সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

যিহোবার সাহায্যে আমরা একদলীয় শাসনতন্ত্রে রক্ষা পেয়েছিলাম

যিহোবার সাহায্যে আমরা একদলীয় শাসনতন্ত্রে রক্ষা পেয়েছিলাম

জীবনকাহিনি

যিহোবার সাহায্যে আমরা একদলীয় শাসনতন্ত্রে রক্ষা পেয়েছিলাম

বলেছেন হেনরিক ডরনিক

 উনিশশো ছাব্বিশ সালে আমার জন্ম হয় আর বাবামা ছিল ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক। তারা দক্ষিণ পোল্যান্ডের কাটোভিট্‌সা শহরের কাছে এক খনি এলাকা রুডা শ্লঁস্কায় থাকত। তারা আমাদের ভাইবোনদেরকে—আমার দাদা বারনার্ট; ছোট দুই বোন রুঝা ও এডিটা আর আমাকে—প্রার্থনা করতে, গির্জায় যেতে এবং পাপস্বীকার করতে শিখিয়েছিল।

বাইবেলের সত্য আমাদের বাড়িতে পৌঁছায়

১৯৩৭ সালের জানুয়ারি মাসে, আমার বয়স যখন দশ বছর, একদিন বাবা খুশিমনে বাড়ি ফিরে আসেন। তিনি যিহোবার সাক্ষিদের কাছ থেকে পাওয়া একটা বড়, মোটা বই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “দেখো, আমি কী নিয়ে এসেছি—পবিত্র শাস্ত্র!” এর আগে আমি কখনো বাইবেল দেখিনি।

রুডা শ্লঁসকা ও এর আশেপাশের এলাকার লোকেদের ওপর ক্যাথলিক গির্জা দীর্ঘদিন ধরে বেশ জোরালো প্রভাব বিস্তার করে এসেছিল। খনি মালিকদের সঙ্গে পাদরিদের খুব বন্ধুত্ব ছিল এবং খনিশ্রমিক ও তাদের পরিবারের কাছ থেকে তারা নিঃশর্ত বাধ্যতা দাবি করেছিল। একজন খনিশ্রমিক যদি মাস্‌-এ যোগদান না করতেন বা পাপস্বীকার করতে না চাইতেন, তা হলে তাকে একজন বিধর্মী বলে বিবেচনা করা হতো আর খনি থেকে বরখাস্ত করার জন্য চিহ্নিত করা হতো। শীঘ্রই বাবাকেও একই হুমকি দেওয়া হয়েছিল কারণ তিনি যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে মেলামেশা করছিলেন। কিন্তু, একজন যাজক যখন আমাদের বাড়িতে আসেন, তখন বাবা সকলের সামনে তার ধর্মীয় কপটতাকে প্রকাশ করে দেন। অপ্রস্তুত হয়ে পড়া যাজক আর কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাননি বলে বাবাকে বরখাস্ত করা হয়নি।

সেই যাজকের সামনে সাক্ষ্য দেওয়া আমার বাইবেল জানার সংকল্পকে আরও দৃঢ় করেছিল। আমি ধীরে ধীরে যিহোবাকে ভালবাসতে শুরু করি এবং তাঁর সঙ্গে এক ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলি। সেই যাজকের সঙ্গে বাবার কথা হওয়ার অল্প কয়েক মাস পর, আমরা খ্রিস্টের মৃত্যুর স্মরণার্থ সভায় যোগ দিয়েছিলাম, যেখানে বাবাকে ৩০ জনের একটা দলের সামনে এই বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল, “ইনি হলেন একজন যিহোনাদব।” শীঘ্রই আমি শিখেছিলাম যে, “যিহোনাদবরা” ছিল সেই খ্রিস্টান, যাদের পার্থিব আশা রয়েছে আর তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। *২ রাজাবলি ১০:১৫-১৭.

“তুমি কি জানো বাপ্তিস্মের অর্থ কী?”

