সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

পূর্ণ-সময় সেবা করে—আমরা যিহোবাকে ধন্যবাদ দিয়েছি!

পূর্ণ-সময় সেবা করে—আমরা যিহোবাকে ধন্যবাদ দিয়েছি!

জীবন কাহিনী

পূর্ণ-সময় সেবা করে—আমরা যিহোবাকে ধন্যবাদ দিয়েছি!

স্ট্যানলি ই. রেনল্ডস দ্বারা কথিত

উনিশশো দশ সালে ইংল্যান্ডের লন্ডনে আমার জন্ম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, আমার বাবামা উইল্টশিয়ার অঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম ওয়েস্টবারি লেই-তে চলে আসেন। ছোটবেলাতেই সবসময় আমি ভাবতাম, ‘ঈশ্বর কে?’ কিন্তু কেউই আমাকে উত্তর দিতে পারেনি। আর আমি ভেবে পেতাম না যে আমাদের এই ছোট্ট গ্রামে লোকেদের ঈশ্বরকে উপাসনা করার জন্য কেন দু-দুটো চ্যাপেল ও একটা গির্জার দরকার।

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার চার বছর আগে, ১৯৩৫ সালে আমি আমার ছোট ভাই ডিকের সঙ্গে সাইকেলে চড়ে ছুটি কাটানোর জন্য বেরিয়ে পড়ি। আমরা ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে ওয়েমাউথ উপসাগর অঞ্চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু, খুব জোরে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আমরা তাঁবুতে বসে বৃষ্টি দেখছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম যে এখন কী করা যেতে পারে। এমন সময় একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আমাদের কাছে আসেন এবং বাইবেল অধ্যয়নের জন্য তিনটে ইংরেজি বই দেন, এগুলো হল—ঈশ্বরের বীণা, দীপ্তি ১ম ও ২য় খণ্ড। আমি বইগুলো নিয়ে নিয়েছিলাম আর ভেবেছিলাম যে অন্তত কিছুটা একঘেয়েমি তো কাটানো যাবে। কিন্তু বইগুলো যেন আমাকে জাদু করেছিল। আমরা তখনও জানতাম না যে এই বইগুলোই আমার ও আমার ভাইয়ের জীবনকে একেবারে বদলে দেবে।

বাড়ি ফিরে এসে আমি মাকে বইগুলো দেখিয়েছিলাম। মা আমাকে বলেছিল যে আমাদের গ্রামেই একজন ভদ্রমহিলা আছেন, যিনি বাইবেলের এইরকম বই লোকেদেরকে দেন। তার নাম কেট্‌ পারসন্স। তাকে সবাই-ই চিনত কারণ বেশ বয়স্কা হলেও তিনি ছোট একটা মোটর সাইকেলে করে আমাদের এলাকার বিভিন্ন লোকেদের কাছে যেতেন। আমি তার কাছে গিয়েছিলাম আর তিনি খুব খুশি হয়ে আমাকে সৃষ্টি (ইংরেজি), ধন (ইংরেজি) ও ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির অন্য আরও বইপত্র দিয়েছিলেন। আর তিনি বলেছিলেন যে তিনি একজন যিহোবার সাক্ষি।

আমার বাইবেলের সঙ্গে মিলিয়ে ওই বইগুলো পড়ে আমি বুঝে ফেলেছিলাম যে যিহোবা হলেন সত্য ঈশ্বর আর আমি তাঁকে উপাসনা করতে চেয়েছিলাম। তাই আমাদের গির্জার পাদ্রিকে আমি চিঠি লিখে বলে দিয়েছিলাম যে আমি গির্জা থেকে আমার নাম কাটিয়ে নিতে চাই আর আমি জন ও আ্যলিস মুডির বাড়িতে যে সভা হতো সেখানে যেতে শুরু করি। তারা আমাদের বাড়ির খুব কাছাকাছি ওয়েস্টবারিতেই থাকতেন। তখন আমরা মাত্র সাতজন ওই সভায় যেতাম। সভার আগে ও পরে কেট্‌ পারসন্স হারমোনিয়াম বাজাতেন এবং আমরা একসঙ্গে গলা ছেড়ে রাজ্যের গানগুলো গাইতাম।

