সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

“আমি বিশ্বাস করিয়াছি”

“আমি বিশ্বাস করিয়াছি”

তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন

“আমি বিশ্বাস করিয়াছি”

মার্থা তার মনের চোখে তার ভাইয়ের কবর অর্থাৎ একটা গুহা যেটার মুখ একটা পাথর দিয়ে বন্ধ করা ছিল, সেটা দেখতে পাচ্ছিলেন। তার শোকের বোঝা সেই পাথরের মতো ভারী ছিল। তিনি বিশ্বাসই করতে পাচ্ছিলেন না যে, তার প্রিয় লাসার আর নেই। চার দিন হল লাসার তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন আর এই চারটে দিন যেন কান্নাকাটিতে, লোকেদের যাওয়া-আসায় ও সান্ত্বনাজনক কথাবার্তায় কেটে গিয়েছিল।

আর এখন, মার্থার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তিনি লাসারের খুব প্রিয় ছিলেন। আবারও যিশুকে দেখতে পাওয়া তার শোককে আরও তীব্র করে তুলেছিল, কারণ সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে তিনিই ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি তার ভাইকে বাঁচাতে পারতেন। তবুও, পাহাড়ের গায়ে থাকা একটা ছোট্ট শহর, বৈথনিয়ার বাইরে যিশুর সঙ্গে থাকায় মার্থা কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকার ফলে, তিনি তাঁর চোখে প্রতিফলিত হওয়া দয়া দেখে আবারও আশ্বস্ত হয়েছিলেন, এক গভীর সহমর্মিতা যা সবসময় খুবই উৎসাজনক। যিশু মার্থাকে কয়েকটা প্রশ্ন করেছিলেন, যেগুলো তাকে তার পুনরুত্থানের বিশ্বাসের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে সাহায্য করেছিল। সেই কথোপকথন মার্থাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা মন্তব্য করতে পরিচালিত করেছিল, যা তার মুখ থেকে কখনো বেরিয়েছিল: “আমি বিশ্বাস করিয়াছি যে, জগতে যাঁহার আগমন হইবে, আপনি সেই খ্রীষ্ট, ঈশ্বরের পুত্ত্র।”—যোহন ১১:২৭.

মার্থা এমন একজন স্ত্রীলোক ছিলেন যার অসাধারণ বিশ্বাস ছিল। বাইবেল তার সম্বন্ধে আমাদেরকে যতটুকু জানায়, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনেক শিক্ষা প্রদান করে, যেগুলো আমাদের নিজেদের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে পারে। কীভাবে তা করতে পারে, সেটা দেখার জন্য আসুন আমরা বাইবেলে মার্থা সম্বন্ধে দেওয়া প্রথম বিবরণটি বিবেচনা করি।

“চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন”

কয়েক মাস আগের কথা। লাসার সুস্থ শরীরে বেঁচে ছিলেন। বৈথনিয়ায় তার বাড়িতে সবচেয়ে বিখ্যাত একজন অতিথি, যিশু খ্রিস্ট আসতে যাচ্ছিলেন। প্রাপ্তবয়স্ক তিন ভাইবোন লাসার, মার্থা ও মরিয়ম নিঃসন্দেহে একই বাড়িতে বাস করত। কিছু গবেষক ইঙ্গিত করে যে, মার্থা হয়তো তিনজনের মধ্যে বড়ো ছিলেন, কারণ তিনিই আতিথেয়তা দেখানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে মনে হয় এবং কখনো কখনো তার নামই প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে। (যোহন ১১:৫) এই তিনজনের মধ্যে কারোরই কখনো বিয়ে হয়েছিল কি না, তা জানার কোনো উপায় নেই। যাইহোক না কেন, তারা যিশুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিল। যিহূদিয়ায়, যেখানে যিশু অনেক বিরোধিতা ও বিদ্বেষের মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেখানে তাঁর পরিচর্যাকালে, তাদের বাড়িকে তাঁর ঘাঁটি করেছিলেন। নিঃসন্দেহে, তিনি শান্তি ও সমর্থনের সেই আশ্রয়স্থলের জন্য খুবই কৃতজ্ঞ ছিলেন।

