সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

তিনি তার ঈশ্বরের কাছ থেকে সান্ত্বনা লাভ করেছিলেন

তিনি তার ঈশ্বরের কাছ থেকে সান্ত্বনা লাভ করেছিলেন

তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন

তিনি তার ঈশ্বরের কাছ থেকে সান্ত্বনা লাভ করেছিলেন

আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল আর এলিয় বৃষ্টির মধ্যে দৌড়াচ্ছিলেন। যিষ্রিয়েলে পৌঁছানোর জন্য তার অনেকটা পথ যাওয়ার ছিল আর তার বয়সও হয়েছিল। কিন্তু তিনি অক্লান্তভাবে দৌড়াচ্ছিলেন, কারণ “সদাপ্রভুর হস্ত” তার উপরে ছিল। তার শরীরে যে-শক্তি কাজ করছিল, নিশ্চিতভাবেই তা তার কাছে পরিচিত যেকোনো শক্তির চেয়ে ভিন্ন ছিল। তিনি সবেমাত্র ঘোড়ার দলকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন যেটা আহাব রাজার রাজকীয় রথকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল!—১ রাজাবলি ১৮:৪৬.

এলিয় এখন আহাব রাজাকে অনেকটা পিছনে ফেলে এসেছেন আর তাকে এক দীর্ঘ পথ যেতে হবে। কল্পনা করুন যে, তিনি যখন দৌড়াচ্ছেন, তখন এলিয়ের চোখে-মুখে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়ছে এবং তিনি তার জীবনে ঘটা সবচেয়ে স্মরণীয় দিনের বিষয়ে চিন্তা করছেন। নিঃসন্দেহে, এটা এলিয়ের ঈশ্বর যিহোবার এবং সত্য উপাসনার পক্ষে এক গৌরবময় বিজয় ছিল। বাল উপাসকদেরকে প্রবল ও অলৌকিকভাবে পরাজিত করার জন্য যিহোবা যেখানে এলিয়কে ব্যবহার করেছিলেন, সেই কর্মিল পর্বতের চূড়া ঝড় ও অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল এবং সেটাকে তিনি দূরে ফেলে এসেছিলেন। শত শত বাল ভাববাদীদের দুষ্টতাপূর্ণ প্রতারণা প্রকাশ হয়ে পড়েছিল এবং ন্যায্যভাবেই তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এরপর এলিয় সেই দেশে সাড়ে তিন বছর ধরে চলা খরা দূর করার জন্য যিহোবার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। বৃষ্টি শুরু হয়েছিল! *১ রাজাবলি ১৮:১৮-৪৫.

বৃষ্টির মধ্যে ৩০ কিলোমিটার দূরে যিষ্রিয়েলে যাওয়ার পথে এলিয় হয়তো মনে করেছিলেন যে, শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি পালটাচ্ছে। আহাবকে পরিবর্তিত হতে হবে! আহাব যা দেখেছিলেন সেটার পর বাল উপাসনাকে ত্যাগ করা, তার রাণী ঈষেবলকে বিরত করা এবং যিহোবার দাসদের ওপর তাড়না বন্ধ করা ছাড়া নিশ্চিতভাবেই তার আর কোনো উপায় ছিল না।

আমরা যেভাবে চাই সেভাবে যখন বিষয়গুলো ঘটে, তখন স্বভাবতই আমাদের আশা বৃদ্ধি পায়। আমরা হয়তো চিন্তা করতে পারি যে, আমাদের জীবনের পরিস্থিতিগুলোর উন্নতি হবে, এমনকী হয়তো চিন্তা করতে পারি যে, আমরা আমাদের সবচেয়ে কঠিন সমস্যাকেও শেষপর্যন্ত কাটিয়ে উঠেছি। এলিয় যদি এরকম চিন্তা করে থাকেন, তাহলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ তিনিও “আমাদের ন্যায় সুখদুঃখভোগী মনুষ্য ছিলেন।” (যাকোব ৫:১৭) কিন্তু আসলে এলিয়ের সমস্যাগুলো কোনোভাবেই শেষ হয়ে যায়নি। বস্তুতপক্ষে, কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এলিয় এতটাই ভীত, এতটাই হতাশ হয়ে পড়বেন যে, তিনি তার মৃত্যু কামনা করবেন। কী ঘটেছিল? আর কীভাবে যিহোবা তাঁর ভাববাদীকে তার বিশ্বাস ও সাহস পুনরায় অর্জন করতে সাহায্য করেছিলেন? আসুন আমরা তা দেখি।

