সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অধ্যায় ৩

“পবিত্র, পবিত্র, পবিত্র . . . যিহোবা”

“পবিত্র, পবিত্র, পবিত্র . . . যিহোবা”

১, ২. ভাববাদী যিশাইয় কোন দর্শন পেয়েছিলেন আর এটা যিহোবা সম্বন্ধে আমাদের কী শিক্ষা দেয়?

যিশাইয় তার সামনের দৃশ্য দেখে—ঈশ্বরের কাছ থেকে এক দর্শন পেয়ে—সশ্রদ্ধ ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এটা একেবারে বাস্তব বলে মনে হয়েছিল! তাই, যিশাইয় পরে লিখেছিলেন যে তিনি আসলে যিহোবার উন্নত সিংহাসনে ‘প্রভুকে [“যিহোবাকে,” NW] দেখিয়াছিলেন।’ যিহোবার রাজকীয় বস্ত্রের অঞ্চলে যিরূশালেমের বিরাট মন্দির পূর্ণ হয়েছিল।—যিশাইয় ৬:১, ২.

যিশাইয় যা শুনেছিলেন—অত্যন্ত জোরালো গানের শব্দ, যা মন্দিরের ভিত পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়েছিল—তাতেও সশ্রদ্ধ ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। সেই গানের শব্দ সরাফদের কাছ থেকে আসছিল, যারা খুবই উচ্চস্তরের আত্মিক প্রাণী। তাদের সমবেতভাবে গাওয়া জোরালো ও সুরেলা গান মহিমার এই বাক্যগুলোতে ধ্বনিত হয়েছিল: “পবিত্র, পবিত্র, পবিত্র, বাহিনীগণের সদাপ্রভু [“যিহোবা,” NW]; সমস্ত পৃথিবী তাঁহার প্রতাপে পরিপূর্ণ।” (যিশাইয় ৬:৩, ৪) “পবিত্র” শব্দটা তিন বার গাওয়া, এটার ওপর এক বিশেষ জোর দেয় আর তা করা উপযুক্ত কারণ যিহোবার পবিত্রতা সর্বোচ্চ মানের। (প্রকাশিত বাক্য ৪:৮) পুরো বাইবেল জুড়ে যিহোবার পবিত্রতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। শত শত পদ রয়েছে, যেখানে তাঁর নামের সঙ্গে “পবিত্র” ও “পবিত্রতা” শব্দগুলো যুক্ত।

৩. যিহোবার পবিত্রতা সম্বন্ধে ভুল দৃষ্টিভঙ্গিগুলো কীভাবে অনেককে ঈশ্বরের নিকটবর্তী করার পরিবর্তে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়?

তা হলে এটা স্পষ্ট যে, যিহোবা সম্বন্ধে যে-মুখ্য বিষয়গুলো আমরা উপলব্ধি করি বলে তিনি চান, সেগুলোর মধ্যে একটা হল যে তিনি পবিত্র। কিন্তু, আজকে অনেকে এই ধারণা থেকে দূরে সরে গেছে। কিছু লোক ভুলভাবে পবিত্রতাকে আত্মধার্মিক মনোভাব বা মিথ্যা ধার্মিকতার সঙ্গে যুক্ত করে। আর যে-লোকেরা নিজেদের সম্বন্ধে হীনমন্যতায় ভোগে, ঈশ্বরের পবিত্রতা তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করার চেয়ে আতঙ্কিত করতে পারে। তারা হয়তো এই ভেবে ভয় পেতে পারে যে তারা কখনোই এই পবিত্র ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়ার যোগ্য হতে পারবে না। তাই, অনেকে ঈশ্বরের পবিত্রতার জন্য তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যায়। সেটা দুঃখজনক কেননা ঈশ্বরের পবিত্রতা তাঁর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য সত্যিই এক জোরালো কারণ। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে, আসুন আমরা আলোচনা করি যে, প্রকৃত পবিত্রতা কী?

পবিত্রতা কী?

৪, ৫. (ক) পবিত্রতা মানে কী এবং এর মানে কী নয়? (খ) যিহোবা কোন দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপায়ে “পৃথক”?

