্পর্শ করে। তাই, আমি বুঝতে পারি যে, আমার পক্ষেও এই বড়ো পরিবর্তনগুলো করা সম্ভব। এই পদ বলে: “তোমরা কি জান না, অধার্মিক লোকেরা ঈশ্বরের রাজ্য লাভ করবে না? ভ্রান্ত হোয়ো না। যারা যৌন অনৈতিকতায় রত আছে, প্রতিমাপূজক, ব্যভিচারী, সমকামী পুরুষ-বেশ্যা, সমকামী পুরুষ ... তারা ঈশ্বরের রাজ্য লাভ করবে না। আর তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ সেই ধরনের লোক ছিলে। কিন্তু, এখন তোমাদের শুচি করা হয়েছে।” যিহোবা অতীতেও তাঁর লোকদের পরিবর্তন হতে সাহায্য করেছিলেন আর তিনি আমাকেও সাহায্য করেছেন। এর জন্য বেশ কয়েক বছর লেগেছিল আর আমাকেও অনেকটাই প্রচেষ্টা করতে হয়েছিল কিন্তু সাক্ষিদের সাহায্য ও ভালোবাসার ফলে আমি নিজেকে পরিবর্তন করতে পেরেছিলাম।
আমি যেভাবে উপকৃত হয়েছি: বর্তমানে, আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছি। আমি বিয়ে করেছি আর আমরা আমাদের ছেলেকে বাইবেলের নীতি অনুযায়ী জীবনযাপন করতে শেখাচ্ছি। আমি আমার আগের জীবনকে পিছনে ফেলে এসেছি আর আমি আধ্যাত্মিকভাবে অনেক উপকৃত হয়েছি এবং অনেক সুযোগও পেয়েছি। আমি মণ্ডলীতে একজন প্রাচীন হিসেবে সেবা করি আর অন্যদের ঈশ্বরের বাক্যের সত্য জানাতে পারছি। আমার পরিবর্তন দেখে আমার মা অনেক খুশি হন আর তিনিও বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেন এবং বাপ্তিস্ম নেন। আমার একজন বোনও নিজের অনৈতিক জীবনযাপন পরিবর্তন করে একজন যিহোবার সাক্ষি হয়।
আমার পূর্ব পরিচিত ব্যক্তিরাও বুঝতে পারে, আমি ভালোর দিকে পরিবর্তন হয়েছি। আমি জানি, এই পরিবর্তনগুলো করার জন্য আমাকে কী কী করতে হয়েছে। আগে আমি পেশাদার ব্যক্তিদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে যাই কিন্তু তারা আমাকে ভুল পরামর্শ দেয়। তবে, যিহোবা আমাকে সত্যিই সাহায্য করেন। যদিও আমি নিজেকে অযোগ্য বলে মনে করতাম, কিন্তু তিনি আমাকে লক্ষ করেন আর আমার সঙ্গে প্রেম ও ধৈর্য সহকারে আচরণ করেন। মহৎ, প্রেমময় ও প্রজ্ঞাবান ঈশ্বর আমার প্রতি আগ্রহ দেখান আর চান, যেন আমি ভালো জীবনযাপন করি আর বাস্তবে এটাই ঘটেছে।
“আমি অসন্তুষ্ট ছিলাম এবং একাকিত্ব বোধ করতাম।”—কাজুরিও কুনিমোচি
জন্ম: ১৯৫১ সাল
দেশ: জাপান
আগে আমি বাইসাইকেল রেসার ছিলাম
আমার অতীত: আমি জাপানের শিজুকা প্রিফেকচার নামক এক শান্ত বন্দর শহরে বড়ো হয়ে উঠি। সেখানে আমাদের একটা ছোট্ট বাড়ি ছিল আর আমাদের পরিবারে মোট আট জন সদস্য ছিল। আমার বাবার একটা সাইকেল দোকান ছিল। ছোটোবেলা থেকেই তিনি আমাকে সাইকেল রেসে নিয়ে যেতেন, যাতে সেই খেলার প্রতি আমার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। আমার বাবা চাইতেন, আমি বড়ো হয়ে একজন সাইকেল রেসার হয়ে উঠি। তিনি এই বিষয়ে এতটাই আগ্রহী ছিলেন যে, স্কুলে পড়ার সময় প্রশিক্ষণ চালু করে দেন। হাই স্কুলে পড়ার সময় পর পর তিন বছর আমি বাৎসরিক জাতীয় অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতায় খেতাব অর্জন করি। স্কুল শেষ করার পর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাই কিন্তু আমি সেখানে যাইনি বরং সরাসরি একটা রেসিং স্কুলে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ১৯ বছর বয়সে আমি একজন পেশাদার রেসার হয়ে উঠি।