প্রথম দিকের দিনগুলো

আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমরা ইতিহাসের খুবই জরুরি সময়ে বাস করছি আর তাই মথি ২৪:১৪ পদে যে প্রচার কাজের কথা ভবিষ্যদ্বাণী করা আছে, তা করার জন্য আমার ভীষণ ইচ্ছা হতো। তাই আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিই, প্রচার করার জন্য একটা ব্রিফকেইস কিনি ও মহান ঈশ্বর যিহোবার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করি।

১৯৩৬ সালের আগস্ট মাসে ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির প্রেসিডেন্ট জোসেফ এফ. রাদারফোর্ড স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে এসেছিলেন ও “হর্‌মাগিদোন” বিষয়ের ওপর বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আমি যেখানে থাকতাম সেখান থেকে গ্লাসগো শহর প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে ছিল কিন্তু তবুও আমি ঠিক করেছিলাম যে আমি সেখানে যাব ও সেই সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নেব। আমার কাছে বেশি টাকা ছিল না, তাই আমি স্কটল্যান্ডের সীমানা কারলিসেল পর্যন্ত ট্রেনে গিয়েছিলাম আর সঙ্গে করে আমার সাইকেলটা নিয়েছিলাম। কারলিসেলে পৌঁছানোর পর আমি সেখান থেকে উত্তর দিকে ১৬০ কিলোমিটার পথ সাইকেলে করে গিয়েছিলাম। এছাড়া ফেরার পথেও বেশির ভাগ রাস্তাই আমি সাইকেলে করে এসেছিলাম। বাড়ি পৌঁছে ক্লান্তিতে আমি যেন আর নড়তে পারছিলাম না কিন্তু আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে আমি অনেক শক্তি পেয়েছিলাম।

এরপর থেকে আমি সাইকেলে করে আশেপাশের গ্রামগুলোতে গিয়ে আমার বিশ্বাস সম্বন্ধে লোকেদের জানাতাম। সেই সময় প্রত্যেক সাক্ষির কাছে একটা পরিচয় পত্র থাকত যাতে বাইবেলের বার্তা লেখা থাকত। প্রচারে গিয়ে আমরা গৃহকর্তাদের এটাই পড়তে দিতাম। এছাড়া আমরা সঙ্গে করে ফোনোগ্রাফও নিয়ে যেতাম আর বাইবেলের বিষয়গুলোর ওপর দেওয়া সোসাইটির প্রেসিডেন্টের বক্তৃতাগুলোর রেকর্ড লোকেদের বাজিয়ে শোনাতাম। আর আমরা সবসময় আমাদের সঙ্গে করে পত্রিকা ভরা একটা ব্যাগ * নিয়ে যেতাম, যেটা দেখেই লোকেরা চিনে ফেলত যে আমরা যিহোবার সাক্ষি।

যুদ্ধের মধ্যে অগ্রগামীর কাজ করা

আমার ভাই ১৯৪০ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং আমরা দুজনেই বুঝতে পেরেছিলাম যে পূর্ণ-সময়ের প্রচার কাজ করা এখন খুবই জরুরি। তাই, আমরা অগ্রগামীর কাজ করার জন্য আবেদনপত্র জমা দিয়েছিলাম। আর আমাদেরকে ব্রিস্টল পাইয়োনিয়ার হোমে যেতে বলা হয়েছিল যেখানে অন্য অগ্রগামীরা ছিলেন। আমাদের দুজনকে একই এলাকায় কাজ করতে দেওয়ায় আমরা খুবই কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম। ব্রিস্টল পাইয়োনিয়ার হোমে এডিথ পুল, বার্ট ফারমার, টম ও ডরথী ব্রিজেস, বার্নার্ড হটন এবং অন্য আরও অনেক অগ্রগামীরা থাকতেন। এতদিন ধরে যাদের বিশ্বাসকে আমরা শ্রদ্ধা করতাম এখন তাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আমরা পেয়েছিলাম।

শীঘ্রিই একটা ছোট্ট ভ্যানে করে আমরা প্রচারে যেতে শুরু করেছিলাম। এই গাড়ির দুদিকেই বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল “যিহোবার সাক্ষি।” ভাই স্ট্যানলি জোনস্‌ গাড়ি চালাতেন, যিনি পরে মিশনারি হয়ে চিনে যান আর সেখানে প্রচার করার জন্য তাকে জেলে দেওয়া হয়। সাত বছর তাকে একা একটা কক্ষে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।

যুদ্ধ বেড়ে চলেছিল আর তাই আমরা বেশির ভাগ সময়ই রাতে ঠিক করে ঘুমাতে পারতাম না। আমাদের হোমের আশেপাশে বোমা পড়ত এবং আমাদের সবসময় নজর রাখতে হতো যে কোথাও কোন বোম পড়ে আছে কিনা যা ফাটতে পারে। ব্রিস্টল শহরের কেন্দ্রে সম্মেলন করা হয়েছিল, যেখানে প্রায় ২০০ জন এসেছিলেন। সম্মেলনের শেষে আমরা কোনরকমে বোমের হাত থেকে বাঁচতে বাঁচতে আমাদের হোমে ফিরে এসেছিলাম, যা সম্মেলনের জায়গার তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ ছিল।

পরের দিন সকালে আমি ও ডিক আবারও সেখানে গিয়েছিলাম কারণ সেখানে আমরা কয়েকটা জিনিস রেখে এসেছিলাম। কিন্তু ওখানে গিয়ে আমরা একেবারে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। ব্রিস্টল শহরের এই জায়গাটা যেন একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেখানে বোম ফেলা হয়েছিল ও সেই জায়গা পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। যেখানে আমাদের কিংডম হল ছিল, সেই পার্ক স্ট্রিট এক ধ্বংসস্তূপ হয়ে উঠেছিল আর সেখান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। তবে আনন্দের বিষয় যে আমরা আগেই কিংডম হল থেকে বইপত্রগুলো সরিয়ে সেগুলো ভাইবোনদের বাড়িতে বাড়িতে রেখে দিয়েছিলাম। আর আমাদের ভাইবোনেদের কারও কোন ক্ষতি হয়নি বা কেউ মারা যাননি। সমস্ত কিছুর জন্য আমরা যিহোবাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম।

স্বাধীনতা যার আশা আমি করিনি

যুদ্ধের সময় অনেক ভাইবোনদের জেল হয়েছিল কারণ তারা কোন দেশের হয়েই যুদ্ধ করতে চাননি। আমিও মনে মনে ভাবছিলাম যে খুব শীঘ্রিই হয়তো আমার স্বাধীনতাও কেড়ে নেওয়া হবে। আর ঠিক সেই সময়েই অন্য ভাইদের মতো আমিও সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য কাগজ পেয়েছিলাম। তখন আমি ব্রিস্টল মণ্ডলীর পরিচালক অধ্যক্ষ ছিলাম, যে মণ্ডলীতে প্রায় ৬৪ জন ভাইবোন ছিলেন। ব্রিস্টলের একটা আদালতে আমার মামলার শুনানি হয়। ভাই এন্থনি বাক ছিলেন আমার পক্ষের উকিল, যিনি আগে জেলের একজন অফিসার ছিলেন। তিনি একজন সাহসী ব্যক্তি ছিলেন আর সাহসের সঙ্গে সবাইকে বাইবেলের সত্য জানাতেন। তার জোরালো সাক্ষ্যের কারণে আমাকে এমন রায় শোনানো হয়েছিল যার আশা আমি একেবারেই করিনি। আমাকে এই শর্তে সামরিক কাজে যোগ দিতে হবে না বলে বলা হয়েছিল যে আমি পূর্ণ-সময়ের কাজ করে চলব!

স্বাধীনতা পেয়ে আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম ও ঠিক করেছিলাম যে আমার এই স্বাধীনতাকে যতখানি বেশি পারা যায় প্রচার করে কাজে লাগাবো। এরপর আমাকে ফোন করে লন্ডন শাখা অফিসে গিয়ে সেখানকার শাখা অধ্যক্ষ, ভাই আ্যলবার্ট শ্রোডারের সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়েছিল। আমি মনে মনে ভাবছিলাম যে আমার জন্য কোন্‌ কাজ জানি রয়েছে। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যখন ভাই শ্রোডার আমাকে ইয়র্কশিয়ারে ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করার জন্য যেতে বলেছিলেন। এর মানে ছিল যে আমাকে প্রত্যেক সপ্তায় আলাদা আলাদা মণ্ডলীগুলোতে গিয়ে ভাইবোনদের সাহায্য করতে ও উৎসাহ দিতে হবে। আমার মনে হয়েছিল যে আমি এই কাজের যোগ্য নই কিন্তু আমার কোন বাধা ছিল না, আমি যে কোন জায়গাতে গিয়েই প্রচার করতে পারতাম। তাই আমি যিহোবার আদেশ মেনে নিয়েছিলাম ও খুশি মনে সেখানে গিয়েছিলাম।

১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে হাডেরস্‌ফিল্ডের এক সম্মেলনে ভাই আ্যলবার্ট শ্রোডার সেখানকার ভাইদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আর আমি আমার নতুন প্রচারের এলাকায় কাজ শুরু করেছিলাম। এই ভাইবোনদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হওয়ায় আমি যে কত খুশি হয়েছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না! তাদের প্রেম ও দয়া দেখে আমি আরও ভাল করে বুঝেছিলাম যে যিহোবার লোকেরা সম্পূর্ণ হৃদয়ে যিহোবার সেবা করেন ও ভাইদেরকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন।—যোহন ১৩:৩৫.

সেবা করার আরও সুযোগ

লেস্টারের ডি মনফোর্ট হলে ১৯৪১ সালে পাঁচ দিনের এক সম্মেলন হয়েছিল, যা সত্যিই মনে রাখার মতো ঘটনা। তখন খাবারের খুব অভাব ছিল আর ট্রেন বাসও খুব বেশি চলছিল না, তবুও অনেক লোকেরা সম্মেলনে এসেছিলেন আর রবিবারে সবচেয়ে বেশি ১২,০০০ জন সেখানে এসেছিলেন; যদিও তখন ব্রিটেনে ১১,০০০ জনের কিছু বেশি সাক্ষি ছিলেন। ওই সম্মেলনে সোসাইটির প্রেসিডেন্টের রেকর্ড করা বক্তৃতা শোনানো হয়েছিল আর সন্তান (ইংরেজি) বইটা প্রকাশ করা হয়েছিল। ব্রিটেনে যিহোবার লোকেদের ইতিহাসে এই সম্মেলন সত্যিই এক বিশেষ সময় ছিল, কারণ তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে হয়েছিল।

এই সম্মেলনের পর পরই আমি লন্ডন বেথেলে কাজ করার জন্য ডাক পাই। সেখানে আমি শিপিং ও প্যাকিং বিভাগে কাজ করি ও পরে অফিসে মণ্ডলীগুলোর কাজকর্ম দেখাশোনার বিভিন্ন কাজ করি।

লন্ডনে শহরে রাতদিন জঙ্গিবিমান হামলা হতো, যে কারণে বেথেল পরিবারকেও অশান্তির মধ্যে থাকতে হতো। এছাড়াও সরকারি কর্তৃপক্ষ সবসময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেই থাকত। ভাই প্রিস হিউস্‌, ইউয়ার্ট চিটি এবং ফ্রাংক প্লাটের জেল হয়েছিল কারণ তারা যুদ্ধ করতে রাজি হননি আর শেষ পর্যন্ত ভাই আ্যলবার্ট শ্রোডারকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এত অসুবিধা ও চাপ থাকা সত্ত্বেও, রাজ্যের প্রচার কাজ বাড়তে থাকে ও মণ্ডলীর কাজও পুরোদমেই চলতে থাকে।

গিলিয়েডে যাওয়া!

১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, আমি ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েড থেকে মিশনারি প্রশিক্ষণের জন্য আবেদন করি আর ১৯৪৬ সালে অষ্টম গিলিয়েড ক্লাসের জন্য আমাকে ডাকা হয়। সোসাইটি আমাদের বেশ কয়েকজনের আসার ব্যবস্থা করেছিলেন। আমার সঙ্গে টনি আ্যটওড্‌, স্ট্যানলি জোনস্‌, হেরল্ড কিং, ডন রেনডেল ও স্ট্যানলি উড্‌বার্ন এই ভাইরাও ছিলেন। আমরা ফৌয়ে করনিশ মৎস্য বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। সেখানকার একজন ভাই, একটা ছোট মালবাহী জাহাজে আমাদের জন্য জায়গা ঠিক করে রেখেছিলেন। আমাদের কামরাগুলো খুবই ছোট ছিল আর ডেক সবসময়ই জলে ভরে থাকত। শেষ পর্যন্ত ফিলাডেলফিয়া বন্দরে পৌঁছে তবেই আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলাম!

নিউ ইয়র্কের উত্তর দিকে সাউথ ল্যান্সিংয়ের খুব সুন্দর জায়গায় গিলিয়েড ক্লাস হয়েছিল। আর সেখান থেকে আমি যা কিছু শিখেছিলাম, তা আমার কাছে অমূল্য ছিল। আমাদের ক্লাসে ১৮টা দেশ থেকে ছাত্ররা এসেছিল। এই প্রথমবারের মতো সোসাইটি বিভিন্ন দেশ থেকে এত ভাইদের গিলিয়েডে ডেকেছিল আর আমরা সবাই একে অন্যের খুব কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। আমি ফিনল্যান্ড থেকে আসা এক ভাই ক্যালে সালাভ্যারার সঙ্গে একই ঘরে ছিলাম আর সে আমার খুব ভাল বন্ধু হয়ে গিয়েছিল।

সময় যেন উড়ে চলেছিল আর পাঁচ মাস পর, সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নেথেন এইচ. নর ব্রুকলিনের প্রধান কার্যালয় থেকে এসেছিলেন। তিনি আমাদের ডিপ্লোমা দিয়েছিলেন ও আমাদের কাকে কোথায় যেতে হবে তা বলেছিলেন। তখন ছাত্ররা আগে থেকে জানত না যে তাদের মিশনারি করে কোথায় পাঠানো হবে। গ্র্যাজুয়েশনের দিন তা ঘোষণা করা হতো। আমাকে আবারও লন্ডন বেথেলে পাঠানো হয়েছিল যাতে আমি সেখানেই কাজ করে চলি।

আবার লন্ডনে

যুদ্ধের পরের বছরগুলোতে ব্রিটেনে খুবই কষ্টের সময় চলছিল। খাবার ও অন্যান্য দরকারি জিনিস, এমনকি কাগজ পর্যন্ত রেশনে দেওয়া হতো। কিন্তু, আমাদের দিন কেটে গিয়েছিল আর যিহোবার রাজ্যের কাজ দিনে দিনে এগিয়ে চলেছিল। বেথেলে কাজ করা ছাড়াও আমি জেলা ও সীমা সম্মেলনগুলোতে প্রতিনিধি হয়ে যেতাম আর কিছু মণ্ডলীতে ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে যেতাম। এর মধ্যে আয়ারল্যান্ডের মণ্ডলীগুলোও ছিল। এই সময়ে ইউরোপের ভাইবোনদের ও বিশেষ করে ভাই এরিক ফ্রস্টের সঙ্গে আলাপ হওয়া আমার জন্য বিশেষ সুযোগ ছিল। তিনি বলেছিলেন যে কীভাবে নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে তার সঙ্গের কিছু ভাইবোনেরা তাদের বিশ্বস্ততা বজায় রেখেছিলেন আর তাদের কোন্‌ কোন্‌ নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। বেথেলে কাজ করাতেই আমি এই আশীর্বাদ পেয়েছিলাম।

দশ বছর ধরে আমি জোয়েন ওয়েবকে চিনতাম। সে লন্ডনের উত্তরে ওয়াটফোর্ডে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে কাজ করত। ১৯৫২ সালে আমরা বিয়ে করি। আমি বেথেল ছাড়ার পর আমরা দুজনেই পূর্ণ-সময়ের কাজ চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম আর আমরা কত খুশিই না হয়েছিলাম যখন আমাকে সীমা অধ্যক্ষের কাজ দেওয়া হয়েছিল। আমার প্রথম সীমা ছিল ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলের সাসেক্স ও হ্যাম্পশিয়ার এলাকা। ওই সময়ে সীমা অধ্যক্ষের কাজ এত সহজ ছিল না। আমরা বেশির ভাগ সময়েই বাস, সাইকেল ও পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতাম। অনেক মণ্ডলীর প্রচারের এলাকা বেশ বড় ও দূরে দূরে ছিল, যেখানে যাওয়া খুব কষ্টের ছিল কিন্তু সাক্ষিদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছিল।

