সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

শস্য কাটার আগে ‘ক্ষেত্রে’ কাজ করা

শস্য কাটার আগে ‘ক্ষেত্রে’ কাজ করা

শস্য কাটার আগে ‘ক্ষেত্রে’ কাজ করা

 মহান শিক্ষকের শিষ্যরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এইমাত্র যীশু তাদেরকে গোম ও শ্যামাঘাস নিয়ে একটা ছোট্ট গল্প বলেছেন। এটা ছাড়াও সেদিন তিনি আরও অনেকগুলো দৃষ্টান্ত বলেছেন। গল্প বলা শেষ হলে বেশির ভাগ লোকেরা যার যার পথে চলে যায়। কিন্তু তাঁর শিষ্যরা জানতেন যে এই দৃষ্টান্তগুলোর, বিশেষ করে গোম ও শ্যামাঘাসের দৃষ্টান্তটার নিশ্চয়ই কোন মানে আছে। কারণ তারা জানতেন যে যীশু শুধু সুন্দর করে গল্পই বলতেন না, এগুলোর বিশেষ বিশেষ অর্থও ছিল।

মথি আমাদের জানান যে শিষ্যরা তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন: “ক্ষেত্রের শ্যামাঘাসের দৃষ্টান্তটী আমাদিগকে স্পষ্ট করিয়া বলুন।” উত্তরে যীশু এই দৃষ্টান্তটা বুঝিয়ে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে তাঁর নকল শিষ্যদের মধ্যে এক বিরাট ধর্মভ্রষ্টতা দেখা দেবে। (মথি ১৩:২৪-৩০, ৩৬-৩৮, ৪৩) আর ঠিক তা-ই হয়েছিল। প্রেরিত যোহন মারা যাওয়ার পর খ্রীষ্টানদের মধ্যে ধর্মভ্রষ্টতা খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়েছিল। (প্রেরিত ২০:২৯, ৩০; ২ থিষলনীকীয় ২:৬-১২) সেই ধর্মভ্রষ্টতা এত বেশি ছড়িয়ে পড়েছিল যে লূক ১৮:৮ পদে যীশু যে প্রশ্নটা করেছিলেন, তা একেবারেই ঠিক ছিল: “মনুষ্যপুত্ত্র যখন আসিবেন, তখন কি পৃথিবীতে বিশ্বাস পাইবেন?”

যীশুর আগমন, গোমতুল্য খ্রীষ্টানদের ‘শস্যচ্ছেদনের সময়ের’ শুরুকে চিত্রিত করে। সেটা ‘যুগান্তের’ একটা লক্ষণ, যা ১৯১৪ সালে শুরু হয়েছিল। তাই, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে শস্য কাটার সময় যখন হয়ে আসছিল তার আগে কিছু ব্যক্তিরা বাইবেলের সত্যের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।—মথি ১৩:৩৯.

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে বিশেষ করে ১৫শ শতাব্দীর পর থেকে কিছু লোকেদের এমনকি খ্রীষ্টীয়জগতের “শ্যামাঘাস” বা নকল খ্রীষ্টানদের মনেও বাইবেলের বিষয়ে আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে। সবার হাতে হাতে বাইবেল পৌঁছে যাওয়ায় এবং বাইবেলের কনকরডেন্স তৈরি হওয়ার পর থেকে সৎ হৃদয়ের ব্যক্তিরা মন দিয়ে বাইবেল পড়তে শুরু করেছিলেন।

জ্যোতি দিনে দিনে আরও উজ্জ্বল হয়

উনিশ শতকের শুরুতে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম থেকে আসা হেনরি গ্রু (১৭৮১-১৮৬২) ছিলেন এই ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। ১৩ বছর বয়সে তিনি তার পরিবারের সঙ্গে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে আমেরিকার পথে যাত্রা করেন আর ১৭৯৫ সালের ৮ই জুলাই সেখানে গিয়ে পৌঁছান। তারা রোড আইল্যান্ডে থাকতে শুরু করেন। তার বাবামা ছোটবেলা থেকেই তাকে বাইবেল পড়ার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন। ১৮০৭ সালে, ২৫ বছর বয়সে গ্রুকে কানেকটিকাটের হার্টফোর্ড ব্যাপ্টিস্ট গির্জার প্যাসটর হওয়ার জন্য ডাকা হয়।