সেই বয়সেই আমার জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল, একদিন আমি জাপানের একজন শীর্ষ বাইসাইকেল রেসার হব। এ ছাড়া, আমি অনেক অর্থ উপার্জন করতে চেয়েছিলাম, যাতে ভবিষ্যতে আমার পরিবারে কখনো টাকাপয়সার সমস্যা না আসে। আমি প্রশিক্ষণ লাভ করার জন্য কঠোর প্রচেষ্টা করতে থাকি। প্রশিক্ষণ চলাকালীন আমি যখন কঠিন বিষয়গুলোর মুখোমুখি হতাম, তখন অনেক সময় ভয় পেয়ে যেতাম কিন্তু আমি নিজেকে বোঝাতাম, আমি একজন বাইসাইকেল রেসার হওয়ার জন্যই জন্মেছি আর যেভাবেই হোক আমাকে তা অর্জন করতে হবে। আমি প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাই আর সেই কঠোর পরিশ্রমের ফলে আমি সাফল্য অর্জন করি। প্রথম বছরেই আমি নতুন রেসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থান লাভ করি। দ্বিতীয় বছরে, আমি এমন এক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য যোগ্য হই, যেখানে জাপানের এক নম্বর রেসার নির্বাচন করা হয়। ছয় বার আমি সেই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করি।
আমি যখন অনেক পুরস্কার লাভ করতাম, তখন আমার বিষয়ে অন্যেরা বলাবলি করত যে, এই ব্যক্তি জাপানের টুকাই এলাকার গৌরব নিয়ে আসবে। আমার মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব খুবই প্রবল ছিল। একেক সময় আমার ভয় লাগত কারণ রেস চলাকালীন আমি কারো প্রতি দয়া-মায়া দেখাতাম না। আমার উপার্জন বেড়ে যায়, ফলে এমন যেকোনো জিনিস কেনার ক্ষমতা আমার ছিল, যেগুলো আমার ভালো লাগত। আমি একটা বাড়ি কিনি। সেখানে আমার ব্যায়াম করার জন্য একটা ঘর ছিল আর সেই ঘরে সবচেয়ে দামি দামি মেশিন ছিল। আমি একটা বিদেশি গাড়ি কিনি, যেটার মূল্য একটা বাড়ির দামের সমান। নিরাপত্তার জন্য আমি রিয়েল এস্টেট ও স্টক মার্কেটে টাকা ইনভেস্ট করি।
এত কিছু পাওয়া সত্ত্বেও, আমি অসন্তুষ্ট ছিলাম এবং একাকিত্ব বোধ করতাম। এই সময়ের মধ্যে আমি বিয়ে করি আর আমার তিন সন্তান হয়। কিন্তু প্রায়ই আমি তাদের প্রতি অধৈর্য হয়ে পড়তাম। আমি ছোটো ছোটো বিষয়েও আমার স্ত্রী ও সন্তানদের উপর রেগে যেতাম। আমি রেগে আছি কি না, তা জানার জন্য তারা ভয়ে ভয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত।
আমার স্ত্রী একসময়ে যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করে। এর ফলে, অনেক পরিবর্তন ঘটে। আমার স্ত্রী আমাকে বলে যে, সে সাক্ষিদের সভাতে যোগ দিতে চায় আর তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, আমরা পরিবারগতভাবে সেখানে যাব। আমার সেই রাতের কথা এখনও মনে পড়ে, যে-দিন একজন প্রাচীন আমার বাড়িতে আসেন এবং আমার সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেন। আমি যা শিখি, সেটা আমার উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
