সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অধ্যায় ১২

“অন্যকে গড়ে তুলবার জন্য যা ভাল তেমন কথাই” বলুন

“অন্যকে গড়ে তুলবার জন্য যা ভাল তেমন কথাই” বলুন

“তোমাদের মুখ থেকে কোন বাজে কথা বের না হোক, বরং . . . অন্যকে গড়ে তুলবার জন্য যা ভাল তেমন কথাই বের হোক।”—ইফিষীয় ৪:২৯, বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারশন।

১-৩. (ক) যিহোবা আমাদের দিয়েছেন এমন একটা দান কী আর কীভাবে এর অপব্যবহার করা হতে পারে? (খ) ঈশ্বরের প্রেমে অবস্থিতি করতে হলে, কীভাবে আমাদের কথা বলার দানকে ব্যবহার করতে হবে?

আপনি যদি কোনো প্রিয়জনকে একটা উপহার দেন আর তিনি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে সেটার অপব্যবহার করেন, তাহলে আপনার কেমন লাগবে? ধরুন, আপনি তাকে একটা গাড়ি দিয়েছেন আর পরে আপনি জানতে পারলেন যে, তিনি সেটা বেপরোয়াভাবে চালিয়েছেন আর এভাবে অন্যদেরকে আহত করেছেন। আপনি কি দুঃখিত হবেন না?

‘সমস্ত উত্তম দান এবং সমস্ত সিদ্ধ বরের’ দাতা যিহোবার কাছ থেকে পাওয়া একটা উপহার বা দান হল, আমাদের বোধগম্যভাবে কথা বলার ক্ষমতা। (যাকোব ১:১৭) এই দান, যা মানবপরিবারকে পশুপাখি থেকে পৃথক করে, তা আমাদেরকে কেবল আমাদের চিন্তাভাবনাই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে অন্যদের প্রতি আমাদের অনুভূতিও প্রকাশ করতে সমর্থ করে। কিন্তু, একটা মোটরগাড়ির মতো আমাদের কথা বলার দানকেও অপব্যবহার করা হতে পারে। আমাদের কথাবার্তাকে যখন বেপরোয়াভাবে ব্যবহার করা হয় আর তা অন্যদের মনোদুঃখ ও কষ্টের কারণ হয়, তখন সেটা ঈশ্বরকে কত দুঃখিতই না করে!

ঈশ্বরের প্রেমে অবস্থিতি করতে চাইলে, আমাদের কথা বলার দানকে এর দাতার ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে। কোন ধরনের কথাবার্তা যিহোবাকে খুশি করে, সেই বিষয়ে তিনি সন্দেহের কোনো অবকাশ রাখেননি। তাঁর বাক্য বলে: “তোমাদের মুখ থেকে কোন বাজে কথা বের না হোক, বরং দরকার মত অন্যকে গড়ে তুলবার জন্য যা ভাল তেমন কথাই বের হোক, যেন যারা তা শোনে তাতে তাদের উপকার হয়।” (ইফিষীয় ৪:২৯) আসুন আমরা আলোচনা করি যে, কেন আমাদের কথাবার্তার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, কোন ধরনের কথাবার্তা আমাদের এড়িয়ে চলতে হবে আর কীভাবে আমরা এমন কথাবার্তা বলতে পারি, যা ‘অন্যকে গড়ে তুলবার জন্য ভাল।’

যে-কারণে আমাদের কথাবার্তার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে

৪, ৫. বাইবেলের কিছু প্রবাদ কথাবার্তার ক্ষমতা সম্বন্ধে কীভাবে বর্ণনা করে?

আমাদের কথাবার্তার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, কথাবার্তার ক্ষমতা রয়েছে। হিতোপদেশ ১৫:৪ পদ বলে: “স্বাস্থ্যজনক জিহ্বা জীবনবৃক্ষ; কিন্তু তাহা বিগড়াইয়া গেলে আত্মা ভগ্ন হয়।” উপশমকারী জিহ্বার স্বাস্থ্যজনক বা প্রশান্ত কথাবার্তা সেই ব্যক্তিদের আত্মা বা মনোভাবকে সতেজ করতে পারে, যারা তা শোনে। অন্যদিকে, অসংযত জিহ্বার বিকৃত কথাবার্তা অন্যদের মনোভাবকে ভেঙে দিতে পারে। বাস্তবিকই, আমরা যে-কথাবার্তা বলে থাকি, সেগুলোর ক্ষমতা রয়েছে—অন্যদেরকে আঘাত দেওয়ার নতুবা আরোগ্য করার।—হিতোপদেশ ১৮:২১.

কথাবার্তার ক্ষমতা সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে গিয়ে আরেকটা প্রবাদ বলে: “কেহ কেহ অবিবেচনার কথা বলে, খড়্গাঘাতের মত।” (হিতোপদেশ ১২:১৮) হুট করে বলে ফেলা অবিবেচনাপূর্ণ কথাবার্তা গভীর আবেগগত ক্ষতের সৃষ্টি করতে এবং সম্পর্ক নষ্ট করে দিতে পারে। আপনার হৃদয় কি কখনো কথার খড়্গ দ্বারা বিদ্ধ হয়েছে? অন্যদিকে, সেই একই প্রবাদ ইতিবাচকভাবে বলে: “জ্ঞানবানদের জিহ্বা স্বাস্থ্যস্বরূপ।” যে-ব্যক্তি ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞা প্রকাশ করেন, তার বলা বিবেচনাপূর্ণ কথাবার্তা এক দুঃখার্ত হৃদয়কে আরোগ্য করতে পারে এবং সম্পর্ককে পুনরায় ঠিক করতে পারে। আপনি কি এমন কোনো মুহূর্তের কথা স্মরণ করতে পারেন, যখন আপনি সদয় কথাবার্তার স্বাস্থ্যকর বা আরোগ্যকর ক্ষমতা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন? (পড়ুন, হিতোপদেশ ১৬:২৪.) আমাদের বলা কথাবার্তার যে ক্ষমতা রয়েছে, তা স্বীকার করে আমরা নিশ্চিতভাবেই আমাদের কথাবার্তাকে অন্যদের আঘাত দেওয়ার জন্য নয় বরং তাদেরকে আরোগ্য করার জন্য ব্যবহার করতে চাইব।

প্রশান্ত কথাবার্তা সতেজতাদায়ক

৬. আমাদের জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করা কেন সত্যিই এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা?

আমরা যত কঠোর প্রচেষ্টাই করি না কেন, আমরা সম্পূর্ণরূপে আমাদের জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তাই, কেন আমাদের কথাবার্তার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, তার দ্বিতীয় কারণটা হল: পাপ ও অসিদ্ধতা আমাদের জিহ্বার অপব্যবহার করতে প্ররোচিত করে। কথাবার্তা আমাদের হৃদয় থেকেই উদ্ভূত হয় আর “মনুষ্যের মনস্কল্পনা দুষ্ট।” (আদিপুস্তক ৮:২১; লূক ৬:৪৫) আর এই কারণেই আমাদের জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সত্যিই এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। (পড়ুন, যাকোব ৩:২-৪.) যদিও আমরা নিখুঁতভাবে আমাদের জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, তবে যেভাবে আমরা তা ব্যবহার করে থাকি, তাতে উন্নতি করার জন্য কাজ করে যেতে পারি। ঠিক যেমন স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কাটতে থাকা একজন সাঁতারুকে স্রোতের বিপরীতে লড়াই করে যেতে হয়, তেমনই আমাদের জিহ্বার অপব্যবহার করার পাপপূর্ণ প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হবে।

৭, ৮. আমাদের কথাবার্তার জন্য কত দূর পর্যন্ত যিহোবার কাছে নিকাশ দিতে হবে?

আমাদের কথাবার্তার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার তৃতীয় কারণটা হল, আমাদের কথাবার্তার জন্য আমাদেরকে যিহোবার কাছে নিকাশ দিতে হবে। আমরা যেভাবে আমাদের জিহ্বাকে ব্যবহার করি, তা কেবল সহমানবদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককেই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে যিহোবার সামনে আমাদের অবস্থানকেও প্রভাবিত করে। যাকোব ১:২৬ পদ বলে, “যে ব্যক্তি আপনাকে ধর্ম্মশীল বলিয়া মনে করে, আর আপন জিহ্বাকে বল্‌গা দ্বারা বশে না রাখে, কিন্তু নিজ হৃদয়কে ভুলায়, তাহার ধর্ম্ম অলীক।” * আগের অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখেছি যে, আমাদের কথাবার্তা আমাদের ধর্ম বা উপাসনা থেকে আলাদা নয়। আমাদের জিহ্বাকে যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা না হয়—প্রায়ই যদি আঘাতজনক ও বিষাক্ত কথাবার্তা বের হয়—তাহলে আমাদের সমস্ত খ্রিস্টীয় কাজ ঈশ্বরের চোখে মূল্যহীন হয়ে পড়তে পারে। এটা কি এক গুরুতর চিন্তার বিষয় নয়?—যাকোব ৩:৮-১০.

এটা স্পষ্ট যে, আমাদের কথা বলার দানকে অপব্যবহার করার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার জোরালো কারণ আমাদের রয়েছে। অন্যকে গড়ে তোলে এমন গঠনমূলক কথাবার্তার ধরন সম্বন্ধে বিবেচনা করার আগে আসুন আমরা সেই কথাবার্তা নিয়ে আলোচনা করি, যেগুলোর স্থান নিশ্চিতভাবেই একজন সত্য খ্রিস্টানের জীবনে থাকতে পারে না।

যে-কথাবার্তা ভেঙে ফেলে

৯, ১০. (ক) আজকের জগতে কোন ধরনের ভাষা রোজকার কথাবার্তার অংশ হয়ে উঠেছে? (খ) কেন আমাদের নোংরা ভাষা প্রত্যাখ্যান করতে হবে? (এ ছাড়া, পাদটীকা দেখুন।)

নোংরা ভাষা। তীব্র গালিগালাজ, কটুক্তি এবং অন্যান্য ধরনের নোংরা ভাষা আজকের জগতের রোজকার কথাবার্তার অংশ। অনেকে রেগে গেলে খারাপ শব্দ ব্যবহার করে থাকে এবং লোকেদেরকে হাসানোর জন্য কুরুচিপূর্ণ ও যৌন উদ্দীপনামূলক কথাবার্তা ব্যবহার করে। কিন্তু, নোংরা ভাষা কোনো হাসি-তামাশার বিষয় নয়। প্রায় ২,০০০ বছর আগে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রেরিত পৌল কলসীয় মণ্ডলীকে নোংরা বা “কুৎসিত আলাপ” পরিত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। (কলসীয় ৩:৮) ইফিষীয় মণ্ডলীকে পৌল বলেছিলেন যে, “শ্লেষোক্তি [“নোংরা ঠাট্টা-তামাশার কথাবার্তা,” বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারশন]” সেই বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত, যেগুলোর “নামও যেন” সত্য খ্রিস্টানদের “মধ্যে না হয়।”—ইফিষীয় ৫:৩, ৪.

১০ নোংরা কথাবার্তা যিহোবার কাছে ঘৃণ্য। এটা সেই ব্যক্তিদের কাছেও ঘৃণ্য, যারা তাঁকে ভালোবাসে। বস্তুতপক্ষে, যিহোবার প্রতি আমাদের ভালোবাসা আমাদেরকে নোংরা ভাষা প্রত্যাখ্যান করতে পরিচালিত করে। ‘মাংসের কার্য্য সকলের’ তালিকা করার সময় পৌল ‘অশুচিতার’ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন, যার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে অশুদ্ধ কথাবার্তা। (গালাতীয় ৫:১৯-২১) এটা এক গুরুতর বিষয়। বার বার পরামর্শ দেওয়া সত্ত্বেও একজন ব্যক্তি যদি অনুতাপহীনভাবে চরম অনৈতিক, অসম্মানজনক ও কলুষিত ভাষা ব্যবহার করেই চলেন, তাহলে তাকে মণ্ডলী থেকে সমাজচ্যুত করা হতে পারে। *

১১, ১২. (ক) কখন অন্য লোকেদের সম্বন্ধে কথা বলা ক্ষতিকর হয়? (খ) কেন যিহোবার উপাসকদের অপবাদমূলক কথাবার্তা এড়িয়ে চলতে হবে?

১১ লোকেরা সাধারণত অন্য লোকেদের সম্বন্ধে ও তাদের জীবনযাপন নিয়ে কথা বলে থাকে। লোকেদের সম্বন্ধে কথাবার্তা বলা কি সবসময়ই ক্ষতিকর? না, যদি আমরা এমন অক্ষতিকর কথাবার্তা বলি, যার মাধ্যমে আমরা হয়তো ইতিবাচক বা উপকারী সংবাদ দিয়ে থাকি, যেমন কে সবেমাত্র বাপ্তাইজিত হয়েছে অথবা কার উৎসাহমূলক বাক্যের প্রয়োজন। প্রথম শতাব্দীর খ্রিস্টানদের পরস্পরের মঙ্গলের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল এবং তারা সহবিশ্বাসীদের সম্বন্ধে উপযুক্ত তথ্য বলত। (ইফিষীয় ৬:২১, ২২; কলসীয় ৪:৮, ৯) কিন্তু, অন্যদের সম্বন্ধে কথা বলা তখনই ক্ষতিকর হতে পারে, যদি তা সত্য বিষয়কে বিকৃত করে অথবা গোপন বিষয়গুলোকে প্রকাশ করে দেয়। আরও গুরুতর বিষয় হল যে, এটা অপবাদের দিকে পরিচালিত করতে পারে, যা সবসময়ই ক্ষতিকর। অপবাদ হল, “মিথ্যা অভিযোগ . . . যা আরেকজন ব্যক্তির মানহানি করে এবং সুনামকে নষ্ট করে দেয়।” উদাহরণ স্বরূপ, ফরীশীরা যিশুর মর্যাদাহানি করার প্রচেষ্টায় বিদ্বেষপূর্ণ অপবাদের আশ্রয় নিয়েছিল। (মথি ৯:৩২-৩৪; ১২:২২-২৪) “কর্ণেজপ [“অপবাদ,” ইজি-টু-রিড ভারশন]” প্রায়ই বিবাদ বা ঝগড়ার সৃষ্টি করে।—হিতোপদেশ ২৬:২০.

১২ যিহোবা সেই ব্যক্তিদের হালকাভাবে দেখেন না, যারা কথা বলার দানকে অন্যদের মানহানি করার অথবা বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য ব্যবহার করে। তিনি সেই ব্যক্তিদের ঘৃণা করেন, যারা “ভ্রাতৃগণের মধ্যে বিবাদ খুলিয়া দেয়।” (হিতোপদেশ ৬:১৬-১৯) যে-গ্রিক শব্দটাকে “অপবাদক” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে, তা হল ডাইয়াবোলস্‌, যেটাকে শয়তানের একটা আখ্যা হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে। সে হল “দিয়াবল,” ঈশ্বরের বিরুদ্ধে মন্দ অপবাদক। (প্রকাশিত বাক্য ১২:৯, ১০) নিশ্চিতভাবেই আমরা এমন কথাবার্তা এড়িয়ে চলতে চাই, যা মূলত আমাদেরকে দিয়াবলে পরিণত করতে পারে। মণ্ডলীতে অপবাদমূলক কথাবার্তার কোনো স্থান নেই, যা “বিবাদ” ও “বিচ্ছিন্নতার” মতো মাংসের কার্যসকলকে জাগিয়ে তোলে। (গালাতীয় ৫:১৯-২১) তাই, কারো সম্বন্ধে কোনো সংবাদ পুনরাবৃত্তি করার সময়, নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: ‘এটা কি সত্য? এটা পুনরাবৃত্তি করা কি সদয় কাজ হবে? এই তথ্য ছড়ানো কি আবশ্যক অথবা উপযুক্ত?’—পড়ুন, ১ পিতর ৪:১৫.

১৩, ১৪. (ক) যাদেরকে নিন্দা করা হয়, তাদের উপর নিন্দার কোন প্রভাব পড়তে পারে? (খ) যে-ব্যক্তি অন্যদের অপমান করার অভ্যাস গড়ে তোলেন, তিনি কেন নিজেকে এক বিপদজনক পরিস্থিতিতে ফেলেন?

১৩ নিন্দা। আগে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, কথাবার্তার আঘাত দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। এটা ঠিক যে, মানব অসিদ্ধতার কারণে মাঝে মাঝে আমরা সকলেই এমন কথা বলে ফেলি, যেটার জন্য দুঃখিত হই। কিন্তু, বাইবেল আমাদেরকে এমন ধরনের কথাবার্তা সম্বন্ধে সাবধান করে দেয়, যে-ধরনের কথাবার্তার একটা খ্রিস্টীয় পরিবার অথবা মণ্ডলীতে কোনো স্থানই নেই। পৌল খ্রিস্টানদের উপদেশ দিয়েছিলেন: “সর্ব্বপ্রকার কটুকাটব্য, রোষ, ক্রোধ, কলহ, নিন্দা এবং সর্ব্বপ্রকার হিংসেচ্ছা তোমাদের হইতে দূরীকৃত হউক।” (ইফিষীয় ৪:৩১) অন্যান্য অনুবাদ ‘নিন্দাকে’ “খারাপ কথাবার্তা,” “ক্ষতিকর ভাষা,” এবং “অপমানজনক ভাষা” হিসেবে অনুবাদ করেছে। নিন্দা—ও সেইসঙ্গে গালিগালাজ এবং রূঢ় ও অবিরাম সমালোচনা—অন্যদের মর্যাদাহানি করতে ও তাদেরকে অযোগ্য মনে করার দিকে পরিচালিত করতে পারে। সন্তানদের কোমল ও নির্ভরশীল হৃদয় বিশেষভাবে নিন্দার মনোবলচূর্ণকারী প্রভাবের প্রতি নাজুক হয়ে থাকে।—কলসীয় ৩:২১.

১৪ অন্যদের অপমান করার অভ্যাসকে বাইবেল যথাসম্ভব জোরালো ভাষায় নিন্দা করে থাকে। যে-ব্যক্তি এই ধরনের অপমানজনক কথাবার্তা বলেই চলেন, তিনি নিজেকে এক বিপদজনক পরিস্থিতিতে ফেলেন, কারণ একজন কটুভাষী ব্যক্তিকে পরিবর্তন হওয়ার জন্য বার বার সাহায্য করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি যদি সেটাতে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে তাকে মণ্ডলী থেকে বের করে দেওয়া হতে পারে। তিনি যদি তার পথ পরিবর্তন না করেন, তাহলে তিনি রাজ্যের আশীর্বাদগুলো থেকেও বঞ্চিত হতে পারেন। (১ করিন্থীয় ৫:১১-১৩; ৬:৯, ১০) তাহলে, স্পষ্টতই আমরা যদি ক্ষতিকর, অসত্য অথবা নির্দয় কথাবার্তা বলার অভ্যাস গড়ে তুলি, তাহলে কোনোভাবেই আমরা ঈশ্বরের প্রেমে অবস্থিতি করতে পারব না। এই ধরনের কথাবার্তা ভেঙে ফেলে।

যে-কথাবার্তা ‘অন্যকে গড়ে তুলবার জন্য ভাল’

১৫. কোন ধরনের কথাবার্তা ‘অন্যকে গড়ে তুলবার জন্য ভাল’?

১৫ কীভাবে আমরা কথা বলার দানকে দাতার উদ্দেশ্য অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারি? মনে করে দেখুন যে, ঈশ্বরের বাক্য আমাদেরকে ‘অন্যদের গড়ে তুলবার জন্য ভাল কথা’ বলতে জোরালো পরামর্শ দিয়েছে। (ইফিষীয় ৪:২৯) আমরা যখন এমন কথাবার্তা বলি, যা অন্যদের গড়ে তোলে, উৎসাহিত করে ও শক্তিশালী করে, তখন যিহোবা খুশি হন। এই ধরনের কথাবার্তা বলার জন্য সতর্কতার সঙ্গে চিন্তা করা প্রয়োজন। বাইবেল এক্ষেত্রে অনুসরণ করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম প্রদান করে না; অথবা বাইবেলের মধ্যে অনুমোদিত গঠনমূলক বা ‘নিরাময় বাক্যের’ কোনো তালিকাও নেই। (তীত ২:৮) ‘অন্যকে গড়ে তুলবার জন্য ভাল’ কথাবার্তা বলতে হলে আমাদেরকে তিনটে সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে, যেগুলো গড়ে তোলে এমন কথাবার্তার বৈশিষ্ট্য আর তা হল: কথাবার্তা হতে হবে গঠনমূলক, সত্য এবং সদয়। এই বিষয়গুলো মনে রেখে আসুন আমরা এমন কথাবার্তার কয়েকটা নির্দিষ্ট উদাহরণ বিবেচনা করি, যেগুলো গড়ে তোলে।—“ আমার কথাবার্তা কি গড়ে তোলার মতো?” শিরোনামের বাক্সটা দেখুন।

১৬, ১৭. (ক) কেন অন্যদেরকে আমাদের প্রশংসা করা উচিত? (খ) মণ্ডলীতে ও পরিবারে অন্যদেরকে প্রশংসা করার কোন কোন সুযোগ আমাদের রয়েছে?

১৬ আন্তরিক প্রশংসা। যিহোবা ও যিশু উভয়েই প্রশংসা ও অনুমোদন বাক্য বলার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে উপলব্ধি করেন। (মথি ৩:১৭; ২৫:১৯-২৩; যোহন ১:৪৭) খ্রিস্টান হিসেবে আমাদেরও অন্যদের অকপট প্রশংসা করা উচিত। কেন? “যথাকালে কথিত বাক্য কেমন উত্তম,” হিতোপদেশ ১৫:২৩ পদ বলে। নিজেকে কেবল জিজ্ঞেস করুন: ‘আমি যখন আন্তরিক প্রশংসা পেয়ে থাকি, তখন আমার কেমন লাগে? এতে কি আমি পরিতৃপ্ত ও উৎসাহিত হই না?’ বস্তুতপক্ষে, আন্তরিক প্রশংসাবাক্য আপনাকে এটা বুঝতে সাহায্য করে যে, কেউ আপনাকে লক্ষ করছেন, কেউ আপনার জন্য চিন্তা করছেন এবং আপনি যে-প্রচেষ্টাগুলো করেন, সেগুলো খুবই উপযুক্ত। এই ধরনের আশ্বাস আপনার আস্থাকে বৃদ্ধি করে এবং ভবিষ্যতে আপনাকে আরও অধ্যবসায়ের সঙ্গে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে। আপনি নিজে যেহেতু প্রশংসা পেয়ে কৃতজ্ঞ হন, তাই প্রতিদানে আপনারও কি অন্যদের প্রশংসা প্রদান করার জন্য যথাসাধ্য করা উচিত নয়?—পড়ুন, মথি ৭:১২.

১৭ অন্যদের মধ্যে ভালো কিছু খুঁজে পাওয়ার জন্য নিজেকে প্রশিক্ষিত করুন ও এরপর তাদের প্রতি আপনার প্রশংসা প্রকাশ করুন। মণ্ডলীতে, আপনি হয়তো কোনো সভাতে উত্তমভাবে তুলে ধরা বক্তৃতা শুনতে পারেন, আধ্যাত্মিক লক্ষ্যের দিকে উন্নতি করছে এমন একজন অল্পবয়সিকে দেখতে পারেন অথবা বার্ধক্যের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সভাগুলোতে বিশ্বস্তভাবে যোগদান করছেন এমন একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে লক্ষ করতে পারেন। আন্তরিক প্রশংসাবাক্য এইরকম ব্যক্তিদের হৃদয় স্পর্শ করতে এবং তাদেরকে আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। পরিবারে, স্বামী ও স্ত্রীদের পরস্পরের কাছ থেকে আন্তরিক প্রশংসার ও উপলব্ধির বাক্য শোনা প্রয়োজন। (হিতোপদেশ ৩১:১০, ২৮) বিশেষভাবে সন্তানরা তখনই উত্তমভাবে বৃদ্ধি পায়, যখন তারা বুঝতে পারে যে, তাদের প্রতি লক্ষ রয়েছে ও তাদেরকে উপলব্ধি করা হয়ে থাকে। একটা সন্তানের কাছে প্রশংসার ও অনুমোদনের বাক্য ঠিক একটা চারাগাছে সূর্যের আলো ও জলের সমরূপ। বাবা-মায়েরা, আপনাদের সন্তানদের প্রশংসনীয় গুণাবলি ও প্রচেষ্টার জন্য প্রশংসা করার বিভিন্ন সুযোগ খুঁজে নিন। এই ধরনের প্রশংসা আপনার সন্তানদের মধ্যে সাহস ও আস্থা গড়ে তুলবে আর তাদেরকে যা সঠিক, তা করার জন্য আরও কঠোর প্রচেষ্টা করতে অনুপ্রাণিত করবে।

১৮, ১৯. সহবিশ্বাসীদের উৎসাহ এবং সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কেন আমাদের যথাসাধ্য করা উচিত আর কীভাবে আমরা তা করতে পারি?

১৮ উৎসাহ এবং সান্ত্বনা। যিহোবা “নম্রদিগের” ও “চূর্ণ লোকদের” জন্য গভীরভাবে চিন্তা করেন। (যিশাইয় ৫৭:১৫) তাঁর বাক্য আমাদেরকে জোরালো পরামর্শ দেয় যে, “পরস্পরকে আশ্বাস” বা সান্ত্বনা “দেও” এবং “ক্ষীণসাহসদিগকে সান্ত্বনা কর, [“বিষণ্ণদের প্রতি সান্ত্বনার বাক্য বল,” NW]।” (১ থিষলনীকীয় ৫:১১, ১৪) আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, দুঃখে ভারাক্রান্ত হৃদয়ের সহবিশ্বাসীদের উৎসাহ এবং সান্ত্বনা দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের প্রচেষ্টাগুলো ঈশ্বর লক্ষ করেন এবং উপলব্ধি করে থাকেন।

আমরা যখন অন্যদেরকে গড়ে তোলার মতো কথাবার্তা বলি, তখন যিহোবা খুশি হন

১৯ তাহলে, একজন নিরুৎসাহিত বা হতাশাগ্রস্ত সহখ্রিস্টানকে গড়ে তোলার জন্য আপনি কী বলতে পারেন? এইরকমটা মনে করবেন না যে, আপনাকে সমস্যার সমাধান করে দিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে, সামান্য কথাবার্তাই মাঝে মাঝে সবচেয়ে উপকারী হয়ে থাকে। মনমরা ব্যক্তিকে আশ্বাস দিন যে, আপনি তার জন্য চিন্তা করেন। নিরুৎসাহিত ব্যক্তির সঙ্গে একত্রে প্রার্থনা করার প্রস্তাব দিন; অন্যেরা এবং যিহোবা সেই ব্যক্তিকে কতটা ভালোবাসেন, তা সেই ব্যক্তিকে জানতে সাহায্য করার জন্য আপনি যিহোবার কাছে মিনতি করতে পারেন। (যাকোব ৫:১৪, ১৫) তাকে আশ্বাস দিন যে, মণ্ডলীর একজন সদস্য হিসেবে তার প্রয়োজন রয়েছে এবং তাকে মূল্য দেওয়া হয়। (১ করিন্থীয় ১২:১২-২৬) বাইবেলের একটা উৎসাহজনক পদ পড়ে তাকে এই আশ্বাস দিন যে, যিহোবা তাকে একজন ব্যক্তি-বিশেষ হিসেবে দেখে তার জন্য প্রকৃতই চিন্তা করেন। (গীতসংহিতা ৩৪:১৮; মথি ১০:২৯-৩১) হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিকে “উত্তম বাক্য” বলার জন্য যথেষ্ট সময় নেওয়া আর আপনার হৃদয় থেকে কথা বলা নিঃসন্দেহে তাকে এইরকম বোধ করতে পরিচালিত করবে যে, তাকে অন্যেরা ভালোবাসে এবং তার প্রতি উপলব্ধি রয়েছে।—পড়ুন, হিতোপদেশ ১২:২৫.

২০, ২১. কোন বিষয়গুলো পরামর্শকে কার্যকারী করে তোলে?

২০ কার্যকারী পরামর্শ। অসিদ্ধ প্রাণী হিসেবে আমাদের সকলেরই সময়ে সময়ে পরামর্শের প্রয়োজন রয়েছে। বাইবেল আমাদেরকে উৎসাহিত করে: “পরামর্শ শুন, শাসন গ্রহণ কর, যেন তুমি শেষকালে জ্ঞানবান হও।” (হিতোপদেশ ১৯:২০) অন্যদেরকে পরামর্শ দেওয়া কেবল প্রাচীনদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বাবা-মায়েরা সন্তানদের পরামর্শ দেয়। (ইফিষীয় ৬:৪) পরিপক্ব বোনদের হয়তো অল্পবয়সি নারীদেরকে পরামর্শ দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। (তীত ২:৩-৫) অন্যদের প্রতি প্রেম আমাদেরকে এমনভাবে পরামর্শ দেওয়ার জন্য পরিচালিত করে, যেন গ্রহণকারী ব্যক্তি চূর্ণ না হয়ে তা গ্রহণ করতে পারেন। কী আমাদেরকে এই ধরনের পরামর্শ দিতে সাহায্য করতে পারে? তিনটে বিষয় বিবেচনা করুন, যেগুলো পরামর্শকে আরও কার্যকারী করে তোলে: পরামর্শদাতার মনোভাব এবং উদ্দেশ্য, পরামর্শের ভিত্তি এবং তা দেওয়ার ধরন।

২১ কার্যকারী পরামর্শের শুরুতেই রয়েছে পরামর্শদাতা। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, ‘কখন পরামর্শ গ্রহণ করা আমার জন্য সহজ?’ আপনি যখন জানেন যে, যিনি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছেন, তিনি আপনার জন্য চিন্তা করেন, ব্যক্তিগত বিরক্তির কারণে কথা বলছেন না ও তার কোনো অসংগত উদ্দেশ্য নেই, তখন পরামর্শ গ্রহণ করা আরও সহজ হয়। তাই, আপনি যখন অন্যদের পরামর্শ দেন, তখন আপনার মনোভাব ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধেও কি একই বিষয় সত্য হওয়া উচিত নয়? এ ছাড়া, সফল পরামর্শ ঈশ্বরের বাক্যের উপর ভিত্তি করে হয়। (২ তীমথিয় ৩:১৬) সরাসরি বাইবেল থেকে উদ্ধৃত করা হোক বা না হোক, প্রদত্ত যেকোনো পরামর্শের জন্য আমাদের শাস্ত্রীয় ভিত্তি থাকা উচিত। তাই, প্রাচীনরা অন্যদের উপর তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে না দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকে; আর তারা শাস্ত্রকে এমনভাবে বিকৃতও করে না যে, এর ফলে মনে হয় যেন বাইবেল কিছু ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে। এ ছাড়া, যদি সঠিকভাবে দেওয়া হয়, তাহলে পরামর্শ আরও কার্যকারী হয়। দয়া দ্বারা আস্বাদযুক্ত পরামর্শ গ্রহণ করা আরও বেশি সহজ এবং তা গ্রহণকারী ব্যক্তিকে তার মর্যাদা বজায় রাখতে সাহায্য করে।—কলসীয় ৪:৬.

২২. কথাবার্তার দানকে ব্যবহার করার বিষয়ে আপনার দৃঢ়সংকল্প কী?

২২ নিশ্চিতভাবেই, কথাবার্তা ঈশ্বরের কাছ থেকে এক মূল্যবান দান। যিহোবার প্রতি আমাদের ভালোবাসা এই দানকে ব্যবহার করতে পরিচালিত করবে, অপব্যবহার করতে নয়। আসুন, আমরা মনে রাখি যে, অন্যদের প্রতি আমরা যে-কথাবার্তা বলি, সেগুলোর ক্ষমতা রয়েছে—হয় গড়ে তোলার নতুবা ভেঙে ফেলার। তাই, আসুন আমরা এই দানকে এর দাতার ইচ্ছা অনুযায়ী—“গড়ে তুলবার জন্য”—ব্যবহার করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। এভাবে আমাদের কথাবার্তা আমাদের চারপাশের ব্যক্তিদের জন্য এক আশীর্বাদ হবে এবং আমাদেরকে ঈশ্বরের প্রেমে অবস্থিতি করতে সাহায্য করবে।

^ অনু. 7 যে-গ্রিক শব্দটা “অলীক” হিসেবে অনূদিত হয়েছে, সেটাকে “অর্থহীন” হিসেবেও অনুবাদ করা যেতে পারে।

^ অনু. 10 শাস্ত্রে যেমন ব্যবহৃত হয়েছে, “অশুচিতা” শব্দটার এক ব্যাপক অর্থ রয়েছে, যা বহুবিধ পাপকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। যদিও সমস্ত ধরনের অশুচিতার জন্য বিচার সংক্রান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন হয় না, তবে একজন ব্যক্তি যদি অনুতাপহীনভাবে চরম অশুচিতার অভ্যাস করেই চলেন, তাহলে তাকে মণ্ডলী থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে।—২ করিন্থীয় ১২:২১; ইফিষীয় ৪:১৯; ২০০৬ সালের ১৫ জুলাই প্রহরীদুর্গ পত্রিকার “পাঠক-পাঠিকাদের থেকে প্রশ্নসকল” দেখুন।