সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অধ্যায় ২০

“চিত্তে বিজ্ঞ”—অথচ নম্র

“চিত্তে বিজ্ঞ”—অথচ নম্র

১-৩. কেন আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, যিহোবা নম্র?

একজন বাবা তার ছোট বাচ্চাকে এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিতে চান। তিনি বাচ্চার হৃদয় স্পর্শ করতে উৎসুক। তার কোন উপায় অবলম্বন করা উচিত? তিনি কি বাচ্চাকে ভয় দেখাবেন এবং কর্কশ ভাষা ব্যবহার করবেন? নাকি বাচ্চার উচ্চতা অনুযায়ী তিনি নিচু হবেন এবং খুব কোমল ও আগ্রহজনকভাবে কথা বলবেন? কোনো সন্দেহ নেই যে, একজন বিজ্ঞ, নম্র বাবা কোমল উপায়ই বেছে নেবেন।

যিহোবা কী ধরনের পিতা—দাম্ভিক নাকি নম্র, কর্কশ নাকি কোমল? যিহোবা সর্বজ্ঞ, সমস্ত দিক দিয়ে বিজ্ঞ। কিন্তু আপনি কি লক্ষ করেছেন যে, জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা সাধারণত লোকেদের নম্র করে না? বাইবেল যেমন বলে, “জ্ঞান গর্ব্বি ত করে।” (১ করিন্থীয় ৩:১৯; ৮:১) কিন্তু, যিহোবা “চিত্তে জ্ঞানবান [“বিজ্ঞ,” NW]” ও সেইসঙ্গে নম্র। (ইয়োব ৯:৪) তবে, এর মানে নয় যে, যিহোবার পদমর্যাদা নিচু বা তাঁর মহত্ত্বে ঘাটতি রয়েছে বরং তিনি দাম্ভিকতাশূন্য। তা কেন?

যিহোবা পবিত্র। তাই দাম্ভিকতা—একটা গুণ যা অশুচি করে—তাঁর মধ্যে নেই। (মার্ক ৭:২০-২২) এ ছাড়া লক্ষ করুন যে, ভাববাদী যিরমিয় যিহোবাকে কী বলেছিলেন: “[যিহোবা নিজে] অবশ্যই তোমার প্রাণ স্মরণে রাখবেন এবং আমার কাছে নত হবেন।” * (বিলাপ ৩:২০, NW) একটু কল্পনা করুন! বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সার্বভৌম প্রভু, যিহোবা ‘নত হতে’ বা যিরমিয়ের অবস্থানে আসতে ইচ্ছুক ছিলেন, যাতে সেই অসিদ্ধ ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহের দৃষ্টি দিতে পারেন। (গীতসংহিতা ১১৩:৭) হ্যাঁ, যিহোবা হলেন নম্র। কিন্তু ঈশ্বরীয় নম্রতার সঙ্গে কী জড়িত? কীভাবে এটা প্রজ্ঞার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত? আর কেন এটা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

যিহোবা যেভাবে নম্র বলে প্রমাণিত হন

৪, ৫. (ক) নম্রতা কী, এটা কীভাবে দেখানো হয় এবং কেন এটাকে কখনও দুর্বলতা বা ভীরুতার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা উচিত নয়? (খ) দায়ূদের সঙ্গে আচরণ করার ক্ষেত্রে কীভাবে যিহোবা নম্রতা দেখিয়েছিলেন এবং যিহোবার নম্রতা আমাদের কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ?

নম্রতা হল নত মন থাকা, ঔদ্ধত্য ও গর্ব না থাকা। হৃদয়ের গভীরের এক গুণ হল নম্রতা আর তা এইরকম বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে প্রকাশ পায় যেমন মৃদুতা, ধৈর্য এবং যুক্তিবাদিতা। (গালাতীয় ৫:২২, ২৩) তবে ঈশ্বরীয় এই গুণগুলোকে ভুলভাবে কখনোই দুর্বলতা বা ভীরুতা বলে মনে করা উচিত নয়। সেগুলো যিহোবার ন্যায্য ক্রোধ বা তাঁর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাকে ব্যবহার করার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এর পরিবর্তে, যিহোবা তাঁর নম্রতা এবং মৃদুতার মাধ্যমে নিজেকে পুরোপুরি নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে তাঁর অপরিমেয় শক্তি, তাঁর ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। (যিশাইয় ৪২:১৪) কীভাবে নম্রতা প্রজ্ঞার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত? বাইবেলের সম্বন্ধে একটা তথ্যগ্রন্থ বলে: “নম্রতাকে চূড়ান্তভাবে . . . নিঃস্বার্থপরতা এবং সমস্ত প্রজ্ঞার এক অপরিহার্য ভিত্তি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।” তাই, নম্রতা ছাড়া প্রকৃত প্রজ্ঞার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। যিহোবার নম্রতা কীভাবে আমাদের উপকার করে?