ঈশ্বর পবিত্র তা বলতে এই বোঝায় না যে তিনি খুবই আত্মতৃপ্ত, উদ্ধত বা অন্যদের অবজ্ঞা করেন। এর বিপরীতে, তিনি এই খারাপ গুণগুলোকে ঘৃণা করেন। (হিতোপদেশ ১৬:৫; যাকোব ৪:৬) তা হলে, “পবিত্র” শব্দটির মানে আসলে কী? বাইবেলের ইব্রীয় পরিভাষায়, এই শব্দটিকে এমন এক শব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে, যেটির মানে “পৃথক।” উপাসনায়, “পবিত্র” সেটার প্রতি প্রযোজ্য, যেটাকে সাধারণ ব্যবহার থেকে পৃথক রাখা হয়। এ ছাড়া, পবিত্রতা শুচি ও বিশুদ্ধতার ধারণাও জোরালোভাবে প্রদান করে। এই শব্দ কীভাবে যিহোবার প্রতি প্রযোজ্য? এর মানে কি এই যে তিনি অসিদ্ধ মানুষের থেকে “পৃথক,” আমাদের থেকে অনেক দূরে?

একেবারেই না। “ইস্রায়েলের পবিত্রতম” হিসেবে, যিহোবা নিজেকে তাঁর লোকেদের “মধ্যে” বাস করেন বলে বর্ণনা করেছিলেন, যদিও তারা পাপী ছিল। (যিশাইয় ১২:৬; হোশেয় ১১:৯) তাই, তাঁর পবিত্রতা তাঁকে দূরবর্তী করে না। তা হলে, কীভাবে তিনি “পৃথক”? দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপায়ে। প্রথমত, তিনি এই অর্থে সমস্ত সৃষ্টি থেকে পৃথক যে, তিনি একাই পরাৎপর। তাঁর বিশুদ্ধতা, তাঁর শুচিতা হল পরম ও অশেষ। (গীতসংহিতা ৪০:৫; ৮৩:১৮) দ্বিতীয়ত, যিহোবা সমস্ত পাপ থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক আর সেটা সান্ত্বনাদায়ক। কেন?

৬. পাপ থেকে যিহোবা যে-সম্পূর্ণভাবে পৃথক তা জেনে কেন আমরা সান্ত্বনা পেতে পারি?

আমরা এমন এক জগতে বাস করি, যেখানে প্রকৃত পবিত্রতা দেখাই যায় না। ঈশ্বরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন মানবসমাজের সমস্তকিছু কোনো না কোনোভাবে দূষিত, পাপ ও অসিদ্ধতার দ্বারা কলঙ্কিত। আমাদের মধ্যে যে-পাপ রয়েছে, সেটার সঙ্গে আমাদের সকলকে লড়াই করতে হয়। আর আমরা যদি আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত না থাকি, তা হলে আমাদের সকলের পাপের কাছে পরাজিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। (রোমীয় ৭:১৫-২৫; ১ করিন্থীয় ১০:১২) যিহোবা এইরকম কোনো ঝুঁকির মধ্যে নেই। পাপ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন থাকায়, তিনি কখনোই পাপের সামান্যতম চিহ্ন দ্বারা কলঙ্কিত হবেন না। এটা আদর্শ পিতা হিসেবে যিহোবার প্রতি আমাদের গভীর অনুভূতিকে আরও দৃঢ় করে কারণ এর মানে হল যে, তিনি সম্পূর্ণভাবে নির্ভরযোগ্য। অনেক পাপী মানব পিতাদের বৈসাদৃশ্যে, যিহোবা কখনোই কলুষিত, অনিয়ন্ত্রিত বা আঘাতপ্রবণ নন। তাঁর পবিত্রতা এইরকম বিষয়গুলো করা একেবারে অসম্ভব করে। যিহোবা কখনও কখনও তাঁর পবিত্রতার শপথ করেছিলেন কারণ এর চেয়ে নির্ভরযোগ্য আর কোনো কিছুই নেই। (আমোষ ৪:২) এটা কি আশ্বাসজনক নয়?

৭. কেন বলা যেতে পারে যে, পবিত্রতা যিহোবার সত্তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য?

