সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অধ্যায় ১৭

“আহা! ঈশ্বরের . . . প্রজ্ঞা . . . কেমন অগাধ!”

“আহা! ঈশ্বরের . . . প্রজ্ঞা . . . কেমন অগাধ!”

১, ২. সপ্তম দিনের জন্য যিহোবার উদ্দেশ্য কী ছিল এবং এই দিনের শুরুতে ঐশিক প্রজ্ঞা কীভাবে পরীক্ষিত হয়েছিল?

ধ্বংস হয়ে গেল! সৃষ্টির ষষ্ঠ দিনের শ্রেষ্ঠ গৌরব মানবজাতি, হঠাৎ করে শীর্ষ থেকে একেবারে নিচে পড়ে গেল। যিহোবা ঘোষণা করেছিলেন যে, মানবজাতি সহ ‘তাঁহার নির্ম্মিত বস্তু সকল অতি উত্তম।’ (আদিপুস্তক ১:৩১) কিন্তু সপ্তম দিনের শুরুতে, আদম ও হবা শয়তানের বিদ্রোহী পথ বেছে নিয়েছিল। অপ্রত্যাশিতভাবে তারা পাপ, অসিদ্ধতা ও মৃত্যু নিয়ে এসেছিল।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, সপ্তম দিনের জন্য যিহোবার যে-উদ্দেশ্য, তা একেবারে বিফল হয়ে গেছে। সেই দিনটা, আগের ছয় দিনের মতো হাজার হাজার বছর দীর্ঘ ছিল। যিহোবা এই দিনটিকে পবিত্র বলে ঘোষণা করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত এই দিনেই সিদ্ধ মানব পরিবার দিয়ে পরমদেশ পৃথিবী পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। (আদিপুস্তক ১:২৮; ২:৩) কিন্তু আকস্মিক বিদ্রোহের পর, কীভাবে এইরকম একটা বিষয় পূর্ণ হতে পারত? ঈশ্বর কী করতে পারতেন? এখানেই যিহোবার প্রজ্ঞার এক নাটকীয় পরীক্ষা হয়েছিল—সম্ভবত সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

৩, ৪. (ক) কেন এদনের বিদ্রোহের প্রতি যিহোবার প্রতিক্রিয়া তাঁর প্রজ্ঞার প্রতি এক সশ্রদ্ধ ভয় উদ্বুদ্ধকারী উদাহরণ? (খ) যিহোবার প্রজ্ঞা সম্বন্ধে অধ্যয়ন করার সময় নম্রতা আমাদের কোন সত্য মনে রাখার জন্য প্রেরণা দেবে?

যিহোবা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। তিনি এদনের বিদ্রোহীদের প্রতি শাস্তি ঘোষণা করেছিলেন ও একই সময়ে একটা চমৎকার বিষয়ের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন: তারা সবেমাত্র যে-ক্ষতিকর বিষয়গুলোর সূত্রপাত করেছিল, সেগুলো দূর করার জন্য তাঁর উদ্দেশ্য। (আদিপুস্তক ৩:১৫) যিহোবার দূরদর্শী উদ্দেশ্যের ব্যাপ্তি এদন থেকে শুরু করে মানবজাতির হাজার হাজার বছরের ইতিহাস ও এরপর সুদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বিস্তৃত। এটা খুবই সাধারণ অথচ এতটাই গভীর যে, একজন বাইবেল পাঠক এই বিষয়ে অধ্যয়ন করে ও তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে পরিতৃপ্তির সঙ্গে তার জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন। এ ছাড়া, যিহোবার উদ্দেশ্য সফল হবেই হবে। এটা সব ধরনের দুষ্টতা, পাপ ও মৃত্যুকে শেষ করবে। এটা বিশ্বস্ত মানবজাতিকে সিদ্ধতায় নিয়ে যাবে। এই সমস্তকিছু সপ্তম দিন শেষ হওয়ার আগেই ঘটবে, যাতে যা কিছুই হোক না কেন, পৃথিবী ও মানবজাতির জন্য যিহোবা তাঁর উদ্দেশ্য একেবারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পূর্ণ করতে পারেন।