একজন বিজ্ঞ বাবা তার সন্তানের সঙ্গে নম্র ও মৃদুভাবে আচরণ করেন

রাজা দায়ূদ যিহোবার উদ্দেশে গান গেয়েছিলেন: “তুমি আমাকে নিজ পরিত্রাণ-ঢাল দিয়াছ; তোমার দক্ষিণ হস্ত আমাকে ধারণ করিয়াছে, তোমার কোমলতা [“নম্রতা,” NW] আমাকে মহান্‌ করিয়াছে।” (গীতসংহিতা ১৮:৩৫) আসলে, যিহোবা এই তুচ্ছ অসিদ্ধ মানুষের জন্য কাজ করতে, তাকে রক্ষা করতে ও দিনের পর দিন বাঁচিয়ে রাখতে নিজেকে নত করেছিলেন। দায়ূদ বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি যদি পরিত্রাণ পেতে চান—আর এমনকি একজন রাজা হিসেবে কিছুটা মহত্ত্ব লাভ করতে চান—তা হলে সেটা একমাত্র নিজেকে নত করার ব্যাপারে যিহোবার ইচ্ছুক মনোভাবের কারণেই সম্ভব হবে। সত্যি বলতে কী, আমাদের মধ্যে কেই বা পরিত্রাণের আশা করতে পারে, যদি না যিহোবা নম্র হন, আমাদের পরিচালনা করার জন্য এক মৃদু ও প্রেমময় পিতা হিসেবে নিজেকে নত করতে ইচ্ছুক হন?

৬, ৭. (ক) কেন বাইবেল কখনও যিহোবাকে বিনয়ী হিসেবে উল্লেখ করে না? (খ) মৃদুতা ও প্রজ্ঞার মধ্যে কী সম্পর্ক রয়েছে এবং এই ক্ষেত্রে মুখ্য উদাহরণ কে স্থাপন করেন?

এটা লক্ষণীয় যে, নম্রতা ও বিনয়ের মধ্যে এক সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বিনয় হল এক চমৎকার গুণ, যা বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের গড়ে তোলা দরকার। নম্রতার মতো এটাও প্রজ্ঞার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, হিতোপদেশ ১১:২ পদ বলে: “প্রজ্ঞাই নম্রদিগের [“বিনয়ীদের,” NW] সহচরী।” তবে, বাইবেল কখনোই যিহোবাকে বিনয়ী হিসেবে বর্ণনা করে না। কেন করে না? বিনয়কে শাস্ত্রে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তা একজনের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে সঠিকভাবে অবগত থাকার বিষয়কে ইঙ্গিত করে। সর্বশক্তিমানের কোনো সীমা নেই কেবলমাত্র সেই বিষয়গুলো ছাড়া, যেগুলো তাঁর নিজস্ব ধার্মিক মানের কারণে তিনি নিজের ওপর আরোপ করেন। (মার্ক ১০:২৭; তীত ১:২) এ ছাড়া, পরাৎপর হিসেবে তিনি কারও বশীভূত নন। তাই, বিনয়ের ধারণাটি স্বাভাবিকভাবেই যিহোবার প্রতি প্রযোজ্য হয় না।

তবে, যিহোবা নম্র এবং মৃদু। তিনি তাঁর দাসদের শিক্ষা দেন যে, প্রকৃত প্রজ্ঞার জন্য মৃদুতা অপরিহার্য। তাঁর বাক্য ‘জ্ঞানের [“প্রজ্ঞার,” NW] মৃদুতার’ * বিষয়ে বলে। (যাকোব ৩:১৩) এই ক্ষেত্রে যিহোবার উদাহরণ বিবেচনা করুন।

যিহোবা নম্রভাবে দায়িত্ব অর্পণ করেন ও শোনেন

৮-১০. (ক) কেন এটা লক্ষণীয় যে, যিহোবা দায়িত্ব অর্পণ করার ও শোনার ক্ষেত্রে এক ইচ্ছুক মনোভাব দেখান? (খ) কীভাবে সর্বশক্তিমান তাঁর দূতেদের সঙ্গে নম্রভাবে আচরণ করেছেন?