পবিত্রতা যিহোবার সত্তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। এর মানে কী? উদাহরণ হিসেবে, “মানুষ” ও “অসিদ্ধ” শব্দগুলো বিবেচনা করুন। আপনি পরের শব্দটার সাহায্য ছাড়া আগের শব্দটাকে বর্ণনা করতে পারবেন না। অসিদ্ধতা আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যাপ্ত আর আমরা যা কিছু করি, সেগুলোর সমস্তকিছুকে প্রভাবিত করে। এখন একেবারে ভিন্ন দুটো শব্দ বিবেচনা করুন—“যিহোবা” ও “পবিত্র।” পবিত্রতা যিহোবার মধ্যে পরিব্যাপ্ত। তাঁর সমস্তকিছু শুচি, বিশুদ্ধ এবং ন্যায়নিষ্ঠ। আমরা এই গভীর অর্থযুক্ত শব্দ “পবিত্র”-কে হৃদয়ঙ্গম করা ও বোঝা ছাড়া যিহোবা আসলে কীরকম, তা জানতে পারি না।

“পবিত্রতা যিহোবার অধিকারভুক্ত”

৮, ৯. কী দেখায় যে, যিহোবা অসিদ্ধ মানুষকে আপেক্ষিক অর্থে পবিত্র হতে সাহায্য করেন?

যেহেতু যিহোবা পবিত্রতার মূর্ত প্রতীক, তাই এটা উপযুক্তভাবে বলা যেতে পারে যে তিনি হলেন সমস্ত পবিত্রতার উৎস। তিনি স্বার্থপরের মতো এই মহামূল্যবান গুণটা শুধু নিজের অধিকারে রাখেন না; তিনি এটা অন্যদের প্রদান করেন আর উদারভাবে তা করেন। ঈশ্বর যখন একজন দূতের মাধ্যমে জ্বলন্ত ঝোপ থেকে মোশির সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তখন যিহোবার উপস্থিতিতে আশেপাশের ভূমি পর্যন্ত পবিত্র হয়ে গিয়েছিল!—যাত্রাপুস্তক ৩:৫.

অসিদ্ধ মানুষেরা কি যিহোবার সাহায্যে পবিত্র হতে পারে? হ্যাঁ, আপেক্ষিক অর্থে। ঈশ্বর তাঁর প্রজা ইস্রায়েলকে “পবিত্র এক জাতি” হওয়ার প্রত্যাশা দিয়েছিলেন। (যাত্রাপুস্তক ১৯:৬) তিনি সেই জাতিকে এক উপাসনা পদ্ধতি দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন, যা পবিত্র, শুচি, বিশুদ্ধ ছিল। তাই, পবিত্রতা মোশির ব্যবস্থার এক পুনরাবৃত্ত বিষয়। বস্তুত, মহাযাজক তাঁর উষ্ণীষ বা পাগড়ির সামনে এক সোনার পাত পরতেন, যেখানে সবাই এটাকে আলোতে চকচক করতে দেখত। এর ওপর খোদাই করে এই শব্দগুলো লেখা ছিল: “পবিত্রতা যিহোবার অধিকারভুক্ত।” (যাত্রাপুস্তক ২৮:৩৬, NW) অতএব, শুচিতা ও বিশুদ্ধতার এক উচ্চমান তাদের উপাসনাকে এবং প্রকৃতপক্ষে তাদের জীবনধারাকে স্বতন্ত্র করত। যিহোবা তাদের বলেছিলেন: “তোমরা পবিত্র হও, কেননা আমি সদাপ্রভু [“যিহোবা,” NW] তোমাদের ঈশ্বর পবিত্র।” (লেবীয় পুস্তক ১৯:২) অসিদ্ধ মানুষের পক্ষে ঈশ্বরের পরামর্শ যতখানি পালন করা সম্ভব, ইস্রায়েলীয়রা যদি ততখানি পালন করত, তা হলে তারা আপেক্ষিক অর্থে পবিত্র হতো।

১০. পবিত্রতার বিষয়ে, প্রাচীন ইস্রায়েল ও আশেপাশের জাতিগুলোর মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল?

১০ পবিত্রতার প্রতি এমন জোরালোভাব ইস্রায়েলের আশেপাশের জাতিগুলোর উপাসনার একেবারে বিপরীত ছিল। সেই পৌত্তলিক জাতিগুলো এমন দেবতাদের উপাসনা করত, যাদের অস্তিত্বই ছিল মিথ্যা ও কপট এবং যে-দেবতাদের হিংস্র, লোভী ও ব্যভিচারী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। তারা সমস্ত দিক থেকে অপবিত্র ছিল। এইরকম দেবতাদের উপাসনা লোকেদের অপবিত্র করে তুলেছিল। তাই, যিহোবা তাঁর দাসদের পৌত্তলিক উপাসক ও তাদের কলুষিত ধর্মীয় অভ্যাসগুলো থেকে পৃথক থাকার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন।—লেবীয় পুস্তক ১৮:২৪-২৮; ১ রাজাবলি ১১:১, ২.

১১. যিহোবার স্বর্গীয় সংগঠনের পবিত্রতা কীভাবে (ক) দূতেদের? (খ) সরাফদের? (গ) যিশুর মধ্যে স্পষ্ট দেখা যায়?

১১ এমনকি সবচেয়ে অনুকূল পরিস্থিতিতেও, যিহোবার মনোনীত প্রাচীন ইস্রায়েল জাতি ঈশ্বরের স্বর্গীয় সংগঠনের পবিত্রতার শুধু সামান্য প্রতিফলন দেখাতে পেরেছিল। লক্ষ লক্ষ আত্মিক প্রাণী, যারা অনুগতভাবে ঈশ্বরের সেবা করে, তাদেরকে তাঁর ‘অযুত অযুত পবিত্র লোক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (যিহূদা ১৪; দ্বিতীয় বিবরণ ৩৩:২) তারা নিখুঁতভাবে ঈশ্বরের পবিত্রতার উজ্জ্বল ও বিশুদ্ধ সৌন্দর্য প্রতিফলিত করে। আর যিশাইয় তার দর্শনে যে-সরাফদের দেখেছিলেন, তাদের কথাও স্মরণে রাখুন। তাদের গানের বিষয়বস্তু নির্দেশ করে যে, এই শক্তিশালী আত্মিক প্রাণীরা যিহোবার পবিত্রতাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র জানানোর ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, একজন আত্মিক প্রাণী তাদের সবার ওপরে—ঈশ্বরের একজাত পুত্র। যিশু হলেন যিহোবার পবিত্রতার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিফলন। উপযুক্তভাবেই, তিনি “ঈশ্বরের . . . পবিত্র ব্যক্তি” হিসেবে পরিচিত।—যোহন ৬:৬৮, ৬৯.

পবিত্র নাম, পবিত্র আত্মা

১২, ১৩. (ক) ঈশ্বরের নামকে কেন যথাযথভাবে পবিত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে? (খ) কেন ঈশ্বরের নামকে অবশ্যই পবিত্রীকৃত হতে হবে?

১২ ঈশ্বরের নিজের নাম সম্বন্ধে কী বলা যায়? আমরা যেমন ১ অধ্যায়ে দেখেছি যে, সেই নাম কোনো উপাধি বা লেবেল নয়। এটা যিহোবা ঈশ্বরকে প্রতিনিধিত্ব করে, তাঁর সমস্ত গুণকে অন্তর্ভুক্ত করে। তাই, বাইবেল আমাদের জানায় যে তাঁর “নাম ‘পবিত্র।’” (যিশাইয় ৫৭:১৫) মোশির ব্যবস্থায় ঈশ্বরের নামের অবজ্ঞা মৃত্যুদণ্ডনীয় অপরাধ ছিল। (লেবীয় পুস্তক ২৪:১৬) আর লক্ষ করুন যে, যিশু প্রার্থনায় সবচেয়ে প্রথমে কোন বিষয়টা উল্লেখ করেছিলেন: “হে আমাদের স্বর্গস্থ পিতঃ, তোমার নাম পবিত্র বলিয়া মান্য হউক।” (মথি ৬:৯) কোনো কিছুকে পবিত্র বলে মান্য করার অর্থ এটিকে পবিত্র হিসেবে আলাদা রাখা ও এটিকে শ্রদ্ধা করা, পবিত্র বলে তুলে ধরা। কিন্তু ঈশ্বরের নিজের নামের মতো সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ বিষয়কে কেন পবিত্র করার দরকার হবে?