এইরকম প্রজ্ঞা সশ্রদ্ধ ভয় জাগিয়ে তোলে, তাই নয় কি? প্রেরিত পৌল এই কথা লিখতে পরিচালিত হয়েছিলেন: “আহা! ঈশ্বরের . . . প্রজ্ঞা . . . কেমন অগাধ!” (রোমীয় ১১:৩৩) এই ঐশিক গুণের বিভিন্ন দিক নিয়ে অধ্যয়ন করার সময় নম্রতা আমাদের এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ সত্য মনে রাখতে প্রেরণা দেবে—সেটা হল, যিহোবার অগাধ প্রজ্ঞা সম্বন্ধে আমরা খুব বেশি হলে ভাসা ভাসা জ্ঞান নিতে পারি। (ইয়োব ২৬:১৪) প্রথমে, আসুন আমরা সশ্রদ্ধ ভয় উদ্বুদ্ধকারী এই গুণটিকে সংজ্ঞায়িত করি।

ঐশিক প্রজ্ঞা কী?

৫, ৬. জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মধ্যে সম্পর্ক কী এবং যিহোবার জ্ঞান কতটা ব্যাপক?

প্রজ্ঞা ও জ্ঞান এক বিষয় নয়। কমপিউটার প্রচুর জ্ঞান মজুত করে রাখতে পারে কিন্তু তাই বলে কেউ এই ধরনের যন্ত্রগুলোকে বিজ্ঞ বলবে, তা ভাবাই যায় না। তবে, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা একটা অন্যটার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। (হিতোপদেশ ১০:১৪) উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য আপনার যদি বিজ্ঞ পরামর্শের দরকার হয়, তা হলে আপনি কি এমন কারও সঙ্গে পরামর্শ করবেন, যার চিকিৎসাবিদ্যা সম্বন্ধে সামান্য জ্ঞান আছে বা কোনো জ্ঞানই নেই? কখনোই না! অতএব, প্রকৃত প্রজ্ঞার জন্য সঠিক জ্ঞান অপরিহার্য।

যিহোবার অসীম জ্ঞান রয়েছে। “জাতিগণের [“যুগপর্য্যায়ের,” পাদটীকা] রাজন্‌” হিসেবে একা তিনি অনন্তকাল ধরে জীবিত আছেন। (প্রকাশিত বাক্য ১৫:৩) আর সেই অবর্ণিত যুগগুলোতে তিনি সমস্তকিছুই অবগত ছিলেন। বাইবেল বলে: “তাঁহার সাক্ষাতে কোন সৃষ্ট বস্তু অপ্রকাশিত নয়; কিন্তু তাঁহার চক্ষুর্গোচরে সকলই নগ্ন ও অনাবৃত রহিয়াছে, যাঁহার কাছে আমাদিগকে নিকাশ দিতে হইবে।” (ইব্রীয় ৪:১৩; হিতোপদেশ ১৫:৩) সৃষ্টিকর্তা হিসেবে, যিহোবা নিজে যা কিছু নির্মাণ করেছেন, সেগুলো সম্বন্ধে তাঁর পূর্ণ বোধগম্যতা রয়েছে এবং তিনি একেবারে শুরু থেকেই মানুষের সমস্ত কাজ পর্যবেক্ষণ করে আসছেন। তিনি প্রত্যেক মানুষের হৃদয় পরীক্ষা করেন, কোনো কিছুই বাদ পড়ে না। (১ বংশাবলি ২৮:৯) আমাদের নৈতিক দিক দিয়ে স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে সৃষ্টি করায় তিনি খুশি হন, যখন দেখেন যে আমরা আমাদের জীবনের বাছাইগুলো বিজ্ঞতার সঙ্গে করছি। একই সময়ে “প্রার্থনা-শ্রবণকারী” হিসেবে তিনি অগণিত অনুরোধ শোনেন! (গীতসংহিতা ৬৫:২) আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যিহোবার নিখুঁত স্মরণশক্তি রয়েছে।

৭, ৮. কীভাবে যিহোবা বোধগম্যতা, বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞা দেখান?

