সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

তাদের পোশাক-আশাক ও সাজগোজ আমার জন্য বাধাস্বরূপ ছিল

তাদের পোশাক-আশাক ও সাজগোজ আমার জন্য বাধাস্বরূপ ছিল

তাদের পোশাক-আশাক ও সাজগোজ আমার জন্য বাধাস্বরূপ ছিল

বলেছেন ইলেন ব্রুমবা

আমি ওল্ড অর্ডার জার্মান ব্যাপটিস্ট ব্রেথরেন ধর্মের একজন সদস্য হিসেবে বড়ো হয়ে উঠি। এই ধর্ম অনেকটা অ্যামিস ও মেনোনাইট ধর্মের মতো। পিটিসম নামক আধ্যাত্মিক জাগরণের অংশ হিসেবে ১৭০৮ সালে জার্মানিতে ব্রেথরেন অগ্রগতি শুরু হয়। দি এনসাইক্লোপিডিয়া অভ্‌ রিলিজিয়ান বলে, “পিটিসমের উদ্দেশ্য ছিল, যাতে খ্রিস্টীয় সুসমাচারের প্রতি মানবজাতির বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।” এই ধরনের দৃঢ়বিশ্বাস থাকার ফলে বিভিন্ন দেশে এই অগ্রগতি সফলভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

১৭১৯ সালে আলেকজান্ডার ম্যাকের পরিচালনায় এই ধর্মের একটা ছোটো দল যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় এসে উপস্থিত হয়। সেই সময় থেকে এই দল ভাঙতে ভাঙতে অনেক ছোটো ছোটো দল গঠিত হয় এবং পরস্পর থেকে আলাদা হতে শুরু করে। প্রত্যেক দল আলেকজান্ডার ম্যাকের শিক্ষা নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করতে থাকে আর সেই অনুযায়ী চলতে থাকে। আমাদের ছোটা গির্জার সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০। আমাদের গির্জা এই বিষয়ের উপর জোর দিত, যেন আমরা বাইবেল পড়ি এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গির্জার সিদ্ধান্ত মেনে চলি।

প্রায় তিন প্রজন্ম ধরে আমাদের পরিবার এই বিশ্বাস অনুযায়ী জীবনযাপন করতে থাকে। আমিও এই গির্জায় যোগ দিই এবং ১৩ বছর বয়সে বাপ্তিস্ম নিই। আমি এই বিশ্বাস নিয়ে বড়ো হয়ে উঠি যে, কোনো গাড়ি, ট্র্যাক্টর, টেলিফোন এমনকী রেডিও অথবা যেকোনো বিদ্যুৎচালিত সরঞ্জাম রাখা কিংবা ব্যবহার করা ভুল। আমরা মেয়েরা সাধারণ পোশাক-আশাক পরতাম, চুল কাটতাম না আর মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতাম। আমাদের পুরুষেরা দাড়ি রাখত। আমাদের ধারণা ছিল, আধুনিক পোশাক-আশাক অথবা গয়নাগাটি পরা কিংবা রূপচর্চা করা জগতের অংশ। আমরা যদি তা করি, তা হলে আমরা গর্বিত হয়ে পড়ব, যেটা হল এক ধরনের পাপ।

আমাদের শেখানো হত, আমরা যেন বাইবেলের প্রতি গভীর সম্মান গড়ে তুলি কারণ বাইবেলের মাধ্যমেই আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি। প্রতিদিন সকালে জলখাবারের আগে আমরা বসার ঘরে জড়ো হতাম। আমার বাবা বাইবেল থেকে একটা অধ্যায় পড়তেন আর সেটার উপর মন্তব্য করতেন। আমরা মন দিয়ে তা শুনতাম। এরপর, বাবা প্রার্থনা করতেন আর সেইসময় আমরা সবাই হাঁটু গেড়ে বসতাম। পরে আমার মা প্রভুর প্রার্থনা পুনরাবৃত্তি করতেন। যেহেতু আমাদের পুরো পরিবার সেই উপাসনায় একত্রিত হত আর সেখানে আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হত, তাই আমি সেখানে উপস্থিত থাকার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম।

আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা রাজ্যের ডেলফি নামক শহরের কাছাকাছি একটা খামারে থাকতাম। আমাদের খামারে নানা ধরনের শস্য ও সবজি উৎপন্ন হত। আমরা সেগুলো ঘোড়ার পিঠে করে এবং ঘোড়ার গাড়ি করে শহরে নিয়ে যেতাম এবং সেখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অথবা দরজায় দরজায় গিয়ে বিক্রি করতাম। আমরা মনে করতাম, ঈশ্বরকে সেবা করার একটা অংশ হল, কঠোর পরিশ্রম করা। তাই আমরা কঠোর পরিশ্রম করার উপর মনোযোগ দিতাম। আমরা শুধুমাত্র রবিবারে কোনো “শ্রমসাধ্য কর্ম্ম” করতাম না। কিন্তু একসময়, আমাদের পরিবার চাষবাসের কাজে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, আধ্যাত্মিক কাজে মনোযোগ দেওয়া আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।

বিয়ে ও পরিবার

১৯৬৩ সালে ১৭ বছর বয়সে আমি জেমসকে বিয়ে করি। সেও আমার মতো ওল্ড ব্রেথরেন গির্জার একজন সদস্য ছিল। তার ঠাকুরদাদার বাবা-মায়ের সময় থেকেই তাদের পরিবার এই ধর্মের সদস্য। আমাদের দু-জনের মধ্যেই ঈশ্বরকে সেবা করার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল আর আমরা বিশ্বাস করতাম, আমাদের গির্জাই একমাত্র সত্য গির্জা।

১৯৭৫ সালের মধ্যে আমাদের ছয় জন সন্তানের জন্ম হয় আর ১৯৮৩ সালে আমাদের সপ্তম সন্তান অর্থাৎ সবচেয়ে ছোটো ছেলে জন্ম নেয়। এদের মধ্যে আমাদের দ্বিতীয় সন্তান রেবেকাই হল আমাদের একমাত্র মেয়ে। আমরা কঠোর পরিশ্রম করতাম, খুব বেশি খরচ করতাম না এবং সাধারণ জীবনযাপন করতাম। আমরা আমাদের সন্তানদের মধ্যেও সেই একই নীতি গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করি, যেটা আমরা আমাদের বাবা-মা এবং আমাদের গির্জার সদস্যদের কাছ থেকে শিখেছি।

ওল্ড ব্রেথরেন গির্জার সদস্যদের কাছে বাহ্যিক বেশভূষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা মনে করতাম, যেহেতু কেউ একজন ব্যক্তির হৃদয় পড়তে পারে না, তাই সেই ব্যক্তি যেভাবে পোশাক-আশাক পরে, সেটা তার হৃদয়ের অবস্থা প্রকাশ করে দেয়। সেইজন্য কোনো সদস্য যদি তার চুলে অতিরিক্ত স্টাইল করে, তা হলে সেটার অর্থ হল সে গর্বিত। এ ছাড়া, আমাদের পোশাকের উপর যদি কোনো বড়ো বড়ো ডিজাইন থাকে, তা হলে সেটাও দেখায় যে, আমাদের মনের মধ্যে অহংকার রয়েছে। একসময় এই বিষয়গুলো আমাদের কাছে শাস্ত্রের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

জেলে থাকার এক অভিজ্ঞতা

আমার স্বামীর ভাইয়ের নাম জেশি আর সেও ওল্ড ব্রেথরেন গির্জার সদস্য ছিল। সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকার করার কারণে ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে তাকে জেলে পাঠানো হয়। সেখানে থাকার সময় যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়, যারা তার মতোই মনে করত যে, যুদ্ধে যোগ দেওয়া বাইবেলের নীতির বিরুদ্ধে। (যিশাইয় ২:৪; মথি ২৬:৫২) জেশি সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেলের অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে এবং তাদের মধ্যে থাকা ভালো গুণাবলি তার নজর কাড়ে। বহু দিন অধ্যয়ন করার পর তিনি যিহোবার সাক্ষি হিসেবে বাপ্তিস্ম নেন। কিন্তু আমরা কেউ তার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত ছিলাম না।

