সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

যিহোবাকে সেবা করতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ

যিহোবাকে সেবা করতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ

জীবন কাহিনী

যিহোবাকে সেবা করতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ

বলেছেন রাইমো কোওকেনেন

১৯৩৯ সালে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় আর সোভিয়েত ইউনিয়ন আমার দেশ ফিনল্যান্ডকে আক্রমণ করে। আমার বাবা ফিনিশ সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যান। শীঘ্রই রুশ যুদ্ধবিমানগুলো আমরা যে-শহরে থাকতাম, সেখানে বোমা ফেলতে থাকে আর আমার মা আমাকে আমার দিদিমার সঙ্গে নিরাপদ জায়গায় থাকার জন্য পাঠিয়ে দেন।

 আমি ১৯৭১ সালে পূর্ব আফ্রিকার উগান্ডায় একজন মিশনারি হিসেবে সেবা করছিলাম। একদিন ঘরে ঘরে প্রচার করার সময় আতঙ্কিত অনেক লোক আমার পাশ দিয়ে দৌড়ে যায়। আমি গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাই এবং ঘরের দিকে ছুটতে শুরু করি। যেহেতু গোলাগুলির আওয়াজ আরও তীব্র হচ্ছিল, তাই আমি রাস্তার পাশের একটা নালায় ঝাঁপ দিই। আমার মাথার ওপর দিয়ে গুলি ছোঁড়া হচ্ছিল আর আমি হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে পৌঁছাই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবগুলো এড়ানোর জন্য আমি বলতে গেলে কিছুই করতে পারিনি কিন্তু কেন আমার স্ত্রী ও আমি পূর্ব আফ্রিকার অস্থির পরিবেশে স্বেচ্ছায় নিজেদেরকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছিলাম? এর উত্তরের সঙ্গে যিহোবাকে সেবা করতে আমাদের দৃঢ়সংকল্প ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

দৃঢ়সংকল্পের এক বীজ বপন করা হয়

১৯৩৪ সালে ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে আমার জন্ম হয়। আমার বাবা একজন রং মিস্ত্রি ছিলেন আর সেই কারণে তাকে একদিন ফিনল্যান্ডে যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিসের বিল্ডিং রং করার জন্য যেতে হয়েছিল। সাক্ষিরা তাকে তাদের মণ্ডলীর সভাগুলো সম্বন্ধে বলে। তিনি ঘরে ফিরে মাকে সেই সভাগুলোর বিষয়ে বলেন। সেই সময়ে মা সভাতে যোগ দিতে শুরু করেননি কিন্তু পরে মা তার একজন সাক্ষি সহকর্মীর সঙ্গে বাইবেলের বিষয়ে আলোচনা করতে শুরু করেন। মা যা শিখেছিলেন, শীঘ্রই তিনি সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেন এবং ১৯৪০ সালে বাপ্তিস্ম নিয়ে তিনি একজন যিহোবার সাক্ষি হন।

এর কয়েক দিন আগেই আমার দিদিমা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আমাকে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। আমার মা হেলসিংকি থেকে চিঠিতে দিদিমা ও ছোট মাসিকে যিহোবার সাক্ষিদের বিভিন্ন বিশ্বাস সম্বন্ধে লিখতেন। তারা দুজনেই আগ্রহ দেখায় আর যা শিখত সেগুলো আমাকেও জানাত। যিহোবার সাক্ষিদের ভ্রমণ প্রতিনিধিরা দিদিমার বাড়িতে আসে এবং আমাদের উৎসাহিত করে কিন্তু তখনও পর্যন্ত ঈশ্বরকে সেবা করতে আমি দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হইনি।

ঈশতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ শুরু

১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হলে, আমি হেলসিংকিতে ফিরে আসি আর মা আমাকে যিহোবার সাক্ষিদের সভাগুলোতে নিয়ে যেতে শুরু করেন। মাঝে মাঝে আমি সভায় না গিয়ে সিনেমা দেখতে যেতাম। কিন্তু মা সভায় যে-বক্তৃতা শুনতেন, আমাকে সেই বিষয়ে বলতেন আর বার বার আমার কাছে একটা বিষয় সম্বন্ধে জোর দিতেন: আরমাগিদোন খুবই কাছে। আমিও তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং সভায় অনুপস্থিত থাকা বন্ধ করি। বাইবেলের সত্যের প্রতি আমার উপলব্ধিবোধ যতই বৃদ্ধি পায়, মণ্ডলীর সমস্ত কাজে অংশ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষাও ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে।