পরিস্থিতি অপ্রত্যাশিতভাবে পরিবর্তিত হয়

আহাব যখন যিষ্রিয়েলে তার প্রাসাদে পৌছেছিলেন, তখন তিনি কি পরিবর্তিত হয়ে আরও আধ্যাত্মিক ব্যক্তি হওয়ার কোনো প্রমাণ দিয়েছিলেন? আমরা পড়ি: “এলিয় যাহা যাহা করিয়াছিলেন, কেমন করিয়া তিনি সমুদয় ভাববাদীকে খড়্গ দ্বারা বধ করিয়াছিলেন, এই সমস্ত বৃত্তান্ত আহাব ঈষেবলকে জ্ঞাত করিলেন।” (১ রাজাবলি ১৯:১) লক্ষ করুন যে, আহাবের সেই দিনের ঘটনাগুলোর বর্ণনায় এলিয়ের ঈশ্বর যিহোবার কোনো উল্লেখ ছিল না। জাগতিকমনা ব্যক্তি আহাব সেই দিনের অলৌকিক ঘটনাগুলোকে শুধুই মানুষের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন কারণ তিনি বলেছিলেন “এলিয়” যা যা “করিয়াছিলেন।” স্পষ্টতই, তিনি যিহোবা ঈশ্বরকে সম্মান করতে শেখেননি। আর প্রতিশোধপরায়ণ ঈষেবল কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন?

তিনি প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন! রেগে গিয়ে তিনি এলিয়কে এই বার্তা পাঠিয়েছিলেন: “কল্য এমন সময়ে যদি আমি তোমার প্রাণকে তাঁহাদের এক জনের প্রাণের সমান না করি, তবে দেবগণ আমাকে অমুক ও ততোধিক দণ্ড দিউন।” (১ রাজাবলি ১৯:২) এটা ছিল নিষ্ঠুরভাবে প্রাণনাশের হুমকি। বস্তুতপক্ষে, ঈষেবল এই প্রতিজ্ঞা করছিলেন যে, তার বাল ভাববাদীদের প্রতিশোধের জন্য পরের দিনের মধ্যে তিনি যদি এলিয়কে হত্যা করতে না পারেন, তাহলে তিনি নিজে মারা যাবেন। কল্পনা করুন যে, এলিয় সেই ঝোড়ো রাতে যিষ্রিয়েলে একটা ছোটো ঘরে ঘুম থেকে উঠেই রাণীর বার্তাবাহককে সেই ভয়াবহ বার্তা ঘোষণা করতে শুনেন। তিনি কেমন বোধ করেছিলেন?

নিরুৎসাহিত ও ভীত

এলিয় যদি এরকম চিন্তা করে থাকেন যে, বাল উপাসনার বিরুদ্ধে লড়াই প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাহলে সেই মুহূর্তে তার আশাভঙ্গ হয়েছিল। ঈষেবল দমে যাননি। তার আদেশে এলিয়ের অসংখ্য বিশ্বস্ত সহকর্মীকে ইতিমধ্যেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল আর এখন মনে হয়েছিল যে, তিনি হলেন পরবর্তী ব্যক্তি। বাইবেল আমাদের বলে: “এলিয় তাহা দেখিয়া উঠিলেন [‘এলিয় এতে ভয় পেয়েছিলেন,’ বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন]।” এলিয় কি তার মনশ্চক্ষে দেখতে পেয়েছিলেন যে, ঈষেবল তাকে কত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করবেন? তিনি যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করে চলেছিলেন, তাহলে কোনো সন্দেহ নেই তিনি সাহস হারিয়ে ফেলেছিলেন। যেকোনোভাবেই হোক এলিয় ‘প্রাণরক্ষার্থে চলিয়া গিয়াছিলেন’—তিনি তার জীবন বাঁচানোর জন্য পালিয়ে গিয়েছিলেন।—১ রাজাবলি ১৮:৪; ১৯:৩.

এলিয়ই একমাত্র বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছিলেন না যিনি ভীত হয়েছিলেন। এর অনেক পরে, প্রেরিত পিতরও একইরকম সমস্যায় পড়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, যিশু যখন জলের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় পিতরকে তার সঙ্গে নিয়েছিলেন, তখন প্রেরিত ‘বাতাস দেখিতে’ শুরু করেছিলেন। এর ফলে তিনি তার সাহস হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং ডুবে যেতে শুরু করেছিলেন। (মথি ১৪:৩০) তাই, পিতর ও এলিয়ের উদাহরণ আমাদেরকে এক মূল্যবান শিক্ষা প্রদান করে। আমরা যদি আমাদের সাহসকে বজায় রাখতে চাই, তাহলে আমরা সেই বিপদগুলো নিয়ে চিন্তা করব না যেগুলোকে আমরা ভয় পাই। আমাদের আশা ও শক্তির উৎসের প্রতি আমাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রাখা প্রয়োজন।

“এই যথেষ্ট”

ভয় পেয়ে এলিয় দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে যিহূদার দক্ষিণ প্রান্তের কাছাকাছি এক শহর বের্‌শেবায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তার পরিচারককে ছেড়ে একাই প্রান্তরে চলে গিয়েছিলেন। বিবরণ বলে যে, তিনি “এক দিনের পথ” গিয়েছিলেন, তাই আমরা হয়তো কল্পনা করতে পারি যে, তিনি সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিলেন, আর স্পষ্টতই তিনি খাবার-দাবার অথবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস নেননি। বিষণ্ণ হয়ে, ভয় পেয়ে তিনি প্রখর রোদে রুক্ষ ও ধু-ধু এলাকার মধ্যে অতি কষ্টে এগিয়ে চলেছিলেন। সূর্য যখন ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছিল ও রাত হচ্ছিল, তখন এলিয়ের চলার শক্তি ফুরিয়ে গিয়েছিল। ক্লান্ত হয়ে তিনি একটা রোতম গাছের নীচে—সেই ধু-ধু মরুভূমিতে সবচেয়ে কাছের আশ্রয়স্থানে—বসে পড়েছিলেন।—১ রাজাবলি ১৯:৪.