দায়িত্ব অর্পণ করা ও শুনতে ইচ্ছুক হওয়ার ক্ষেত্রে যিহোবার নম্রতার উৎসাহজনক প্রমাণ রয়েছে। তিনি যে সত্যিই শোনেন, তা বিস্ময়কর; যিহোবার কোনো সাহায্যের বা পরামর্শের দরকার নেই। (যিশাইয় ৪০:১৩, ১৪; রোমীয় ১১:৩৪, ৩৫) তা সত্ত্বেও, বাইবেল বার বার আমাদের দেখায় যে, যিহোবা এই বিষয়গুলোতে স্বেচ্ছায় উচ্চ অবস্থা থেকে নেমে আসেন।

উদাহরণস্বরূপ, অব্রাহামের জীবনের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা বিবেচনা করুন। অব্রাহামের কাছে তিন জন অতিথি এসেছিল, যাদের একজনকে তিনি “প্রভু [“যিহোবা,” NW]” বলে সম্বোধন করেছিলেন। অতিথিরা আসলে স্বর্গদূত ছিল কিন্তু তাদের মধ্যে একজন যিহোবার নামে এসেছিলেন এবং তাঁর নামে কাজ করছিলেন। সেই স্বর্গদূত যা বলেছিলেন ও করেছিলেন, তা আসলে যিহোবাই বলছিলেন এবং করছিলেন। সেই দূতের মাধ্যমে যিহোবা অব্রাহামকে বলেছিলেন যে, তিনি শুনেছিলেন “সদোমের ও ঘমোরার ক্রন্দন আত্যন্তিক।” যিহোবা বলেছিলেন: “আমি নীচে গিয়া দেখিব, আমার নিকটে আগত ক্রন্দনানুসারে তাহারা সর্ব্বতোভাবে করিয়াছে কি না; যদি না করিয়া থাকে, তাহা জানিব।” (আদিপুস্তক ১৮:৩, ২০, ২১) অবশ্যই যিহোবার এই বার্তা বোঝায়নি যে, সর্বশক্তিমান ব্যক্তিগতভাবে ‘নীচে নামিবেন।’ এর পরিবর্তে তিনি তাঁকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আবারও স্বর্গদূতেদের পাঠিয়েছিলেন। (আদিপুস্তক ১৯:১) কেন? যিহোবা, যিনি সবকিছু দেখতে পারেন, তিনি কি নিজেই সেই অঞ্চলের প্রকৃত অবস্থা ‘জানিতে’ পারতেন না? নিশ্চয়ই পারতেন। কিন্তু, এর পরিবর্তে যিহোবা নম্রভাবে সেই দূতেদের কার্যভার দিয়েছিলেন যাতে তারা পরিস্থিতির তদন্ত করতে পারে এবং সদোমে লোট ও তার পরিবারের কাছে যেতে পারে।

১০ এ ছাড়া, যিহোবা শোনেন। একবার তিনি দুষ্ট রাজা আহাবকে কীভাবে ধ্বংস করা যায়, সেই বিষয়ে তাঁর দূতেদের কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন। এই ধরনের কোনো সাহায্যের যিহোবার দরকার ছিল না। তা সত্ত্বেও, তিনি একজন দূতের পরামর্শ মেনে নিয়েছিলেন এবং তা কার্যকরী করার জন্য তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। (১ রাজাবলি ২২:১৯-২২) এটি কি নম্রতা ছিল না?

১১, ১২. কীভাবে অব্রাহাম যিহোবার নম্রতা দেখতে পেয়েছিলেন?