প্যাসটর হিসেবে শিক্ষা দেওয়ার কাজকে তিনি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন এবং যারা বাইবেলের সঙ্গে মিল রেখে জীবনযাপন করতেন তাদেরকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি মণ্ডলীকে পরিচ্ছন্ন রাখার পক্ষে ছিলেন আর তাই কেউ যদি জেনেশুনে পাপ করেই চলে, তাহলে তাকে মণ্ডলী থেকে বের করে দেওয়া উচিত বলে মনে করতেন। এই কারণে মাঝে মাঝে তিনি ও গির্জার অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা, সেই ব্যক্তিদের মণ্ডলী থেকে বের করে দিতেন (সমাজচ্যুত করতেন), যারা ব্যভিচার বা অন্যান্য নোংরা কাজ করেই চলত।

এছাড়া গির্জায় আরও অন্যান্য সমস্যাও ছিল, যেগুলো তার ভাল লাগত না। গির্জার সদস্য নন এমন কিছু ব্যক্তিরা গির্জার টাকাপয়সা সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখাশোনা করত ও গির্জার গানে নেতৃত্ব দিত। এই পুরুষেরা মণ্ডলীর বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যে ভোট হতো তাতেও অংশ নিতে পারত আর এর ফলে তাদের হাতেও কিছুটা কর্তৃত্ব ছিল। জগতের থেকে আলাদা থাকার নীতিটা মনে রেখে গ্রু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে একমাত্র বিশ্বস্ত পুরুষদেরই এই দায়িত্বগুলো পালন করা উচিত। (২ করিন্থীয় ৬:১৪-১৮; যাকোব ১:২৭) তিনি মনে করতেন যে অবিশ্বাসীরা যদি ঈশ্বরের উদ্দেশে প্রশংসা গান করে, তাহলে তা ঈশ্বরনিন্দারই সামিল। এই বিশ্বাসের কারণে ১৮১১ সালে হেনরি গ্রুকে ওই গির্জা থেকে বের করে দেওয়া হয়। যে সদস্যরা তার মতোই মনে করতেন, তারাও গির্জা থেকে বেরিয়ে আসেন।

খ্রীষ্টীয়জগৎ থেকে বেরিয়ে আসা

হেনরি গ্রু এবং যে ব্যক্তিরা গির্জা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, তারা বাইবেলের সঙ্গে মিল রেখে জীবনযাপন করার ও সমস্ত কাজে এর পরামর্শ মেনে চলার সংকল্প নিয়ে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। অধ্যয়ন করার ফলে তারা খুব তাড়াতাড়ি বাইবেলের সত্য বুঝতে পারেন ও খ্রীষ্টীয়জগতের মিথ্যা শিক্ষাগুলোকে প্রকাশ করে দেন। উদাহরণস্বরূপ, ১৮২৪ সালে গ্রু খুব জোরালো যুক্তি দেখিয়ে ত্রিত্ব মতবাদকে ভুল প্রমাণ করে একটা প্রবন্ধ লেখেন। ওই প্রবন্ধ থেকে তার এই যুক্তিটা দেখুন: “‘সেই দিনের বা সেই সময়ের কথা কোন মানুষই জানে না; স্বর্গের দূতেরাও না, পুত্রও না, কেবল পিতা জানেন।’ [মার্ক ১৩:৩২] খেয়াল করুন যে এখানে পদমর্যাদার পার্থক্য আছে। মানুষ, দূত, পুত্র, পিতা। . . . প্রভু আমাদের শিখিয়েছেন যে কেবল পিতা সেই দিন সম্বন্ধে জানেন। কিছু লোকেরা যদি বলেন যে পিতা, বাক্য ও পবিত্র আত্মা এক ঈশ্বরের তিন ব্যক্তি আর তাদের কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে যীশুর এই কথা ঠিক হতে পারে না কারণ [ত্রিত্বের শিক্ষা] অনুযায়ী . . . পিতা-পুত্র দুজনেরই সেই দিন সম্বন্ধে জানার কথা।”

