সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

পরিশিষ্ট

মানুষের মধ্যে কি প্রকৃতপক্ষে কোনো অদৃশ্য বা অমর অংশ রয়েছে?

মানুষের মধ্যে কি প্রকৃতপক্ষে কোনো অদৃশ্য বা অমর অংশ রয়েছে?

অনেক ভাষায় এইরকম কিছু শব্দ রয়েছে, যেগুলো ধারণা দেয় যে, মানুষ ও পশুপাখি উভয়ের মধ্যেই এক অদৃশ্য অংশ রয়েছে, যা দেহের মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে এবং অমর। তাই, লোকেরা সাধারণত এক অমর আত্মা সম্বন্ধে বলে থাকে আর এটাকে এই ধারণার সঙ্গে যুক্ত করে যে, মানুষের মধ্যে কিছু অংশ অন্য আরেকটা দেহে পুনর্জন্ম লাভ করার জন্য বেঁচে থাকে।

বাইবেলকে যখন বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল তখন অনুবাদকরা সেই শব্দগুলোকে ব্যবহার করেছিলেন, যা এই ভুল ধারণাকে প্রকাশ করে। এই কারণে কেউ কেউ মনে করে, বাইবেলও শিক্ষা দেয় যে দেহের মৃত্যুর পর কোনো কিছু বেঁচে থাকে। লক্ষ করা গিয়েছে যে, প্রাণ, প্রাণী ও জীবের মতো শব্দগুলোও এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। বাইবেলের মূল ভাষাগুলোতে ব্যবহৃত শব্দগুলোর প্রতি মনোযোগপূর্ণ দৃষ্টি আমাদেরকে বাইবেল যা শিক্ষা দেয়, তা স্পষ্টভাবে দেখতে সাহায্য করে।

নেফিশ এবং সিখি শব্দগুলো বাইবেলে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে

আপনার হয়তো মনে আছে যে, বাইবেল প্রথমে মূলত ইব্রীয় এবং গ্রিক ভাষায় লেখা হয়েছিল। বাংলা বাইবেলে যে-জায়গাগুলোতে অনুবাদকরা প্রাণ বা প্রাণী ব্যবহার করেছেন, সেই জায়গাগুলোতে মূল ভাষায় বাইবেল লেখকরা ইব্রীয় শব্দ নেফিশ বা গ্রিক শব্দ সিখি ব্যবহার করেছেন। এই দুটো শব্দ শাস্ত্রে ৮০০ বারের বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু, বাংলা শব্দ প্রাণ এবং প্রাণী হয়তো এই ইব্রীয় ও গ্রিক শব্দগুলোর সর্বোত্তম অনুবাদ নয়। বাইবেলে নেফিশ বা সিখি শব্দগুলো যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা যখন আপনি পরীক্ষা করে দেখবেন, তখন এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, এই শব্দগুলো মূলত (১) লোকেদের, (২) জীবজন্তুর অথবা (৩) একজন ব্যক্তি বা কোনো জীবজন্তুর যে-জীবন রয়েছে, সেটাকে নির্দেশ করে। আসুন আমরা কয়েকটা শাস্ত্রপদ বিবেচনা করি, যা এই তিনটে ভিন্ন অর্থকে তুলে ধরে।

লোকেদের। “নোহের সময়ে, . . . অল্প লোক, অর্থাৎ আটটী প্রাণ [সিখি], জল দ্বারা রক্ষা পাইয়াছিল।” (১ পিতর ৩:২০) এখানে সিখি শব্দটা স্পষ্টভাবে লোকেদের—নোহ, তার স্ত্রী, তার তিন পুত্র এবং তাদের স্ত্রীদেরকে—বোঝায়। আরেকটা উদাহরণ আদিপুস্তক ৪৬:১৮ পদে উল্লেখ করা আছে। এখানে যাকোবের ছেলেদের কথা বলা হয়েছে। এটা বলে: “ইহারা সেই সিল্পার সন্তান, যাহাকে লাবন আপন কন্যা লেয়াকে দিয়াছিলেন; সে যাকোবের জন্য ইহাদিগকে প্রসব করিয়াছিল। ইহারা ষোল প্রাণী [নেফিশ]।” “নেফিশ” বা “সিখি” [বাংলা বাইবেলে প্রাণ বা প্রাণী হিসেবে অনুবাদিত হয়েছে] শব্দগুলো যে একজন ব্যক্তি বা লোকেদের প্রতি প্রয়োগ করা হয়েছে, সেই সম্বন্ধে বাইবেলের আরও অন্যান্য উদাহরণ যিহোশূয়ের পুস্তক ১১:১১; বিলাপ ৩:২৫; এবং রোমীয় ১৩:১ পদে পাওয়া যায়।