মার্থাকে বাড়ির আরামদায়ক পরিবেশ বজায় রাখা ও আতিথেয়তা দেখানোর ব্যাপারে অনেক কাজ করতে হতো। একজন ব্যস্ত, পরিশ্রমী ব্যক্তি হিসেবে তিনি প্রায়ই কাজের মধ্যে ডুবে থাকতেন বলে মনে হয়। যিশুর পরিদর্শন করতে আসার সময়টা কোনোভাবে আলাদা ছিল না। দেরি না করে তিনি তার সেই বিশেষ অতিথি এবং খুব সম্ভবত তাঁর কয়েকজন ভ্রমণসঙ্গীর জন্য অনেকগুলো পদসহ এক বিশেষ খাবার প্রস্তুত করার পরিকল্পনা করেছিলেন। সেই সময়ে, আতিথেয়তা দেখানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। একজন অতিথি আসলে, তাকে চুম্বন করে অভ্যর্থনা জানানো হতো, জুতো খুলে তার পা ধুইয়ে দেওয়া হতো এবং তার মাথায় সুগন্ধি তেল মাখানো হতো। (লূক ৭:৪৪-৪৭) আর তার থাকার ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সমস্ত যত্ন নেওয়া হতো।

মার্থা ও মরিয়মের তাদের সেই বিশেষ অতিথির যত্ন নেওয়ার জন্য অনেক কাজ করার ছিল। মরিয়ম, যাকে কখনো কখনো দুজনের মধ্যে বেশি সংবেদনশীল ও চিন্তাশীল বলে মনে করা হয়, তিনি নিশ্চয় প্রথমদিকে তার দিদিকে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু যিশু আসার পর, বিষয়গুলো পালটে গিয়েছিল। যিশু সেখানে উপস্থিত লোকেদেরকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য এই উপলক্ষ্যকে ব্যবহার করেছিলেন! সেই সময়কার ধর্মীয় নেতাদের বিপরীতে, যিশু স্ত্রীলোকদেরকে সম্মান করতেন এবং ঈশ্বরের রাজ্য, যা তাঁর পরিচর্যার বিষয়বস্তু ছিল, সেই সম্বন্ধে তাদেরকে নির্দ্বিধায় শিক্ষা দিতেন। মরিয়ম এই সুযোগ পাওয়ার জন্য রোমাঞ্চিত হয়ে তাঁর পায়ের কাছে বসে তাঁর সমস্ত কথা শুনেছিলেন।

মার্থার মনের মধ্যে যে-চাপ বাড়ছিল, তা আমরা কল্পনা করতে পারি। অতিথিদের জন্য তাকে যে-সমস্ত খাবার প্রস্তুত করতে হতো এবং যে-সমস্ত কাজ করতে হতো, সেগুলোর কথা ভেবে তিনি আরও বেশি চিন্তিত ও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। কাজের ব্যস্ততায় চলাফেরা করার সময়, মার্থা যখন তাকে সাহায্য করার পরিবর্তে তার বোনকে বসে থাকতে দেখেছিলেন, তখন তিনি কি কিছুটা রেগে গিয়েছিলেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন বা বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন? যদি তিনি তা করে থাকেন, তাহলে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এই সমস্ত কাজ তিনি একা হাতে সামলাতে পারতেন না!