আমি বিশেষভাবে সম্মেলনগুলোতে যোগ দেওয়া উপভোগ করতাম। ১৯৪৮ সালে আমি আমার দিদিমার বাড়ির কাছাকাছি অনুষ্ঠিত একটা জেলা সম্মেলনে যোগ দিই, যেখানে সেই সময়ে আমি গ্রীষ্মের ছুটি কাটাচ্ছিলাম। আমার একজন বন্ধু সেই সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নিতে যাচ্ছিল আর সে আমাকেও বাপ্তিস্ম নিতে আমন্ত্রণ জানায়। আমি তাকে বলি যে, আমি কোনো সাঁতারের পোশাক নিয়ে আসিনি কিন্তু সে আমাকে বলে যে, তার বাপ্তিস্মের পর আমি তার পোশাকটা ব্যবহার করতে পারব। আমি এতে রাজি হই আর ১৯৪৮ সালের ২৭শে জুন, ১৩ বছর বয়সে আমি বাপ্তিস্ম নিই।

সম্মেলনের পর আমার মায়ের কয়েক জন বন্ধু তাকে জানায় যে, আমি বাপ্তিস্ম নিয়েছি। এরপর তার সঙ্গে যখন আমার দেখা হয়, তখন তিনি জানতে চান যে, কেন আমি তার সঙ্গে আলোচনা না করেই এই ধরনের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছি। আমি ব্যাখ্যা করি যে, বাইবেলের মৌলিক শিক্ষাগুলো আমি বুঝি আর এও জানি যে, আমার আচরণের জন্য আমিই যিহোবার কাছে দায়বদ্ধ।

আমার দৃঢ়সংকল্প গড়ে ওঠে

যিহোবাকে সেবা করার জন্য আমার দৃঢ়সংকল্পকে শক্তিশালী করতে মণ্ডলীর ভাইয়েরা আমাকে সাহায্য করেছিল। তারা আমার সঙ্গে ঘরে ঘরে পরিচর্যায় যেত এবং প্রায় প্রতি সপ্তাহে সভাগুলোতে আমাকে বক্তৃতা দেওয়ার দায়িত্ব দিত। (প্রেরিত ২০:২০) ১৬ বছর বয়সে আমি প্রথম জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতা দিই। খুব শীঘ্রই আমাকে মণ্ডলীর বাইবেল অধ্যয়ন পরিচারক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। সেই সমস্ত আধ্যাত্মিক কাজকর্ম আমাকে পরিপক্ব হতে সাহায্য করেছিল কিন্তু তখনও পর্যন্ত আমার লোকভয় কাটিয়ে ওঠার দরকার ছিল।

সেই সময়ে আমরা জেলা সম্মেলনের জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতার বিষয়বস্তু প্ল্যাকার্ডের মধ্যে বড় বড় হরফে লিখে ঘোষণা করতাম। দুটো প্ল্যাকার্ডের মধ্যে এটা লেখা হতো, যেগুলো ফিতা দিয়ে সংযুক্ত করে একজন ব্যক্তির কাঁধের ওপর দিয়ে এমনভাবে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো যে সেটা তার শরীরের সামনের ও পিছনের দিক ঢেকে রাখত। এই কারণে কিছু লোক আমাদের স্যান্ডউইচ ম্যান বলে ডাকত।

একবার যখন আমি সেই প্ল্যাকার্ড পরিহিত অবস্থায় এক নিরিবিলি রাস্তার কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন আমি দেখতে পাই যে আমার কয়েক জন সহপাঠী আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের চাহনি দেখে আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে যাই। আমি যিহোবার কাছে সাহস চেয়ে প্রার্থনা করি এবং সেই প্ল্যাকার্ড নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকি। সেই সময়ে লোকভয় কাটিয়ে ওঠা আমাকে খ্রিস্টীয় নিরপেক্ষতা বজায় রাখার মতো আরও বড় পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করেছিল।