১১ যিহোবা এমনকি অসিদ্ধ মানুষদের কথা শুনতেও ইচ্ছুক, যারা তাদের উদ্বিগ্নতাগুলো প্রকাশ করতে চায়। উদাহরণস্বরূপ, যিহোবা সদোম ও ঘমোরা ধ্বংস করার বিষয়ে প্রথম যখন তাঁর ইচ্ছা সম্বন্ধে অব্রাহামকে জানিয়েছিলেন, তখন সেই বিশ্বস্ত ব্যক্তি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলেন। “এই প্রকার কর্ম্ম আপনা হইতে দূরে থাকুক,” অব্রাহাম বলেছিলেন আর তিনি সেইসঙ্গে এও বলেছিলেন: “সমস্ত পৃথিবীর বিচারকর্ত্তা কি ন্যায়বিচার করিবেন না?” তিনি যিহোবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, সেই নগরগুলোতে যদি ৫০ জন ধার্মিক ব্যক্তি পাওয়া যায়, তা হলে তিনি সেগুলোকে ধ্বংস করা থেকে বিরত হবেন কি না। যিহোবা তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তা হলে তিনি ধ্বংস করা থেকে বিরত হবেন। কিন্তু অব্রাহাম সেই সংখ্যাকে ৪৫, ৪০ ও এভাবে আরও কমিয়ে এনে বার বার জিজ্ঞেস করেছিলেন। যিহোবার দেওয়া আশ্বাস সত্ত্বেও, অব্রাহাম সেই সংখ্যা দশ না হওয়া পর্যন্ত বলে চলেছিলেন। সম্ভবত অব্রাহাম তখনও পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারেননি যে, যিহোবা কতখানি করুণাময়। যাইহোক, যিহোবা ধৈর্যপূর্বক এবং নম্রভাবে তাঁর বন্ধু ও দাস অব্রাহামকে তার উদ্বিগ্নতাগুলো প্রকাশ করার সুযোগ দিয়েছিলেন।—আদিপুস্তক ১৮:২৩-৩৩.

১২ অত্যন্ত মেধাবী, শিক্ষিত কত জন ব্যক্তি বুদ্ধিমত্তায় তার চেয়ে শতগুণে নিকৃষ্ট ব্যক্তির কথা ধৈর্যপূর্বক শুনবে? * আমাদের ঈশ্বরের নম্রতা এইরকম। সেই একই আলোচনায় অব্রাহাম এও লক্ষ করেছিলেন যে, যিহোবা “ক্রোধে ধীর।” (যাত্রাপুস্তক ৩৪:৬) পরাৎপরের কাজ সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করার অধিকার তার নেই সম্ভবত এটি বুঝতে পেরে অব্রাহাম দুবার অনুরোধ করেছিলেন: “প্রভু [“যিহোবা, দয়া করে,” NW] বিরক্ত হইবেন না।” (আদিপুস্তক ১৮:৩০, ৩২) অবশ্যই যিহোবা বিরক্ত হননি। সত্যিই তাঁর ‘প্রজ্ঞার মৃদুতা’ রয়েছে।

যিহোবা যুক্তিবাদী

১৩. বাইবেলে ব্যবহৃত “যুক্তিযুক্ত” শব্দের অর্থ কী এবং এই শব্দটি কেন উপযুক্তভাবে যিহোবাকে বর্ণনা করে?

১৩ যিহোবার নম্রতা আরেকটা সুন্দর গুণের মাধ্যমে দেখা যায় আর তা হল যুক্তিবাদিতা। অসিদ্ধ মানুষদের মধ্যে এই গুণটির প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। যিহোবা শুধু তাঁর বুদ্ধিমান প্রাণীদের কথা শুনতেই আগ্রহী নন সেইসঙ্গে তিনি তা মেনেও নিতে চান, যখন তা তাঁর ধার্মিক নীতিগুলোর সঙ্গে কোনোরকম সংঘাত তৈরি না করে। “যুক্তিযুক্ত” শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল “মেনে নেওয়া,” যেমন বাইবেলে ব্যবহৃত হয়েছে। এই গুণটিও ঐশিক প্রজ্ঞার এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। যাকোব ৩:১৭ পদ বলে: “যে জ্ঞান [“প্রজ্ঞা,” NW] উপর হইতে আইসে, তাহা . . . ক্ষান্ত [“যুক্তিযুক্ত,” NW]।” কোন অর্থে সমস্ত দিক দিয়ে বিজ্ঞ যিহোবা যুক্তিবাদী? একটা হল তিনি মানিয়ে নেন। মনে করে দেখুন, তাঁর ব্যক্তিগত নাম আমাদের শেখায় যে যিহোবা তাঁর উদ্দেশ্যগুলো পূরণ করার জন্য যা কিছুই হওয়ার দরকার হোক না কেন, তা-ই হন। (যাত্রাপুস্তক ৩:১৪, NW) এর থেকে কি মানিয়ে নেওয়ার ও যুক্তিবাদী হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায় না?