সত্য গ্রহণ করার পর, বাবা মদ খাওয়া ছেড়ে দেন এবং একজন উত্তম স্বামী ও বাবা হয়ে ওঠেন। তা সত্ত্বেও, বাবার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে মা মেনে নেননি আর তিনি প্রায়ই বলতেন যে, তিনি খুশি হবেন, যদি বাবা আগের মতো জীবনযাপন করেন ও একজন ক্যাথলিকই থাকেন। কিন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, তিনি লক্ষ করেন যে, জার্মানির ওপর পোল্যান্ডের জয়লাভের জন্য যে-পাদরিরা প্রার্থনা করেছিল, তারাই এখন হিটলারের সাফল্যের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে প্রার্থনা করছে! পরে, ১৯৪১ সালে মা যিহোবাকে সেবা করার জন্য আমাদের বাকি চারজনের সঙ্গে যোগ দেন।

তার আগে, আমি ঈশ্বরের কাছে আমার উৎসর্গীকরণের চিহ্ন হিসেবে জলে বাপ্তিস্ম নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলাম কিন্তু মণ্ডলীর প্রাচীনরা মনে করেছিল যে, আমি তখনও বেশ ছোট ছিলাম। তারা আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত, ১৯৪০ সালের ১০ই ডিসেম্বর, একটা ছোট আ্যপার্টমেন্টে কনরেট গ্র্যাবোভি (একজন ভাই, যিনি বিশ্বস্ত থেকে পরবর্তী সময়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মারা গিয়েছিলেন) খুব সতর্কতার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তিনি আমাকে পাঁচটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলেন আর আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হওয়ায় আমাকে বাপ্তিস্ম দিয়েছিলেন। তার প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটা ছিল, “তুমি কি জানো বাপ্তিস্মের অর্থ কী?” আরেকটা ছিল, “তুমি কি জানো যে, এখন যেহেতু যুদ্ধ চলছে, তাই তোমাকে শীঘ্রই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তুমি কি হিটলারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে নাকি যিহোবার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে আর তোমার সিদ্ধান্তের জন্য হয়তো তোমাকে মৃত্যুবরণও করতে হতে পারে?” নির্দ্বিধায় আমি উত্তর দিয়েছিলাম, “আমি জানি।”

তাড়না শুরু হয়

কনরেট গ্র্যাবোভি কেন এই ধরনের প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করেছিলেন? জার্মান সৈন্যরা ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ড আক্রমণ করেছিল আর সেটার পর আমাদের বিশ্বাস এবং নীতিনিষ্ঠা অত্যন্ত কঠোরভাবে পরীক্ষিত হয়েছিল। দিন দিন পরিস্থিতি আরও উদ্বেগপূর্ণ হয়ে ওঠে, যখন আমরা শুনতে পাই যে, আমাদের খ্রিস্টান ভাইবোনদেরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, নির্বাসিত করা হচ্ছে এবং কারাগার বা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে পাঠানো হচ্ছে। শীঘ্রই আমাদেরও একইরকম পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে।

নাৎসিরা তরুণ প্রজন্মকে—এর মধ্যে আমাদের চার ভাইবোনকেও—নাৎসি শাসনের উদ্যোগী সমর্থক করে তুলতে চেয়েছিল। যেহেতু বাবামা বেশ কয়েকবার ফকলিস্ট-এ (সেই লোকেদের তালিকা, যাদের জার্মান নাগরিকত্ব ছিল বা যারা তা পেতে চেয়েছিল) সই করতে অস্বীকার করেছিল, তাই তাদেরকে আমাদের ভাইবোনদেরকে মানুষ করে তোলার আইনগত অধিকার দেওয়া হয়নি। বাবাকে আউশভিটস্‌ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল। ১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাকে ও আমার দাদাকে নিইসার কাছে অবস্থিত গ্রডকুভের একটা সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছিল আর আমার বোনদেরকে ওপোলের কাছে অবস্থিত চারনোভংসির (ক্লোসটারব্রুক) একটা ক্যাথলিক কনভেন্টে পাঠানো হয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমাদেরকে দিয়ে কর্তৃপক্ষদের কথা অনুসারে “আমাদের বাবামার ভ্রান্ত মতামতকে” প্রত্যাখ্যান করানো। মাকে ঘরে একা রেখে আসা হয়েছিল।

প্রত্যেকদিন সকালে সেই সংশোধনাগারের মাঠে, স্বস্তিকা (নাৎসিবাদের প্রতীক) চিহ্নযুক্ত পতাকা উত্তোলন করা হতো আর আমাদেরকে আমাদের ডান হাত তুলে “হাইল হিটলার” বলে পতাকাকে অভিবাদন করার আদেশ দেওয়া হতো। এটা বিশ্বাসের এক কঠিন পরীক্ষা ছিল কিন্তু বারনার্ট আর আমি আপোশ না করার বিষয়ে দৃঢ় ছিলাম। এর ফলে, আমাদের “অসম্মানজনক” আচরণের কারণে প্রচণ্ড মারধর করা হয়েছিল। এরপর আমাদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়, তাই এসএস রক্ষীরা শেষ পর্যন্ত আমাদের সামনে একটা চূড়ান্ত শর্ত রাখে, “হয় তোমরা জার্মান সরকারের প্রতি তোমাদের আনুগত্য ঘোষণা করে সই করবে ও ভ্যারমাখ্‌তে [জার্মান সৈন্যবাহিনী] যোগ দেবে নতুবা তোমাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে।”

১৯৪৪ সালের আগস্ট মাসে, যখন কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারিভাবে সুপারিশ করেছিল, তখন তারা বলেছিল: “তাদেরকে দিয়ে কোনোকিছু করানো অসম্ভব। তারা শহীদ হয়ে আনন্দ পায়। তাদের বিদ্রোহী অবস্থান পুরো সংশোধনাগারের জন্যই হুমকিস্বরূপ।” যদিও আমার শহীদ হওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না, তবুও যিহোবার প্রতি আমার আনুগত্যের কারণে সাহস ও মর্যাদার সঙ্গে কষ্টভোগ করে আমি আনন্দিত ছিলাম। (প্রেরিত ৫:৪১) আমি যে-কষ্টের মুখোমুখি হতে যাচ্ছিলাম, তা আমি কখনোই নিজের শক্তিতে সহ্য করতে পারতাম না। অন্যদিকে, আন্তরিক প্রার্থনাগুলো আমাকে যিহোবার নিকটবর্তী করেছিল আর এইভাবে তিনি আমার কাছে একজন নির্ভরযোগ্য সহায় বলে প্রমাণিত হয়েছিলেন।—ইব্রীয় ১৩:৬, NW.

কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে

শীঘ্রই আমাকে সাইলিশিয়ার গ্রোস-রোজেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বন্দি হিসেবে আমাকে একটা নম্বর ও একজন যিহোবার সাক্ষি হিসেবে শনাক্ত করার জন্য একটা বেগুনি ত্রিভুজ দেওয়া হয়েছিল। এসএস রক্ষীরা আমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিল। একটা শর্তে আমি ক্যাম্প থেকে মুক্ত হতে পারি ও এমনকি নাৎসি সৈন্যবাহিনীর একজন অফিসারও হতে পারি। “তোমাকে অবশ্যই বাইবেল ছাত্রদের সেইসমস্ত ধারণাকে পরিত্যাগ করতে, হবে যেগুলো নাৎসি শাসনের বিপরীত।” অন্য কোনো বন্দিকে এইরকম লোভনীয় প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র যিহোবার সাক্ষিদেরকেই সেই ক্যাম্পগুলো থেকে বাইরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তবুও, আমি—আরও হাজার হাজার সাক্ষিদের মতো—দৃঢ়তার সঙ্গে সেই “সুযোগ” প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। রক্ষীরা বলেছিল: “ওই শবদাহের চুল্লির দিকে একটু ভাল করে দেখো। আবারও ভাল করে ভেবে দেখো, তা না হলে ওই চুল্লির দ্বারাই তুমি মুক্তি পাবে।” আমি আবারও দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম আর সেই মুহূর্তে আমি “সমস্ত চিন্তার অতীত . . . ঈশ্বরের শান্তি” দ্বারা পূর্ণ হয়েছিলাম।—ফিলিপীয় ৪:৬, ৭.

আমি প্রার্থনা করেছিলাম যেন ক্যম্পের সহবিশ্বাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি আর যিহোবা তা সম্ভবপর করেছিলেন। সেই সহখ্রিস্টানদের মধ্যে একজন বিশ্বস্ত ভাইয়ের নাম ছিল গুসটাফ বমার্ট, যিনি কোমলভাবে ও প্রেমের সঙ্গে আমার যত্ন নিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে, যিহোবা আমার কাছে “করুণা-সমষ্টির পিতা এবং সমস্ত সান্ত্বনার ঈশ্বর” বলে প্রমাণিত হয়েছিলেন।—২ করিন্থীয় ১:৩.

অল্প কয়েক মাস পরে, এগিয়ে আসা রুশ সৈন্যবাহিনী, নাৎসিবাহিনীকে দ্রুত ক্যাম্প খালি করে দিতে বাধ্য করেছিল। আমরা যখন চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, সেই সময় আমরা ভাইয়েরা—আমাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে—মহিলাদের ব্যারাকগুলোতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং আমাদের প্রায় ২০ জন আধ্যাত্মিক বোনের—তাদের মধ্যে এল্জা আ্যপ্টের ও গেটরুট অটের—অবস্থার খোঁজ নিয়েছিলাম। * আমাদেরকে দেখামাত্র, তারা তাড়াতাড়ি আমাদের কাছে ছুটে এসেছিল এবং অল্প কিছু উৎসাহমূলক কথাবার্তা বলার পর তারা একসঙ্গে রাজ্যের গান গাইতে শুরু করেছিল, যেটার মধ্যে এই কথাগুলো রয়েছে: “বিশ্বস্ত ব্যক্তি যে-কিনা ভক্ত, ভয়ে সে সঁপে না প্রাণ।” * আমাদের সকলের চোখে জল এসে গিয়েছিল!

পরবর্তী ক্যাম্পে

নাৎসিরা ১০০ থেকে ১৫০ জন বন্দিকে কোনো খাবার বা জল ছাড়াই কয়লা নিয়ে যাওয়ার একটা খালি বগিতে ঠাসাঠাসি করে উঠিয়ে দিয়েছিল আর আমরা তুষারপাত এবং প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বৃষ্টিপাতের মধ্যে দিয়ে যাত্রা করেছিলাম। আমরা পিপাসায় ও জ্বরে কষ্ট পেয়েছিলাম। অসুস্থ ও ক্লান্ত বন্দিরা যখন অজ্ঞান হচ্ছিল ও মারা যাচ্ছিল, তখন সেই বগিগুলোতে ভিড় কমে গিয়েছিল। আমার পা আর গাঁটগুলো এতটাই ফুলে গিয়েছিল যে, আমি এমনকি দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিলাম না। দশদিন ধরে যাত্রা করার পর, হাতেগোনা মাত্র কয়েক জন বন্দি যারা বেঁচে গিয়েছিল, তারা থুরিনজিয়ার ওয়াইমারের কাছে অবস্থিত নর্টহাউজেনের মিটিলবাউডোরা বন্দিশিবিরে এসে পৌঁছেছিল। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সেই ভয়ংকর যাত্রার সময় একজন ভাইও মারা যাননি।

সেই যাত্রার ধকল সামলাতে না সামলাতেই ক্যাম্পের মধ্যে আমাশয় রোগের প্রকোপ দেখা দেয় আর আমি ও বেশ কিছু ভাই অসুস্থ হয়ে পড়ি। ক্যাম্পে যে-সুপ দেওয়া হতো, আমাদেরকে কিছুদিনের জন্য তা খেতে নিষেধ করা হয়েছিল আর শুধুমাত্র সেঁকা মচমচে রুটি খেতে বলা হয়েছিল। আমি তা করি ও শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠি। ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে আমরা সেই বছরের শাস্ত্রপদটা শুনি, সেটা ছিল মথি ২৮:১৯: “অতএব তোমরা গিয়া সমুদয় জাতিকে শিষ্য কর।” (মথি ২৮:১৯) স্পষ্টতই, শীঘ্রই ক্যাম্পগুলোর দ্বার খুলে যাবে ও সুসমাচার ক্রমাগত প্রচারিত হবে! সেটা আমাদের আনন্দ ও আশায় পূর্ণ করেছিল কারণ আমরা ভেবেছিলাম যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শীঘ্রই হর্‌মাগিদোনের মাধ্যমে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাবে। কী চমৎকারভাবেই না যিহোবা আমাদেরকে সেই কঠিন সময়গুলোর মধ্যে শক্তি জুগিয়েছিলেন!

ক্যাম্পগুলো থেকে মুক্তি

১৯৪৫ সালের ১লা এপ্রিল, মিত্রবাহিনী এসএস ব্যারাকে এবং আমাদের কাছাকাছি শিবিরে বোমাবর্ষণ করেছিল। অনেকেই নিহত বা আহত হয়েছিল। পরদিন, আমাদের ওপর প্রচুর বোমাবর্ষণ করা হয়েছিল এবং সেই আক্রমণের সময় এক শক্তিশালী বোমার আঘাতে আমার শরীর বাতাসে ছিটকে গিয়েছিল।

ফ্রিট্‌জ উলরিখ নামে একজন ভাই আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। আমি হয়তো তখনও বেঁচে আছি এই আশায় তিনি ধ্বংসস্তুপ খুঁড়তে থাকেন। শেষ পর্যন্ত, তিনি আমাকে খুঁজে পান আর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে টেনে বের করেন। যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসে, তখন আমি বুঝতে পারি যে, আমার মুখে ও শরীরে আমি গুরুতরভাবে আঘাত পেয়েছি আর আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড আওয়াজে আমার কানের পর্দা ফেটে গিয়েছিল। অনেক বছর ধরে আমার কানে গুরুতর সমস্যা ছিল, তবে শেষপর্যন্ত তা ভাল হয়েছে।

হাজার হাজার বন্দির মধ্যে মাত্র অল্প কয়েকজন সেই বোমাবর্ষণ থেকে বেঁচে গিয়েছিল। আমাদের কয়েকজন ভাই মারা গিয়েছিল, যাদের মধ্যে প্রিয় ভাই গুসটাফ বমার্টও ছিলেন। আমার শরীরে যে-ক্ষত হয়েছিল, তাতে ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল এবং সঙ্গে প্রচণ্ড জ্বর হয়েছিল। কিন্তু, শীঘ্রই আমাদের খুঁজে বের করা হয়েছিল ও মিত্রবাহিনীর দ্বারা আমরা মুক্ত হয়েছিলাম। এর মধ্যে, মৃত বা নিহত বন্দিদের পচে যাওয়া দেহগুলো থেকে টাইফাস রোগের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছিল, যা আমারও হয়েছিল। আমাকে অন্যান্য অসুস্থ বন্দির সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। চিকিৎসকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, আমাদের মধ্যে মাত্র তিনজন রক্ষা পেয়েছিল। আমি কতই না কৃতজ্ঞ ছিলাম যে, যিহোবা আমাকে সেই কষ্টকর সময়ের মধ্যেও বিশ্বস্ত থাকতে শক্তিশালী করেছিলেন! আমি এইজন্যও কৃতজ্ঞ ছিলাম যে, যিহোবা আমাকে ‘মৃত্যুচ্ছায়া’ থেকে উদ্ধার করাকে উপযুক্ত মনে করেছেন।—গীতসংহিতা ২৩:৪.

অবশেষে বাড়িতে!

জার্মানি আত্মসমর্পণ করার পর, আমি আশা করেছিলাম যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি বাড়ি ফিরে আসব কিন্তু আমি যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়েও তা বেশি কঠিন বলে প্রমাণিত হয়েছিল। আমাকে কিছু প্রাক্তন বন্দি চিনে ফেলেছিল, যারা ক্যাথলিক আ্যকশন দলের সদস্য ছিল। তারা চিৎকার করে বলেছিল “ওকে মেরে ফেলো!” আর তারা আমাকে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে মাড়াতে শুরু করেছিল। একজন ব্যক্তি এগিয়ে এসে তাদের নিষ্ঠুরতার হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করেছিলেন কিন্তু আমার সেরে উঠতে অনেক সময় লেগেছিল কারণ আহত এবং টাইফাসের কারণে আমি খুবই দুর্বল বোধ করছিলাম। কিন্তু শেষপর্যন্ত, আমি বাড়ি যেতে পেরেছিলাম। আমার পরিবারের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হতে পেরে আমি কতই না খুশি হয়েছিলাম! আমাকে দেখে তারা খুবই রোমাঞ্চিত হয়েছিল, কারণ তারা ভেবেছিল যে আমি মরে গিয়েছি।

শীঘ্রই আমরা আবার প্রচার কাজ শুরু করেছিলাম এবং আন্তরিকভাবে সত্য খুঁজে চলেছে এমন অনেক ব্যক্তি ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছিল। আমাকে মণ্ডলীগুলোতে বাইবেল সাহিত্যাদি সরবরাহ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য ভাইয়ের সঙ্গে আমার ওয়াইমার শহরে জার্মান শাখা অফিস থেকে আসা কয়েক জন প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করার বিশেষ সুযোগ হয়েছিল আর সেখান থেকে আমরা পোল্যান্ডে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ছাপানো প্রহরীদুর্গ পত্রিকার একেবারে প্রথম সংখ্যাগুলো নিয়ে এসেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোকে অনুবাদ করা হয়েছিল, স্টেনসিল প্রস্তুত করা হয়েছিল এবং বিভিন্ন কপি ছাপানো হয়েছিল। লড্জে অবস্থিত আমাদের অফিস যখন পোল্যান্ডের কাজকর্ম পুরোপুরি দেখাশোনা করতে শুরু করেছিল, তখন বাইবেলভিত্তিক সাহিত্যাদি নিয়মিতভাবে মণ্ডলীগুলোতে পৌঁছাতে শুরু করেছিল। আমি একজন বিশেষ অগ্রগামী বা পূর্ণসময়ের সুসমাচার প্রচারক হিসেবে সাইলিশিয়ার বিশাল এলাকায় সেবা করতে শুরু করেছিলাম, যেটা সেই সময় পোল্যান্ডের অংশ ছিল।

কিন্তু, শীঘ্রই যিহোবার সাক্ষিদের আবারও তাড়না করা হয়েছিল, তবে এবার পোল্যান্ডের নবপ্রতিষ্ঠিত সাম্যবাদী শাসনতন্ত্রের দ্বারা। আমার খ্রিস্টীয় নিরপেক্ষতার কারণে ১৯৪৮ সালে, আমাকে দুবছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সেখানে থাকাকালীন, আমি অন্যান্য অনেক বন্দিকে ঈশ্বরের আরও নিকটবর্তী হতে সাহায্য করতে সমর্থ হয়েছিলাম। তাদের মধ্যে একজন সত্যের পক্ষ নিয়েছিলেন এবং পরে নিজেকে যিহোবার কাছে উৎসর্গ করেছিলেন ও বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন।

১৯৫২ সালে, আবার আমাকে জেলে পাঠানো হয়েছিল কিন্তু এই সময়ে আমাকে মিথ্যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল! আমার বিচারের জন্য অপেক্ষা করার সময়, আমাকে নির্জন কারাগারে রাখা হয়েছিল ও দিনরাত জেরা করা হয়েছিল। কিন্তু, আবারও যিহোবা আমাকে আমার তাড়নাকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন এবং তার পরের বছরগুলোতে আমি এই ধরনের আর কোনো খারাপ ব্যবহার ভোগ করিনি।

যা আমাকে সহ্য করতে সাহায্য করেছিল

এই ধরনের পরীক্ষা ও কষ্টকর বছরগুলোর কথা ভেবে আমি উৎসাহের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উৎসকে শনাক্ত করতে পারি। সর্বপ্রথম, যিহোবা ও তাঁর বাক্য বাইবেল থেকে সহ্য করার শক্তি পেয়েছিলাম। ‘সমস্ত সান্ত্বনার ঈশ্বরের’ প্রতি ক্রমাগত ঐকান্তিক বিনতি ও তাঁর বাক্য প্রতিদিন অধ্যয়ন করা আমাকে এবং অন্যদেরকে আধ্যাত্মিকভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছিল। হাতে-লেখা প্রহরীদুর্গ পত্রিকার কপিগুলোও অতি প্রয়োজনীয় আধ্যাত্মিক পুষ্টি জুগিয়েছিল। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে, আমি সেই যত্নশীল সহবিশ্বাসীদের দ্বারা প্রচুর শক্তি পেয়েছিলাম, যারা সাহায্য করতে প্রস্তুত ও ইচ্ছুক ছিল।

যিহোবার কাছ থেকে পাওয়া আরেকটা আশীর্বাদ ছিল আমার স্ত্রী মারিয়া। আমরা ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে বিয়ে করেছিলাম আর পরে আমাদের মেয়ে হেলিনার জন্ম হয়েছিল আর সে ছোট থেকেই যিহোবাকে ভালবেসেছে ও সেবা করেছে। মারিয়া ও আমি ৩৫ বছর বিবাহিত জীবন উপভোগ করেছি ও এরপর সে অসুস্থতার সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াই করে মারা গিয়েছে। তার মৃত্যু আমাকে শোক ও যন্ত্রণায় জর্জরিত করেছিল। যদিও কখনো কখনো আমার মনে হয় যে, আমি “অধঃক্ষিপ্ত” কিন্তু ‘আমি বিনষ্ট হই নাই।’ (২ করিন্থীয় ৪:৯) সেই কঠিন দিনগুলোতে আমি আমার প্রিয় মেয়ে, তার স্বামী এবং তাদের সন্তানদের—আমার নাতিনাতনিদের সাহচর্যে সমর্থন খুঁজে পেয়েছিলাম, যারা সকলেই বিশ্বস্তভাবে যিহোবার সেবা করছে।

১৯৯০ সাল থেকে আমি পোল্যান্ডের শাখা অফিসে সেবা করছি। এক চমৎকার বেথেল পরিবারের সঙ্গে রোজ মেলামেশা করতে পারা এক বিরাট আশীর্বাদ। মাঝে মাঝে আমার ক্রমেই অবনতির দিকে যাওয়া স্বাস্থ্য আমাকে এক দুর্বল ঈগলের মতো অনুভব করায়, যে কেবল ডানা ঝাঁপটাতে পারে। তা সত্ত্বেও, আমি আস্থা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকাই এবং আমি ‘সদাপ্রভুর উদ্দেশে গীত গাহি, কেননা তিনি’ আজ পর্যন্ত “আমার মঙ্গল করিয়াছেন।” (গীতসংহিতা ১৩:৬) আমি সেই সময়ের জন্য সানন্দে অপেক্ষা করে আছি, যখন আমার সহায় যিহোবা, শয়তানের পীড়নকর শাসনের কারণে ঘটা সমস্ত ক্ষতিকে দূর করবেন।

[পাদটীকাগুলো]

^ ১৯৯৮ সালের ১লা জানুয়ারি সংখ্যার প্রহরীদুর্গ পত্রিকার, ১৩ পৃষ্ঠার ৬ অনুচ্ছেদ দেখুন।

^ ১৯৮০ সালের ১৫ই এপ্রিল প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) পত্রিকার ১২-১৫ পৃষ্ঠায় এল্জা আ্যপ্টের জীবনকাহিনি দেখুন।

^ ১৯২৮ সালে যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত, যিহোবার উদ্দেশে প্রশংসা গীত (ইংরেজি) নামক গানবইয়ের গান সংখ্যা ১০১. বর্তমান গানবইয়ে এটির সংখ্যা হল ৫৬.

[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]

কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আমি এই নম্বর ও একটা বেগুনি ত্রিভুজ পেয়েছিলাম

[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৮০ সালে, আমার স্ত্রী মারিয়ার সঙ্গে