গ্রু সেইসব পাদ্রি ও সেনা অফিসারদের মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন, যারা খ্রীষ্টকে সেবা করেন বলে দাবি করতেন। ১৮২৮ সালে তিনি ঘোষণা করেছিলেন: “একজন খ্রীষ্টান নিরালায় তার শত্রুদের জন্য প্রার্থনা করার পরপরই যদি সেই শত্রুদের হত্যা করার জন্য সেনাবাহিনীকে অস্ত্র ছুঁড়ার নির্দেশ দেন, তাহলে তা কতটা বেখাপ্পা তা কি আমরা কল্পনা করতে পারি? শত্রুর জন্য প্রার্থনা করে সে খুশি মনে তাঁর প্রভুর মতো কাজ করে, যিনি তার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন কিন্তু সেই শত্রুকেই হত্যা করার আদেশ দিয়ে সে কার মতো কাজ করে? যীশুকে যারা হত্যা করেছিল, তিনি তাদের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু, খ্রীষ্টানেরা সেই লোকেদের হত্যা করে যাদের জন্য তারা প্রার্থনা করে।”

আরও জোরালোভাবে গ্রু লিখেছিলেন: “আমরা কখন সর্বশক্তিমানের ওপর বিশ্বাস দেখাব, যিনি আমাদের বলেন যে ‘তাঁকে উপহাস করা যায় না’? সেই পবিত্র ধর্মের বৈশিষ্ট্যকে আমরা কখন বুঝতে পারব, যে ধর্মে থাকতে হলে আমাদের যে কোন ধরনের ‘খারাপ কাজ’ থেকে দূরে থাকতে হবে? . . . ঈশ্বরের পুত্রের জন্য এটা কি নিন্দনীয় নয় যে তাঁর ধর্মের লোকেরা একদিকে স্বর্গদূতেদের মতো কাজ করে আবার অন্যদিকে শয়তানের মতো কাজ করে?”

মানুষ অনন্ত জীবন নিয়ে জন্মায়নি

রেডিও ও টেলিভিশন আসার আগে, একজনের মতামত প্রকাশের সবচেয়ে ভাল উপায় ছিল প্যামফ্ল্যাট ছাপিয়ে তা সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া। প্রায় ১৮৩৫ সালে আত্মার অমরত্ব ও নরকাগ্নির শিক্ষা যে বাইবেলে নেই সেই বিষয়ে গ্রু একটা প্যামফ্ল্যাট ছাপান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এই মতবাদগুলো ঈশ্বরের ওপর নিন্দা নিয়ে আসে।

এই প্যামফ্ল্যাট বিতরণের অনেক ভাল ফল হয়েছিল। ১৮৩৭ সালে ৪০ বছর বয়সী জর্জ স্টর্স নামে একজন ব্যক্তি ট্রেনে বসে এর একটা কপি পেয়েছিলেন। স্টর্স ছিলেন লেবাননের নিউ হ্যাম্পশায়ারের লোক, যিনি তখন নিউ ইয়র্কের ইউটিকাতে থাকতেন।

তিনি মেথোডিস্ট এপিসকোপাল চার্চের একজন উর্ধ্বতন পাদ্রি ছিলেন। প্যামফ্ল্যাটটা পড়ে তিনি ভাবতেই পারেননি যে খ্রীষ্টীয়জগতের মৌলিক শিক্ষাগুলোর বিরুদ্ধে এত জোরালো যুক্তি দেখানো যেতে পারে, যে বিষয়গুলো নিয়ে তিনি এর আগে কখনও সন্দেহ করেননি। এটা কে লিখেছেন তা তিনি জানতেন না। তারা দুজনেই পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়াতেই থাকতেন কিন্তু তবুও প্রায় ১৮৪৪ সালের আগে পর্যন্ত হেনরি গ্রুর সঙ্গে তার দেখাই হয়নি। তবে স্টর্স তিন বছর ধরে নিজে নিজে এই বিষয়গুলো নিয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন এবং শুধু পাদ্রিদের সঙ্গেই এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছিলেন।