যিহোবার কেবল জ্ঞান নয় আরও বেশি কিছু রয়েছে। তিনি বিভিন্ন ঘটনা কীভাবে একটা অন্যটার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সেটাও দেখেন এবং অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিবরণের দ্বারা তৈরি পূর্ণাঙ্গ চিত্রটা নির্ণয় করেন। তিনি মূল্যায়ন করেন ও বিচার করেন, ভাল ও মন্দ এবং গুরুত্বপূর্ণ ও তুচ্ছ বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য করেন। এ ছাড়া, তিনি বাহ্যিক বিষয় দেখেন না বরং হৃদয় পরীক্ষা করেন। (১ শমূয়েল ১৬:৭) অতএব, যিহোবার বোধগম্যতা ও বিচক্ষণতা রয়েছে, যে-গুণগুলো জ্ঞানের চেয়েও উৎকৃষ্ট। কিন্তু, প্রজ্ঞা এগুলোর চেয়ে আরও অনেক বেশি উৎকৃষ্ট।

জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও বোধগম্যতাকে প্রজ্ঞা ঐক্যবদ্ধ করে এবং সেগুলোকে কাজে প্রয়োগ করায়। আসলে, কয়েকটা মূল ভাষার বাইবেলে যে-শব্দগুলোকে “প্রজ্ঞা” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে, সেগুলোর আক্ষরিক অর্থ হল, “ফলপ্রসূ কাজ” বা “ব্যবহারিক প্রজ্ঞা।” তাই, যিহোবার প্রজ্ঞা নিছক পুঁথিগত কোনো বিষয় নয়। এটা ব্যবহারিক এবং কার্যকরী। যিহোবা তাঁর ব্যাপক জ্ঞান ও গভীর বোধগম্যতার ওপর নির্ভর করে যথাসম্ভব সর্বোত্তম সিদ্ধান্তগুলো নেন, সেগুলো কল্পনাসাধ্য সর্বোত্তম কার্যধারার মাধ্যমে পূর্ণ করেন। হ্যাঁ, সেটাই হল প্রকৃত প্রজ্ঞা! যিশুর এই কথাগুলো যে সত্য, তা যিহোবা দেখান: “প্রজ্ঞা নিজ কর্ম্মসমূহ দ্বারা নির্দ্দোষ বলিয়া গণিত হয়।” (মথি ১১:১৯) বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে যিহোবার কাজগুলো তাঁর প্রজ্ঞার বিষয়ে জোরালো সাক্ষ্য দেয়।

ঐশিক প্রজ্ঞার প্রমাণগুলো

৯, ১০. (ক) যিহোবা কী ধরনের প্রজ্ঞা প্রদর্শন করেন এবং তিনি কীভাবে তা দেখিয়েছেন? (খ) কীভাবে কোষ যিহোবার প্রজ্ঞার প্রমাণ দেয়?

সুন্দর সুন্দর কার্যকরী জিনিস তৈরি করেন, এমন একজন কারিগরের উদ্ভাবনী দক্ষতা দেখে আপনি কি কখনও বিস্মিত হয়ে গেছেন? সেটা হৃদয়ে ছাপ ফেলার মতো এক ধরনের প্রজ্ঞা। (যাত্রাপুস্তক ৩১:১-৩) স্বয়ং যিহোবা এই ধরনের প্রজ্ঞার উৎস এবং সর্বমহান অধিকারী। যিহোবার সম্বন্ধে রাজা দায়ূদ বলেছিলেন: “আমি তোমার স্তব করিব, কেননা আমি ভয়াবহরূপে ও আশ্চর্য্যরূপে নির্ম্মিত; তোমার কর্ম্ম সকল আশ্চর্য্য, তাহা আমার প্রাণ বিলক্ষণ জানে।” (গীতসংহিতা ১৩৯:১৪) সত্যিই, মানবদেহ সম্বন্ধে আমরা যত বেশি জানব, যিহোবার প্রজ্ঞার প্রতি আমরা তত বেশি সশ্রদ্ধ ভয় প্রদর্শন করব।

