সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অধ্যায় ১৪

যিহোবা ‘অনেকের পরিবর্ত্তে মুক্তির মূল্যের’ ব্যবস্থা করেন

যিহোবা ‘অনেকের পরিবর্ত্তে মুক্তির মূল্যের’ ব্যবস্থা করেন

১, ২. কীভাবে বাইবেল মানবজাতির অবস্থা সম্বন্ধে বর্ণনা করে এবং এর থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায় কী?

“সমস্ত সৃষ্টি . . . একসঙ্গে আর্ত্তস্বর করিতেছে, ও একসঙ্গে ব্যথা খাইতেছে।” (রোমীয় ৮:২২) এই কথাগুলোর দ্বারা প্রেরিত পৌল আমরা যে-দুঃখজনক অবস্থায় আছি, তা বর্ণনা করেন। একজন মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে কষ্ট, পাপ ও মৃত্যু থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো পথ নেই বলেই মনে হয়। কিন্তু, যিহোবার মধ্যে মানুষের সীমাবদ্ধতাগুলো নেই। (গণনাপুস্তক ২৩:১৯) ন্যায়বিচারের ঈশ্বর আমাদের দুর্দশা থেকে মুক্ত করার একটা উপায় দিয়েছেন। এটাকে মুক্তির মূল্য বলা হয়।

মুক্তির মূল্য হল মানবজাতিকে দেওয়া যিহোবার সবচেয়ে বড় উপহার। এটা পাপ ও মৃত্যু থেকে আমাদের উদ্ধার সম্ভবপর করে। (ইফিষীয় ১:৭) এটা অনন্তজীবনের আশার ভিত্তি, তা সেটা স্বর্গে বা পৃথিবীতে যেখানেই হোক না কেন। (লূক ২৩:৪৩; যোহন ৩:১৬; ১ পিতর ১:৪) কিন্তু মুক্তির মূল্য আসলে কী? কীভাবে এটা যিহোবার সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচার সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষা দেয়?

যেকারণে মুক্তির মূল্যের প্রয়োজন হয়েছিল

৩. (ক) মুক্তির মূল্য কেন অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল? (খ) কেন ঈশ্বর আদমের বংশধরদের মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে অন্য কোনো লঘু শাস্তি দিতে পারতেন না?

আদমের পাপের কারণে মুক্তির মূল্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। ঈশ্বরের অবাধ্য হওয়ার দ্বারা, আদম তার বংশধরদের উত্তরাধিকারসূত্রে অসুস্থতা, দুঃখ, ব্যথা ও মৃত্যু দিয়েছিল। (আদিপুস্তক ২:১৭; রোমীয় ৮:২০) ঈশ্বর আবেগের দ্বারা পরিচালিত হতে এবং মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে অন্য কোনো লঘু শাস্তি দিতে পারতেন না। তা দিলে তাঁর নিজের এই আইনকেই অবজ্ঞা করা হতো: “পাপের বেতন মৃত্যু।” (রোমীয় ৬:২৩) আর যিহোবা নিজেই যদি তাঁর ন্যায়বিচারের মানগুলোকে অমান্য করতেন, তা হলে সারা বিশ্বে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা আধিপত্য বিস্তার করত!

৪, ৫. (ক) শয়তান কীভাবে ঈশ্বরকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল এবং কেন যিহোবা এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোর উত্তর দিতে বাধ্যবাধকতা অনুভব করেছিলেন? (খ) যিহোবার অনুগত দাসদের সম্বন্ধে শয়তান কোন অভিযোগ করেছিল?