জীবজন্তু। বাইবেলের সৃষ্টির বিবরণে আমরা পড়ি: “ঈশ্বর কহিলেন, জল নানাজাতীয় জঙ্গম প্রাণিবর্গে [নেফিশবর্গে] প্রাণিময় হউক, এবং ভূমির ঊর্দ্ধে আকাশমণ্ডলের বিতানে পক্ষিগণ উড়ুক। পরে ঈশ্বর কহিলেন, ভূমি নানাজাতীয় প্রাণিবর্গ [নেফিশবর্গে], অর্থাৎ স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী গ্রাম্য পশু, সরীসৃপ ও বন্য পশু উৎপন্ন করুক; তাহাতে সেইরূপ হইল।” (আদিপুস্তক ১:২০, ২৪) এই বাক্যাংশে মাছ, গৃহপালিত জীবজন্তু এবং বন্যপশু সকলকে একই শব্দ—প্রাণী [নেফিশ]—দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। পাখি এবং অন্যান্য জীবজন্তুকে আদিপুস্তক ৯:১০; লেবীয় পুস্তক ১১:৪৬ পদে নেফিশ [বাংলা বাইবেলে প্রাণী হিসেবে অনুবাদিত] বলা হয়েছে।

ব্যক্তির জীবন। মাঝে মাঝে নেফিশ এবং সিখি শব্দগুলো দিয়ে ব্যক্তির জীবনকে বোঝায়। যিহোবা মোশিকে বলেছিলেন: “যে লোকেরা তোমার প্রাণনাশের [নেফিশনাশের] চেষ্টায় ছিল, তাহারা সকলে মরিয়া গিয়াছে।” (যাত্রাপুস্তক ৪:১৯) মোশির শত্রুরা কী নাশ করার চেষ্টা করছিল? তারা মোশির জীবন নেওয়ার চেষ্টা করছিল। এরও আগে, রাহেল তার ছেলে বিন্যামীনকে জন্ম দেওয়ার সময় “তাঁহার মৃত্যু হইল, আর প্রাণবিয়োগ [নেফিশবিয়োগ]” হয়েছিল। (আদিপুস্তক ৩৫:১৬-১৯) সেই সময়ে রাহেল তার জীবন হারিয়েছিলেন। এ ছাড়া, যিশুর কথাগুলোও বিবেচনা করুন: “আমিই উত্তম মেষপালক; উত্তম মেষপালক মেষদের জন্য আপন প্রাণ [সিখি] সমর্পণ করে।” (যোহন ১০:১১) যিশু মানবজাতির জন্য তাঁর সিখি বা জীবন (বাংলা বাইবেলে প্রাণ হিসেবে অনুবাদিত) দান করেছিলেন। বাইবেলের এই বাক্যাংশগুলোতে নেফিশ এবং সিখি শব্দগুলো স্পষ্টভাবে ব্যক্তির জীবনকে নির্দেশ করে। আপনি নেফিশ এবং সিখি শব্দগুলোর এই অর্থের আরও উদাহরণ ১ রাজাবলি ১৭:১৭-২৩; মথি ১০:৩৯; যোহন ১৫:১৩; এবং প্রেরিত ২০:১০ পদে পাবেন।

ঈশ্বরের বাক্যের আরও অধ্যয়ন আপনাকে দেখাবে যে, সমগ্র বাইবেলে কোথাও “অমর” বা “অনন্ত” শব্দটা নেফিশ বা সিখি শব্দগুলোর সঙ্গে যুক্ত নয়। এর পরিবর্তে শাস্ত্র বলে যে, একজন নেফিশ বা সিখি মরণশীল অর্থাৎ মারা যায়। (যিহিষ্কেল ১৮:৪, ২০) অতএব, বাইবেল অনুসারে কোনো ব্যক্তি যখন মারা যান, তখন তার কিছুই বেঁচে থাকে না।—উপদেশক ৯:৫, ১০.