১০ উদাহরণস্বরূপ: আপনার জীবন একটামাত্র কোষ থেকে শুরু হয়েছিল—আপনার মায়ের একটা ডিম্বাণু, আপনার বাবার শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত হয়েছিল। শীঘ্রই, সেই কোষ বিভাজিত হতে শুরু করেছিল। সর্বশেষ ফল হল, আপনি প্রায় হাজার হাজার কোটি কোটি কোষ দিয়ে গঠিত। সেগুলো অত্যন্ত ক্ষুদ্র। মাঝারি আকারের প্রায় ১০,০০০টা কোষ একটা পিনের মাথার সমান হবে। অথচ প্রত্যেকটা কোষ অত্যন্ত জটিল এক সৃষ্টি, যা বোঝা অসম্ভব। এই কোষ, মনুষ্যনির্মিত যেকোনো যন্ত্র বা কারখানার চেয়েও হাজার গুণ বেশি জটিল। বিজ্ঞানীরা বলে যে, কোষ হল একটা প্রাচীরবেষ্টিত শহরের মতো—যেটার নিয়ন্ত্রিত প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ, পরিবহন ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বৈদ্যুতিক উৎস, উৎপাদন কারখানা, আবর্জনা নিষ্কাশন পদ্ধতি এবং পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত পদ্ধতি, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও এমনকি এর নিউক্লিয়াসে কেন্দ্রীয় সরকার পদ্ধতি রয়েছে। এ ছাড়া, কোষ মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে এর অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করতে পারে!

১১, ১২. (ক) কোন বিষয়টা একটা বেড়ে ওঠা ভ্রূণের কোষগুলোকে বিভাজিত করে এবং কীভাবে তা গীতসংহিতা ১৩৯:১৬ পদের সঙ্গে মিল রাখে? (খ) কোন কোন উপায়ে মানুষের মস্তিষ্ক দেখায় যে, আমরা “আশ্চর্য্যরূপে নির্ম্মিত”?

১১ অবশ্য, সব কোষই একরকম নয়। কোনো একটা ভ্রূণের কোষগুলো যখন বিভাজিত হতে থাকে, তখন সেগুলো একটা অন্যটার চেয়ে একেবারে আলাদা কাজ করে থাকে। কিছু হবে স্নায়ুকোষ; অন্যগুলো অস্থি, পেশী, রক্ত বা চোখের কোষ। এই ধরনের সমস্ত বিভাজন কোষের বংশগত প্রতিচিত্রের “গ্রন্থাগার,” ডিএনএ-তে প্রোগ্রাম করা থাকে। আগ্রহের বিষয় হল যে, যিহোবাকে দায়ূদ এই কথা বলতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন: “তোমার চক্ষু আমাকে পিণ্ডাকার [“ভ্রূণ অবস্থায়,” NW] দেখিয়াছে, তোমার পুস্তকে সমস্তই লিখিত ছিল।”—গীতসংহিতা ১৩৯:১৬.

১২ দেহের কিছু কিছু অঙ্গ অত্যন্ত জটিল। উদাহরণ হিসেবে, মানুষের মস্তিষ্কের কথা ভেবে দেখুন। কেউ কেউ এটাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এ যাবৎ আবিষ্কৃত সবচেয়ে জটিল বস্তু বলে আখ্যায়িত করেছে। এতে প্রায় ১০ হাজার হাজার কোটি স্নায়ুকোষ রয়েছে, যা আমাদের ছায়াপথে যত নক্ষত্র রয়েছে সেই সংখ্যার সমান। এই কোষগুলোর প্রত্যেকটা হাজার হাজার শাখায় বিভক্ত হয়ে অন্য কোষগুলোর সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞানীরা বলে যে, বিশ্বের সমস্ত গ্রন্থাগার মিলিয়ে যে-তথ্য রয়েছে, সেগুলোর সব মানুষের মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারে এবং বাস্তবিকই এর ধারণ ক্ষমতা নির্ণয়ের অসাধ্য। “আশ্চর্য্যরূপে নির্ম্মিত” এই অঙ্গ সম্বন্ধে যুগ যুগ ধরে অধ্যয়ন করা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা স্বীকার করে যে, এটা কীভাবে কাজ করে তা হয়তো তারা কখনোই বুঝে উঠতে পারবে না।

১৩, ১৪. (ক) কীভাবে পিঁপড়া ও অন্যান্য প্রাণীগুলো দেখায় যে, সেগুলো “প্রবৃত্তিগতভাবে বুদ্ধিমান” এবং তা এদের সৃষ্টিকর্তা সম্বন্ধে আমাদের কী শিক্ষা দেয়? (খ) কেন আমরা বলতে পারি যে, মাকড়সার জালের মতো সৃষ্টিগুলো “প্রজ্ঞা দ্বারা” নির্মিত হয়েছে?