১৪, ১৫. যিহোবার স্বর্গীয় রথের বিষয়ে যিহিষ্কেলের দর্শন যিহোবার স্বর্গীয় সংগঠন সম্বন্ধে আমাদের কী শিক্ষা দেয় এবং কীভাবে এটা জাগতিক সংগঠনগুলোর চেয়ে আলাদা?

১৪ বাইবেলে এক উল্লেখযোগ্য বাক্যাংশ রয়েছে, যা আমাদের যিহোবার মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বুঝতে সাহায্য করে। ভাববাদী যিহিষ্কেলকে আত্মিক প্রাণীদের নিয়ে গঠিত যিহোবার স্বর্গীয় সংগঠনের একটা দর্শন দেখানো হয়েছিল। তিনি এক ভয়ংকর রথ দেখেছিলেন, যেটা ছিল যিহোবার নিজস্ব “যান” ও সবসময় তাঁর নিয়ন্ত্রণের অধীনে। এটা যেভাবে চলছিল, সেটাই ছিল সবচেয়ে আগ্রহের বিষয়। প্রকাণ্ড চাকাগুলো চারদিকে মুখ করে ছিল এবং চোখে পরিপূর্ণ ছিল, যাতে এটা চারদিক দেখতে পারে এবং কোনোরকম না থেমে বা না ঘুরে সঙ্গে সঙ্গে দিক পরিবর্তন করতে পারে। আর এই প্রকাণ্ড রথটি মানুষের তৈরি কোনো রথের মতো ধীরে ধীরে বা কোনোরকমে চলে না। এটা বিদ্যুতের গতির মতো দ্রুত চলতে পারে, এমনকি ৯০ ডিগ্রি বাঁকও নিতে পারে! (যিহিষ্কেল ১:১, ১৪-২৮) হ্যাঁ, যিহোবার সংগঠন, যেটার নিয়ন্ত্রণ সর্বশক্তিমান সার্বভৌম প্রভুর অধীনে রয়েছে সেটা সবচেয়ে বেশি মানিয়ে নিতে পারে, পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি ও প্রয়োজনগুলোর প্রতি সাড়া দেয়।

১৫ মানুষেরা এই ধরনের নিখুঁত মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাকে অনুকরণ করার জন্য কেবল চেষ্টা করে দেখতে পারে। কিন্তু, প্রায়ই দেখা যায় যে মানুষ ও তাদের সংগঠনগুলো মানিয়ে নেওয়ার চেয়ে বরং আরও কঠোর হয়, ত্যাগস্বীকার করার চেয়ে বরং আরও অযৌক্তিক হয়। উদাহরণস্বরূপ: একটা বিশাল মালবাহী জাহাজ কিংবা ট্রেনের আকার ও ক্ষমতা দেখে আমরা হয়তো বিস্মিত হতে পারি। কিন্তু এই দুটোর একটাও কি পরিস্থিতির আকস্মিক পরিবর্তনের প্রতি সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিতে পারে? একটা মালবাহী ট্রেনের সামনে রেললাইনের ওপর আড়াআড়ি যদি বাধা সৃষ্টিকারী একটা বস্তু পড়ে, তা হলে সেটার মোড় ঘোরা অসম্ভব। হঠাৎ করে থেমে যাওয়া এত সহজ নয়। একটা ভারী মালবাহী ট্রেন হয়তো ব্রেক কষার পরে আরও প্রায় দুই কিলোমিটার পথ যাওয়ার পর থামে! একইভাবে, একটা বিশাল মালবাহী জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার পরে আরও প্রায় আট কিলোমিটার সামনে এগিয়ে বন্ধ হয়। এমনকি ইঞ্জিনকে যদি বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়, তারপরও মালবাহী জাহাজ হয়তো তখনও আরও প্রায় তিন কিলোমিটার এগিয়ে গিয়ে থামে। মানব সংগঠনগুলো যা কঠোর এবং অযৌক্তিক সেগুলোর ক্ষেত্রে একই বিষয়গুলো ঘটে। গর্বের কারণে মানুষেরা প্রায়ই পরিবর্তনশীল প্রয়োজন ও পরিস্থিতিগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াকে প্রত্যাখ্যান করে। এইরকম কঠোরতা বিভিন্ন সংস্থাকে দেউলিয়া করে দিয়েছে এবং এমনকি সরকারের পতন ঘটিয়েছে। (হিতোপদেশ ১৬:১৮) আমরা কতই না সুখী হতে পারি যে, যিহোবা বা তাঁর সংগঠন এগুলোর একটার মতোও নয়!