শেষপর্যন্ত, মার্থা তার বিরক্তিকে আর চেপে রাখতে পারেননি। যিশুর কথায় বাধা দিয়ে উত্তেজনার বশে তিনি বলে ফেলেছিলেন: “প্রভু, আপনি কি কিছু মনে করিতেছেন না যে, আমার ভগিনী পরিচর্য্যার ভার একা আমার উপরে ফেলিয়া রাখিয়াছে? অতএব উহাকে বলিয়া দিউন, যেন আমার সাহায্য করে।” (লূক ১০:৪০) কথাগুলো খুবই কড়া ছিল। বেশ কয়েকটা অনুবাদ মার্থার করা প্রশ্নকে এভাবে অনুবাদ করে: “প্রভু, আপনার কি কোন চিন্তা নেই . . . ?” এরপর তিনি মরিয়মকে সংশোধন করতে, তাকে কাজে ফিরে যেতে বলার জন্য যিশুকে বলেছিলেন।

যিশুর উত্তর হয়তো মার্থাকে অবাক করেছিল, যেমনটা সেই সময় থেকে বাইবেলের অনেক পাঠককে অবাক করেছে। তিনি কোমলভাবে বলেছিলেন: “মার্থা, মার্থা, তুমি অনেক বিষয়ে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন আছ; কিন্তু অল্প কএকটী বিষয়, বরং একটী মাত্র বিষয় আবশ্যক; বাস্তবিক মরিয়ম সেই উত্তম অংশটী মনোনীত করিয়াছে, যাহা তাহার নিকট হইতে লওয়া যাইবে না।” (লূক ১০:৪১, ৪২) যিশু কী বোঝাতে চেয়েছিলেন? তিনি কি মার্থাকে বস্তুবাদী বলছিলেন? তিনি কি উত্তম খাবার প্রস্তুত করার ব্যাপারে তার কঠোর পরিশ্রমকে উপেক্ষা করছিলেন?

না। স্পষ্টতই, যিশু দেখেছিলেন যে, মার্থার উদ্দেশ্য প্রেমময় ও অকৃত্রিম ছিল। এ ছাড়া, তিনি মনে করেননি যে, এমনকী উদারভাবে আতিথেয়তা দেখানো মানেই তা ভুল। কিছুদিন আগে, তিনি তাঁর জন্য করা মথির ‘বড় এক ভোজে’ আনন্দের সঙ্গে যোগদান করেছিলেন। (লূক ৫:২৯) মার্থার খাবার প্রস্তুত করা এই ক্ষেত্রে মূল বিষয় ছিল না; বরং এটা ছিল অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়। অনেক রকমের খাবার প্রস্তুত করার ব্যাপারে তিনি এতই চিন্তিত ছিলেন যে, তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাকে উপেক্ষা করেছিলেন। সেটা কী ছিল?

যিহোবা ঈশ্বরের একজাত পুত্র, যিশু সত্য শেখানোর জন্য মার্থার বাড়িতে ছিলেন। কোনোকিছুই, যেটার অন্তর্ভুক্ত প্রেমের সঙ্গে প্রস্তুত করা মার্থার খাবার, এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। নিঃসন্দেহে, যিশু এই জন্য দুঃখ পেয়েছিলেন যে, মার্থা তার বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করার এই অদ্বিতীয় সুযোগকে হারাচ্ছিলেন কিন্তু তিনি তাকে তার বাছাইটা করতে দিয়েছিলেন। অবশ্য, মরিয়মকেও সেই সুযোগটা হারাতে চাপ দেওয়ার জন্য যিশুকে বলাটা মার্থার ঠিক হয়নি।

তাই, যিশু তার উত্তেজিত অবস্থাকে শান্ত করতে মৃদুস্বরে বার বার তার নাম নেওয়ার দ্বারা মার্থাকে কোমলভাবে সংশোধন করেছিলেন আর তিনি তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, “অনেক বিষয়ে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন” হওয়ার প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে যখন আধ্যাত্মিক ভোজের ব্যবস্থা ছিল, তখন একটা বা দুটো পদের সাধারণ খাবারই যথেষ্ট হতো। তাই, মরিয়মের বাছাই করা “উত্তম অংশটী”—যিশুর কাছ থেকে শেখাকে—তিনি কোনোভাবেই তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারেন না!