১৩ কিন্তু, মানুষ যিহোবার সৃজনশীল প্রজ্ঞার কেবল একটা উদাহরণ মাত্র। গীতসংহিতা ১০৪:২৪ পদ বলে: “হে সদাপ্রভু, তোমার নির্ম্মিত বস্তু কেমন বহুবিধ! তুমি প্রজ্ঞা দ্বারা সে সমস্ত নির্ম্মাণ করিয়াছ; পৃথিবী তোমার সম্পত্তিতে পরিপূর্ণ।” যিহোবার প্রজ্ঞা আমাদের চারপাশের প্রতিটা সৃষ্টির মধ্যে স্পষ্ট দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পিঁপড়া “বড় বুদ্ধি ধরে [“প্রবৃত্তিগতভাবে বুদ্ধিমান,” NW]।” (হিতোপদেশ ৩০:২৪) সত্যিই, পিঁপড়াদের দলগুলো খুবই সুসংগঠিত। কিছু পিঁপড়া পাহারা দেয়, সুরক্ষা জোগায় এবং জাবপোকা নামের কীটপতঙ্গের কাছ থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে, যেন সেগুলো গৃহপালিত পশু। অন্য পিঁপড়াগুলো কৃষক হিসেবে কাজ করে, ছত্রাকের “শস্য” তোলে ও চাষ করে। অন্যান্য অনেক প্রাণীকেও এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে তারা এই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিষয়গুলো সহজাতভাবে করে। একটা সাধারণ মাছি বিমানচালনার এমন দুরূহ কাজ করতে পারে, যা মানুষের উদ্ভাবিত সবচেয়ে আধুনিক বিমান তা নকল করতে পারে না। পরিযায়ী পাখিগুলো আকাশের তারা দেখে, পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের দিক নির্দেশনা বা কোনো ধরনের আভ্যন্তরীণ মানচিত্র অনুযায়ী ভ্রমণ শুরু করে। এই প্রাণীদের মধ্যে যে-অদ্ভুত স্বভাবগুলো রয়েছে, সেগুলো নিয়ে গবেষণা করার জন্য উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়। তা হলে, যে-ঐশিক ব্যক্তি এদের তৈরি করেছেন তিনি কতই না বিজ্ঞ!

১৪ বিজ্ঞানীরা যিহোবার সৃজনশীল প্রজ্ঞা থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছে। এমনকি বায়োমিমেটিকস্‌ নামে প্রকৌশলবিদ্যায় একটা ক্ষেত্র রয়েছে, যা প্রকৃতি থেকে পাওয়া নকশাগুলো নকল করে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি হয়তো আশ্চর্য হয়ে মাকড়সার জালের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন। কিন্তু একজন প্রকৌশলী এতে এক চমৎকার নকশা দেখতে পান। দেখতে দুর্বল এমন কিছু সুতা সমানুপাতিকভাবে ইস্পাতের চেয়েও বেশি শক্ত, একটা বুলেটপ্রুফ অন্তর্বাসের তন্তুর চেয়েও বলিষ্ঠ। কতটা শক্ত? কল্পনা করুন যে, একটা মাকড়সার জাল প্রসারিত হতে হতে একটা মাছ ধরার নৌকায় ব্যবহৃত জালের সমান হয়েছে। এইরকম একটা জাল একটা যাত্রীবাহী উড়োজাহাজকে পর্যন্ত উড়ন্ত অবস্থায় থামিয়ে দিতে পারে! হ্যাঁ, যিহোবা “প্রজ্ঞা দ্বারা” এই সমস্ত কিছু নির্মাণ করেছেন।

পৃথিবীর প্রাণীদের “প্রবৃত্তিগতভাবে বুদ্ধিমান” হিসেবে কে তৈরি করেছে?

পৃথিবীকে অতিক্রম করে প্রজ্ঞা

১৫, ১৬. (ক) তারকাখচিত আকাশমণ্ডল যিহোবার প্রজ্ঞা সম্বন্ধে কী প্রমাণ দেয়? (খ) বিশাল দূতবাহিনীর সর্বপ্রধান কর্তা হিসেবে যিহোবার পদমর্যাদা কীভাবে এই পরিচালকের প্রজ্ঞার সাক্ষ্য দেয়?

১৫ পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিতে যিহোবার প্রজ্ঞা দেখা যায়। তারকাখচিত আকাশমণ্ডল বিশৃঙ্খলভাবে মহাবিশ্বে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে না, যে-বিষয়ে ৫ অধ্যায়ে আমরা বিশদভাবে আলোচনা করেছি। ‘আকাশমণ্ডলের বিধানকলাপে’ যিহোবার প্রজ্ঞার কারণে আকাশমণ্ডল সুবিন্যস্ত ছায়াপথগুলো দিয়ে চমৎকারভাবে সংগঠিত, সেগুলো আবার গুচ্ছাকারে দলে দলে বিভক্ত এবং গুচ্ছগুলো একসঙ্গে আরও বড় বড় গুচ্ছে সংযুক্ত থাকে। (ইয়োব ৩৮:৩৩) তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, যিহোবা আকাশমণ্ডলের নক্ষত্রপুঞ্জকে ‘বাহিনী’ নামে ডাকেন! (যিশাইয় ৪০:২৬) কিন্তু, আরেক ধরনের বাহিনী রয়েছে, যা এমনকি আরও স্পষ্টভাবে যিহোবার প্রজ্ঞা তুলে ধরে।

১৬ চার অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখেছি যে, কোটি কোটি আত্মিক প্রাণীদের বিশাল বাহিনীর মধ্যে সর্বপ্রধান কর্তা হিসেবে তাঁর পদমর্যাদার কারণে ঈশ্বরের “বাহিনীগণের সদাপ্রভু” উপাধি রয়েছে। এটা যিহোবার শক্তির প্রমাণ। কিন্তু, এতে কীভাবে তাঁর প্রজ্ঞা জড়িত? ভেবে দেখুন: যিহোবা ও যিশু খ্রিস্ট কখনও কাজ ছাড়া থাকে না। (যোহন ৫:১৭) তাই এটা যুক্তিসংগত যে, একইভাবে সর্বোচ্চ কর্তার দূত পরিচারকেরা সবসময় ব্যস্ত। আর মনে রাখবেন যে, তারা মানুষের চেয়েও উচ্চ, অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং ক্ষমতাবান। (ইব্রীয় ১:৭; ২:৭) কিন্তু, যিহোবা সেই সমস্ত দূতকে ব্যস্ত রেখেছেন, আনন্দের সঙ্গে সন্তোষজনক কাজে রত রেখেছেন অর্থাৎ তারা অগণিত বছর ধরে “তাঁহার বাক্য-সাধক” এবং “তাঁহার অভিমত-সাধক।” (গীতসংহিতা ১০৩: ২০, ২১) এই পরিচালকের প্রজ্ঞা কতই না সশ্রদ্ধ ভয় জাগায়!

যিহোবা “একমাত্র প্রজ্ঞাবান্‌”

১৭, ১৮. কেন বাইবেল বলে যে, যিহোবা “একমাত্র প্রজ্ঞাবান্‌” এবং কেন তাঁর প্রজ্ঞা আমাদের মধ্যে সশ্রদ্ধ ভয় জাগিয়ে তোলে?

১৭ এইসমস্ত প্রমাণের পরিপ্রেক্ষিতে, এতে কি অবাক হওয়ার মতো কিছু আছে যে, বাইবেল দেখায় যিহোবার প্রজ্ঞাই সর্বশ্রেষ্ঠ? উদাহরণস্বরূপ, এটা বলে যে, যিহোবাই “একমাত্র প্রজ্ঞাবান্‌।” (রোমীয় ১৬:২৭) একমাত্র যিহোবাই পুরোপুরি অর্থে প্রজ্ঞার অধিকারী। তিনিই সমস্ত প্রকৃত প্রজ্ঞার উৎস। (হিতোপদেশ ২:৬) সেইজন্য যিশু যদিও যিহোবার সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, তবুও তিনি তাঁর নিজস্ব প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করেননি বরং এমনভাবে কথা বলতেন যেন তাঁর পিতা তাঁকে আজ্ঞা দিয়েছেন।—যোহন ১২:৪৮-৫০.