জেশি নিজে যা শিখত, তা আমার স্বামীকেও বলত। এ ছাড়া, আমার স্বামী যেন নিয়মিত প্রহরীদুর্গসজাগ হোন! পত্রিকা পায়, সেটাও সে ঠিক করে দিয়েছিল। এই পত্রিকাগুলো পড়ার মাধ্যমে বাইবেলের প্রতি আমার স্বামীর আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পায়। আমার স্বামীর মনে ঈশ্বরকে সেবা করার গভীর আকাঙ্ক্ষা ছিল, কিন্তু প্রায়ই তার মনে হত যে, ঈশ্বর তার থেকে অনেক দূরে রয়েছেন। সেইজন্য ও যখন এমন কিছু জানতে পারত, যেটা তাকে ঈশ্বরের নিকটবর্তী হতে সাহায্য করে, তখন সেই বিষয়ে গভীর আগ্রহ দেখাত।

আমাদের অধ্যক্ষেরা আমাদের উৎসাহিত করতেন, আমরা যেন অ্যামিস, মেনোনাইটস এবং অন্যান্য ওল্ড ব্রেথরেন ধর্মের পত্রপত্রিকা পড়ি, যদিও আমরা আমাদের ধর্ম ছাড়া এইসমস্ত ধর্মকে জগতের অংশ বলে মনে করতাম। আমার বাবার যিহোবার সাক্ষিদের সম্বন্ধে অনেক ভুল ধারণা ছিল। তিনি মনে করতেন, আমাদের প্রহরীদুর্গসজাগ হোন! পত্রিকা কখনো পড়া উচিত নয়। তাই, আমি আমার স্বামীকে সেই পত্রিকাগুলো পড়তে দেখে ভয় পেয়ে যেতাম। আমার মনে হত, আমার স্বামী মিথ্যা শিক্ষায় জড়িয়ে পড়ছে।

কিন্তু, আমার স্বামীর মনে আমাদের গির্জার কিছু বিশ্বাস নিয়ে অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন প্রশ্ন ছিল। ও মনে করত, ওল্ড ব্রেথরেন গির্জার কিছু শিক্ষা বাইবেলে দেওয়া শিক্ষার বিপরীত, বিশেষ করে একটা শিক্ষা হল, রবিবারে “শ্রমসাধ্য কর্ম্ম” করা পাপ। উদাহরণস্বরূপ, ওল্ড ব্রেথরেন গির্জা শিক্ষা দিত, রবিবার পশুদের জল দেওয়া যেতে পারে কিন্তু আগাছা তোলা যাবে না। আমাদের গির্জার অধ্যক্ষরা বাইবেল থেকে তার এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেনি। ধীরে ধীরে আমার মনের মধ্যেও এই ধরনের শিক্ষা নিয়ে সন্দেহ জাগতে শুরু করে।

আমাদের মধ্যে অনেক দিন ধরে এই বিশ্বাস ছিল যে, আমাদের গির্জাই একমাত্র ঈশ্বরের উপাসনা করে আর সেইসঙ্গে আমরা এটাও বুঝতে পারি, ওল্ড ব্রেথরেন গির্জার সদস্যপদ ছেড়ে দিলে আমরা অনেক সমস্যায় পড়ব, তাই আমরা সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি। কিন্তু আমাদের বিবেক এই ধর্মে থাকার বিষয়ে আমাদের দংশন করছিল কারণ আমরা বুঝতে পারছিলাম, আমাদের গির্জা বাইবেলের শিক্ষা অনুযায়ী সম্পূর্ণভাবে চলছে না। তাই, ১৯৮৩ সালে আমরা আমাদের গির্জায় একটা চিঠি পাঠাই আর সেই চিঠিতে আমাদের সদস্যপদ ত্যাগ করার কারণ জানাই। আমরা এই চিঠি মণ্ডলীর সামনে পড়ার অনুরোধ জানাই। ফলে, আমাদের সেই গির্জা থেকে সমাজচ্যুত করা হয়।