এই ছোট্ট ঘরোয়া দৃশ্যটি আজকের দিনের খ্রিস্টের অনুসারীদের অনেক শিক্ষা প্রদান করে। আমাদের “আত্মাতে দীনহীন” বা আধ্যাত্মিক চাহিদাকে পূরণ করার জন্য আমরা কখনোই কোনোকিছুকেই বাধা হতে দেব না। (মথি ৫:৩) যদিও আমরা মার্থার উদার, পরিশ্রমী মনোভাবকে অনুকরণ করতে চাই কিন্তু আমরা কখনোই আতিথেয়তা দেখানোর কম গুরুত্বপূর্ণ দিকটা নিয়ে এত বেশি “চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন” হতে চাই না যে, আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাকে হারাই। আমরা সহবিশ্বাসীদের সঙ্গে মেলামেশা করি, মূলত তাদেরকে ভালো ভালো খাবার খাওয়ানোর বা তাদের ভালো ভালো খাবার খাওয়ার জন্য নয় বরং উভয় পক্ষের আশ্বাস বা উৎসাহ লাভ এবং আধ্যাত্মিক বর প্রদান করার জন্য। (রোমীয় ১:১১, ১২) এমনকী অতি সাধারণ খাবারও এইধরনের গঠনমূলক উপলক্ষ্য সম্ভবপর করে তুলতে পারে।

একজন প্রিয় ভাই মারা গিয়েছিল —তাকে পুনরুত্থিত করা হয়েছিল

মার্থা কি যিশুর কোমল সংশোধনকে গ্রহণ করেছিলেন এবং তা থেকে শিখেছিলেন? এই নিয়ে আমাদের চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। মার্থার ভাই সম্বন্ধে এক রোমাঞ্চকর বিবরণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময়, প্রেরিত যোহন আমাদেরকে মনে করিয়ে দেন: “যীশু মার্থাকে ও তাঁহার ভগিনীকে এবং লাসারকে প্রেম করিতেন।” (যোহন ১১:৫) ওপরে বর্ণিত যিশুর বৈথনিয়ায় যাওয়ার পর কয়েক মাস কেটে গিয়েছিল। স্পষ্টতই, মার্থা বিমর্ষ হয়ে থাকেননি; তিনি তাঁর দেওয়া প্রেমময় পরামর্শের জন্য যিশুর বিরুদ্ধে রাগ পোষণ করে রাখেননি। তিনি তাঁর পরামর্শে মনোযোগ দিয়েছিলেন। এই ব্যাপারেও, তিনি আমাদের জন্য বিশ্বাসের এক চমৎকার উদাহরণ স্থাপন করেছেন, কারণ আমাদের মধ্যে কার-ই বা মাঝেমধ্যে ছোটোখাটো সংশোধনের প্রয়োজন হয় না?

তার ভাই যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তখন মার্থা নিজে তার ভালোমতো যত্ন নিয়েছিলেন। তার যন্ত্রণাকে লাঘব করার এবং তাকে সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করার জন্য তিনি তার যথাসাধ্য করেছিলেন। তা সত্ত্বেও, লাসার ক্রমশ আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন, তার বোনেরা তার পাশে থেকে তার যত্ন নিয়েছিল। মার্থা কত বারই না তার ভাইয়ের শুকনো মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন এবং তারা একসঙ্গে যে-দিনগুলো কাটিয়েছিল ও তাদের সুখ-দুঃখকে ভাগ করে নিয়েছিল, সেগুলোর কথা মনে করছিলেন?

যখন মনে হয়েছিল যে, লাসারকে আর কোনোভাবে সুস্থ করে তোলা যাবে না, তখন মার্থা ও মরিয়ম যিশুর কাছে এক বার্তা পাঠিয়েছিল। তিনি যেখানে প্রচার করছিলেন, সেটা দু-দিনের পথ ছিল। তাদের বার্তাটি খুবই সংক্ষিপ্ত ছিল: “প্রভু, দেখুন, আপনি যাহাকে ভাল বাসেন তাহার পীড়া হইয়াছে।” (যোহন ১১:১, ৩) তারা জানত যে, যিশু তাদের ভাইকে ভালোবাসেন আর তাদের বিশ্বাস ছিল যে, তাঁর বন্ধুকে সাহায্য করার জন্য তিনি তাঁর যথাসাধ্য করবেন। তারা কি এমনটা আশা করেছিল যে, যিশু হয়তো খুব বেশি দেরি হওয়ার আগেই সেখানে আসবেন? যদি তাই করে থাকে, তাহলে তাদের সেই আশা ভঙ্গ হয়েছিল। লাসার মারা গিয়েছিলেন।