বাইবেল যেভাবে আমার জীবনকে পরিবর্তন করেছে: ইফিষীয় ৫:৫ পদ যেভাবে আমাকে নাড়া দিয়েছিল, তা আমি কখনো ভুলতে পারি না। এটি বলে: “যারা যৌন অনৈতিকতায় রত আছে, যারা অশুচি কাজ করে এবং যারা লোভী অর্থাৎ যাদের এক ধরনের প্রতিমাপূজক বলা যায়, তারা খ্রিস্ট ও ঈশ্বরের রাজ্য লাভ করে না।” আমি বুঝতে পারি, রেসিং জুয়া খেলার সঙ্গে যুক্ত এবং এই খেলা লোভী মনোভাব গড়ে তোলে। আমার বিবেক আমাকে দংশন করতে শুরু করে। আমি উপলব্ধি করি, আমি যদি যিহোবাকে খুশি করতে চাই, তা হলে আমাকে রেসিং ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার পক্ষে খুবই কঠিন ছিল।
সেই বছর আমি সবচেয়ে সন্তোষজনক ফলাফল লাভ করেছিলাম আর আমি আরও উন্নতি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, আমি লক্ষ করি, বাইবেল অধ্যয়ন করার মাধ্যমে আমার মধ্যে যে-শান্তিপূর্ণ মনোভাব গড়ে উঠছিল, সেটা প্রতিযোগীতায় জেতার মনোভাব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল! অধ্যয়ন শুরু করার পর আমি মোটে তিন বার রেসে অংশ নিই, কিন্তু আমি মন থেকে রেসিং ছাড়তে পারছিলাম না। কীভাবে আমি আমার পরিবারের ভরণ-পোষণ জোগাব, সেই নিয়েও আমি চিন্তায় পড়ে যাই। আমি না এগোতে পারছিলাম, না পিছোতে পারছিলাম আর সেইসঙ্গে আমার আত্মীয়স্বজনও আমার নতুন বিশ্বাস নিয়ে বিরোধিতা করতে শুরু করে। আমার বাবা খুবই হতাশ হয়ে পড়েন আর তাই আমিও মনের দিক দিয়ে খুবই ভেঙে পড়ি এবং আমার আলসার ধরা পড়ে।
সেই কঠিন সময়ে আমাকে যে-বিষয়টা সাহায্য করে, সেটা হল আমি বাইবেল অধ্যয়ন চালিয়ে যাই এবং যিহোবার সাক্ষিদের সভাতে যাওয়া বাদ দিইনি। আমার বিশ্বাস বাড়তে থাকে। আমি যিহোবার কাছে প্রার্থনা করি, যাতে আমি দেখতে পাই তিনি কীভাবে আমাকে সাহায্য করছেন। সেইসময় আমার চাপ কমে যায়, যখন আমার স্ত্রী আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলে যে, সুখী হওয়ার জন্য তার বড়ো বাড়ির প্রয়োজন নেই। ধীরে ধীরে আমি উন্নতি করতে থাকি।
আমি যেভাবে উপকৃত হয়েছি: আমি উপলব্ধি করি যে, যিশু মথি ৬:৩৩ পদে যা বলেছিলেন, তা একেবারে সত্য। সেখানে বলা আছে: “অতএব, তোমরা ঈশ্বরের রাজ্যকে এবং তাঁর দৃষ্টিতে যে-বিষয়গুলো সঠিক, সেগুলো করাকে সবসময় জীবনে প্রথম স্থান দাও, তা হলে এইসমস্ত বিষয়ও তোমাদের দেওয়া হবে।” এখানে ‘এইসমস্ত বিষয়’ বলতে যিশু যা বুঝিয়েছিলেন অর্থাৎ মৌলিক চাহিদাগুলোর আমরা কখনোই অভাব বোধ করিনি। যদিও আমার আয় ৩০ ভাগ কমে গিয়েছে, তবে বিগত ২০ বছরে আমার এবং আমার পরিবারের কোনো অভাব হয়নি।
ভালো বিষয়টা হল, সহবিশ্বাসীদের সঙ্গে যিহোবার উপাসনা করে যে-আনন্দ ও সন্তুষ্টি পাই, তা আমি আগে কখনো পাইনি। এরপর অনেক দিন কেটে যায়। আমার পারিবারিক জীবনে উন্নতি হতে থাকে। এখন আমার তিন ছেলে এবং তাদের স্ত্রীরা বিশ্বস্তভাবে যিহোবার সেবা করে চলেছে।