আমরা যেমন ১২ অধ্যায়ে দেখেছি যে, এদনে সংঘটিত বিদ্রোহ অনেক বড় বড় বিচার্য বিষয়ের উত্থাপন করেছিল। ঈশ্বরের সুনামের ওপর শয়তান এক কালো ছায়া ফেলেছিল। মূলত, সে যিহোবাকে মিথ্যাবাদী ও এমন এক নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক হিসেবে অভিযুক্ত করেছিল, যিনি তাঁর সৃষ্ট প্রাণীদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করেছেন। (আদিপুস্তক ৩:১-৫) আপাতদৃষ্টিতে, ধার্মিক মানুষ দিয়ে পৃথিবী পূর্ণ করার বিষয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করার মাধ্যমে, শয়তান ঈশ্বরকে ব্যর্থ ব্যক্তি হিসেবেও আখ্যা দিয়েছিল। (আদিপুস্তক ১:২৮; যিশাইয় ৫৫:১০, ১১) যিহোবা যদি এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোর উত্তর না দিতেন, তা হলে তাঁর সৃষ্ট অনেক বুদ্ধিমান প্রাণী হয়তো তাঁর শাসনের ওপর অনেকখানি আস্থা হারিয়ে ফেলত।

এ ছাড়াও, যিহোবার অনুগত দাসদের বিরুদ্ধেও শয়তান মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল এই অভিযোগ করে যে, তারা শুধু স্বার্থপর উদ্দেশ্যের জন্য যিহোবার সেবা করে আর তাদের ওপর যদি চাপ আনা হয়, তা হলে কেউই ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে না। (ইয়োব ১:৯-১১) এই বিচার্য বিষয়গুলো মানুষের কঠিন পরিস্থিতি থেকে শত গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যিহোবা উপযুক্তভাবেই শয়তানের মিথ্যা অপবাদজনক অভিযোগগুলোর উত্তর দিতে বাধ্যবাধকতা অনুভব করেছিলেন। কিন্তু, কীভাবে ঈশ্বর এই বিচার্য বিষয়গুলো সমাধান ও সেইসঙ্গে মানবজাতিকে রক্ষা করতে পারতেন?

মুক্তির মূল্য—এক সমতুল্যতা

৬. বাইবেলে ব্যবহৃত কিছু অভিব্যক্তি কী, যা মানবজাতিকে রক্ষার জন্য ঈশ্বরের উপায়কে বর্ণনা করে?

যিহোবার সমাধান ছিল অত্যন্ত করুণাপূর্ণ ও একইসঙ্গে পুরোপুরি ন্যায্য—যা কোনো মানুষ কখনও কল্পনা করতে পারবে না। কিন্তু, এটা ছিল একেবারে সহজ বিষয়। এটাকে সম্মিলন, মুক্তি ও প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। (গীতসংহিতা ৪৯:৮; দানিয়েল ৯:২৪; কলসীয় ১:২০; ইব্রীয় ২:১৭) কিন্তু যে-অভিব্যক্তিটি সবচেয়ে ভালভাবে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করতে পারে তা যিশু নিজে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “মনুষ্যপুত্ত্র পরিচর্য্যা পাইতে আইসেন নাই, কিন্তু পরিচর্য্যা করিতে, এবং অনেকের পরিবর্ত্তে আপন প্রাণ মুক্তির মূল্যরূপে [গ্রিক, লিট্রন] দিতে আসিয়াছেন।”—মথি ২০:২৮.

৭, ৮. (ক) শাস্ত্রে “মুক্তির মূল্য” শব্দের মানে কী? (খ) কীভাবে মুক্তির মূল্যের সঙ্গে সমতুল্যতা জড়িত?

মুক্তির মূল্য কী? এখানে যে-গ্রিক শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে, সেটা এমন এক ক্রিয়াপদ থেকে এসেছে যেটার অর্থ, “মুক্ত করে দেওয়া, ছেড়ে দেওয়া।” এই পরিভাষা টাকার বিনিময়ে যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দেওয়ার ধারণাকে বর্ণনা করতে ব্যবহার করা হয়েছিল। তাই, মুক্তির মূল্যকে মূলত কিছু কেনার জন্য কিছু দেওয়া হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। ইব্রীয় শাস্ত্রাবলিতে, ‘মুক্তির মূল্যের’ (কফের) জন্য যে-শব্দ রয়েছে, সেটা এমন এক ক্রিয়াপদ থেকে এসেছে, যেটার অর্থ “আচ্ছাদন করা।” এটা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে মুক্তির মূল্য দেওয়া বলতে পাপগুলো আচ্ছাদন করাও বোঝায়।