সত্য ধর্মের খোঁজ

এরপর শুরু হয় সত্য ধর্মের খোঁজ। আমরা খুঁজতে থাকি, কোন ধর্ম তাদের শিক্ষা অনুযায়ী কাজ করে। প্রথমত, আমরা সেই ধর্মগুলো বাদ দিই, যেগুলো যুদ্ধে অংশ নেয়। তখনও আমাদের খোঁজাখুঁজি “সরল” ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল কারণ আমরা মনে করতাম, সাধারণ জীবনযাপন করা এবং সাধারণ পোশাক-আশাক পরা ইঙ্গিত দেয় যে, সেই ধর্মগুলো এই জগতের অংশ নয়। ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করি এবং একের-পর-এক ধর্ম পরীক্ষা করতে থাকি, যেমন মেনোনাইটস, কোয়েকার্স ও অন্যান্য “সরল” ধর্ম।

সেই সময় আমরা ইন্ডিয়ানার ক্যামডেন শহরের কাছাকাছি একটা খামার বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করি আর সেখানে যিহোবার সাক্ষিরা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসে। আমরা তাদের কথা শুনি কিন্তু তাদের অনুরোধ করি, তারা যেন শুধুমাত্র কিং জেমস্‌ ভারশন বাইবেল ব্যবহার করে। সাক্ষিরা যে যুদ্ধে অংশ নেয় না, সেই বিষয়টাকে আমি সম্মান করতাম। কিন্তু তারা যদি এটা মনে না করে যে, জগৎ থেকে আলাদা থাকার জন্য সাধারণ পোশাক-আশাক পরা প্রয়োজন, তা হলে আমার মতে তারা সত্য ধর্ম অনুসরণ করছে না আর তাই তাদের কথা শোনা আমার পক্ষে কঠিন ছিল। আমি ভাবতাম, আমাদের চেয়ে অন্য ধরনের পোশাক-আশাক পরার অর্থ সেই ব্যক্তি গর্বিত। এ ছাড়া আমার বিশ্বাস ছিল, জিনিসপত্র কিংবা বস্তুগত সম্পদ একজন ব্যক্তিকে অহংকারী করে তোলে।

আমার স্বামী আমাদের কয়েক জন ছেলেকে নিয়ে যিহোবার সাক্ষিদের কিংডম হলে যেতে শুরু করে। এর ফলে আমি খুবই দুঃখিত হয়ে পড়ি। আমার স্বামী আমাকে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে কিন্তু আমি রাজি হইনি। একদিন ও আমাকে বলে, “তুমি যদি তাদের সমস্ত শিক্ষার সঙ্গে একমত নাও হও, তাও তুমি একবার সেখানে গিয়ে দেখতে পার যে, তারা একে অন্যের সঙ্গে কেমন আচার-আচরণ করে।” এর কারণ হল, আমার স্বামী ইতিমধ্যেই তাদের আচার-আচরণ দেখে অভিভূত হয়েছিল।

শেষপর্যন্ত আমি সেখানে যেতে রাজি হই কিন্তু আমি খুবই সতর্ক থাকি। একটা সাধারণ পোশাক ও টুপি পরে আমি কিংডম হলে যাই। আমাদের কোনো কোনো ছেলে তো খালি পায়েই কিংডম হলে গিয়েছিল আর তাদের পোশাক-আশাকও খুবই সাধারণ ছিল। তা সত্ত্বেও, সাক্ষিরা আমাদের অভ্যর্থনা জানায়, আমাদের দিকে এগিয়ে আসে এবং আমাদের সঙ্গে প্রেমময় আচরণ করে। আমি মনে মনে চিন্তা করি, ‘এরা আমাদের থেকে কত আলাদা, কিন্তু তাও এরা আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে।’