বাইবেল অধ্যয়ন করে তিনি যা কিছু শিখেছিলেন কেউই যেহেতু সেগুলোকে ভুল প্রমাণ করতে পারেননি, তাই শেষ পর্যন্ত স্টর্স বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি যদি মেথোডিস্ট গির্জায় থাকেন, তাহলে তিনি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারবেন না। এইজন্য, ১৮৪০ সালে তিনি এই গির্জা থেকে তার নাম কাটিয়ে নেন ও নিউ ইয়র্কের আলবেনিতে চলে যান।

“একটা প্রশ্ন—দুষ্টেরা কি অমর?” এই বিষয়ের ওপর ১৮৪২ সালের বসন্তকালের প্রথম দিকে স্টর্স ছসপ্তাহ ধরে ধারাবাহিকভাবে ছটা ভাষণ দেন। এই ভাষণ শুনে লোকেরা এত আগ্রহ দেখিয়েছিল যে পরে তিনি এই ভাষণগুলোকে বইয়ের আকারে ছাপিয়েছিলেন আর পরের ৪০ বছরে আমেরিকা ও গ্রেট ব্রিটেনে এই বইয়ের প্রায় ২,০০,০০০ কপি বিতরণ করা হয়েছিল। আত্মার অমরত্বের মতবাদকে ভুল প্রমাণ করার জন্য স্টর্স এবং গ্রু একসঙ্গে কাজ করেছিলেন। ১৮৬২ সালের ৮ই আগস্ট ফিলাডেলফিয়াতে গ্রু মারা যান। এর আগে পর্যন্ত তিনি জোরকদমে প্রচার করেছিলেন।

একটু আগে যে ছটা বক্তৃতার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো দেওয়ার অল্প কয়েকদিন পরই উইলিয়াম মিলারের প্রচারের প্রতি স্টর্স আগ্রহী হয়ে উঠেন। উইলিয়াম মিলার আশা করতেন যে খ্রীষ্ট ১৮৪৩ সালে ফিরে আসবেন ও সবাই তা দেখতে পাবে। স্টর্স প্রায় দুবছর ধরে উত্তরপূর্ব আমেরিকায় এই খবর প্রচার করেছিলেন। কিন্তু, ১৮৪৪ সালের পর তিনি খ্রীষ্টের আসার বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন তারিখ সম্বন্ধে লোকেদের আর বলেননি। অবশ্য অন্যরা যদি দিন গণনার বিষয়ে পরীক্ষা করতে চাইতেন তাতেও তিনি কোন আপত্তি জানাতেন না। স্টর্স বিশ্বাস করতেন যে খ্রীষ্ট খুব শীঘ্রিই ফিরে আসবেন আর তাই খ্রীষ্টানদের আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে সতর্ক ও জেগে থাকা অর্থাৎ শেষ পরীক্ষার জন্য তৈরি থাকা দরকার। কিন্তু, তিনি উইলিয়াম মিলারের দল ছেড়ে চলে আসেন কারণ তারা এমন কিছু মতবাদ বিশ্বাস করত, যেগুলো বাইবেলে ছিল না। মিলারের দলের লোকেরা আত্মার অমরত্ব, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বিষয় এবং যারা সত্য বিষয়গুলো না জেনে মারা যায় তাদের জন্য অনন্ত জীবনের কোন আশা নেই এইরকম মতবাদগুলো বিশ্বাস করত।

ঈশ্বরের জন্য ভালবাসা কোথায় নিয়ে যাবে?