মার্থা ও মরিয়ম, দুজনেই তাদের ভাইয়ের জন্য শোক করেছিল, তাকে কবর দেওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করেছিল এবং বৈথনিয়া ও আশেপাশের জায়গা থেকে আসা অতিথিদের দেখাশোনা করেছিল। তখনও যিশুর কোনো খবর নেই। সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্থা নিশ্চয়ই আরও বেশি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে, লাসার মারা যাওয়ার চার দিন পর, মার্থা শুনতে পেয়েছিলেন যে, যিশু শহরের কাছাকাছি এসেছেন। এমনকী এই অত্যন্ত দুঃখজনক সময়েও, সবসময় কর্মব্যস্ত মহিলা, মার্থা উঠে মরিয়মকে কিছু না বলেই যিশুর সঙ্গে দেখা করতে ছুটে গিয়েছিলেন।—যোহন ১১:২০.

তিনি যখন তার প্রভুকে দেখতে পেয়েছিলেন, তখন তিনি তাকে ও মরিয়মকে যে-বিষয়টা কয়েকদিন ধরে যন্ত্রণা দিয়ে চলেছিল তা বলেছিলেন: “প্রভু, আপনি যদি এখানে থাকিতেন, আমার ভাই মরিত না।” তবুও, মার্থার আশা ও বিশ্বাস ম্লান হয়ে যায়নি। তিনি আরও বলেছিলেন: “আর এখনও আমি জানি, আপনি ঈশ্বরের কাছে যে কিছু যাচ্ঞা করিবেন, তাহা ঈশ্বর আপনাকে দিবেন।” তার আশাকে দৃঢ় করার জন্য যিশু সঙ্গেসঙ্গে কিছু বলেছিলেন: “তোমার ভাই আবার উঠিবে।”—যোহন ১১:২১-২৩.

মার্থা ভেবেছিলেন যে, যিশু ভবিষ্যৎ পুনরুত্থানের বিষয় বলছিলেন, তাই তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: “আমি জানি, শেষ দিনে পুনরুত্থানে সে উঠিবে।” (যোহন ১১:২৪) সেই শিক্ষার প্রতি তার বিশ্বাস উল্লেখযোগ্য ছিল। কিছু যিহুদি ধর্মীয় নেতা, যাদেরকে সদ্দূকী বলা হতো, তারা পুনরুত্থানের শিক্ষাকে অস্বীকার করেছিল, যদিও অনুপ্রাণিত শাস্ত্র-এ সেই সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। (দানিয়েল ১২:১৩; মার্ক ১২:১৮) কিন্তু, মার্থা জানতেন যে, যিশু পুনরুত্থানের আশা সম্বন্ধে শিক্ষা দিয়েছিলেন আর এমনকী লোকেদের পুনরুত্থিতও করেছিলেন—যদিও এমন কাউকে নয়, যিনি লাসারের মতো কয়েক দিন ধরে মৃত অবস্থায় ছিলেন। তিনি জানতেন না যে, কী ঘটতে চলেছিল।

এরপর, যিশু অবিস্মরণীয় এই উক্তিটি করেছিলেন: “আমিই পুনরুত্থান ও জীবন।” বস্তুত, যিহোবা ঈশ্বর তাঁর পুত্রকে ভবিষ্যতে পৃথিবীব্যাপী লোকেদের পুনরুত্থিত করার ক্ষমতা দিয়েছেন। যিশু মার্থাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “ইহা কি বিশ্বাস কর?” এরপর, তিনি সেই উত্তরটি দিয়েছিলেন, যা এই প্রবন্ধের শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, যিশু ছিলেন খ্রিস্ট বা মশীহ এবং যিহোবা ঈশ্বরের পুত্র আর ভাববাদীরা ভাববাণী করেছিল যে, তিনি জগতে আসবেন।—যোহন ৫:২৮, ২৯; ১১:২৫-২৭.