১৯৫৮ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে

১৯৫৭ সালে আমি লন্ডন বেথেল থেকে আরেকবার ডাক পাই: “১৯৫৮ সালে নিউ ইয়র্কের ইয়াংকি স্টেডিয়াম ও পোলো গ্রাউন্ডে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হবে। আপনি কি তার জন্য বেথেলে এসে ভাইদের যাওয়া-আসার ব্যবস্থা করায় সাহায্য করতে চান?” সোসাইটির ভাড়া নেওয়া প্লেন ও জাহাজে টিকিট বুক করার জন্য ভাইদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আসতে শুরু করে আর জোয়েন ও আমি সেই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এটা ছিল ঈশ্বরের ইচ্ছা আন্তর্জাতিক সম্মেলন, যেখানে প্রায় ২,৫৩,৯২২ জন এসেছিলেন। এই সম্মেলনে ৭,১৩৬ জন জলে বাপ্তিস্ম নিয়ে তাদের উৎসর্গীকরণকে দেখিয়েছিলেন। বাইবেলে বলা সা.কা. ৩৩ সালে পঞ্চাশত্তমীর দিনের ঐতিহাসিক ঘটনায় যত জন বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন তার প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি লোকেরা এই সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন।—প্রেরিত ২:৪১.

আমি ও জোয়েন ভাই নরের ভালবাসার কথা কখনও ভুলব না, যিনি নিজে আমাদের ওই সম্মেলনে আসার জন্য ডেকেছিলেন, যেন আমরা নিউ ইয়র্ক শহরের এই সম্মেলনের জন্য ১২৩টা দেশ থেকে আসা ভাইবোনেদের সাহায্য করতে পারি। এই কাজ করতে পেরে আমরা দুজনেই খুব খুশি হয়েছিলাম।

পূর্ণ-সময়ের কাজের আশীর্বাদ

নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরে এসে যতদিন পর্যন্ত আমাদের স্বাস্থ্য ভাল ছিল, আমরা ভ্রমণ কাজ চালিয়ে গিয়েছি। জোয়েনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল আর আমার মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছিল। আমাদেরকে আবারও বিশেষ অগ্রগামী করা হয় কিন্তু পরে কিছু সময়ের জন্য আমরা আবার সীমার কাজও করি। শেষ পর্যন্ত আমরা আবার ব্রিস্টলে ফিরে আসি এবং এখানে আমরা এখনও পূর্ণ-সময়ের কাজ করে চলেছি। আমার ভাই ডিকও তার পরিবার নিয়ে কাছেই থাকে আর আমাদের প্রায়ই দেখা হয়।

১৯৭১ সালে আমার চোখ একেবারেই খারাপ হয়ে যায়। তখন থেকে আমি আর প্রায় পড়তেই পারি না, তাই এখন যখন আমি বাইবেলের বইপত্রের রেকর্ড করা ক্যাসেট শুনি তখন এই ব্যবস্থার জন্য যিহোবাকে ধন্যবাদ দিই। জোয়েন ও আমি এখনও লোকেদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের বাইবেল শেখাই আর গত কয়েক বছরে আমরা ৪০ জন ব্যক্তিকে বাইবেলের সত্য জানানোর সুযোগ পেয়েছি, যার মধ্যে সাত জনের একটা পরিবারও সত্যে এসেছে।

ষাট বছর আগে আমরা যখন যিহোবার কাছে আমাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলাম তখন থেকেই আমাদের ইচ্ছা ছিল যে আমরা পূর্ণ-সময় তাঁর সেবা করব আর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা করে চলব। আমরা কতই না কৃতজ্ঞ যে এখনও মহান ঈশ্বর যিহোবাকে সেবা করার মতো শক্তি আমাদের আছে। আর এটাই তো একটা উপায়, যা করে আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে পারি আর আমাদের জন্য তিনি যে মঙ্গল করেছেন ও আমাদেরকে সুখী করেছেন তার জন্য ধন্যবাদ দিতে পারি!

[পাদটীকাগুলো]

^ এই কাপড়ের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নেওয়া যেত আর এই ব্যাগ এমনভাবে বানানো হতো যাতে প্রহরীদুর্গ ও সান্ত্বনা (পরে, সচেতন থাক!) পত্রিকাগুলো নেওয়া যেত।

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

ব্রিস্টল পাইয়োনিয়ার হোমের সামনে আমার ভাই ডিক (একেবারে বামে; ডিক দাঁড়ানো) এবং অন্যান্য অগ্রগামীদের সঙ্গে

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৪০ সালে ব্রিস্টল পাইয়োনিয়ার হোম

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৫২ সালের ১২ই জানুয়ারি বিয়ের দিনে স্ট্যানলি ও জোয়েন রেনল্ডস এবং আজকে তারা দুজনে