উল্লেখ করার মতো বিষয় হল যে, নতুন নিয়মের ঈশ্বরতত্ত্বের অভিধান (ইংরেজি) বলে যে এই শব্দ (কফের) “সবসময় সমতুল্যতাকে বোঝায়” বা সমরূপতাকে বোঝায়। এইজন্য, নিয়মসিন্দুকের আবরণের গঠন ঠিক সিন্দুকের সমরূপ ছিল। একইভাবে, পাপের কারণে মুক্তির মূল্য দেওয়ার বা পাপকে আচ্ছাদন করার জন্য এমন এক মূল্য দিতে হবে, যা পাপের ফলে হওয়া ক্ষতির পুরোপুরি সমরূপ বা সেটাকে সম্পূর্ণভাবে আচ্ছাদন করে। তাই, ইস্রায়েলকে দেওয়া ঈশ্বরের ব্যবস্থা উল্লেখ করেছিল: “প্রাণের পরিশোধ প্রাণ, চক্ষুর পরিশোধ চক্ষু, দন্তের পরিশোধ দন্ত, হস্তের পরিশোধ হস্ত, পদের পরিশোধ পদ।”—দ্বিতীয় বিবরণ ১৯:২১.

৯. বিশ্বাসী ব্যক্তিরা কেন পশুবলি উৎসর্গ করত এবং এই বলিগুলোকে যিহোবা কীভাবে দেখেছিলেন?

হেবল থেকে শুরু করে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা ঈশ্বরের উদ্দেশে পশুবলি উৎসর্গ করত। তা করে, তারা প্রদর্শন করেছিল যে পাপ ও মুক্তির প্রয়োজন সম্বন্ধে তারা অবগত আছে আর ঈশ্বর তাঁর ‘বংশের’ মাধ্যমে উদ্ধার করার যে-প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তাতে তারা বিশ্বাস দেখিয়েছিল। (আদিপুস্তক ৩:১৫; ৪:১-৪; লেবীয় পুস্তক ১৭:১১; ইব্রীয় ১১:৪) যিহোবা এইরকম বলিগুলোকে অনুগ্রহের সঙ্গে দেখেছিলেন এবং এই উপাসকদের এক উত্তম অবস্থান দান করেছিলেন। তা সত্ত্বেও, পশুবলি ছিল বড় জোর এক প্রতীক মাত্র। পশু কখনোই মানুষের পাপকে আচ্ছাদন করতে পারে না কারণ সেগুলো মানুষের চেয়ে নিকৃষ্ট। (গীতসংহিতা ৮:৪-৮) এই কারণে, বাইবেল বলে: “বৃষের কি ছাগের রক্ত যে পাপ হরণ করিবে, ইহা হইতেই পারে না।” (ইব্রীয় ১০:১-৪) এই বলিগুলো ছিল আসন্ন প্রকৃত মুক্তির মূল্যরূপ বলিদানের এক প্রতীক মাত্র।

‘সমরূপ মুক্তির মূল্য’

১০. (ক) মুক্তির মূল্যদাতার কার সমরূপ হওয়ার দরকার ছিল এবং কেন? (খ) কেন শুধু একজন মানুষের বলি আবশ্যক ছিল?

১০ “আদমে . . . সকলে মরে,” প্রেরিত পৌল বলেছিলেন। (১ করিন্থীয় ১৫:২২) তাই মুক্তির মূল্য আদমের—এক সিদ্ধ মানুষের—পুরোপুরি সমতুল্য মৃত্যুকে জড়িত করেছিল। (রোমীয় ৫:১৪) অন্য আর কোনো প্রজাতির প্রাণী ন্যায়বিচারের মাপকাঠিতে ভারসাম্য আনতে পারত না। আদমের মৃত্যুদণ্ডের অধীনে নন, একমাত্র এমন একজন সিদ্ধ মানুষই নিজেকে এক [“সমরূপ,” NW] মুক্তির মূল্যরূপে” উৎসর্গ করতে পারতেন—যিনি একেবারে নিখুঁতভাবে আদমের সমরূপ। (১ তীমথিয় ২:৬) আদমের প্রত্যেক বংশধরের সমরূপ হওয়ার জন্য, অগণিত লক্ষ লক্ষ মানুষের নিজেকে বলি দেওয়ার দরকার হবে না। প্রেরিত পৌল ব্যাখ্যা করেছিলেন: “এক মনুষ্য [আদমের] দ্বারা পাপ, পাপ দ্বারা মৃত্যু জগতে প্রবেশ করিল।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (রোমীয় ৫:১২) আর “[এক] মনুষ্য দ্বারা যখন মৃত্যু আসিয়াছে,” তখন ঈশ্বর “[এক] মনুষ্য দ্বারা” মানবজাতির মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। (১ করিন্থীয় ১৫:২১) কীভাবে?

‘সকলের নিমিত্ত সমরূপ মুক্তির মূল্য’

১১. (ক) মুক্তির মূল্যদাতা কীভাবে “সকলের নিমিত্ত মৃত্যুর আস্বাদ গ্রহণ” করবেন? (খ) কেন আদম ও হবা মুক্তির মূল্য থেকে উপকার পেতে পারত না? (পাদটীকা দেখুন।)

১১ যিহোবা একজন সিদ্ধ মানুষের ব্যবস্থা করেছিলেন, যিনি স্বেচ্ছায় তাঁর জীবন বলি দেন। রোমীয় ৬:২৩ পদ অনুযায়ী, “পাপের বেতন মৃত্যু।” মুক্তির মূল্যদাতা তাঁর জীবন বলি দিয়ে “সকলের নিমিত্ত মৃত্যুর আস্বাদ গ্রহণ” করবেন। অন্য কথায়, তিনি আদমের পাপের জন্য বেতন দেবেন। (ইব্রীয় ২:৯; ২ করিন্থীয় ৫:২১; ১ পিতর ২:২৪) আর এর অন্তর্নিহিত আইনগত পরিণতিগুলো থাকবে। আদমের বাধ্য বংশধরদের ওপর থেকে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করার মাধ্যমে, মুক্তির মূল্য পাপের ধ্বংসাত্মক শক্তিকে এর একেবারে উৎস থেকে দূর করে দেবে। *রোমীয় ৫:১৬.

১২. উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করুন যে, কীভাবে একটা ঋণ পরিশোধ অনেক লোকের উপকার করে।

১২ উদাহরণস্বরূপ: কল্পনা করুন যে আপনি এমন একটা শহরে বাস করেন, যেখানকার বেশির ভাগ লোক একটা বড় কারখানায় কাজ করে। আপনি এবং আপনার প্রতিবেশীরা আপনাদের পরিশ্রমের জন্য ভাল বেতন পান আর আরামদায়ক জীবনযাপন করেন। কিন্তু, তা শুধুমাত্র সেই কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। কেন কারখানাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? কারখানার ম্যানেজার অসৎ হয়ে গেছেন আর ব্যাবসাকে দেউলিয়া করে দিয়েছেন। হঠাৎ করে কাজ চলে যাওয়ায়, আপনি ও আপনার প্রতিবেশীরা আপনাদের ঋণগুলো দিতে সমর্থ নন। বিবাহ সাথি, সন্তান ও ঋণদাতারা সবাই একজন ব্যক্তির অসততার জন্য কষ্টভোগ করে। এর কি কোনো সমধান আছে? হ্যাঁ আছে! একজন ধনী পরোপকারী ব্যক্তি হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সেই কোম্পানির মূল্য জানেন। এ ছাড়া, এর কর্মচারী ও তাদের পরিবারগুলোর প্রতিও তার সহানুভূতি রয়েছে। তাই, তিনি কোম্পানির ঋণ পরিশোধ ও কারখানাটা পুনরায় চালু করার ব্যবস্থা করেন। সেই একটা ঋণ পরিশোধ, অনেক কর্মচারী ও তাদের পরিবারগুলো এবং ঋণদাতাদের জন্য স্বস্তি নিয়ে আসে। একইভাবে আদমের ঋণ পরিশোধ করা অগণিত লক্ষ লক্ষ লোকের উপকার করে।

কে মুক্তির মূল্যের ব্যবস্থা করেন?

১৩, ১৪. (ক) কীভাবে যিহোবা মানবজাতির জন্য মুক্তির মূল্যের ব্যবস্থা করেছিলেন? (খ) কাকে মুক্তির মূল্য প্রদান করা হয়েছিল এবং কেন এই ধরনের এক পরিশোধ আবশ্যক?

১৩ একমাত্র যিহোবাই এমন এক ‘মেষশাবকের’ ব্যবস্থা করতে পারতেন, “যিনি জগতের পাপভার লইয়া যান।” (যোহন ১:২৯) কিন্তু, ঈশ্বর মানবজাতিকে উদ্ধার করার জন্য যেকোনো এক দূতকে পাঠাননি। এর পরিবর্তে, তিনি এমন একজনকে পাঠিয়েছিলেন, যিনি যিহোবার দাসদের বিরুদ্ধে শয়তানের অভিযোগের চূড়ান্ত উত্তর দিতে পারতেন। হ্যাঁ, যিহোবা তাঁর একজাত পুত্র, যিনি “তাঁহার আনন্দজনক” ছিলেন তাঁকে পাঠানোর মাধ্যমে সবচেয়ে বড় ত্যাগস্বীকার করেছিলেন। (হিতোপদেশ ৮:৩০, পাদটীকা) ঈশ্বরের পুত্র স্বেচ্ছায় তাঁর স্বর্গীয় রূপ থেকে “আপনাকে শূন্য করিলেন।” (ফিলিপীয় ২:৭) যিহোবা তাঁর প্রথমজাত স্বর্গীয় পুত্রের জীবন ও ব্যক্তিত্ব মরিয়ম নামে এক যিহুদি কুমারীর গর্ভে অলৌকিকভাবে স্থানান্তরিত করেছিলেন। (লূক ১:২৭, ৩৫) মানুষ হিসেবে তাঁকে যিশু নামে ডাকা হবে। কিন্তু আইনগত অর্থে, তাঁকে দ্বিতীয় আদম বলা যেতে পারে কারণ তিনি আদমের একেবারে নিখুঁত সমরূপ ছিলেন। (১ করিন্থীয় ১৫:৪৫, ৪৭) ফলে যিশু নিজেকে পাপী মানবজাতির জন্য বলিরূপে উৎসর্গ করতে পারতেন।

১৪ কাকে সেই মুক্তির মূল্য দেওয়া হবে? গীতসংহিতা ৪৯:৭ পদ নির্দিষ্ট করে বলে যে, মুক্তির মূল্য “ঈশ্বরকে” দেওয়া হয়। কিন্তু, যিহোবাই কি প্রথমে মুক্তির মূল্যের ব্যবস্থা করেননি? হ্যাঁ, কিন্তু এটা মুক্তির মূল্যের গুরুত্বকে এক অর্থহীন, যান্ত্রিক বিষয় বলে কমিয়ে দেয় না—এক পকেট থেকে টাকাপয়সা বের করে অন্য পকেটে রাখার মতো। এটা বুঝতে হবে যে, মুক্তির মূল্য কোনো বস্তুগত বিনিময় নয় কিন্তু এক আইনগত বিনিময়। মুক্তির মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা করার দ্বারা, এমনকি যিহোবাকে এর জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হলেও তিনি তাঁর নিজের নিখুঁত ন্যায়বিচারের প্রতি তাঁর অটল আনুগত্য নিশ্চিত করেছিলেন।—আদিপুস্তক ২২:৭, ৮, ১১-১৩; ইব্রীয় ১১:১৭; যাকোব ১:১৭.

১৫. কেন যিশুর কষ্টভোগ করা ও মারা যাওয়া আবশ্যক ছিল?