১৮ লক্ষ করুন যে, প্রেরিত পৌল কীভাবে যিহোবার প্রজ্ঞার অদ্বিতীয়তা প্রকাশ করেছেন: “আহা! ঈশ্বরের ধনাঢ্যতা ও প্রজ্ঞা ও জ্ঞান কেমন অগাধ! তাঁহার বিচার সকল কেমন বোধাতীত! তাঁহার পথ সকল কেমন অননুসন্ধেয়!” (রোমীয় ১১:৩৩) “আহা,” শব্দটা দিয়ে পদটা শুরু করে পৌল এক জোরালো আবেগ—এই ক্ষেত্রে গভীর সশ্রদ্ধ ভয়—দেখিয়েছিলেন। “অগাধ” এর জন্য যে-গ্রিক শব্দ তিনি বেছে নিয়েছেন, তা “অতল গহ্বর” এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই, তার শব্দগুলো মনের মধ্যে এক সুস্পষ্ট চিত্র জাগিয়ে তোলে। যিহোবার প্রজ্ঞা সম্বন্ধে আমরা যখন চিন্তা করি, তখন এটা ঠিক যেন আমরা এক সীমাহীন, অতল গহ্বরে তাকাচ্ছি, এত গভীর এক রাজ্য, এত ব্যাপক যে আমরা কখনও এর বিশালতা পুরোপুরি বুঝতে পারব না আর তা স্পষ্ট ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করা তো দূরের কথা। (গীতসংহিতা ৯২:৫) এই চিন্তাধারা কি একজনকে নম্র করে না?

১৯, ২০. (ক) কেন ঈগল ঐশিক প্রজ্ঞার এক উপযুক্ত উদাহরণ? (খ) কীভাবে যিহোবা ভবিষ্যতের বিষয় আগে থেকে দেখতে পারার বিষয়ে তাঁর ক্ষমতা দেখিয়েছেন?

১৯ আরেক অর্থে যিহোবা “একমাত্র প্রজ্ঞাবান্‌”: একমাত্র তিনিই ভবিষ্যতের বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখতে পারেন। মনে করে দেখুন, ঐশিক প্রজ্ঞাকে রূপক অর্থে তুলে ধরার জন্য যিহোবা তীক্ষ্ন দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ঈগলকে ব্যবহার করেন। গোল্ডেন প্রজাতির একটা ঈগলের ওজন হয়তো মাত্র ৫ কিলোগ্রাম কিন্তু এর চোখগুলো একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের চোখের চেয়েও আরও বড়। ঈগলের দৃষ্টিশক্তি এত তীক্ষ্ন যে, শত শত মিটার উঁচু থেকে, এমনকি কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে এই পাখি এর ক্ষুদ্র শিকারটা ঠিক কোথায় আছে, তা নির্দিষ্ট করতে পারে! ঈগলের বিষয়ে যিহোবা নিজে একবার বলেছিলেন: “তাহার চক্ষু দূর হইতে তাহা নিরীক্ষণ করে।” (ইয়োব ৩৯:২৯) একইভাবে, যিহোবা “দূর হইতে” অর্থাৎ ভবিষ্যতের বিষয় আগে থেকে দেখতে পারেন!

২০ বাইবেলে অনেক প্রমাণ রয়েছে যে, এটাই সত্য। এতে শত শত ভবিষ্যদ্বাণী বা ইতিহাস রয়েছে, যা অনেক আগে লেখা হয়েছে। যুদ্ধের ফলাফল, বিশ্বশক্তিগুলোর উত্থান-পতন ও এমনকি নির্দিষ্ট কিছু সেনাপতিদের সমরকৌশলের বিষয়ে সমস্তকিছু বাইবেলে ভবিষ্যদ্বাণী করা ছিল—কিছু কিছু ক্ষেত্রে শত শত বছর আগে।—যিশাইয় ৪৪:২৫–৪৫:৪; দানিয়েল ৮:২-৮, ২০-২২.