১৩ ঈশ্বরের পবিত্র নাম মিথ্যা ও অপবাদের দ্বারা জর্জরিত ও কলঙ্কিত হয়েছে। এদনে, যিহোবার বিরুদ্ধে শয়তান মিথ্যা বলেছিল আর ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, তিনি একজন ন্যায়পরায়ণহীন সার্বভৌম প্রভু। (আদিপুস্তক ৩:১-৫) সেই সময় থেকে শয়তান—এই অপবিত্র জগতের শাসক—ঈশ্বরের বিরুদ্ধে মিথ্যাগুলো যেন বৃদ্ধি পায়, সেই বিষয়টা নিশ্চিত করেছে। (যোহন ৮:৪৪; ১২:৩১; প্রকাশিত বাক্য ১২:৯) ধর্মগুলো ঈশ্বরকে স্বেচ্ছাচারী, দূরবর্তী ও হিংস্র হিসেবে তুলে ধরেছে। তারা তাদের রক্তপিপাসু যুদ্ধগুলোর পিছনে তাঁর সমর্থন আছে বলে দাবি করেছে। ঈশ্বরের অলৌকিক সৃষ্টি কাজের কৃতিত্ব প্রায়ই অস্পষ্ট দৈবঘটনা বা বিবর্তনবাদকে দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, ঈশ্বরের নাম মারাত্মকভাবে কলঙ্কিত হয়েছে। এটিকে পবিত্রীকৃত হতে হবে; এটির ন্যায্য গৌরব পুনর্স্থাপিত হতে হবে। আমরা আকুলভাবে চাই যেন তাঁর নাম পবিত্র ও তাঁর সার্বভৌমত্ব ন্যায্য প্রতিপন্ন হোক আর সেই মহান উদ্দেশ্যে যেকোনোভাবে অংশ নিতে পেরে আমরা আনন্দিত হই।

১৪. কেন ঈশ্বরের আত্মাকে পবিত্র বলা যায় আর পবিত্র আত্মার নিন্দা করা কেন এত গুরুতর?

১৪ আরেকটা বিষয় রয়েছে, যা যিহোবার সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে সম্পর্কযুক্ত আর সেটাকে প্রায় চিরন্তনভাবে পবিত্র বলা যায়—তাঁর আত্মা বা সক্রিয় শক্তি। (আদিপুস্তক ১:২) যিহোবা তাঁর উদ্দেশ্য সম্পাদন করার জন্য এই অপ্রতিরোধ্য শক্তি ব্যবহার করেন। ঈশ্বর যা কিছু করেন, সেগুলো সবই পবিত্র, বিশুদ্ধ ও শুচিভাবে করেন আর তাই তাঁর সক্রিয় শক্তিকে উপযুক্তভাবেই পবিত্র আত্মা বা পবিত্রতার আত্মা বলা যায়। (লূক ১১:১৩; রোমীয় ১:৪) পবিত্র আত্মার নিন্দা করা, যেটার সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে যিহোবার উদ্দেশ্যগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করা জড়িত, তা করলে ক্ষমার অযোগ্য পাপ করা হয়।—মার্ক ৩:২৯.

যেকারণে যিহোবার পবিত্রতা আমাদের তাঁর নিকটবর্তী করে

১৫. ঈশ্বরীয় ভয় থাকা কেন যিহোবার পবিত্রতার প্রতি এক উপযুক্ত সাড়া এবং এইরকম ভয়ের সঙ্গে কী জড়িত?