আ্যডভেনটিস্টরা বিশ্বাস করত, যে দুষ্ট লোকেরা মারা গেছে তাদেরকে ঈশ্বর আবারও মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য বাঁচিয়ে তুলবেন। স্টর্স এই বিশ্বাসকে মেনে নেননি। তিনি বাইবেলের কোথাও এইরকম কিছু খুঁজে পাননি, যেখানে বলা আছে যে ঈশ্বর এইরকম অযৌক্তিক কাজ করতে পারেন বা এতটা প্রতিশোধ নিতে পারেন। স্টর্স ও তার সঙ্গীরা বলেছিলেন যে দুষ্টদের কোন পুনরুত্থান নেই। অধার্মিক লোকেদের পুনরুত্থিত করা হবে সেই পদগুলো যদিও তারা ঠিক মতো ব্যাখ্যা করতে পারতেন না, তবুও তাদের মনে হয়েছিল যে তাদের ধারণায় ঈশ্বরের প্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায়। ঈশ্বরের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে শীঘ্রিই তারা আরও বেশি কিছু বুঝতে পেরেছিলেন।

১৮৭০ সালে স্টর্স খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কয়েক মাস কোন কাজই করতে পারেননি। এই সময় তিনি গত ৭৪ বছর ধরে যা কিছু শিখেছিলেন, সেগুলোকে আরও একবার যাচাই করে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মানুষের জন্য ঈশ্বরের উদ্দেশ্যের একটা জরুরি বিষয়কে তিনি বুঝতে পারেননি আর সেটা হল অব্রাহামের কাছে করা ঈশ্বরের চুক্তি, যেখানে বলা হয়েছে: ‘অব্রাহামের বংশে পৃথিবীর সমস্ত পিতৃকূল আশীর্ব্বাদ প্রাপ্ত হইবে; কারণ অব্রাহাম তাঁর বাক্যে অবধান করিয়াছিলেন।’—আদিপুস্তক ২২:১৮; প্রেরিত ৩:২৫.

এই কথাগুলো দেখে তার মনে আরেকটা নতুন চিন্তা আসে। যদি ‘সমস্ত পিতৃকূলের’ আশীর্বাদ পাওয়ার কথা থাকে, তাহলে সবার কি সুসমাচার শোনা উচিত নয়? তারা কীভাবে তা শুনবে? লাখ লাখ লোকেরা কি ইতিমধ্যে মারা যায়নি? আরও মন দিয়ে বাইবেল পড়ার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যে “দুষ্ট” লোকেরা মারা গেছে তাদের মধ্যে দুটো শ্রেণী আছে: একটা শ্রেণী হল, যারা জেনেশুনে ঈশ্বরের দেখানো ভালবাসাকে অবহেলা করেছে এবং অন্য শ্রেণী হল যারা ঈশ্বরের ভালবাসা সম্বন্ধে না জেনেই মারা গেছে।

যারা ঈশ্বরের ভালবাসা সম্বন্ধে না জেনে মারা গেছে তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে, যাতে তারা যীশু খ্রীষ্টের মুক্তির মূল্য থেকে উপকার পেতে পারে। যারা এটাকে মেনে নেবে তারা চিরকাল পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে। যারা এটাকে মেনে নেবে না তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। স্টর্স বিশ্বাস করতেন যে কোন আশা ছাড়া এমনি এমনি মৃতদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে না। আদমের পাপের জন্য আর কেউই মারা যাবে না। কিন্তু তাদের কথা কী বলা যায়, যারা প্রভু যীশু খ্রীষ্টের আগমনের সময় বেঁচে থাকবে? স্টর্স শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিলেন যে তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য সারা পৃথিবীতে প্রচার করার কাজ শুরু করতে হবে। এই কাজ কীভাবে করা হবে সেই সম্বন্ধে তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন, যে করেই হোক এই কাজ হবেই আর তাই তিনি লিখেছিলেন: “কিছু লোক আছেন যারা কোন কাজ দেখে অসম্ভব বলে মনে করেন কারণ তারা বুঝতে পারেন না যে কীভাবে তা করা যাবে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেন না বলে ঈশ্বরের পক্ষে তা করা অসম্ভব কিছু নয়।”

জর্জ স্টর্স ১৮৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে তার নিজের বাড়িতে মারা যান। পরে তার বাড়ি থেকে একটু দূরেই সারা পৃথিবীর প্রচার কাজের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল, যার জন্য তিনি অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেছিলেন।