যিহোবা যেভাবে যুক্তিবাদিতা দেখান

১৬. সদোম ও ঘমোরা ধ্বংস করার আগে কীভাবে যিহোবা লোটের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে যুক্তিবাদিতা দেখিয়েছিলেন?

১৬ সদোম ও ঘমোরার ধ্বংস সম্বন্ধে আবারও বিবেচনা করুন। লোট ও তার পরিবার যিহোবার স্বর্গদূতের কাছ থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা পেয়েছিল: “পর্ব্বতে পলায়ন কর।” কিন্তু, এটা লোটের কাছে কোনো আবেদন তৈরি করেনি। “হে আমার প্রভু [“যিহোবা,” NW], এমন না হউক,” তিনি অনুরোধ করেছিলেন। পর্বতে পালিয়ে গেলে তিনি মারা যাবেন মনে করে লোট অনুরোধ করেছিলেন যে তাকে ও তার পরিবারকে যেন কাছের শহর সোয়রে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। মনে করে দেখুন যে, যিহোবা সেই শহর ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। এ ছাড়া, লোটের ভয় পাওয়ার পিছনে আসলে প্রকৃত কোনো কারণ ছিল না। নিশ্চিতভাবেই যিহোবা লোটকে পাহাড়ি এলাকায় বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন! তা সত্ত্বেও, যিহোবা লোটের অনুরোধ রেখেছিলেন এবং সোয়র ধ্বংস করেননি। ‘ভাল, আমি এ বিষয়েও তোমার প্রতি অনুগ্রহ করি,’ স্বর্গদূত লোটকে বলেছিলেন। (আদিপুস্তক ১৯:১৭-২২) এটা কি যিহোবার যুক্তিবাদিতার প্রমাণ নয়?

১৭, ১৮. নীনবীর লোকেদের সঙ্গে আচরণের সময় কীভাবে যিহোবা দেখিয়েছিলেন যে, তিনি যুক্তিবাদী?

১৭ এ ছাড়া যিহোবা আন্তরিক অনুতাপের প্রতিও সাড়া দেন, সবসময় তা-ই করেন যা করুণাপূর্ণ ও সঠিক। ভাববাদী যোনাকে যখন দুষ্ট, দৌরাত্ম্যপূর্ণ শহর নীনবীতে পাঠানো হয়, তখন কী হয়েছিল তা বিবেচনা করুন। যোনা যখন নীনবী শহরের রাস্তায় রাস্তায় ভ্রমণ করেছিলেন, তখন তিনি যে-অনুপ্রাণিত বার্তা ঘোষণা করেছিলেন, তা খুবই সাধারণ ছিল: ৪০ দিন পর বড় শহর নীনবী উৎপাটিত হবে। কিন্তু, পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পালটে গিয়েছিল। নীনবীর লোকেরা অনুতাপ করেছিল!—যোনা, ৩ অধ্যায়।