যিহোবা ঈশ্বর ও তাঁর পুত্র, যিশু খ্রিস্ট কি এইধরনের বিশ্বাসকে মূল্যবান বলে মনে করে? এরপর মার্থার চোখের সামনে যে-ঘটনাগুলো ঘটেছিল, সেগুলো এর সবচেয়ে স্পষ্ট উত্তর প্রদান করে। তিনি তার বোনকে ডাকার জন্য দৌড়ে গিয়েছিলেন। এরপর, তিনি দেখেছিলেন যে, মরিয়মের এবং তার সঙ্গে থাকা শোকার্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার সময় যিশু গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। যিশু যখন মৃত্যুর ফলে যে-দুঃখ হয় সেটার প্রতি খোলাখুলিভাবে তাঁর গভীর শোক প্রকাশ করেছিলেন, তখন মার্থা দেখেছিলেন যে, তাঁর চোখে জল এসে গিয়েছিল। তিনি যিশুকে এই আদেশ দিতে শুনেছিলেন যে, তার ভাইয়ের কবর থেকে পাথরটা যেন সরানো হয়।—যোহন ১১:২৮-৩৯.

মার্থা আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন যে, মারা যাওয়ার পর চার দিন কেটে গিয়েছে, তাই মৃতদেহ থেকে এখন দুর্গন্ধ বের হবে আর তা ব্যবহারিকই ছিল। যিশু তাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন: “আমি কি তোমাকে বলি নাই যে, যদি বিশ্বাস কর, তবে ঈশ্বরের মহিমা দেখিতে পাইবে?” তিনি বিশ্বাস করেছিলেন ও যিহোবা ঈশ্বরের মহিমা দেখেছিলেন। তক্ষুনি, ঈশ্বর লাসারকে জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁর পুত্রকে শক্তি প্রদান করেছিলেন! সেই মুহূর্তগুলোর কথা চিন্তা করুন, যেগুলো মার্থার স্মৃতিতে তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থেকে গিয়েছিল: যিশুর আদেশমূলক এই আহ্বান, “লাসার, বাহিরে আইস”; লাসারকে যেখানে কবর দেওয়া হয়েছিল সেখান থেকে তার ওঠার এবং তার দেহকে প্রস্তুত করার জন্য ব্যবহৃত কাপড়ে তখনও বাঁধা অবস্থায় গুহার দরজার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসার হালকা আওয়াজ; যিশুর এই আদেশ, “ইহাকে খুলিয়া দেও, ও যাইতে দেও”; আর নিশ্চিতভাবেই অত্যন্ত আনন্দে মার্থা ও মরিয়মের দৌড়ে গিয়ে তার ভাইকে জড়িয়ে ধরা। (যোহন ১১:৪০-৪৪) মার্থার হৃদয়ের বোঝা হালকা হয়ে গিয়েছিল!

এই বিবরণটি দেখায় যে, মৃতদের পুনরুত্থান কেবল কাল্পনিক বিষয় নয়; এটা হল বাইবেলের হৃদয়গ্রাহী এক শিক্ষা এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত এক ঘটনা। যিহোবা এবং তাঁর পুত্র বিশ্বাসকে পুরস্কৃত করে থাকে, যেমনটা তারা মার্থা, মরিয়ম ও লাসারের ক্ষেত্রে করেছিল। আপনিও যদি মার্থার মতো দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে তোলেন, তাহলে তারা আপনাকেও এই ধরনের পুরস্কার দেবেন। *

“মার্থা পরিচর্য্যা করিলেন”