আমি তাদের প্রেমপূর্ণ আচরণ দেখে খুবই অভিভূত হই কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি এই বিষয়ে দৃঢ় ছিলাম যে, আমি শুধুমাত্র তাদের লক্ষ করব। গানের সময় আমি এমনকী দাঁড়াইনি আর তাদের গানও গাইনি। সভার পরে আমি তাদের একের-পর-এক প্রশ্ন করতে থাকি। আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, কেন তারা সেই কাজগুলো করছে, যেগুলো আমার দৃষ্টিতে সঠিক নয়। এ ছাড়া, আমি তাদের কাছে বিভিন্ন শাস্ত্রপদের অর্থও জানতে চাই। যদিও আমি বিচক্ষণতার সঙ্গে প্রশ্ন করিনি, কিন্তু তাও আমি যাদের কাছে প্রশ্ন করি, তারা আমার প্রতি আগ্রহ দেখায়। আমি এটা জেনেও অভিভূত হই যে, আমি বিভিন্ন জনের কাছে একই প্রশ্ন করি আর তারা আমাকে একই উত্তর দেয়। কখনো কখনো তারা আমাকে উত্তরগুলো লিখে দিত আর সেটা আমার জন্য খুবই সাহায্যকারী হত। এর ফলে, আমি পরবর্তী সময়ে সেই উত্তরগুলো নিয়ে অধ্যয়ন করতে পারি।

১৯৮৫ সালের গরম কালে টেনেসি রাজ্যের মেমফিস শহরে যিহোবার সাক্ষিদের একটা সম্মেলন হয়। আমরা পরিবারগতভাবে সেই সম্মেলনে যাই শুধুমাত্র এটা দেখার জন্য যে, সম্মেলনে কী হয়। তখনও আমার স্বামীর দাড়ি ছিল আর আমরা সাধারণ পোশাক পরেছিলাম। বিরতির সময় এমন এক মুহূর্তও ছিল না, যখন কোনো-না-কোনো ব্যক্তি এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করেনি। তারা আমাদের প্রতি যে-প্রেম ও আগ্রহ দেখায় আর যেভাবে আমাদের মেনে নেয়, আমরা সেটার দ্বারা আকৃষ্ট হই। এ ছাড়া, আমরা তাদের একতা দেখেও অভিভূত হই। তারা যেকোনো স্থানেই মিলিত হোক না কেন, তাদের শিক্ষাও একই ছিল।

আমার স্বামী সাক্ষিদের দেখানো ব্যক্তিগত আগ্রহের জন্য বাইবেল অধ্যয়ন করতে রাজি হয়। ও যেগুলো শিখত, সেগুলো আসলেই সত্য কি না, সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রতিটা বিষয় খতিয়ে দেখত। (প্রেরিত ১৭:১১; ১ থিষলনীকীয় ৫:২১) একসময় আমার স্বামী বুঝতে পারে, ও সত্য খুঁজে পেয়েছে কিন্তু আমি দোটানার মধ্যে পড়ে যাই। আমি যা সঠিক, তা-ই করতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমি “আধুনিক” ও “জাগতিক” বলে চিহ্নিত হতে চাইনি। আমি যখন প্রথম বার বাইবেল অধ্যয়নে বসতে রাজি হই, তখন আমার এক কোলে ছিল কিং জেমস্‌ ভারশন, আরেক কোলে ছিল নতুন জগৎ অনুবাদ, যেটা ওই বাইবেল থেকে অনেক আধুনিক। আমি প্রত্যেকটা শাস্ত্রপদ দুটো বাইবেল থেকেই মিলিয়ে দেখি, যাতে আমাকে বোকা বানানো না হয়।