১৮ পরিস্থিতির এই পরিবর্তনে যোনা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, সেটার সঙ্গে যিহোবার প্রতিক্রিয়া তুলনা করে দেখা শিক্ষণীয়। এই ঘটনায়, যিহোবা মানিয়ে নিয়েছিলেন, “যুদ্ধবীর” হওয়ার বদলে তিনি পাপের ক্ষমাকারীতে পরিণত হয়েছিলেন। * (যাত্রাপুস্তক ১৫:৩) অন্যদিকে, যোনা ছিলেন অনমনীয় এবং নির্দয়। যিহোবার যুক্তিবাদিতা নিয়ে চিন্তা করার পরিবর্তে তিনি পূর্বে উল্লেখিত মালবাহী ট্রেন বা জাহাজের মতো প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। তিনি ধ্বংসের বিষয়ে ঘোষণা করেছিলেন, তাই ধ্বংস আসতেই হবে! কিন্তু, যিহোবা ধৈর্যপূর্বক তাঁর অধৈর্য ভাববাদীকে যুক্তিবাদিতা ও করুণার এক স্মরণীয় শিক্ষা শিখিয়েছিলেন।—যোনা, ৪ অধ্যায়।

যিহোবা যুক্তিবাদী এবং আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো বোঝেন

১৯. (ক) কেন আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, যিহোবা আমাদের কাছ থেকে যা আশা করেন সেই ক্ষেত্রে তিনি যুক্তিবাদী? (খ) হিতোপদেশ ১৯:১৭ পদ কীভাবে দেখায় যে, যিহোবা “সজ্জন ও যুক্তিবাদী” প্রভু ও অত্যন্ত প্রগাঢ়ভাবে নম্র?

১৯ সবশেষে বলা যায় যে, যিহোবা আমাদের কাছ থেকে যা আশা করেন, সেই ক্ষেত্রেও তিনি যুক্তিবাদী। রাজা দায়ূদ বলেছিলেন: “তিনিই আমাদের গঠন জানেন; আমরা যে ধূলিমাত্র, ইহা তাঁহার স্মরণে আছে।” (গীতসংহিতা ১০৩:১৪) যিহোবা আমাদের সীমাবদ্ধতা ও অসিদ্ধতার বিষয়ে আমাদের নিজেদের চেয়েও আরও ভাল বোঝেন। তিনি কখনও আমরা যতখানি করতে পারব, সেটার চেয়ে বেশি আশা করেন না। বাইবেল সেইসব মানব প্রভুদের মধ্যে বৈসাদৃশ্য তুলে ধরে, যারা “সজ্জন ও শান্ত [“যুক্তিবাদী,” NW]” এবং যারা “কুটিল।” (১ পিতর ২:১৮) যিহোবা কোন ধরনের প্রভু? হিতোপদেশ ১৯:১৭ পদ কী বলে দেখুন: “যে দরিদ্রকে কৃপা করে, সে সদাপ্রভুকে ঋণ দেয়।” স্পষ্টতই, একমাত্র একজন সৎ ও যুক্তিবাদী প্রভুই দরিদ্রদের পক্ষে সমস্ত দয়ার কাজের দিকে নজর রাখবেন। এর চেয়ে বড় কথা, এই শাস্ত্রপদ ইঙ্গিত করে যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা আসলে যারা এইরকম করুণার কাজ করে সেই সামান্য মানুষদের কাছে নিজেকে ঋণী হিসেবে দেখেন! এটাই সবচেয়ে প্রগাঢ় নম্রতা।

২০. কোন নিশ্চয়তা রয়েছে যে, যিহোবা আমাদের প্রার্থনা শোনেন এবং সেগুলোর উত্তর দেন?

২০ আজকে, যিহোবা তাঁর দাসদের সঙ্গে আচরণের বেলায়ও একইরকম মৃদু ও যুক্তিবাদী। যখন আমরা বিশ্বাস সহকারে প্রার্থনা করি, তিনি শোনেন। আর এমনকি যদিও তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য দূত বার্তাবাহকদের পাঠান না, তবুও আমাদের এই উপসংহারে পৌঁছানো উচিত নয় যে, আমাদের প্রার্থনার উত্তর তিনি দেবেন না। মনে করে দেখুন যে, প্রেরিত পৌল যখন কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তার সহবিশ্বাসীদের ‘প্রার্থনা করিবার’ জন্য অনুরোধ করেছিলেন, তখন তিনি আরও বলেছিলেন: “আমি যেন শীঘ্রই তোমাদিগকে পুনর্দত্ত হই।” (ইব্রীয় ১৩:১৮, ১৯) তাই, আমাদের প্রার্থনা আসলে যিহোবাকে সেই কাজ করতে পরিচালিত করবে, যা প্রার্থনা না করলে তিনি হয়তো করতেন না!—যাকোব ৫:১৬.