বাইবেলের বিবরণ মার্থা সম্বন্ধে কেবল আরেকবার উল্লেখ করে। এটা ছিল পৃথিবীতে যিশুর জীবনের শেষ সপ্তাহের শুরুতে। তাঁর সামনে যে-কঠিন সময় অপেক্ষা করেছিল তা ভালোভাবে অবগত থাকায়, যিশু আবারও তাঁর থাকার জায়গা হিসেবে বৈথনিয়ার সেই আশ্রয়স্থলকে বেছে নিয়েছিলেন। এখান থেকে তিনি দুই মাইল (৩ কিলোমিটার) পথ যিরূশালেমে হেঁটে যাবেন। যিশু ও লাসার কুষ্ঠরোগী শিমোনের বাড়িতে রাতের খাবার খাচ্ছিল আর সেখানে আমরা মার্থা সম্বন্ধে এই শেষ উক্তিটি পাই: “মার্থা পরিচর্য্যা করিলেন।”—যোহন ১২:২.

এই পরিশ্রমী স্ত্রীলোকটি কতই না আদর্শ! বাইবেলে আমরা যখন তার সম্বন্ধে প্রথম উল্লেখ পাই, তখন তিনি কাজ করছেন; আর শেষ বিবরণে, তিনি তখনও কাজ করছেন, তার চারপাশে থাকা লোকেদের প্রয়োজনগুলোর যত্ন নেওয়ার জন্য তার যথাসাধ্য করছেন। আজকের দিনে, খ্রিস্টের অনুসারীদের মণ্ডলীগুলো মার্থার মতো স্ত্রীলোকদের দ্বারা আশীর্বাদপ্রাপ্ত, যারা নির্ভয়চিত্ত ও উদার, নিজেদেরকে বিলিয়ে দিয়ে তাদের বিশ্বাস অনুসারে কাজ করে। খুব সম্ভবত মার্থা তা-ই করে গিয়েছিলেন। যদি তা করে থাকেন, তাহলে তিনি বিজ্ঞতার সঙ্গে কাজ করেছিলেন কারণ তার তখনও আরও কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হওয়ার ছিল।

কয়েক দিনের মধ্যে, মার্থার তার প্রিয় প্রভু, যিশুর কষ্টদায়ক মৃত্যু সহ্য করার ছিল। এ ছাড়া, সেই একই হত্যাকারী কপটীরা যারা তাঁকে হত্যা করেছিল, তারা লাসারকেও হত্যা করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল, কারণ তার পুনরুত্থান অনেকের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করছিল। (যোহন ১২:৯-১১) আর অবশ্যই, পরিশেষে মৃত্যু সেই প্রেমময় বন্ধনকে ছিন্ন করেছিল, যা মার্থাকে তার ভাইবোনের সঙ্গে জুড়ে রেখেছিল। আমরা জানি না যে, কীভাবে অথবা কখন তা ঘটেছিল কিন্তু আমরা হয়তো এই ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারি: মার্থার অমূল্য বিশ্বাস তাকে শেষ পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে সাহায্য করেছিল। সেই কারণে, আজকে খ্রিস্টানদের মার্থার বিশ্বাসকে অনুকরণ করা উচিত। (w১১-E ০৪/০১)

[পাদটীকা]

^ পুনরুত্থান সম্বন্ধীয় বাইবেলের শিক্ষার বিষয়ে আরও জানার জন্য যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত বাইবেল প্রকৃতপক্ষে কী শিক্ষা দেয়? বইয়ের ৭ অধ্যায় দেখুন।

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

এমনকী শোক করার সময়েও, মার্থা বিশ্বাসকে দৃঢ় করে এমন বিষয়গুলোর ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার জন্য তাকে নির্দেশনা দিতে যিশুকে সুযোগ দিয়েছিলেন

[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

যদিও মার্থা “চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন” ছিলেন, তবুও তিনি নম্রভাবে সংশোধন গ্রহণ করেছিলেন

[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

যিশুর ওপর মার্থার বিশ্বাসকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল, যখন তিনি তার ভাইকে পুনরুত্থিত হতে দেখেছিলেন