১৫ অতএব এটা বোঝা কঠিন নয় যে, বাইবেল কেন ঈশ্বরের পবিত্রতা ও মানুষের পক্ষে ঈশ্বরীয় ভয়ের মধ্যে এক সম্পর্ক স্থাপন করে। উদাহরণ হিসেবে, ২ করিন্থীয় ৭:১ পদ বলে: “প্রিয়তমেরা এই সকল প্রতিজ্ঞার অধিকারী হওয়াতে আইস, আমরা মাংসের ও আত্মার সমস্ত মালিন্য হইতে আপনাদিগকে শুচি করি, ঈশ্বরভয়ে পবিত্রতা সিদ্ধ করি।” তবে, এই ভয় আতঙ্কজনক কিছু নয়। বরং, এটি শ্রদ্ধাজনক ভয়, সবচেয়ে উচ্চতর সম্মানের গভীর অনুভূতি। এভাবে উপলব্ধি করা উপযুক্ত কারণ ঈশ্বরের পবিত্রতা আমাদের চেয়ে শত শত গুণে শ্রেষ্ঠ। এটা অত্যন্ত শুচি, গৌরবময়। তবুও, এটি আমাদের দূরে সরিয়ে দেয় না। বিপরীতে, ঈশ্বরের পবিত্রতার প্রতি এক সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকে তাঁর আরও নিকটবর্তী করবে। কেন?

সৌন্দর্য যেমন আমাদের আকৃষ্ট করে, তেমনই পবিত্রতাও করবে

১৬. (ক) পবিত্রতা কীভাবে সৌন্দর্যের সঙ্গে যুক্ত? একটা উদাহরণ দিন। (খ) দর্শনে পাওয়া যিহোবার বর্ণনাগুলো কীভাবে শুচিতা, বিশুদ্ধতা ও আলোর ওপর জোর দেয়?

১৬ একটা কারণ হল, বাইবেল পবিত্রতাকে সৌন্দর্যের সঙ্গে যুক্ত করে। গীতসংহিতা ৯৬:৬ পদে ঈশ্বরের পবিত্র স্থান সম্বন্ধে আমরা পড়ি: “শক্তি ও শোভা তাঁহার ধর্ম্মধামে বিদ্যমান।” শোভা বা সৌন্দর্য আমাদের আকৃষ্ট করে। উদাহরণ হিসেবে, ৩৩ পৃষ্ঠার ছবিটা দেখুন। আপনি কি ওই দৃশ্যের প্রতি আকৃষ্ট হন না? কী এটাকে এত আবেদনময় করে তোলে? লক্ষ করুন যে, জল কতটা নির্মল দেখাচ্ছে। এমনকি বাতাসও বিশুদ্ধ কারণ আকাশ নীল এবং আলো ঝলমল করছে বলে মনে হয়। এখন, ওই একই দৃশ্যকে যদি পালটে দেওয়া হতো—জলস্রোত আবর্জনায় ভরা, গাছপালা ও পাহাড়ের গায়ে লেখালেখি করে সৌন্দর্য হানি করা হয়েছে, বাতাস ধোঁয়াশায় অপরিচ্ছন্ন—তা হলে আমরা আর এর প্রতি আকৃষ্ট হতাম না; দূরে সরে যেতাম। আমরা সাধারণত সৌন্দর্যকে শুচি, বিশুদ্ধ ও আলোর সঙ্গে যুক্ত করি। এই একই শব্দগুলো যিহোবার পবিত্রতা সম্বন্ধে বর্ণনা করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে, সেই দর্শনে পাওয়া যিহোবার বর্ণনাগুলো আমাদের আকৃষ্ট করে! আলোর বিকিরণ, রত্নের ঝলমলানি, আগুনের ন্যায় প্রখর দীপ্তিপূর্ণ বা নিখুঁত ও উজ্জ্বল মহামূল্যবান ধাতু—এইরকমই আমাদের পবিত্র ঈশ্বরের সৌন্দর্য।—যিহিষ্কেল ১:২৫-২৮; প্রকাশিত বাক্য ৪:২, ৩.

১৭, ১৮. (ক) যিশাইয় তার দর্শনের দ্বারা প্রথমে কীভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন? (খ) যিশাইয়কে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য যিহোবা কীভাবে একজন সরাফকে ব্যবহার করেছিলেন আর সরাফের কাজের তাৎপর্য কী ছিল?

১৭ কিন্তু, ঈশ্বরের পবিত্রতা কি তুলনার দিক দিয়ে আমাদের নিকৃষ্ট করবে? এর উত্তর অবশ্যই হ্যাঁ। কারণ, আমরা যিহোবার চেয়ে নিকৃষ্ট—আর সেই অনুপাত এতটাই ক্ষুদ্র যে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তা জানা কি আমাদেরকে তাঁর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে? সরাফগণকে যিহোবার পবিত্রতা ঘোষণা করতে শুনে যিশাইয়ের প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল, তা বিবেচনা করুন। “আমি কহিলাম, হায়, আমি নষ্ট হইলাম, কেননা আমি অশুচি-ওষ্ঠাধর মনুষ্য, এবং অশুচি-ওষ্ঠাধর জাতির মধ্যে বাস করিতেছি; আর আমার চক্ষু রাজাকে, বাহিনীগণের সদাপ্রভুকে, দেখিতে পাইয়াছে।” (যিশাইয় ৬:৫) হ্যাঁ, যিহোবার চিরন্তন পবিত্রতা যিশাইয়কে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে তিনি কতটা পাপী ও অসিদ্ধ ছিলেন। প্রথমে, সেই বিশ্বস্ত পুরুষ অসহায় বোধ করেছিলেন। কিন্তু, যিহোবা তাঁকে সেই অবস্থায় ত্যাগ করেননি।

১৮ একজন সরাফ সঙ্গে সঙ্গে ভাববাদীকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। কীভাবে? সেই শক্তিশালী আত্মিক প্রাণী বেদির দিকে উড়ে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে একটা কয়লা তুলে নিয়ে এসে যিশাইয়ের ঠোঁট সেই কয়লা দিয়ে স্পর্শ করেছিলেন। এটিকে হয়তো সান্ত্বনার চেয়ে আরও যন্ত্রণাদায়ক বলে মনে হতে পারে। তবে, মনে রাখবেন যে এটা প্রতীকী অর্থে পরিপূর্ণ একটা দর্শন ছিল। একজন বিশ্বস্ত যিহুদি, যিশাইয় ভালভাবেই জানতেন যে মন্দিরের বেদিতে প্রতিদিন পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য বলি উৎসর্গ করা হতো। আর সরাফ প্রেমের সঙ্গে ভাববাদীকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি অসিদ্ধ, “অশুচি-ওষ্ঠাধর” হওয়া সত্ত্বেও, ঈশ্বরের সামনে এক শুচি অবস্থানে আসতে পারেন। * একজন অসিদ্ধ, পাপী মানুষকে যিহোবা অন্তত এক আপেক্ষিক অর্থে পবিত্র হিসেবে দেখতে ইচ্ছুক।—যিশাইয় ৬:৬, ৭.

১৯. অসিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, আমাদের পক্ষে কীভাবে এক আপেক্ষিক অর্থে পবিত্র হওয়া সম্ভব?

১৯ আজকে একই বিষয় সত্য। যিরূশালেমের বেদিতে যে-বলিগুলো উৎসর্গ করা হতো, সেগুলো আরও মহান কিছু অর্থাৎ সা.কা. ৩৩ সালে যিশু খ্রিস্টের মাধ্যমে উৎসর্গীকৃত এক সিদ্ধ বলির ছায়া মাত্র ছিল। (ইব্রীয় ৯:১১-১৪) আমরা যদি সত্যিই আমাদের পাপের জন্য অনুতপ্ত হই, আমাদের ভুল আচরণ সংশোধন করি ও সেই বলিদানে বিশ্বাস অনুশীলন করি, তা হলে আমরা ক্ষমা পাই। (১ যোহন ২:২) আমরাও ঈশ্বরের সামনে এক শুচি অবস্থান উপভোগ করতে পারি। তাই, প্রেরিত পিতর আমাদের মনে করিয়ে দেন: “লেখা আছে, ‘তোমরা পবিত্র হইবে, কারণ আমি পবিত্র’।” (১ পিতর ১:১৬) লক্ষ করুন, যিহোবা বলেননি যে আমাদের তাঁর মতো পবিত্র হতে হবে। তিনি কখনোই আমাদের কাছ থেকে অসম্ভব কিছু আশা করেন না। (গীতসংহিতা ১০৩:১৩, ১৪) বরং, যিহোবা আমাদের পবিত্র হতে বলেন কারণ তিনি পবিত্র। অসিদ্ধ মানুষ হিসেবে আমরা “প্রিয় বৎসদের ন্যায়” তাঁকে যথাসম্ভব অনুকরণ করার চেষ্টা করি। (ইফিষীয় ৫:১) তাই, পবিত্রতা অর্জন করা এক চলমান প্রক্রিয়া। আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দিন দিন “পবিত্রতা সিদ্ধ” করার চেষ্টা করি।—২ করিন্থীয় ৭:১.

২০. (ক) কেন এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা আমাদের পবিত্র ঈশ্বরের চোখে শুচি হতে পারি? (খ) যিশাইয় যখন জানতে পেরেছিলেন যে তার পাপগুলোর জন্য প্রায়শ্চিত্ত করা হয়েছে, তখন তিনি কীভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন?

২০ যিহোবা যা কিছু ন্যায়পরায়ণ ও বিশুদ্ধ তা ভালবাসেন। তিনি পাপ ঘৃণা করেন। (হবক্‌কূক ১:১৩) কিন্তু তিনি আমাদের ঘৃণা করেন না। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত পাপকে তাঁর মতো করে দেখি—যা মন্দ তা ঘৃণা করা, যা উত্তম তা ভালবাসা—এবং যিশুর নিখুঁত পদচিহ্নগুলো অনুসরণ করার চেষ্টা করি, ততক্ষণ পর্যন্ত যিহোবা আমাদের পাপ ক্ষমা করেন। (আমোষ ৫:১৫; ১ পিতর ২:২১) আমরা যখন বুঝি যে আমরা আমাদের পবিত্র ঈশ্বরের চোখে শুচি হতে পারি, তখন এর প্রভাবগুলো গভীর হয়। মনে রাখবেন যে, যিহোবার পবিত্রতা যিশাইয়কে প্রথমে তার নিজের অশুচিতাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল। তিনি কেঁদে উঠেছিলেন: “হায়।” কিন্তু তিনি যখন বুঝেছিলেন যে তার পাপগুলোর জন্য প্রায়শ্চিত্ত করা হয়েছে, তখন তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছিল। যিহোবা যখন একটা কাজ করার জন্য একজন স্বেচ্ছাসেবকের বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তখন যিশাইয় সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিয়েছিলেন, যদিও তিনি এমনকি জানতেন না যে এর সঙ্গে কী জড়িত আছে। তিনি চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন: “এই আমি, আমাকে পাঠাও।”—যিশাইয় ৬:৫-৮.

২১. আমরা যে পবিত্রতা গুণটি অনুশীলন করতে পারি, সেই আস্থার কোন ভিত্তি আমাদের রয়েছে?

২১ আমাদেরকে পবিত্র ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে নির্মাণ করা হয়েছে আর আমাদের মধ্যে নৈতিক গুণাবলি ও আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো বোঝার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। (আদিপুস্তক ১:২৬) তাই, আমাদের সকলের মধ্যে পবিত্রতার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা যখন ক্রমাগত পবিত্রতা অনুশীলন করি, তখন যিহোবা আমাদের সাহায্য করতে আনন্দিত হন। এই প্রক্রিয়ায়, আমরা আমাদের পবিত্র ঈশ্বরের আরও নিকটবর্তী হব। এ ছাড়া, পরের অধ্যায়গুলোতে আমরা যখন যিহোবার গুণগুলো আলোচনা করব, তখন আমরা দেখব যে তাঁর নিকটবর্তী হওয়ার অনেক জোরালো কারণ রয়েছে!

^ অনু. 18 “অশুচি-ওষ্ঠাধর” অভিব্যক্তিটা যথাযথ কারণ বাইবেলে ওষ্ঠাধর প্রায়ই কথা বা ভাষাকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। সমস্ত অসিদ্ধ মানুষের ক্ষেত্রে, আমরা যেভাবে আমাদের কথা বলার শক্তিকে ব্যবহার করি, তাতে এক ব্যাপক মাত্রায় পাপকে চিহ্নিত করা যেতে পারে।—হিতোপদেশ ১০:১৯; যাকোব ৩:২, ৬.