আরও জ্যোতি দরকার ছিল

হেনরি গ্রু ও জর্জ স্টর্সের মতো লোকেরা কি আমাদের মতো এত স্পষ্টভাবে সত্য বুঝতে পেরেছিলেন? না। এর জন্য তাদেরকে যে সংগ্রাম করতে হয়েছে সেই সম্বন্ধে স্টর্স ১৮৪৭ সালে বলেছিলেন: “আমাদের মনে রাখা উচিত যে আমরা সবেমাত্র গির্জার আধ্যাত্মিক অন্ধকারের যুগ থেকে বেরিয়ে এসেছি; আর আমরা যদি সত্য ভেবে এখনও ‘বাবিলনীয় শিক্ষাগুলো’ মেনে চলি, তাহলে তা অবাক হওয়ার মতো কিছুই হবে না।” উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে গ্রু, যীশুর দেওয়া মূক্তির মূল্যের জন্য কৃতজ্ঞ ছিলেন কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি যে এটা “সমরূপ মুক্তির মূল্য” ছিল অর্থাৎ আদম যে সিদ্ধ জীবন হারিয়েছিল, তার বদলে যীশু তাঁর সিদ্ধ জীবন দিয়েছিলেন। (১ তীমথিয় ২:৬, NW) এছাড়াও হেনরি গ্রুর আরেকটা ভুল বিশ্বাস ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে যীশু সশরীরে এই পৃথিবীতে ফিরে এসে মানুষের ওপর শাসন করবেন। তবে গ্রু যিহোবার নামকে পবিত্র করার বিষয়ে চিন্তিত ছিলেন, যে বিষয়টার প্রতি সা.কা. দ্বিতীয় শতাব্দীর পর থেকে খুব কম লোকেরাই আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।

একইভাবে স্টর্সও কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঠিক মতো বুঝতে পারেননি। পাদ্রিরা যে মিথ্যা বিষয়গুলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেগুলো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ঠিকই কিন্তু কখনও কখনও তিনিও ভুল বিষয় বিশ্বাস করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শয়তানের বিষয়ে অর্থোডক্স পাদ্রিদের ধারণাকে তিনি মেনে নিতে চাননি। আর তাই শয়তান যে আসলে একজন ব্যক্তি সেই বিষয়টাকেই স্টর্স অস্বীকার করেছিলেন। তিনি ত্রিত্ব মতবাদকে মেনে নেননি কিন্তু পবিত্র আত্মা একজন ব্যক্তি কিনা সেই বিষয়ে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অনিশ্চিত ছিলেন। জর্জ স্টর্স যদিও আশা করেছিলেন যে খ্রীষ্টের আগমন আসলে অদৃশ্যভাবেই হবে কিন্তু তারপরও তিনি ভেবেছিলেন যে একসময় খ্রীষ্ট সশরীরে আসবেন। তবে এটা স্পষ্ট যে তারা দুজনেই আন্তরিক ও সৎ ছিলেন এবং তাদের সময়কার অনেকের চেয়ে বাইবেলের সত্য বিষয়গুলো আরও ভালভাবে বুঝতে পেরেছিলেন।

গোম ও শ্যামাঘাসের দৃষ্টান্তে যীশু যে ‘ক্ষেত্রের’ কথা বলেছিলেন, তা থেকে তখনও ফসল কাটার মতো তৈরি হয়নি। (মথি ১৩:৩৮) গ্রু, স্টর্স এবং অন্যান্যরা শস্য কাটার আগে ‘ক্ষেত্রে’ কাজ করেছিলেন।