এর কিছু সময় পর, সরকার আমাকে এবং আরও কয়েক জন যুবক সাক্ষিকে সেনাবাহিনীর কাজে যোগ দেওয়ার আদেশ দেয়। আমরা আদেশ অনুযায়ী সেনানিবাসে যাই কিন্তু আমরা সম্মানপূর্বক সামরিক পোশাক পরা প্রত্যাখ্যান করি। কর্মকর্তারা আমাদের হাজতে ভরে রাখে এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা আদালত আমাদের ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়। এ ছাড়া, সেনাবাহিনীর কাজের জন্য যে-আট মাস থাকতে হতো আমাদের সেই আট মাসও কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাই, আমাদের নিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে আমরা মোট ১৪ মাস কারাগারে ছিলাম।

কারাগারের মধ্যে আমরা প্রতিদিন বাইবেল নিয়ে আলোচনা করার জন্য একে অন্যের সঙ্গে দেখা করতাম। সেই মাসগুলোতে আমাদের মধ্যে অনেকেই দুবার পুরো বাইবেল পড়ে শেষ করেছিল। শাস্তি শেষ হওয়ার পর, আমাদের মধ্যে অধিকাংশই যিহোবাকে সেবা করতে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে এসেছিলাম। সেই যুবক সাক্ষি দলের অনেকেই আজ পর্যন্ত বিশ্বস্তভাবে যিহোবাকে সেবা করে যাচ্ছে।

কারাগার থেকে বের হয়ে আমি আমার বাবামার সঙ্গে থাকার জন্য ফিরে যাই। এর অল্প সময় পর, ভিরা নামে একজন উদ্যোগী, নতুন বাপ্তাইজিত সাক্ষির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ১৯৫৭ সালে আমরা বিয়ে করি।

এক সন্ধ্যা আমাদের জীবনকে পালটে দিয়েছিল

একদিন সন্ধ্যায় আমরা যখন শাখা অফিস থেকে আসা কয়েক জন দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলাম, তখন তাদের মধ্যে একজন আমাদের জিজ্ঞেস করেন যে, আমরা সীমার কাজ করতে চাই কি না। সারারাত প্রার্থনা করার পর আমি শাখা অফিসে ফোন করি এবং তা করব বলে জানাই। পূর্ণসময়ের পরিচর্যা গ্রহণ করার অর্থ ছিল, আমার ভাল বেতনের চাকরিটা ছেড়ে দেওয়া কিন্তু আমরা রাজ্যকে আমাদের জীবনে প্রথম স্থানে রাখতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। ১৯৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আমরা যখন ভ্রমণের কাজ শুরু করি, তখন আমার বয়স ছিল ২৩ বছর আর ভিরার বয়স ১৯ বছর। আমরা তিন বছর ধরে ফিনল্যান্ডে যিহোবার লোকেদের মণ্ডলীগুলোতে পরিদর্শনের ও উৎসাহদানের কাজ উপভোগ করি।

১৯৬০ সালের শেষের দিকে আমি নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অভ্‌ গিলিয়েড থেকে আমন্ত্রণ পাই। ফিনল্যান্ড থেকে আমাদের তিন জনকে শাখার কাজকর্ম পরিচালনায় প্রশিক্ষণ লাভের জন্য দশ মাসের এক বিশেষ কোর্সে যোগ দিতে হয়েছিল। আমাদের স্ত্রীরা আমাদের সঙ্গে যায়নি, তারা ফিনল্যান্ড শাখা অফিসেই কাজ করছিল।

কোর্স শেষ হওয়ার অল্প সময় আগে আমাকে নেথেন এইচ. নরের অফিসে দেখা করতে বলা হয়, যিনি সেই সময় বিশ্বব্যাপী যিহোবার সাক্ষিদের কাজের দেখাশোনা করছিলেন। ভাই নর আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে মালাগাসি রিপাবলিকে মিশনারি হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দেন, যে-জায়গা বর্তমানে মাদাগাস্কার নামে পরিচিত। ভিরা এই কার্যভারে রাজি কি না, তা জানতে চেয়ে আমি তার কাছে চিঠি লিখেছিলাম আর সে অবিলম্বে “হ্যাঁ” বলে উত্তর দেয়। আমি ফিনল্যান্ডে ফেরার পর, শীঘ্রই আমরা মাদাগাস্কারে থাকার জন্য তৈরি হয়েছিলাম।