যেভাবে আমি দৃঢ়নিশ্চিত হই

সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করার মাধ্যমে আমরা শিখি যে, আমাদের স্বর্গীয় পিতা একমাত্র ঈশ্বর, ত্রিত্বের কোনো অংশ নন আর আমাদের মধ্যে কোনো অমর আত্মা নেই। (দ্বিতীয় বিবরণ ৬:৪; ১ করিন্থীয় ৮:৫, ৬) এ ছাড়া, আমরা শিখি, নরক কোনো অগ্নিময় যাতনার স্থান নয় বরং মানবজাতির এক সাধারণ কবর। (ইয়োব ১৪:১৩; গীতসংহিতা ১৬:১০; উপদেশক ৯:৫, ১০; প্রেরিত ২:৩১) যেহেতু ওল্ড ব্রেথরেন গির্জায় নরক সম্বন্ধে যে-শিক্ষা দেওয়া হত, সেই শিক্ষার সঙ্গে এই শিক্ষার অনেক পার্থক্য রয়েছে, তাই তা আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

কিন্তু, তখনও আমি এই বিষয় নিয়ে উদ্‌বিগ্ন ছিলাম যে, সাক্ষিরা কীভাবে সত্য ধর্ম পালন করতে পারে কারণ আমি মনে করেছিলাম, তারা জগতেরই অংশ। আমার মতে জগতের অংশ না হওয়ার জন্য “সরল” জীবনযাপন করা প্রয়োজন কিন্তু তারা তো তা করছিল না। একইসময়ে আমি উপলব্ধি করি যে, তারাই সমস্ত লোকের কাছে রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করার মাধ্যমে যিশুর আজ্ঞা পালন করছিল। আমি বুঝে উঠতে পারিনি যে, আমি কী করব!—মথি ২৪:১৪; ২৮:১৯, ২০.

এই সময়ে সাক্ষিদের ভালোবাসা আমাকে তাদের পরীক্ষা করে দেখতে সাহায্য করে। মণ্ডলীর সবাই আমাদের পরিবারের প্রতি আগ্রহ দেখায়। মণ্ডলীর সদস্যেরা যখন দুধ ও ডিম কেনার বাহানায় আমাদের কাছে আসত, তখন আমরা লক্ষ করতাম যে, তারা সত্যিই ভালো লোক। কোনো একজন নির্দিষ্ট সাক্ষি আমাদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করছিল বলে অন্যেরা যে আমাদের বাড়িতে আসা ছেড়ে দিয়েছিল, এমন নয়। মণ্ডলীর কোনো ভাই অথবা বোন যদি আমাদের বাড়ির কাছাকাছি আসতেন, তা হলে তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করে যেতেন। সাক্ষিদের জানার জন্য আমরা এই সুযোগেরই অপেক্ষায় থাকতাম আর আমরা তাদের প্রকৃত ভালোবাসা ও আগ্রহের প্রতি উপলব্ধি দেখাই।

এই ব্যক্তিগত আগ্রহ কেবলমাত্র আমাদের মণ্ডলীর কাছাকাছি থাকা সাক্ষিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আমি যখন পোশাক-আশাক ও সাজগোজের বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলাম, তখন কাছাকাছি মণ্ডলীর একজন সাক্ষি বোন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। বোনের নাম ছিল কে ব্রিগস্‌ আর তিনি সাধারণ পোশাক-আশাক পরতেন আর সাজগোজ করতেন না। আমি তার সঙ্গে স্বচ্ছন্দে ও মন খুলে কথা বলি। একদিন আরেকজন ভাই লুইস ফ্লোরা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, যিনি নিজেও “সরল” ধর্মে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আমার মুখ দেখে বুঝতে পারেন, আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছি আর তা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাকে দশ পাতার একটা চিঠি লেখেন। তার সদয় মনোভাব দেখে আমার চোখ জলে ভরে যায় আর আমি সেই চিঠি বার বার পড়ি।

আমার একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়, যার নাম হল ওডেল। তাকে আমি যিশাইয় ৩:১৮-২৩ এবং ১ পিতর ৩:৩, ৪ পদ ব্যাখ্যা করতে বলি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, “এই শাস্ত্রপদগুলো কি দেখায় না যে, ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য সাধারণ পোশাক-আশাক পরা প্রয়োজন?” তিনি যুক্তি করে বলেন: “বোনেট বা টুপি পরা কিংবা চুলে বিনুনি করা কি ভুল?” ওল্ড ব্রেথরেন গির্জায় ছোটো মেয়েদের চুলে বিনুনি করা হয় এবং মহিলারা বোনেট পরে। আমি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি, তাদের শিক্ষার মধ্যে অমিল রয়েছে আর আমি ভ্রমণ অধ্যক্ষের ধৈর্য ও সদয় আচরণ দেখে অভিভূত হয়ে যাই।

ধীরে ধীরে আমি আরও দৃঢ়নিশ্চিত হই কিন্তু একটা সমস্যা আমার মনের মধ্যে থেকে যায় আর সেটা হল, কেন মহিলারা চুল কাটবে? প্রাচীনরা যুক্তি দেখিয়ে বলেন, কোনো মহিলার চুল কিছুটা লম্বা হয়, আবার অনেকের চুল অনেকটা লম্বা হয়। এর মানে কি এই যে, একজন মহিলার চুল আরেকজন মহিলার চেয়ে আরও ভালো? এ ছাড়া, তারা আমাকে পোশাক-আশাক ও সাজগোজের ব্যাপারে বিবেকের ভূমিকা সম্বন্ধে বুঝতে সাহায্য করেন আর আমাকে কিছু তথ্য দেন, যাতে আমি সেগুলো বাড়ি নিয়ে গিয়ে পড়তে পারি।

আমরা যা শিখি, তা কাজে লাগাই

আমরা উত্তম ফলের অন্বেষণ করছিলাম আর আমরা তা পেয়েও যাই। যিশু বলেছিলেন: “তোমাদের মধ্যে যদি প্রেম থাকে, তা হলেই সকলে জানবে, তোমরা আমার শিষ্য।” (যোহন ১৩:৩৫) আমরা নিশ্চিত হই, যিহোবার সাক্ষিরাই প্রকৃত প্রেম দেখায়। কিন্তু আমরা আমাদের বড়ো ছেলে নেথেন এবং বড়ো মেয়ে রেবেকাকে নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলাম কারণ তারা ইতিমধ্যেই ওল্ড ব্রেথরেন ধর্ম গ্রহণ করেছে এবং বাপ্তিস্ম নিয়েছে। শেষপর্যন্ত আমাদের শেখানো বাইবেলের সত্য আর সাক্ষিদের দেখানো প্রেম তাদের সত্যের প্রতি আকৃষ্ট করে।

যেমন, রেবেকা সবসময় চাইত যেন তার ঈশ্বরের সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে যখন জানতে পারে, কোনো ব্যক্তি কী কাজ করবে অথবা কোনো ব্যক্তির ভবিষ্যৎ কী হবে, তা ঈশ্বর আগে থেকে নির্ধারণ করে রাখেন না, তখন তার পক্ষে প্রার্থনা করা খুবই সহজ হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া, সে যখন উপলব্ধি করে যে, ঈশ্বর কোনো রহস্যময় ত্রিত্বের অংশ নন কিন্তু একজন প্রকৃত ব্যক্তি, যাঁকে সে অনুকরণ করতে পারে, তখন সে ঈশ্বরের আরও নিকটবর্তী হয়। (ইফিষীয় ৫:১) সে যখন জানতে পারে, ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাকে কিং জেমস্‌ ভারশনের পুরোনো ভাষা ব্যবহার করতে হবে না, তখন সে আরও খুশি হয়। এ ছাড়া, সে জানতে পারে প্রার্থনা সম্বন্ধে ঈশ্বরের কোন কোন চাহিদা রয়েছে আর সেইসঙ্গে কীভাবে তিনি পুরো মানবজাতির জন্য এক পার্থিব পরমদেশ নিয়ে আসবেন, যেখানে মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকার সুযোগ পাবে। এগুলো তাকে ঈশ্বরের আরও নিকটবর্তী হতে সাহায্য করে।—গীতসংহিতা ৩৭:২৯; প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪.

