সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

রক্তাক্ত ইতিহাস

রক্তাক্ত ইতিহাস

রক্তাক্ত ইতিহাস

মাত্র কয়েক বছর আগে, সন্ত্রাসবাদ শুধু কয়েকটা বিচ্ছিন্ন জায়গা যেমন আয়ার্ল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল, স্পেনের উত্তরাঞ্চলের ব্যাস্ক কান্ট্রি এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল বলে মনে হয়। এখন—বিশেষত ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারের ধ্বংসের পর থেকে—এটা পৃথিবীব্যাপী দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, পরমদেশতুল্য বালি দ্বীপ; স্পেনের মাদ্রিদ; ইংল্যান্ডের লন্ডন; শ্রীলঙ্কা; থাইল্যান্ড; আর এমনকি নেপালেও সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু, সন্ত্রাসবাদ নতুন কোনো ঘটনা নয়। “সন্ত্রাসবাদ” শব্দটির অর্থ কী?

সন্ত্রাসবাদ শব্দটিকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, “বেশির ভাগ সময়ই ভাবাদর্শগত অথবা রাজনৈতিক কারণগুলোর জন্য বিভিন্ন সমাজ অথবা সরকারকে ভয় দেখানোর বা দমন করার উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠিত দলের দ্বারা লোকেদের অথবা সম্পদের বিরুদ্ধে শক্তি অথবা দৌরাত্ম্যকে বেআইনিভাবে বা হুমকিস্বরূপ ব্যবহার করা।” (দি আ্যমেরিকান হেরিটেজ ডিকশনারি অভ দি ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ) তবে, লেখিকা জেসিকা স্টার্ন বলেন: “সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পড়াশোনা করেন এমন একজন ছাত্র শত শত সংজ্ঞার সম্মুখীন হন . . . কিন্তু, সন্ত্রাসবাদের মাত্র দুটো বৈশিষ্ট্যই সন্ত্রাসবাদকে অন্যান্য দৌরাত্ম্য থেকে পৃথক করার জন্য অপরিহার্য।” সেগুলো কী? “প্রথমত, সন্ত্রাসবাদের লক্ষ্যবস্তু হল, সাধারণ নাগরিকরা। . . . দ্বিতীয়ত, সন্ত্রাসীরা নাটকীয় উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য দৌরাত্ম্য ঘটিয়ে থাকে: নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের হৃদয়ে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া প্রায়ই দৈহিক আক্রমণের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সৃষ্ট এই আতঙ্কই সন্ত্রাসবাদকে সাধারণ হত্যা অথবা আক্রমণ থেকে পৃথক করে।”

অতীতেই দৌরাত্ম্যের সূচনা হয়

প্রথম শতাব্দীর যিহূদিয়াতে, জেলট (ধর্মান্ধ যিহুদি) নামে এক দৌরাত্ম্যপ্রিয় দল রোমের কাছ থেকে যিহুদি স্বাধীনতা লাভ করতে চেয়েছিল। তাদের সবচেয়ে অনুগত সমর্থকদের মধ্যে কয়েক জন সিকারিও অথবা ছোরাধারী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল, যে-নাম তারা তাদের জামার নীচে যে-ছোট ছোরা লুকিয়ে রাখত, সেটা থেকে এসেছে। যিরূশালেমের উৎসবে আসা জনতার মধ্যে মিশে গিয়ে এই সিকারিওরা তাদের শত্রুদের গলা কেটে ফেলত অথবা পিছন দিক থেকে তাদেরকে ছুরি বিদ্ধ করত। *

সাধারণ কাল ৬৬ সালে, জেলটদের একটা দল ডেড সীর নিকটবর্তী মাসাডার দুর্গ দখল করে। তারা দুর্গের রোমীয় সেনাদলকে ব্যাপকভাবে হত্যা করে এবং সেই উচ্চদুর্গকে তাদের কর্মকাণ্ডের ঘাঁটি করে তোলে। কয়েক বছর ধরে তারা সেখান থেকেই আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে যায় এবং সাম্রাজ্যের কর্তৃপক্ষদের নাজেহাল করতে থাকে। সা.কা. ৭৩ সালে, গভর্নর ফ্লেভিয়াস সিলভার নেতৃত্বাধীনে রোমীয় দশম সংঘ যদিও মাসাডাকে পুনরায় অধিকার করে কিন্তু তারা জেলটদের বশ্যতা স্বীকার করাতে পারেনি। সমসাময়িক একজন ইতিহাসবেত্তা দাবি করেন যে, রোমীয়দের কাছে আত্মসমর্পণ করার পরিবর্তে, তাদের মধ্যে ৯৬০ জনই—দুজন মহিলা এবং পাঁচ জন ছেলেমেয়ে ছাড়া সেখানকার প্রত্যেকে—আত্মহত্যা করে।

কেউ কেউ মনে করে যে, সন্ত্রাসবাদ বলতে আমরা যা বুঝি সেটার শুরু জেলট বিদ্রোহ থেকেই হয়েছে। সত্যি হোক বা না-ই হোক, সেই সময় থেকে সন্ত্রাসবাদ ইতিহাসের পথে গভীর চিহ্ন রেখে গিয়েছে।