আনন্দ ও হতাশা

১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসে আমরা প্লেনে করে, পশমের তৈরি টুপি ও ভারী কোট পরে সেই দেশের রাজধানী আ্যনটান্যানারিভোতে যাই কারণ আমরা যে-সময়ে ফিনল্যান্ড ছেড়ে যাই, তখন সেখানে শীতকাল ছিল। মাদাগাস্কারের গ্রীষ্মণ্ডলীয় তাপমাত্রার কারণে আমরা শীঘ্রই আমাদের পোশাক-আশাকের ধরন পালটাই। আমাদের প্রথম মিশনারি হোম ছিল একটা ছোট্ট বাড়ি, যেখানে কেবলমাত্র একটা শোবার ঘর ছিল। ইতিমধ্যেই সেখানে এক মিশনারি দম্পতি থাকত, তাই আমি ও ভিরা বারান্দায় ঘুমাতাম।

আমরা মাদাগাস্কারের একটা সরকারি ভাষা ফ্রেঞ্চ শিখতে শুরু করি। এটা বেশ কঠিন ছিল কারণ আমাদের দুজনের ভাষা এবং আমাদের শিক্ষিকা বোন ক্যারবনোর ভাষা এক ছিল না। আমাদের ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখানোর জন্য তিনি ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতেন কিন্তু ভিরা ইংরেজি বলতে পারত না। তাই, আমি ভিরার জন্য বোন ক্যারবনোর নির্দেশনা ফিনিশ ভাষায় অনুবাদ করতাম। এরপর আমরা বুঝতে পারি যে, ভিরা বিভিন্ন পারিভাষিক শব্দ সুইডিশ ভাষায় আরও ভাল বুঝতে পারে, তাই আমি তার কাছে ফ্রেঞ্চ ব্যাকরণ সুইডিশ ভাষায় ব্যাখ্যা করি। শীঘ্রই আমরা ফ্রেঞ্চ ভাষায় আরও উন্নতি করি এবং স্থানীয় ভাষা মালাগাসি শিখতে শুরু করি।

মাদাগাস্কারে প্রথমে আমি এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করি, যিনি শুধুমাত্র মালাগাসি ভাষায় কথা বলতেন। আমি প্রথমে আমার ফিনিশ ভাষার বাইবেলে পদগুলো দেখতাম আর তারপর আমরা সেই পদগুলো তার মালাগাসি ভাষার বাইবেল থেকে খুঁজতাম। আমি শাস্ত্র সম্বন্ধে তার কাছে তেমন একটা ব্যাখ্যা করতে পারতাম না কিন্তু শীঘ্রই সেই ব্যক্তি বাইবেলের সত্যগুলোকে হৃদয়ে নিতে শুরু করেন এবং বাপ্তিস্ম নেওয়ার মতো উন্নতি করেন।

১৯৬৩ সালে যিহোবার সাক্ষিদের ব্রুকলিন প্রধান কার্যালয় থেকে মিলটন হেনশেল মাদাগাস্কার পরিদর্শনে আসেন। এর অল্প সময় পরেই মাদাগাস্কারে একটি নতুন শাখা অফিস স্থাপন করা হয় আর সীমা ও ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে আমার কাজ পরিবর্তন করে আমাকে শাখা অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। যিহোবা সবসময় আমাদের প্রচুররূপে আশীর্বাদ করেছেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে মাদাগাস্কারে রাজ্য প্রকাশকের সংখ্যা বেড়ে ৮৫ থেকে ৪৬৯ জন হয়।

১৯৭০ সালে একদিন আমরা যখন জনসাধারণ্যে পরিচর্যা থেকে ফিরে আসি, তখন আমরা আমাদের দরজায় একটা চিরকুট দেখতে পাই, যেখানে সমস্ত যিহোবার সাক্ষি মিশনারিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেখা করতে বলা হয়েছিল। সেখানে একজন কর্মকর্তা আমাদের বলেন যে, সরকার আদেশ দিয়েছে আমরা যেন অবিলম্বে সেই দেশ ত্যাগ করি। আমি যখন জিজ্ঞেস করি যে, কোন অপরাধে আমাদের বিতাড়িত করা হচ্ছে, তখন সেই কর্মকর্তা বলেন: “মিস্টার কোওকেনেন, আপনাদের কোনো অপরাধ নেই।”