রুয়াখ্‌ ও প্নেভ্‌মা শব্দগুলো বাইবেলে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে

আসুন আমরা বাইবেলের রুয়াখ্‌ প্নেভ্‌মা শব্দগুলোর ব্যবহার বিবেচনা করি। বাইবেল স্পষ্ট করে যে, এই শব্দগুলো নেফিশ সিখি থেকে আলাদা কোনো কিছুকে নির্দেশ করে। সেগুলো কীভাবে আলাদা?

বাইবেল লেখকরা ইব্রীয় শব্দ রুয়াখ্‌ বা গ্রিক শব্দ প্নেভ্‌মা ব্যবহার করেছেন এবং এই শব্দগুলো বাংলা বাইবেলের কিছু জায়গায় “আত্মা” বা “নিঃশ্বাস” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে। কিন্তু, এগুলো হয়তো সেই শব্দগুলোর সর্বোত্তম অনুবাদ নয়। শাস্ত্র স্বয়ং সেই শব্দগুলোর অর্থ ইঙ্গিত করে। উদাহরণ স্বরূপ, গীতসংহিতা ১০৪:২৯ পদ বলে: “তুমি [সদাপ্রভু] তাহাদের নিঃশ্বাস [রুয়াখ্‌] হরণ করিলে তাহারা মরিয়া যায়, তাহাদের ধূলিতে প্রতিগমন করে।” আর যাকোব ২:২৬ পদ উল্লেখ করে যে, “আত্মাবিহীন [প্নেভ্‌মাবিহীন] দেহ মৃত।” তাহলে, এই পদগুলোতে রুয়াখ্‌ বা প্নেভ্‌মা [বাংলা বাইবেলে এই পদগুলোতে নিঃশ্বাস এবং আত্মা হিসেবে অনুবাদিত হয়েছে] সেই বিষয়কে নির্দেশ করে, যা একটা দেহকে জীবনদান করে। রুয়াখ্‌ বা প্নেভ্‌মা ছাড়া, দেহ মৃত। তাই, বাইবেলে রুয়াখ্‌ শব্দটাকে কেবলমাত্র আত্মা হিসেবে নয়, কিন্তু সেইসঙ্গে “প্রাণবায়ু” বা জীবনীশক্তি হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, নোহের দিনে জলপ্লাবন সম্বন্ধে আদিপুস্তক ৬:১৭ পদ বলে: “আকাশের নীচে প্রাণবায়ুবিশিষ্ট [রুয়াখ্‌বিশিষ্ট] যত জীবজন্তু আছে, সকলকে বিনষ্ট করণার্থে আমি পৃথিবীর উপরে জলপ্লাবন আনিব।” (আদিপুস্তক ৭:১৫, ২২) অতএব, রুয়াখ্‌ বলতে এক অদৃশ্য শক্তিকে (জীবনের স্ফুলিঙ্গকে) বোঝায়, যা সমস্ত জীবিত প্রাণীকে সজীব রাখে।