১৫ সাধারণ কাল ৩৩ সালের বসন্তকালে যিশু খ্রিস্ট স্বেচ্ছায় এক কঠিন পরীক্ষা মেনে নিয়েছিলেন, যা মুক্তির মূল্য পরিশোধের দিকে পরিচালিত করেছিল। তিনি নিজেকে মিথ্যা অভিযোগগুলোর জন্য গ্রেপ্তার হতে, দোষী সাব্যস্ত হতে এবং শাস্তিদণ্ডে বিদ্ধ হতে দিয়েছিলেন। যিশুর এত কষ্টভোগ করার সত্যিই কি কোনো দরকার ছিল? হ্যাঁ, কারণ ঈশ্বরের দাসদের নীতিনিষ্ঠা সম্বন্ধীয় বিচার্য বিষয়টা সমাধান হওয়ার দরকার ছিল। লক্ষণীয় বিষয় হল যে, শিশু যিশুকে ঈশ্বর হেরোদের দ্বারা হত হতে দেননি। (মথি ২:১৩-১৮) কিন্তু যিশু যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছিলেন, তখন তিনি বিচার্য বিষয়গুলো পুরোপুরি উপলব্ধি করে শয়তানের পূর্ণ শক্তি দিয়ে করা আক্রমণগুলোকে প্রতিরোধ করতে সমর্থ ছিলেন। * অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার সত্ত্বেও, ‘সাধু [“অনুগত,” NW], অহিংসক, বিমল, পাপিগণ হইতে পৃথক’ থাকার মাধ্যমে, যিশু লক্ষণীয় চূড়ান্ত অবস্থার মধ্যে প্রমাণ করেছিলেন যে, যিহোবার এমন দাসেরা রয়েছে যারা পরীক্ষার মধ্যে বিশ্বস্ত থাকে। (ইব্রীয় ৭:২৬) তাই, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, যিশু তাঁর মৃত্যুর সময় জয়সূচকভাবে চিৎকার করে উঠেছিলেন: “সমাপ্ত হইল।”—যোহন ১৯:৩০.

তাঁর মুক্তির কাজ সম্পূর্ণ করা

১৬, ১৭. (ক) কীভাবে যিশু তাঁর মুক্তির কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন? (খ) কেন যিশুর “আমাদের জন্য ঈশ্বরের সাক্ষাতে প্রকাশমান” হওয়ার দরকার ছিল?

১৬ যিশুর তখনও তাঁর মুক্তির কাজ সম্পূর্ণ করা বাকি ছিল। যিশুর মৃত্যুর তৃতীয় দিনে, যিহোবা তাঁকে মৃতদের মধ্য থেকে উঠিয়েছিলেন। (প্রেরিত ৩:১৫; ১০:৪০) এই অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজের মাধ্যমে, যিহোবা শুধু তাঁর পুত্রকে তাঁর বিশ্বস্ত কাজের জন্য পুরস্কৃতই করেননি কিন্তু সেইসঙ্গে ঈশ্বরের মহাযাজক হিসেবে তাঁর মুক্তির কাজ সম্পূর্ণ করার সুযোগও দিয়েছিলেন। (রোমীয় ১:৪; ১ করিন্থীয় ১৫:৩-৮) প্রেরিত পৌল ব্যাখ্যা করেন: “খ্রীষ্ট, . . . মহাযাজকরূপে উপস্থিত হইয়া . . . ছাগদের ও গোবৎসদের রক্তের গুণে নয়, কিন্তু নিজ রক্তের গুণে—একেবারে পবিত্র স্থানে প্রবেশ করিয়াছেন, ও অনন্তকালীয় মুক্তি উপার্জ্জন করিয়াছেন। কেননা খ্রীষ্ট হস্তকৃত পবিত্র স্থানে প্রবেশ করেন নাই—এ ত প্রকৃত বিষয়গুলির প্রতিরূপমাত্র—কিন্তু স্বর্গেই প্রবেশ করিয়াছেন, যেন তিনি এখন আমাদের জন্য ঈশ্বরের সাক্ষাতে প্রকাশমান হন।”—ইব্রীয় ৯:১১, ১২, ২৪.