“আমরা এখানে আট বছর ধরে আছি,” আমি বলি। “এটাই আমাদের দেশ। আমরা এমনি এমনিই চলে যেতে পারি না।” আমাদের বিভিন্ন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্ত মিশনারিকে সেখান থেকে চলে যেতে হয়েছিল। সেই শাখা অফিস বন্ধ হয়ে যায় এবং স্থানীয় একজন সাক্ষি কাজ দেখাশোনা করতে শুরু করে। মাদাগাস্কারে আমাদের প্রিয় ভাইবোনদের ছেড়ে যাওয়ার আগে আমরা উগান্ডাতে আমাদের নতুন কার্যভার পাই।

নতুন কার্যভার শুরু করি

মাদাগাস্কার ছেড়ে যাওয়ার কিছুদিন পর আমরা উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় পৌঁছাই। আমরা অবিলম্বে লুগান্ডা ভাষা শিখতে শুরু করি, যে-ভাষাটা খুব সুন্দর ছন্দময় কিন্তু তা শেখা অত্যন্ত কঠিন। অন্য মিশনারিরা ভিরাকে প্রথমে ইংরেজি ভাষা শিখতে সাহায্য করে আর সেই ভাষাতে আমরা কার্যকারীভাবে প্রচার করতে সক্ষম হই।

কাম্পালার উষ্ণ, আর্দ্র জলবায়ু ভিরার স্বাস্থ্যের অনেক ক্ষতি করে। তাই, আমরা উগান্ডার এক শহর আ্যমবারারায় কার্যভার পাই, যেখানকার জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ ছিল। আমরাই ছিলাম সেখানকার প্রথম সাক্ষি আর পরিচর্যার প্রথম দিনেই আমরা অত্যন্ত উৎসাহজনক এক অভিজ্ঞতা লাভ করি। আমি যখন একজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন তার স্ত্রী রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসেন। তার নাম মার্গারেট এবং তিনি আমার উপস্থাপনা শোনেন। ভিরা, মার্গারেটের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করে আর তিনি চমৎকার আধ্যাত্মিক উন্নতি করেন। তিনি বাপ্তিস্ম নিয়ে একজন উদ্যোগী রাজ্য প্রকাশক হন।

স্তায় দাঙ্গা

১৯৭১ সালে উগান্ডায় গৃহযুদ্ধ আমাদের শান্তি নষ্ট করে। একদিন আ্যমবারারায় আমাদের মিশনারি হোমের কাছাকাছি লড়াই শুরু হয়ে যায়। সেই সময়ই আমি এই কাহিনীর শুরুতে বলা ঘটনার অভিজ্ঞতা লাভ করি।

সৈন্যদের কাছ থেকে লুকিয়ে একটা লম্বা নালার মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে আমি যখন মিশনারি হোমে পৌঁছাই, তখন ভিরা ইতিমধ্যেই সেখানে ছিল। আমরা ঘরের এক কোনায় কয়েকটা তোশক ও আসবাবপত্র দিয়ে একটা “দুর্গ” তৈরি করি। এক সপ্তাহ পর্যন্ত আমরা ঘরেই ছিলাম, রেডিওতে খবর শুনেছি। মাঝে মাঝে আমাদের দেয়ালে গুলি আঘাত করত, তখন আমরা ভয়ে আমাদের দুর্গে জড়সড় হয়ে থাকতাম। রাতের বেলা আমরা কোনো আলো জ্বালাতাম না, আমরা যে ঘরের মধ্যেই রয়েছি, তা বুঝতে দিতাম না। একদিন সৈন্যরা আমাদের সামনের দরজায় এসে চিৎকার করতে থাকে। আমরা কোনোরকম নড়াচড়া না করে নিঃশব্দে যিহোবার কাছে প্রার্থনা করতে থাকি। দাঙ্গা শেষ হওয়ার পর প্রতিবেশীরা আমাদের কাছে আসে এবং তাদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের ধন্যবাদ জানায়। তারা বিশ্বাস করেছিল যে, যিহোবাই আমাদের সকলকে রক্ষা করেছেন আর আমরাও তাদের সঙ্গে একমত হয়েছিলাম।