খ্রিস্টীয়জগতের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ

১০৯৫ সাল থেকে শুরু করে এরপর দুই শতাব্দী ধরে, ধর্মযোদ্ধারা ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে অহরহ যাতায়াত করত। তাদের বিরোধী ছিল, এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার মুসলিমবাহিনী। তারা সকলে যিরূশালেমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল এবং প্রত্যেক দলই সুবিধা লাভ করার চেষ্টা করেছিল। তাদের অনেক যুদ্ধে সেই তথাকথিত “পবিত্র যোদ্ধারা” একে অপরকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল। এ ছাড়া, তারা নিরপরাধ ব্যক্তিদের ওপর তলোয়ার এবং যুদ্ধকুঠার চালিয়েছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর পাদরি টাইরের উইলিয়াম, ১০৯৯ সালে ধর্মযোদ্ধাদের যিরূশালেমে প্রবেশ সম্বন্ধে এভাবে বর্ণনা করেছেন:

“তারা তলোয়ার ও বর্শা হাতে একত্রে রাস্তা দিয়ে গিয়েছিল। যত লোককে তারা দেখেছিল, তাদের প্রত্যেককে তারা হত্যা করেছিল এবং পুরুষ, নারী এবং ছোট ছেলেমেয়ে প্রত্যেককে আঘাত করেছিল, কাউকে রেহাই দেয়নি। . . . রাস্তায় রাস্তায় তারা এত লোককে হত্যা করেছিল যে, সেখানে লাশের স্তূপ হয়ে উঠেছিল এবং একজন ব্যক্তির পক্ষে সেখান দিয়ে যাওয়ার জন্য অথবা পার হওয়ার জন্য সেই লাশের ওপর দিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। . . . এত রক্তের ধারা বয়ে গিয়েছিল যে, প্রণালী এবং নালাগুলোতে রক্তের স্রোত বইছিল আর শহরের রাস্তাগুলো লাশে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।” *

পরের শতাব্দীগুলোতে সন্ত্রাসীরা বিস্ফোরক এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করেছিল, যার পরিণতি ছিল ভয়াবহ ও মারাত্মক।

কোটি কোটি লোক মারা যায়

১৯১৪ সালের ২৮শে জুনকে, ইতিহাসবেত্তারা ইউরোপের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণ হিসেবে দেখে থাকে। একজন যুবক, যাকে কেউ কেউ বীরপুরুষ বলে মনে করে থাকে, তিনি অস্ট্রিয়ার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ আর্চডুক ফ্রান্সিস ফার্ডিনান্ডকে গুলি করেন। সেই ঘটনা মানবজাতিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। দুই কোটি লোক মারা যাওয়ার পর এই মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়, যার বৈশিষ্ট্য ছিল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, বোমা বর্ষণে সাধারণ নাগরিকদের হত্যা এবং নির্দোষ লোকেদের ওপর প্রতিশোধপরায়ণ কাজ। যুদ্ধের পর, হত্যা চলতেই থাকে। ১৯৭০ এর দশকে কম্বোডিয়ার গণহত্যাভূমিতে দশ লক্ষেরও বেশি লোক মারা যায়। আর রুয়ান্ডার লোকেরা এখনও ১৯৯০ এর দশকের ৮,০০,০০০রেরও বেশি গণহত্যার কথা মনে করে কেঁপে ওঠে।

১৯১৪ সাল থেকে আমাদের সময় পর্যন্ত, অনেক দেশে মানবজাতি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে কষ্টভোগ করেছে। অথচ, কিছু লোক আজকে এমন সব কাজ করে থাকে যেন ইতিহাস থেকে আধুনিক দিনের লোকেরা কোনো শিক্ষাই লাভ করেনি। সন্ত্রাসী আক্রমণ নিয়মিতভাবে শত শত লোককে হত্যা করে, হাজার হাজার ব্যক্তিকে পঙ্গু করে দেয় এবং লক্ষ লক্ষ লোকের মনের শান্তি ও নিরাপত্তার অধিকারকে ছিনিয়ে নেয়। মার্কেটগুলোতে বোমা বিস্ফোরিত হচ্ছে, গ্রামগুলো জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, মহিলাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, ছোট ছেলেমেয়েদের বন্দিত্বে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, লোকেরা মারা যাচ্ছে। বিভিন্ন আইন এবং বিশ্বের কাছ থেকে নিন্দা সত্ত্বেও, এই নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড বন্ধ হচ্ছে না। এমন কোনো আশা কি রয়েছে যে, সন্ত্রাসবাদ আর থাকবে না? (g ৬/০৬)

[পাদটীকাগুলো]

^ প্রেরিত ২১:৩৮ পদে যেমন লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, একজন রোমীয় সহস্রপতি অন্যায়ভাবে প্রেরিত পৌলকে ৪,০০০ “গুপ্তহন্তাদের” বা ছোরাধারী ব্যক্তিদের নেতা বলে মিথ্যা অভিযোগ করেছিলেন।

^ যিশু তাঁর শিষ্যদের “আপন আপন শত্রুদিগকে প্রেম” করতে শিখিয়েছিলেন, তাদেরকে ঘৃণা ও হত্যা করতে নয়।—মথি ৫:৪৩-৪৫.

[৬ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

১৯১৪ সালের ২৮শে জুন বিশ্ব এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে

[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

ইস্তানবুল নভেম্বর ১৫, ২০০৩

[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

মাদ্রিদ মার্চ ১১, ২০০৪

[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

লন্ডন জুলাই ৭, ২০০৫

[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

নিউ ইয়র্ক সেপ্টেম্বর ১১, ২০০১

[৫ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

বাঁদিক থেকে ডানদিকে: AP Photo/Murad Sezer; AP Photo/ Paul White; Photo by Peter Macdiarmid/Getty Images

[৬ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

Culver Pictures