২১. যিহোবার নম্রতার বিষয়ে আমাদের কখনও কোন উপসংহারে আসা উচিত নয় কিন্তু এর বদলে তাঁর সম্বন্ধে আমাদের কী উপলব্ধি করা উচিত?

২১ অবশ্যই, যিহোবার নম্রতার এই প্রকাশগুলোর একটাও অর্থাৎ তাঁর মৃদুতা, শুনতে ইচ্ছুক মনোভাব, তাঁর ধৈর্য, তাঁর যুক্তিবাদিতা কোনোটাই বোঝায় না যে, যিহোবা তাঁর ধার্মিক নীতিগুলোর বিষয়ে আপোশ করেন। খ্রিস্টীয়জগতের পাদরি শ্রেণী হয়তো মনে করতে পারে যে, তারা যখন যিহোবার নৈতিক মানগুলোকে হালকা করে তুলে ধরে তাদের পালের কানে সুড়সুড়ি দেয়, তখন তারা যুক্তিবাদী হচ্ছে। (২ তীমথিয় ৪:৩) কিন্তু, নিজেদের সুবিধার্থে আপোশ করার জন্য মানুষের প্রবণতার সঙ্গে ঐশিক যুক্তিবাদিতার কোনো সম্পর্ক নেই। যিহোবা পবিত্র; তিনি কখনও তাঁর ধার্মিক মানগুলোকে কলুষিত করবেন না। (লেবীয় পুস্তক ১১:৪৪) তাই, আসুন আমরা যিহোবার যুক্তিবাদিতাকে ভালবাসি কারণ এটা তাঁর নম্রতার এক প্রমাণ। আপনি কি ভেবে পুলকিত হন না যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তি, যিহোবা ঈশ্বর অত্যন্ত নম্রও? এই সশ্রদ্ধ ভয় উদ্রেককারী অথচ মৃদু, ধৈর্যবান, যুক্তিবাদী ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়া কতই না আনন্দের বিষয়!

^ অনু. 3 প্রাচীন অধ্যাপক বা সোফেরিমরা এই শাস্ত্রপদটাকে পরিবর্তন করেছিল, এটা বলার জন্য যে, যিহোবা নয় কিন্তু যিরমিয় নত হচ্ছেন। স্পষ্টতই তারা ভেবেছিল যে, ঈশ্বর এতটা অবনমিত হবেন, তা বলা উপযুক্ত নয়। ফলে, অনেক অনুবাদ থেকে এই চমৎকার পদের মূল বিষয়বস্তুটা বাদ হয়ে যায়। কিন্তু, দ্যা নিউ ইংলিশ বাইবেল সঠিকভাবে অনুবাদ করে যে, ঈশ্বরকে যিরমিয় বলছেন: “স্মরণ কর, স্মরণ কর এবং আমার প্রতি অবনত হও।”

^ অনু. 7 অন্যান্য সংস্করণগুলো বলে যে, “নম্রতা প্রজ্ঞা থেকে আসে” এবং “শান্তভাবই হল প্রজ্ঞার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।”

^ অনু. 12 আগ্রহের বিষয় হল যে, বাইবেল ধৈর্য এবং ঔদ্ধত্যকে সম্পূর্ণ বিপরীত বিষয় হিসেবে তুলে ধরে। (উপদেশক ৭:৮, NW) যিহোবার ধৈর্য তাঁর নম্রতার আরও প্রমাণ দেয়।—২ পিতর ৩:৯.

^ অনু. 18 গীতসংহিতা ৮৬:৫ পদে যিহোবাকে বলা হয়েছে “মঙ্গলময় ও ক্ষমাবান্‌ [“ক্ষমা করার জন্য তৈরি,” NW]।” সেই গীতকে যখন গ্রিক ভাষায় অনুবাদ করা হয়, তখন “ক্ষমা করার জন্য তৈরি” শব্দটিকে ইপিয়িকিস বা “যুক্তিবাদী” হিসেবে অনুবাদ করা হয়।”