১৭ খ্রিস্ট তাঁর আক্ষরিক রক্ত স্বর্গে নিতে পারতেন না। (১ করিন্থীয় ১৫:৫০) এর পরিবর্তে, তিনি সেই রক্ত যা চিত্রিত করে, সেটা সঙ্গে নিয়েছিলেন: তাঁর বলিদানকৃত সিদ্ধ মানব জীবনের আইনগত মূল্য। এরপর, তিনি পাপী মানবজাতির বিনিময়ে এক মুক্তির মূল্য হিসেবে ঈশ্বরের সাক্ষাতে সেই জীবনের মূল্য আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। যিহোবা কি সেই বলি গ্রহণ করেছিলেন? হ্যাঁ, আর এটা সা.কা. ৩৩ সালের পঞ্চাশত্তমীর দিনে স্পষ্ট হয়েছিল, যখন যিরূশালেমের প্রায় ১২০ জন শিষ্যের ওপর পবিত্র আত্মা বর্ষিত হয়েছিল। (প্রেরিত ২:১-৪) যদিও সেই ঘটনা খুবই রোমাঞ্চকর ছিল কিন্তু মুক্তির মূল্য তখন কেবল চমৎকার উপকারগুলো এনে দিতে শুরু করেছিল।

মুক্তির মূল্যের উপকারগুলো

১৮, ১৯. (ক) খ্রিস্টের রক্তের মাধ্যমে যে-সম্মিলন সম্ভব হয়েছে সেটা থেকে কোন দুটো দল উপকার পাবে? (খ) ‘বিস্তর লোকের’ জন্য মুক্তির মূল্যের কিছু বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উপকার কী?

১৮ কলসীয়দের প্রতি পত্রে পৌল ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, ঈশ্বর যাতনাদণ্ডে যিশুর পাতিত রক্তের দ্বারা শান্তি স্থাপন করে খ্রিস্টের মাধ্যমে সমস্তকিছু তাঁর সঙ্গে পুনরায় সম্মিলিত করাকে উপযুক্ত বলে মনে করেন। পৌল এও ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, এই সম্মিলন দুটো আলাদা দলকে অন্তর্ভুক্ত করে যথা, “স্বর্গস্থ” এবং “পৃথিবীস্থ।” (কলসীয় ১:১৯, ২০; ইফিষীয় ১:১০) প্রথম দলটা ১,৪৪,০০০ জন খ্রিস্টানদের নিয়ে গঠিত, যাদের খ্রিস্ট যিশুর সঙ্গে স্বর্গীয় যাজক হিসেবে সেবা করার ও রাজা হিসেবে পৃথিবীর ওপর শাসন করার আশা দেওয়া হয়েছে। (প্রকাশিত বাক্য ৫:৯, ১০; ৭:৪; ১৪:১-৩) তাদের মাধ্যমে, মুক্তির মূল্যের উপকারগুলো হাজার বছর ধরে ক্রমান্বয়ে বাধ্য মানবজাতির ওপর প্রয়োগ হবে।—১ করিন্থীয় ১৫:২৪-২৬; প্রকাশিত বাক্য ২০:৬; ২১:৩, ৪.

১৯ “পৃথিবীস্থ” বিষয়গুলো হল সেই ব্যক্তিরা, যারা পরমদেশ পৃথিবীতে সিদ্ধ জীবন উপভোগ করার আশা রাখে। প্রকাশিত বাক্য ৭:৯-১৭ পদ তাদের “বিস্তর লোক” হিসেবে বর্ণনা করে, যারা আসন্ন ‘মহাক্লেশ’ থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু, মুক্তির মূল্যের উপকারগুলো উপভোগ করার জন্য তাদের সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। তারা ইতিমধ্যেই “মেষশাবকের রক্তে আপন আপন বস্ত্র ধৌত করিয়াছে ও শুক্লবর্ণ করিয়াছে।” তারা মুক্তির মূল্যে বিশ্বাস অনুশীলন করায়, এখনই সেই প্রেমময় ব্যবস্থা থেকে আধ্যাত্মিক উপকারগুলো লাভ করছে। তাদের ঈশ্বরের বন্ধু হিসেবে ধার্মিক ঘোষণা করা হয়েছে! (যাকোব ২:২৩) যিশুর বলিদানের ফলস্বরূপ, তারা “সাহসপূর্ব্বক অনুগ্রহ-সিংহাসনের নিকটে উপস্থিত” হতে পারে। (ইব্রীয় ৪:১৪-১৬) তারা যখন ভুল করে, তখন প্রকৃত ক্ষমা লাভ করে। (ইফিষীয় ১:৭) অসিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, তারা এক শুদ্ধ বিবেক উপভোগ করে। (ইব্রীয় ৯:৯; ১০:২২; ১ পিতর ৩:২১) অতএব, ঈশ্বরের সঙ্গে সম্মিলিত হওয়া এমন কিছু নয়, যা ধীরে ধীরে পূর্ণ হবে বরং এটা এক বর্তমান বাস্তবতা! (২ করিন্থীয় ৫:১৯, ২০) হাজার বছরের রাজত্বের সময়, তারা ধীরে ধীরে “ক্ষয়ের দাসত্ব হইতে মুক্ত” হবে আর শেষ পর্যন্ত “ঈশ্বরের সন্তানগণের প্রতাপের স্বাধীনতা” পাবে।—রোমীয় ৮:২১.

২০. মুক্তির মূল্যের ওপর ধ্যান কীভাবে আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রভাবিত করে?

২০ মুক্তির মূল্যের জন্য ‘যীশু খ্রীষ্ট দ্বারা . . . ঈশ্বরকে ধন্যবাদ’! (রোমীয় ৭:২৫) নীতিগতভাবে এটা একেবারে সরল কিন্তু আমাদের সশ্রদ্ধ ভয়ে পূর্ণ করার জন্য যথেষ্ট গভীর বিষয়। (রোমীয় ১১:৩৩) আর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে এই নিয়ে ধ্যান করার মাধ্যমে, মুক্তির মূল্য আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে, ন্যায়বিচারক ঈশ্বরের আরও নিকটবর্তী করে। গীতরচকের মতো, আমাদেরও যিহোবা যিনি “ধার্ম্মিকতা ও ন্যায়বিচার ভালবাসেন,” তাঁর প্রশংসা করার উত্তম কারণ রয়েছে।—গীতসংহিতা ৩৩:৫.

^ অনু. 11 আদম ও হবা মুক্তির মূল্য থেকে উপকার পেতে পারত না। মোশির ব্যবস্থা একজন স্বেচ্ছাচারী খুনির বিষয়ে এই নীতি উল্লেখ করেছিল: “প্রাণদণ্ডের অপরাধী নরহন্তার প্রাণের জন্য তোমরা কোন প্রায়শ্চিত্ত [“মুক্তির মূল্য,” NW] গ্রহণ করিবে না।” (গণনাপুস্তক ৩৫:৩১) অতএব এটা স্পষ্ট যে, আদম ও হবা মৃত্যুর যোগ্য ছিল কারণ তারা স্বেচ্ছায় এবং জেনেশুনে ঈশ্বরের অবাধ্য হয়েছিল। এভাবে তারা তাদের অনন্তজীবনের প্রত্যাশা হারিয়েছিল।

^ অনু. 15 আদমের পাপের ভারসাম্য রক্ষার জন্য যিশুকে এক সিদ্ধ শিশু হিসেবে নয় কিন্তু একজন প্রাপ্তবয়স্ক সিদ্ধ পুরুষ হিসেবে মারা যেতে হতো। মনে রাখবেন যে, আদমের পাপ ছিল ইচ্ছাকৃত, এই কাজ করা কতটা গুরুতর ও এর পরিণতিগুলো কী, সেই সম্বন্ধে পুরো জ্ঞান নিয়ে সে তা করেছিল। তাই, “শেষ আদম” হওয়ার ও সেই পাপ আচ্ছাদন করার জন্য যিশুকে যিহোবার প্রতি তাঁর নীতিনিষ্ঠা বজায় রাখতে এক পরিপক্ব ও সবকিছু জেনেশুনে বাছাই করতে হয়েছিল। (১ করিন্থীয় ১৫:৪৫, ৪৭) এভাবে যিশুর সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত জীবনধারা—যেটার মধ্যে রয়েছে তাঁর বলিদানমূলক মৃত্যু—“ধার্ম্মিকতার একটী কার্য্য” হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।—রোমীয় ৫:১৮, ১৯.