চার্লস টেইজ রাসেল ১৮৭৯ সাল থেকে এই পত্রিকা ছাপাতে শুরু করেছিলেন আর প্রথম দিকের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন: “প্রভু তাঁর বাক্য অধ্যয়ন করার জন্য আমাদের অনেক সাহায্যকারী দিয়েছেন, যার মধ্যে আমাদের প্রিয় ও বয়স্ক ভাই জর্জ স্টর্সের নাম খুবই উল্লেখযোগ্য। তিনি তার মুখের কথা ও লেখার মাধ্যমে আমাদের অনেক সাহায্য জুগিয়েছেন; কিন্তু আমরা মানুষকে নয় বরং ‘প্রিয় সন্তানের মতো ঈশ্বরকে অনুসরণ’ করার সংকল্প নিয়েছি কারণ তা করাই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক ও বিজ্ঞতার কাজ।” হ্যাঁ, ভাল মনের বাইবেল ছাত্ররা গ্রু ও স্টর্সের আন্তরিক চেষ্টা থেকে উপকার পেয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু সত্যের প্রকৃত উৎস, ঈশ্বরের বাক্য বাইবেল পরীক্ষা করাও তাদের জন্য জরুরি বিষয় ছিল।—যোহন ১৭:১৭.

[২৬ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]

হেনরি গ্রু যা বিশ্বাস করতেন

যিহোবার নামের ওপর নিন্দা নিয়ে আসা হয়েছে আর তাই এই নামকে পবিত্র করতে হবে।

ত্রিত্ব, আত্মার অমরত্ব এবং নরকাগ্নির শিক্ষা ভুল।

খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীকে অবশ্যই জগৎ থেকে আলাদা থাকতে হবে।

খ্রীষ্টানদেরকে যুদ্ধ থেকে আলাদা থাকতে হবে।

খ্রীষ্টানদের শনিবার বা রবিবারকে বিশ্রামবার হিসেবে মানার দরকার নেই।

ফ্রিম্যাসনদের মতো খ্রীষ্টানদের গুপ্ত সমাজের সদস্য হওয়া উচিত নয়।

খ্রীষ্টানদের মধ্যে কোন পাদ্রি বা যাজক শ্রেণী থাকা উচিত নয়।

বিভিন্ন ধর্মীয় উপাধি যীশু খ্রীষ্টের শিক্ষার বিপরীত।

সমস্ত মণ্ডলীতে প্রাচীন গোষ্ঠী থাকা উচিত।

প্রাচীনদের সমস্ত কাজে অনিন্দনীয় এবং শুচি হওয়া দরকার।

সমস্ত খ্রীষ্টানদের সুসমাচার প্রচার করতে হবে।

কিছু লোকেরা পরমদেশ পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে।

যিহোবা ও যীশু খ্রীষ্টের উদ্দেশে খ্রীষ্টানদের প্রশংসা গান করা উচিত।

[সৌজন্যে]

ফটো: Collection of The New-York Historical Society/৬৯২৮৮

[২৮ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]

জর্জ স্টর্স যা বিশ্বাস করতেন

যীশু তাঁর জীবনকে মানুষদের জন্য মুক্তির মূল্য হিসেবে দিয়েছিলেন।

সারা পৃথিবীতে এখনও (১৮৭১) সুসমাচার প্রচার করা হয়নি।

সেইজন্য, তখনও (১৮৭১) শেষ আসতে পারে না। সামনে এমন এক সময় আসবে যখন প্রচার কাজ করা হবে।

কিছু লোকেরা পৃথিবীতে অনন্ত জীবন লাভ করবে।

যারা সত্য না জেনে মারা গেছেন তাদের পুনরুত্থান হবে। যারা খ্রীষ্টের মুক্তির মূল্যকে স্বীকার করবে তারা পৃথিবীতে অনন্ত জীবন পাবে। যারা এটাকে মেনে না নেবে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।

আত্মার অমরত্ব ও নরকাগ্নির শিক্ষা ভুল আর তা ঈশ্বরকে অসম্মান করে।

প্রতি বছর শুধু ১৪ই নিশান প্রভুর সান্ধ্যভোজ উদ্‌যাপন করা উচিত।

[সৌজন্যে]

ফটো: SIX SERMONS, by George Storrs (১৮৫৫)

[২৯ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

১৯০৯ সালে “জায়ন্স ওয়াচ টাওয়ার” এর সম্পাদক সি. টি. রাসেল যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে চলে যান