২১, ২২. (ক) জীবনে আপনি যে-বিষয়গুলো বেছে নেবেন, সেগুলোর সবই যিহোবা আগে থেকে জানেন, তা মনে করার কোনো ভিত্তি নেই কেন? উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করুন। (খ) কীভাবে আমরা জানি যে, যিহোবার প্রজ্ঞা নিরাবেগ বা অনুভূতিবিহীন নয়।

২১ কিন্তু, এর মানে কি এই যে, আপনি আপনার জীবনে কোন বিষয়গুলো বেছে নেবেন তা ঈশ্বর ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছেন? অদৃষ্টবাদ প্রচার করে এমন কিছু ব্যক্তি জোরগলায় বলে যে, এর উত্তর হল হ্যাঁ। কিন্তু, সেই ধারণা আসলে যিহোবার প্রজ্ঞাকে দুর্বল করে দেয় কারণ এটা ইঙ্গিত করে যে, তিনি ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জানার বিষয়ে তাঁর ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: আপনার যদি অপূর্ব অতুলনীয় গানের গলা থাকে, তা হলে আপনি কি অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে সারাক্ষণ কেবল গানই গাইবেন? এটা এক উদ্ভট ধারণা! একইভাবে, ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আগে থেকে জানার ক্ষমতা যিহোবার আছে, কিন্তু তিনি সবসময় তা কাজে লাগান না। তা করলে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছার ওপর অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করা হবে, যা এমন এক মূল্যবান উপহার যেটা যিহোবা কখনও নিয়ে নেবেন না।—দ্বিতীয় বিবরণ ৩০:১৯, ২০.

২২ এর চেয়েও খারাপ বিষয়টা হল, অদৃষ্টবাদের ধারণা ইঙ্গিত করে যে, যিহোবার প্রজ্ঞা হল নিরাবেগ, হৃদয়হীন, অনুভূতিবিহীন বা সমবেদনাহীন। কিন্তু, এটা একেবারেই সত্য নয়! বাইবেল শিক্ষা দেয় যে, যিহোবা “চিত্তে জ্ঞানবান [“বিজ্ঞ,” NW]।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (ইয়োব ৯:৪) এর মানে নয় যে, তাঁর আক্ষরিক চিত্ত বা হৃদয় রয়েছে কিন্তু বাইবেল প্রায়ই ব্যক্তিবিশেষ ভিতরে কেমন তা বোঝাতে এই শব্দটা ব্যবহার করে, যেটার মধ্যে প্রেরণা ও অনুভূতি, যেমন প্রেম জড়িত। তাই, যিহোবার প্রজ্ঞা, তাঁর অন্যান্য গুণগুলোর মতো প্রেমের দ্বারা চালিত।—১ যোহন ৪:৮.

২৩. যিহোবার প্রজ্ঞার সর্বোৎকৃষ্টতা আমাদের কী করতে পরিচালিত করবে?

২৩ স্বাভাবিকভাবেই, যিহোবার প্রজ্ঞা নিখুঁতভাবে নির্ভরযোগ্য। এটা আমাদের প্রজ্ঞার চেয়ে এতটাই ওপরে যে, ঈশ্বরের বাক্য প্রেমের সঙ্গে আমাদের পরামর্শ দেয়: “তুমি সমস্ত চিত্তে সদাপ্রভুতে বিশ্বাস [“নির্ভর,” NW] কর; তোমার নিজ বিবেচনায় নির্ভর করিও না; তোমার সমস্ত পথে তাঁহাকে স্বীকার কর; তাহাতে তিনি তোমার পথ সকল সরল করিবেন।” (হিতোপদেশ ৩:৫, ৬) এখন আসুন আমরা যিহোবার প্রজ্ঞাকে আরেকটু গভীরভাবে বিবেচনা করি, যাতে আমরা সমস্ত দিক দিয়ে বিজ্ঞ আমাদের ঈশ্বরের আরও নিকটবর্তী হতে পারি।