উগান্ডা সরকার যিহোবার সাক্ষিদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, একদিন সকালে রেডিওতে এই খবর শোনার আগে পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্তই ছিল। ঘোষক বলেন যে, সমস্ত যিহোবার সাক্ষির তাদের আগের ধর্মে ফিরে যাওয়া উচিত। আমি সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে এই বিষয়ে মামলার জন্য আবেদন করি কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এরপর আমি রাষ্ট্রপতি ইডি আমিনের কার্যালয়ে যাই এবং তার সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চাই। রিসেপশনিস্ট আমাকে জানান যে, রাষ্ট্রপতি ব্যস্ত। আমি অনেক বার সেখানে যাই কিন্তু কোনোদিনই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। শেষপর্যন্ত, ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে আমাদের উগান্ডা ছেড়ে চলে যেতে হয়।

এক বছরের জায়গায় দশ বছর

মাদাগাস্কার থেকে বের করে দেওয়ায় যে-দুঃখ আমরা পেয়েছিলাম, উগান্ডার প্রিয় ভাইবোনদের ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ও আমাদের একই অনুভূতি হয়। সেনেগালে আমাদের নতুন কার্যভারে যাওয়ার আগে আমরা ফিনল্যান্ডে যাই। সেখানে যাওয়ার পর আফ্রিকায় আমাদের কার্যভার বাতিল করা হয় আর আমাদের ফিনল্যান্ডেই থাকতে বলা হয়। মিশনারি হিসেবে, আমাদের সেবা করার সুযোগ শেষ হয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়েছিল। ফিনল্যান্ডে আমরা বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করি আর তারপর আবারও সীমার কাজ করি।

১৯৯০ সালে মাদাগাস্কারে বিরোধিতা কমে যায় আর ব্রুকলিনের প্রধান কার্যালয় থেকে যখন আমাদের জিজ্ঞেস করা হয় যে, এক বছরের জন্য সেখানে কাজ করব কি না, তখন আমরা অনেক অবাক হয়ে যাই। আমরা সেখানে যেতে চাই কিন্তু আমরা দুটো বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হচ্ছিলাম। আমার বয়স্ক বাবার যত্ন নেওয়া দরকার ছিল আর ভিরাও একটার পর একটা স্বাস্থ্যগত সমস্যা ভোগ করছিল। ১৯৯০ সালের নভেম্বর মাসে আমার বাবার মৃত্যুতে আমি অনেক বিষণ্ণ হয়ে পড়ি কিন্তু ভিরার স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে থাকে, যার ফলে আমরা মিশনারি কাজে ফিরে যাওয়ার আশা রাখি। ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমরা আবার মাদাগাস্কারে ফিরে যাই।

মাদাগাস্কারে আমাদের কার্যভার এক বছরের জন্য ছিল কিন্তু তা দশ বছরে পরিণত হয়। সেই সময়ের মধ্যে প্রকাশকের সংখ্যা ৪,০০০ থেকে বেড়ে ১১,৬০০ জন হয়। মিশনারি হিসেবে সেবা করার বিষয়টা আমি খুবই উপভোগ করেছি। কিন্তু, মাঝে মাঝে আমি নিরুৎসাহিত বোধ করতাম, ভাবতাম যে আমি আমার প্রিয় স্ত্রীর শারীরিক ও আবেগগত চাহিদাগুলোকে উপেক্ষা করছি কি না। যিহোবা আমাদের দুজনকেই কাজ চালিয়ে যাওয়ার শক্তি দিয়েছিলেন। অবশেষে, আমরা ২০০১ সালে ফিনল্যান্ডে ফিরে আসি এবং এখানেই শাখা অফিসে কাজ করছি। রাজ্যের জন্য আমাদের উদ্যোগ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে আর এখনও পর্যন্ত আমরা আফ্রিকার বিষয়ে চিন্তা করি। যিহোবা আমাদের যেখানেই নিযুক্ত করুন না কেন, আমরা তাঁর ইচ্ছা পালন করতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ।—যিশাইয় ৬:৮.

[১২ পৃষ্ঠার মানচিত্র]

(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)

ফিনল্যান্ড

ইউরোপ

[১৪ পৃষ্ঠার মানচিত্র]

(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)

আফ্রিকা

মাদাগাস্কার

[১৫ পৃষ্ঠার মানচিত্র]

(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)

আফ্রিকা

উগান্ডা

[১৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমাদের বিয়ের দিন

[১৪, ১৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

১৯৬০ সালে ফিনল্যান্ডে সীমার কাজ থেকে . . .

. . . ১৯৬২ সালে মাদাগাস্কারে মিশনারি কাজ পর্যন্ত

[১৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

বর্তমানে ভিরার সঙ্গে