দেহের জন্য রুয়াখ্‌ বা প্নেভ্‌মার প্রয়োজন রয়েছে, অনেকটা যেমন একটা রেডিও চালু করার জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজন রয়েছে। এটা উদাহরণের সাহায্যে আরেকটু বোঝার জন্য সহজে বহনযোগ্য একটা রেডিওর কথা চিন্তা করুন। আপনি যখন এমন একটা রেডিওতে ব্যাটারি লাগিয়ে তা চালান, তখন ব্যাটারিতে সঞ্চিত বিদ্যুৎ, বলতে গেলে রেডিওকে জীবন্ত করে তোলে। কিন্তু, ব্যাটারি ছাড়া রেডিওটা মৃত। অন্য ধরনের রেডিওর বেলায়ও একই বিষয় ঘটে থাকে, যখন এটাকে একটা বৈদ্যুতিক সকেট থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। অনুরূপভাবে, রুয়াখ্‌ বা প্নেভ্‌মা হল সেই শক্তি, যা আমাদের দেহকে জীবন্ত করে তোলে। এ ছাড়া, বিদ্যুতের মতো রুয়াখেরও কোনো অনুভূতি নেই এবং এটা চিন্তা করতে পারে না। এটা এক নৈর্ব্যক্তিক শক্তি। কিন্তু, এই রুয়াখ্‌ বা প্নেভ্‌মা—জীবনীশক্তি—ছাড়া, আমাদের দেহ “মরিয়া যায়, তাহাদের ধূলিতে প্রতিগমন করে,” যেমন গীতরচক বলেছিলেন।

মানুষের মৃত্যু সম্বন্ধে বলতে গিয়ে উপদেশক ১২:৭ পদ বলে: “[তাহার দেহের] ধূলি পূর্ব্ববৎ মৃত্তিকাতে প্রতিগমন করিবে; এবং রুয়াখ্‌ [বাংলা বাইবেলে আত্মা হিসেবে অনুবাদিত] যাঁহার দান, সেই ঈশ্বরের কাছে প্রতিগমন করিবে।” যখন রুয়াখ্‌ বা প্নেভ্‌মা—জীবনীশক্তি—দেহ ত্যাগ করে, তখন দেহের মৃত্যু হয় এবং সেই দেহ যেখান থেকে এসেছে সেখানে—সেই মাটিতে—ফিরে যায়। অনুরূপভাবে, জীবনীশক্তিও সেখানে ফিরে যায়, যেখান থেকে এটা এসেছে—সেই ঈশ্বরের কাছে। (ইয়োব ৩৪:১৪, ১৫; গীতসংহিতা ৩৬:৯) তার মানে এই নয় যে, জীবনীশক্তি সত্যি সত্যি স্বর্গে চলে যায়। বরং, এটা বোঝায় যে, মারা গিয়েছে এমন কোনো ব্যক্তির ভবিষ্যৎ জীবনের যেকোনো আশা তখন যিহোবা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে। বলতে গেলে, তার জীবন ঈশ্বরের হাতে রয়েছে। একমাত্র ঈশ্বরের শক্তিতেই রুয়াখ্‌ বা প্নেভ্‌মা—জীবনীশক্তি—ফিরিয়ে দেওয়া যেতে পারে, যাতে সেই ব্যক্তি আবার বেঁচে থাকতে পারে।

এটা জানা কতই-না সান্ত্বনাদায়ক যে, ঈশ্বর সেইসমস্ত ব্যক্তির জন্য ঠিক এই বিষয়টাই করবেন, যারা ‘কবরে’ বিশ্রাম নিচ্ছে! (যোহন ৫:২৮, ২৯) পুনরুত্থানের সময়, যিহোবা সেই ব্যক্তিদের জন্য এক নতুন দেহ গঠন করবেন, যারা মৃত্যুতে ঘুমিয়ে আছে আর সেই দেহের মধ্যে রুয়াখ্‌ বা প্নেভ্‌মা—জীবনীশক্তি—দান করার মাধ্যমে সেটাকে জীবনে ফিরিয়ে আনবেন। সেটা কী এক আনন্দদায়ক দিনই না হবে!

নেফিশ, সিখি, রুয়াখ্‌ এবং প্নেভ্‌মা শব্দগুলো বাইবেলে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, সেই সম্বন্ধে আপনি যদি আরও বেশি জানতে চান, তা হলে আমরা মারা গেলে আমাদের কী হয়? (ইংরেজি) ব্রোশারে ও শাস্ত্র থেকে যুক্তি করা (ইংরেজি) বইয়ের ৩৭৫-৩৮৪ পৃষ্ঠায় মূল্যবান তথ্য খুঁজে পাবেন, দুটোই যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত।