সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

“দেখুন, আমি যিহোবার দাসী”

“দেখুন, আমি যিহোবার দাসী”

তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন

“দেখুন, আমি যিহোবার দাসী”

 অতিথি তার গৃহে প্রবেশ করতেই মরিয়ম বড় বড় চোখ করে অবাক দৃষ্টিতে তাকান। অতিথি তার বাবা অথবা মা সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। তিনি তাকেই দেখতে এসেছেন! তিনি নাসরৎ থেকে হতে পারেন না; এই বিষয়ে মরিয়ম নিশ্চিত ছিলেন। তিনি যে-ছোট্ট শহরে বাস করতেন, সেখানে অপরিচিত ব্যক্তিরা সহজেই চোখে পড়ত। এই ব্যক্তি যেকোনো জায়গায়ই চোখে পড়ার মতো। মরিয়মের কাছে একেবারেই নতুন ছিল এমনভাবে সম্বোধন করে তিনি বলেন: “অয়ি মহানুগৃহীতে, মঙ্গল হউক; প্রভু [“যিহোবা,” NW] তোমার সহবর্ত্তী।”—লূক ১:২৮.

এভাবেই বাইবেল আমাদেরকে গালীলের নাসরৎ শহরের এলির কন্যা মরিয়মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বাইবেল মরিয়মকে তার জীবনের এমন এক সময়ে আমাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়, যখন তাকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতে হয়েছিল। তিনি সূত্রধর যোষেফকে—ধনী নন কিন্তু বিশ্বস্ত একজন ব্যক্তিকে—বিয়ে করার জন্য বাগ্‌দত্তা ছিলেন। তাই, তার জীবন যেন ইতিমধ্যেই পরিকল্পিত ছিল বলে মনে হয়েছিল আর তা হল যোষেফের স্ত্রী হিসেবে সহযোগিতা করার ও একত্রে তার সঙ্গে এক পরিবার গঠন করার এক সাধাসিধে জীবন। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি এই অতিথির মুখোমুখি হন, যিনি তার ঈশ্বরের কাছ থেকে তার জন্য এক কার্যভার নিয়ে এসেছিলেন, যে-দায়িত্ব তার জীবনকে বদলে দেবে।

আপনি হয়তো এটা জেনে অবাক হবেন যে, বাইবেল আমাদেরকে মরিয়ম সম্বন্ধে বেশি কিছু জানায় না। এটি তার পটভূমি ও তার ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে সামান্যই জানায় আর তার বাহ্যিক চেহারা সম্বন্ধে কিছুই জানায় না। তা সত্ত্বেও, তার সম্বন্ধে ঈশ্বরের বাক্য যা বলে, তা বাস্তবিকই যথেষ্ট।

মরিয়মের সঙ্গে পরিচিত হতে হলে, আমাদেরকে তার সম্বন্ধে বিভিন্ন ধর্মে ছড়িয়ে থাকা পূর্বকল্পিত ধারণাগুলোকে ছাড়িয়ে আরও বেশি কিছু দেখতে হবে। তাই, আসুন আমরা চিত্র, মার্বেল বা প্লাসটারে তুলে ধরা অগণিত “প্রতিকৃতি” আলোচনা করা থেকে দূরে থাকি। এ ছাড়া, আসুন আমরা সেই জটিল ঈশ্বরতত্ত্ববিদ্যা ও মতবাদগুলো আলোচনা করা থেকেও দূরে থাকি, যেগুলো এই সাধারণ নারীকে “ঈশ্বরের মা” এবং “স্বর্গের রানি” নামক বিভিন্ন উচ্চ উপাধিতে ভূষিত করেছে। এর পরিবর্তে, আসুন আমরা তার সম্বন্ধে প্রকৃতপক্ষে বাইবেল যা বলে, সেটার ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করি। এটি আমাদেরকে তার বিশ্বাস সম্বন্ধে এবং কীভাবে আমরা তা অনুকরণ করতে পারি, সেই বিষয়ে অতুলনীয় অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।

একজন স্বর্গদূতের সাক্ষাৎ

আপনি হয়তো জানেন যে, মরিয়মের অতিথি কোনো মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন স্বর্গদূত গাব্রিয়েল। তিনি যখন মরিয়মকে “অয়ি মহানুগৃহীতে” বলে সম্বোধন করেন, তখন মরিয়ম তার কথাগুলো শুনে “অতিশয় উদ্বিগ্ন হইলেন” এবং এই অস্বাভাবিক মঙ্গলবাদ শুনে অবাক হন। (লূক ১:২৯) কার দ্বারা মহানুগৃহীতা বা অনেক অনুগ্রহপ্রাপ্ত? মরিয়ম লোকেদের মাঝে অনেক অনুগ্রহপ্রাপ্ত হওয়ার আশা করেননি। কিন্তু, স্বর্গদূত যিহোবা ঈশ্বরের অনুগ্রহ সম্বন্ধে কথা বলছিলেন। সেটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। তবুও, তিনি গর্বিত হয়ে এইরকম মনে করেননি যে, ঈশ্বরের অনুগ্রহ তার ওপর রয়েছে। ইতিমধ্যেই আমাদের ঈশ্বরের অনুগ্রহ রয়েছে, অহংকারের সঙ্গে কখনো এইরকম মনে না করে, আমরা যদি ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি, তাহলে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা শিক্ষা লাভ করব, যা যুবতী মরিয়ম পুরোপুরি বুঝতে পেরেছিলেন। ঈশ্বর অহংকারীদের প্রতিরোধ করেন কিন্তু নম্র ব্যক্তিদের ভালবাসেন ও সমর্থন করেন।—যাকোব ৪:৬.

মরিয়মের এইরকম নম্রতারই প্রয়োজন হয়েছিল, কারণ স্বর্গদূত তাকে প্রায় কল্পনাতীত এক সুযোগ প্রদান করেছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, মরিয়মকে এমন এক সন্তান গর্ভে ধারণ করতে হবে, যিনি সমস্ত মানুষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হবেন। গাব্রিয়েল বলেছিলেন: “প্রভু ঈশ্বর তাঁহার পিতা দায়ূদের সিংহাসন তাঁহাকে দিবেন; তিনি যাকোব-কুলের উপরে যুগে যুগে রাজত্ব করিবেন, ও তাঁহার রাজ্যের শেষ হইবে না।” (লূক ১:৩২, ৩৩) এক হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে, ঈশ্বর দায়ূদের কাছে যে-প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—অর্থাৎ তার বংশধরদের মধ্যে একজন চিরকাল রাজত্ব করবেন—সেই বিষয়ে মরিয়ম নিশ্চিতভাবেই জানতেন। (২ শমূয়েল ৭:১২, ১৩) তাই, তার পুত্র হবেন সেই মশীহ, যাঁর জন্য ঈশ্বরের লোকেরা শত শত বছর ধরে অপেক্ষা করে ছিল!

স্বর্গদূত তাকে আরও বলেছিলেন যে, তার পুত্রকে “পরাৎপরের পুত্ত্র বলা যাইবে।” কীভাবে এক মানব নারী ঈশ্বরের পুত্রকে জন্ম দিতে পারেন? প্রকৃতপক্ষে, কীভাবেই বা মরিয়ম এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে পারেন? তিনি যোষেফের বাগ্‌দত্তা ছিলেন কিন্তু তখনও তার সঙ্গে মরিয়মের বিয়ে হয়নি। তাই, মরিয়ম অকপটভাবে এই প্রশ্নটা করেছিলেন: “ইহা কিরূপে হইবে? আমি ত পুরুষকে জানি না।” (লূক ১:৩৪) লক্ষ করুন যে, কোনোরকম লজ্জা না করেই মরিয়ম তার কুমারীত্ব সম্বন্ধে কথা বলেছিলেন। এর বিপরীতে, তিনি তার সতীত্বকে খুবই মূল্যবান বলে গণ্য করেছিলেন। আজকে, বহু অল্পবয়সী তাদের কুমারীত্বকে পরিত্যাগ করতে উৎসুক আর যারা তা করতে চায় না, তাদেরকে তারা উপহাস করার জন্য তৈরি থাকে। নিশ্চিতভাবেই জগৎ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, যিহোবার কোনো পরিবর্তন হয়নি। (মালাখি ৩:৬) মরিয়মের দিনের মতোই তিনি সেই ব্যক্তিদের মূল্যবান বলে গণ্য করেন, যারা তাঁর নৈতিক মানগুলো মেনে চলে।—ইব্রীয় ১৩:৪.

যদিও মরিয়ম ঈশ্বরের একজন বিশ্বস্ত দাস ছিলেন, তবুও তিনি একজন অসিদ্ধ মানুষ ছিলেন। তাহলে কীভাবে তিনি এক সিদ্ধ বংশধর, ঈশ্বরের পুত্রের জন্ম দিতে পারতেন? গাব্রিয়েল ব্যাখ্যা করেছিলেন: “পবিত্র আত্মা তোমার উপরে আসিবেন, এবং পরাৎপরের শক্তি তোমার উপরে ছায়া করিবে; এই কারণ যে পবিত্র সন্তান জন্মিবেন, তাঁহাকে ঈশ্বরের পুত্ত্র বলা যাইবে।” (লূক ১:৩৫) পবিত্র শব্দটির অর্থ “শুচি,” “শুদ্ধ।” সাধারণত, সন্তানরা তাদের বাবামার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে অসিদ্ধতা পেয়ে থাকে। কিন্তু, এই ক্ষেত্রে যিহোবা এক অদ্বিতীয় অলৌকিক কাজ সম্পাদন করেছিলেন। তিনি তাঁর পুত্রের জীবন স্বর্গ থেকে মরিয়মের গর্ভে স্থানান্তরিত করেছিলেন আর এরপর সেই সন্তানকে পাপের দ্বারা কলুষিত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য মরিয়মের ওপরে “ছায়া” করতে তাঁর সক্রিয় শক্তি বা পবিত্র আত্মা ব্যবহার করেছিলেন। মরিয়ম কি স্বর্গদূতের সেই প্রতিজ্ঞায় বিশ্বাস করেছিলেন? তিনি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন?

গাব্রিয়েলের প্রতি মরিয়মের প্রতিক্রিয়া

খ্রিস্টীয়জগতের কিছু ঈশ্বরতত্ত্ববিদসহ বিভিন্ন সন্দেহবাদীর পক্ষে এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে, একজন কুমারী সন্তানের জন্ম দিতে পারেন। এত শিক্ষাদীক্ষা থাকা সত্ত্বেও, তারা এক সাধারণ সত্য বুঝতে ব্যর্থ হয়। গাব্রিয়েল যেমন বলেন, “ঈশ্বরের কাছে অসম্ভব বলে কোন কিছুই নেই।” (লূক ১:৩৭, বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন) মরিয়ম গাব্রিয়েলের কথাগুলোকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিলেন, কারণ তিনি এমন একজন যুবতী নারী ছিলেন, যার অগাধ বিশ্বাস ছিল। কিন্তু, সেই বিশ্বাস অন্ধবিশ্বাস ছিল না। যেকোনো যুক্তিবাদী ব্যক্তির মতো মরিয়মেরও সেই প্রমাণের প্রয়োজন হয়েছিল, যেটার ওপর ভিত্তি করে তিনি বিশ্বাস করবেন। মরিয়ম ইতিমধ্যেই যেটাকে সত্য বলে জানতেন, গাব্রিয়েল সেটার সঙ্গে আরও কিছু যোগ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তিনি তাকে তার বয়স্ক আত্মীয়া ইলিশাবেৎ সম্বন্ধে বলেছিলেন, যিনি অনেক দিন যাবৎ বন্ধ্যা বলে পরিচিত ছিলেন। ঈশ্বর অলৌকিকভাবে তাকে গর্ভধারণ করতে সমর্থ করেছিলেন!

মরিয়ম এখন কী করবেন? তার সামনে এক কার্যভার রয়েছে আর এই প্রমাণও রয়েছে যে, গাব্রিয়েল যা যা বলেছিলেন, সেই সমস্তকিছুই ঈশ্বর করতে যাচ্ছেন। আমাদের এইরকম ধরে নেওয়া উচিত নয় যে, এই বিশেষ সুযোগটা কোনো ভয় বা কষ্ট নিয়ে আসেনি। একটা বিষয় হল, যোষেফের সঙ্গে তার বাগ্‌দত্তা হওয়ার বিষয়টা বিবেচনা করার মতো বিষয় ছিল। যোষেফ যখন মরিয়মের গর্ভাবস্থা সম্বন্ধে জানবেন, তখন তিনি কি মরিয়মকে বিয়ে করতে চাইবেন? আরেকটা বিষয় হল, কার্যভারটাই এক কঠিন দায়িত্ব বলে মনে হয়েছিল। তাকে ঈশ্বরের সমস্ত সৃষ্ট প্রাণীর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান এক জীবনকে—তাঁর নিজ প্রিয় পুত্রকে—ধারণ করতে হয়েছিল! তিনি যখন এক অসহায় শিশু ছিলেন, তখন মরিয়মকে তাঁর যত্ন নিতে ও এক দুষ্ট জগতের মধ্যে তাঁকে রক্ষা করতে হয়েছিল। বাস্তবিকই, এক গুরু দায়িত্ব!

বাইবেল দেখায় যে, এমনকি দৃঢ়, বিশ্বস্ত পুরুষরাও মাঝে মাঝে ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রাপ্ত কঠিন কার্যভারগুলো গ্রহণ করতে ইতস্তত করেছিল। মোশি এই বলে আপত্তি জানিয়েছিলেন যে, ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার জন্য তিনি যথেষ্ট সাবলীলভাবে কথা বলতে পারেন না। (যাত্রাপুস্তক ৪:১০) যিরমিয় এই বলে আপত্তি জানিয়েছিলেন যে, তিনি “বালক” অর্থাৎ ঈশ্বর তাকে যে-কার্যভার দিয়েছেন, তা গ্রহণ করার জন্য কমবয়সি ছিলেন। (যিরমিয় ১:৬) আর যোনা তার কার্যভার ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন! (যোনা ১:৩) মরিয়ম সম্বন্ধে কী বলা যায়?

তার কথাগুলো যুগ যুগ ধরে এর সহজ-সরল নম্রতা ও বাধ্যতার মাধ্যমে প্রতিধ্বনিত হয়। তিনি গাব্রিয়েলকে বলেছিলেন: “দেখুন, আমি প্রভুর [“যিহোবার,” NW] দাসী; আপনার বাক্যানুসারে আমার প্রতি ঘটুক।” (লূক ১:৩৮) একজন দাসী সমস্ত দাসের মধ্যে সবচেয়ে নিচু ছিলেন; তার জীবন সম্পূর্ণরূপে তার প্রভুর হাতেই ছিল। মরিয়ম তার প্রভু যিহোবা সম্বন্ধে এইরকমটাই বোধ করেছিলেন। তিনি জানতেন যে, তাঁর হাতে তিনি নিরাপদ ছিলেন, যারা তাঁর প্রতি “অনুগত,” তাদের প্রতি তিনি অনুগত এবং এই কঠিন কার্যভার সম্পাদন করার ক্ষেত্রে তিনি যদি তার সর্বোত্তমটুকু করেন, তাহলে যিহোবা তাকে আশীর্বাদ করবেন।—গীতসংহিতা ১৮:২৫, NW.

কখনো কখনো ঈশ্বর আমাদেরকে এমন কিছু করতে বলেন, যা হয়তো আমাদের দৃষ্টিতে কঠিন, এমনকি অসম্ভব বলে মনে হতে পারে। কিন্তু, তাঁর বাক্যে তিনি আমাদেরকে তাঁর ওপর বিশ্বাস বা নির্ভর করার ও মরিয়ম যেমন করেছিলেন, তেমনই তাঁর হাতে নিজেদেরকে অর্পণ করার প্রচুর কারণ জোগান। (হিতোপদেশ ৩:৫, ৬) আমরাও কি তা করব? আমরা যদি তা করি, তাহলে তিনি আমাদেরকে পুরস্কৃত করবেন ও আমাদেরকে এমনকি তাঁর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে তোলার অনেক কারণ জোগাবেন।

ইলিশাবেতের সঙ্গে সাক্ষাৎ

ইলিশাবেৎ সম্বন্ধে গাব্রিয়েলের কথাগুলো মরিয়মের কাছে অনেক অর্থ রেখেছিল। জগতের সমস্ত স্ত্রীলোকের মধ্যে কে তার পরিস্থিতি আরও ভালভাবে বুঝতে পারত? মরিয়ম তাড়াতাড়ি করে যিহূদার পাহাড়ি অঞ্চলে গিয়েছিলেন, যেটা সম্ভবত তিন বা চার দিনের যাত্রাপথ ছিল। ইলিশাবেৎ ও সখরিয় যাজকের বাড়িতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে, যিহোবা মরিয়মের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করার জন্য আরও দৃঢ় প্রমাণ জুগিয়েছিলেন। ইলিশাবেৎ মরিয়মের মঙ্গলবাদ শোনামাত্রই অনুভব করেছিলেন যে, তার জঠরে থাকা শিশুটি আনন্দে নেচে উঠেছিল। তিনি পবিত্র আত্মায় পূর্ণ হয়ে মরিয়মকে “আমার প্রভুর মাতা” বলে উল্লেখ করেছিলেন। ঈশ্বর ইলিশাবেতের কাছে প্রকাশ করেছিলেন যে, মরিয়মের পুত্র তার প্রভু, মশীহ হবেন। অধিকন্তু, মরিয়মের বিশ্বস্ততাপূর্ণ বাধ্যতার জন্য তিনি এই বলে তার প্রশংসা করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন: “আর ধন্য যিনি বিশ্বাস করিলেন।” (লূক ১:৩৯-৪৫) হ্যাঁ, যিহোবা মরিয়মের কাছে যা-কিছুই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সমস্তই সত্য হবে!

এর পরিপ্রেক্ষিতে, মরিয়ম কথা বলেছিলেন। তার কথাগুলো লূক ১:৪৬-৫৫ পদে যত্ন সহকারে সংরক্ষিত রয়েছে। বাইবেলের বিবরণে এটা হল মরিয়মের বলা দীর্ঘতম কথা আর তা তার সম্বন্ধে অনেক কিছু প্রকাশ করে। এই কথাগুলো সেই সময়ে তার কৃতজ্ঞ ও উপলব্ধিপূর্ণ মনোভাবকে প্রকাশ করে, যখন তিনি মশীহের মা হিসেবে সেবা করার বিশেষ সুযোগ দিয়ে তাকে আশীর্বাদ করার জন্য যিহোবার প্রশংসা করেন। এ ছাড়া, এই কথাগুলো তার গভীর বিশ্বাসকেও প্রকাশ করে, যখন তিনি যিহোবাকে এমন একজন ব্যক্তি বলে উল্লেখ করেন, যিনি অহংকারী ও পরাক্রমী ব্যক্তিদেরকে অবনত করেন এবং সেই নম্র ও দরিদ্র ব্যক্তিদের সাহায্য করেন, যারা তাঁকে সেবা করতে চায়। এ ছাড়া, এই কথাগুলো তার জ্ঞানের পরিধিকেও প্রকাশ করে। একটা হিসেব অনুসারে, তিনি ইব্রীয় শাস্ত্র থেকে ২০ বারেরও বেশি বার উল্লেখ করেন!

স্পষ্টতই, মরিয়ম ঈশ্বরের বাক্য সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করেছিলেন। তবুও, তিনি নম্র ছিলেন ও তার পরিস্থিতি সম্বন্ধে নিজে বলার চাইতে, শাস্ত্রকেই সেই বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে দেওয়া বেছে নিয়েছিলেন। যে-পুত্রসন্তান তখন তার গর্ভে বড় হচ্ছিলেন, তিনিও একদিন এই বলে সেই একই মনোভাব দেখিয়েছিলেন: “আমার উপদেশ আমার নহে, কিন্তু যিনি আমাকে পাঠাইয়াছেন, তাঁহার।” (যোহন ৭:১৬) আমাদের নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করা উচিত: ‘আমি কি ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি এই ধরনের সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখাই? নাকি আমি আমার নিজস্ব ধারণা ও শিক্ষাগুলোকে পছন্দ করি?’ এই বিষয়ে মরিয়মের উত্তরটা স্পষ্ট।

মরিয়ম তিন মাস ইলিশাবেতের সঙ্গে ছিলেন আর নিঃসন্দেহে তিনি অনেক উৎসাহ পেয়েছিলেন ও তা প্রদান করেছিলেন। (লূক ১:৫৬) উভয়েই আমাদেরকে বন্ধুত্বের গুরুত্ব সম্বন্ধে মনে করিয়ে দেয়। আমরা যদি এমন বন্ধুদের খোঁজার চেষ্টা করি, যারা সত্যিই আমাদের ঈশ্বর যিহোবাকে ভালবাসে, তাহলে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, আমরা আধ্যাত্মিকভাবে বৃদ্ধি পাব ও তাঁর আরও নিকটবর্তী হব। (হিতোপদেশ ১৩:২০) কিন্তু অবশেষে, মরিয়মের বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় চলে এসেছিল। যোষেফ যখন মরিয়মের অবস্থা সম্বন্ধে জানতে পেরেছিলেন, তখন তিনি কী বলেছিলেন?

মরিয়ম ও ষোষেফ

সম্ভবত মরিয়ম তার গর্ভাবস্থা প্রকাশ হয়ে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি। নিঃসন্দেহে, ষোষেফের সঙ্গে তার কথা বলতে হতো। ষোষেফকে বলার আগে, মরিয়ম হয়তো ভেবেছিলেন যে, তিনি তাকে যা বলতে যাচ্ছেন, তার প্রতি এই ভদ্র ও ঈশ্বরভয়শীল ব্যক্তিটি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন। যাই হোক, তিনি যোষেফের কাছে গিয়েছিলেন ও তার প্রতি ঘটা সমস্তকিছুই তাকে বলেছিলেন। আপনি যেমন কল্পনা করতে পারেন, ষোষেফ অতিশয় উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। তিনি তার প্রিয়তমাকে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলেন কিন্তু মরিয়ম তাকে এমন বিষয় সম্বন্ধে বলেছিলেন, যা আগে কখনো ঘটেনি। তার মনের মধ্যে কোন চিন্তাভাবনা চলছিল অথবা তিনি কীভাবে যুক্তি করেছিলেন, সেই বিষয়ে বাইবেল কিছু বলে না। কিন্তু বাইবেল বলে যে, তিনি তার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কারণ তখনকার দিনে বাগ্‌দত্তা দম্পতিকে বিবাহিত হিসেবেই দেখা হতো। তবে তিনি চাননি যে, মরিয়ম জনসমক্ষে লজ্জায় পড়ুক অথবা শাস্তি পাক, তাই তিনি গোপনে তাকে ত্যাগ করা বা তার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করা বেছে নিয়েছিলেন। (মথি ১:১৮, ১৯) এই সদয় ব্যক্তিটিকে এই ব্যতিক্রম পরিস্থিতির কারণে যন্ত্রণা পেতে দেখে মরিয়ম নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছিলেন। তবুও, মরিয়ম তিক্ত হননি।

যোষেফের কাছে যেটা সবচেয়ে ভাল বলে মনে হয়েছিল, যিহোবা তাকে সেই অনুসারে কাজ করতে দেননি। একটা স্বপ্নে, ঈশ্বরের দূত তাকে বলেছিলেন যে, মরিয়মের গর্ভাবস্থা বাস্তবিকই অলৌকিক ছিল। এটা নিশ্চয়ই স্বস্তি জুগিয়েছিল! যোষেফ তখন তা-ই করেন, যা মরিয়ম শুরু থেকেই করেছিলেন —যোষেফ যিহোবার পরিচালনার সঙ্গে মিল রেখে কাজ করেছিলেন। তিনি মরিয়মকে তার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ও যিহোবার পুত্রের যত্ন নেওয়ার অদ্বিতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন।—মথি ১:২০-২৪.

বিবাহিত ব্যক্তিদের—ও সেইসঙ্গে বিয়ে করার কথা চিন্তা করছে এমন ব্যক্তিদের—২,০০০ বছর আগের এই অল্পবয়সি দম্পতির কাছ থেকে শেখা উচিত। যোষেফ যখন তার এই অল্পবয়সি স্ত্রীকে মাতৃত্বের কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করতে দেখেছিলেন, তখন নিশ্চিতভাবেই তিনি এই বিষয়ে খুশি হয়েছিলেন যে, যিহোবার দূত তাকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। যোষেফ নিশ্চয়ই বড় বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় যিহোবার ওপর নির্ভর করার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। (গীতসংহিতা ৩৭:৫; হিতোপদেশ ১৮:১৩) নিঃসন্দেহে, পরিবারের মস্তক হিসেবে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তিনি যত্নশীল ও সদয় ছিলেন।

অন্যদিকে, যোষেফকে বিয়ে করার জন্য মরিয়মের ইচ্ছুক মনোভাব থেকে আমরা কী অনুমান করতে পারি? যদিও প্রথমে মরিয়মের কথা বুঝতে হয়তো ষোষেফের কঠিন লেগেছিল, তবুও মরিয়ম এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে তার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন, যিনি পরিবারের মস্তক হবেন। নিশ্চিতভাবে, সেটা তার জন্য এক উত্তম শিক্ষা ছিল, যেমন আজকের খ্রিস্টান নারীদের জন্য এটা এক শিক্ষা। পরিশেষে, এই ঘটনাগুলো সম্ভবত ষোষেফ ও মরিয়ম উভয়কেই সৎ ও খোলাখুলিভাবে ভাববিনিময় করার মূল্য সম্বন্ধে অনেক শিক্ষা দিয়েছিল।

নিশ্চিতভাবেই, সেই অল্পবয়সি দম্পতি উত্তম ভিত্তির ওপর তাদের বিবাহিত জীবন শুরু করেছিল। তারা উভয়েই সমস্তকিছুর ঊর্ধ্বে যিহোবা ঈশ্বরকে ভালবেসেছিল এবং দায়িত্ববান ও যত্নশীল বাবামা হিসেবে তাঁকে খুশি করতে আকুল আকাঙ্ক্ষী ছিল। অবশ্য, তাদের জন্য মহৎ মহৎ আশীর্বাদ—ও সেইসঙ্গে বড় বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতা—অপেক্ষা করে ছিল। তাদের সামনে যিশুকে প্রতিপালন করার প্রত্যাশা ছিল, যিনি জগতের সর্বকালের সর্বমহান পুরুষ হিসেবে বড় হয়ে উঠবেন। (w০৮ ৭/১)