আমরা যে-বিশেষ সুযোগগুলো উপভোগ করেছি

আমি ও আমার স্বামী আর আমার প্রথম পাঁচ জন ছেলে-মেয়ে—নেথেন, রেবেকা, জর্জ, ড্যানিয়েল ও জন—১৯৮৭ সালে গরম কালে যিহোবার সাক্ষি হিসেবে বাপ্তিস্ম নেয়। এরপর, ১৯৮৯ সালে হার্লে এবং ১৯৯৪ সালে সাইমন বাপ্তিস্ম নেয়। আমাদের পুরো পরিবার ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার ঘোষণা করার কাজে ব্যস্ত রয়েছে, যে-কাজ করার জন্য যিশু তাঁর অনুসারীদের আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

আমাদের প্রথম পাঁচ ছেলে—নেথেন, জর্জ, ড্যানিয়েল, জন ও হার্লে আর সেইসঙ্গে আমাদের মেয়ে রেবেকা যুক্তরাষ্ট্রে যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিসে সেবা করার সুযোগ পায়। ১৪ বছর পর জর্জ এখনও সেখানে সেবা করে চলেছে আর ২০০১ সালে স্কুল শেষ করার পর সাইমন সবেমাত্র সেখানকার শাখা অফিসে একজন সদস্য হিসেবে যোগ দেয়। আমাদের সব ছেলেই যিহোবার সাক্ষিদের মণ্ডলীতে হয় প্রাচীন, নতুবা পরিচারক দাস হিসেবে সেবা করছে। আমার স্বামী মিশৌরির থায়ার মণ্ডলীতে একজন প্রাচীন হিসেবে সেবা করছে আর আমি পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছি।

আমাদের এখন দুই নাতনি রয়েছে, যাদের নাম জেসিকা ও ল্যাটিশা এবং এক নাতি রয়েছে, যার নাম কেলেব। আমরা এটা দেখে খুশি হই, শিশুকাল থেকেই তাদের বাবা-মা তাদের হৃদয়ে যিহোবার প্রতি ভালোবাসা গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। পরিবারগতভাবে আমার খুশি যে, যিহোবা আমাদের তাঁর প্রতি আকর্ষণ করেছেন আর যে-ব্যক্তিরা ঈশ্বরীয় প্রেম দেখায়, তাদের মধ্যে আমাদের থাকার সুযোগ দিয়েছেন।

আমরা সেই ব্যক্তিদের প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করি, যাদের মধ্যে ঈশ্বরকে খুশি করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে অথচ তাদের বিবেক বাইবেলের দ্বারা নয় কিন্তু তারা যেভাবে বড়ো হয়ে উঠেছে এবং তাদের পরিবেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। আমরা চাই তারাও আমাদের মতো আনন্দ উপভোগ করুক কারণ আমরা আগে ঘরে ঘরে গিয়ে শাকসবজি বিক্রি করতাম কিন্তু এখন আমরা তাদের বাড়ি গিয়ে ঈশ্বরের রাজ্য এবং ভবিষ্যতে তিনি যে-চমৎকার কাজগুলো সম্পাদন করবেন, সেই সম্বন্ধে জানিয়ে থাকি। আমি যখন সেই ব্যক্তিদের ধৈর্য ও প্রেমের কথা চিন্তা করি, যারা যিহোবার নাম বহন করে, তখন কৃতজ্ঞতায় আমার চোখ জলে ভরে যায়!

[ছবি]

আমি যখন প্রায় সাত বছরের ছিলাম এবং যখন প্রাপ্তবয়স্ক হই

[ছবি]

জেমস, জর্জ, হার্লে ও সাইমন সাধারণ পোশাক পরিহিত

[ছবি]

স্থানীয় সংবাদপত্রে বাজারে বিক্রি করার সময় আমার ছবি

[সৌজন্যে]

সাহিত্যাদি ও ডাক, লাফায়িটি, ইন্ডিয়ানা

[ছবি]

বর্তমানে আমাদের পরিবার