অত্যন্ত হতাশ হয়ে এলিয় প্রার্থনা করেছিলেন। তিনি মৃত্যু কামনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “আপন পিতৃপুরুষদের হইতে আমি উত্তম নহি।” তিনি জানতেন যে, তার পিতৃপুরুষরা কবরের মধ্যে থাকা শুধুমাত্র ধুলি ও অস্থি ছাড়া আর কিছুই ছিল না, যারা কারো জন্য কোনো ভালো কিছু করতে পারত না। (উপদেশক ৯:১০) এলিয় নিজেকে অযোগ্য বলে মনে করেছিলেন। তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, তিনি আর্তনাদ করে বলেছিলেন: “এই যথেষ্ট।” বেঁচে থেকে কী লাভ?

এটা জানা কি আশ্চর্যজনক যে, ঈশ্বরের একজন ব্যক্তি এতটা হতাশ হয়ে পড়তে পারেন? অবশ্যই নয়। বাইবেলের বিবরণে বেশ কিছু পুরুষ ও নারীর বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে যারা এতটাই দুঃখিত হয়ে পড়েছিল যে, তারা মারা যেতে চেয়েছিল—তাদের মধ্যে রয়েছে রিবিকা, যাকোব, মোশি এবং ইয়োব।—আদিপুস্তক ২৫:২২; ৩৭:৩৫; গণনাপুস্তক ১১:১৩-১৫; ইয়োব ১৪:১৩.

আজকে আমরা ‘বিষম সময়ে’ বাস করছি, তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, অনেকে এমনকী ঈশ্বরের বিশ্বস্ত দাসেরা কখনো কখনো হতাশ হয়ে পড়ে। (২ তীমথিয় ৩:১) আপনি নিজে যদি কখনো এই ধরনের কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েন, তাহলে এই ক্ষেত্রে এলিয়ের উদাহরণ অনুসরণ করুন: ঈশ্বরের কাছে নিজের হৃদয় উজাড় করে দিন। সর্বোপরি, যিহোবা হলেন “সমস্ত সান্ত্বনার ঈশ্বর।” (২ করিন্থীয় ১:৩) তিনি কি এলিয়কে সান্ত্বনা প্রদান করেছিলেন?

যিহোবা তাঁর ভাববাদীকে শক্তি জুগিয়েছিলেন

যিহোবা যখন স্বর্গ থেকে তাঁর প্রিয় ভাববাদীকে প্রান্তরে সেই গাছের নীচে শুয়ে থাকতে এবং তাকে তার মৃত্যু কামনা করতে দেখেছিলেন, তখন তিনি কেমন অনুভব করেছিলেন বলে আপনি মনে করেন? এই নিয়ে আমাদের অনুমান করার প্রয়োজন নেই। এলিয় গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়ার পর যিহোবা একজন স্বর্গদূতকে তার কাছে পাঠিয়েছিলেন। সেই স্বর্গদূত এলিয়কে কোমলভাবে স্পর্শ করে জাগিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন: “উঠ, আহার কর।” এলিয় তা-ই করেছিলেন, কারণ স্বর্গদূত সদয়ভাবে সাধারণ খাবার অর্থাৎ টাটকা ও গরম-গরম রুটি এবং জল পরিবেশন করেছিলেন। এটার জন্য কি এলিয় এমনকী সেই স্বর্গদূতকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন? বিবরণ শুধু বলে যে, ভাববাদী ভোজন ও পান করেছিলেন এবং আবারও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তিনি কি এতটাই হতাশ ছিলেন যে, তিনি কথা বলতে চাননি? যা-ই হোক না কেন, স্বর্গদূতটি তাকে দ্বিতীয়বার, সম্ভবত ভোরের দিকে জাগিয়েছিলেন। আরও একবার তিনি এলিয়কে বলেছিলেন, “উঠ, আহার কর” আর এরপর তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলেছিলেন, “কেননা তোমার শক্তি হইতেও পথ অধিক।”—১ রাজাবলি ১৯:৫-৭.

ঈশ্বরদত্ত অন্তর্দৃষ্টির কারণে সেই স্বর্গদূত জানতেন যে, এলিয় কোথায় যাচ্ছিলেন। এ ছাড়া, তিনি এও জানতেন যে, সেই যাত্রা এলিয়ের জন্য এতটাই কঠিন হবে যে, তিনি নিজের শক্তিতে তা সম্পন্ন করতে পারবেন না। এমন একজন ঈশ্বরকে সেবা করা কতই না সান্ত্বনাদায়ক যিনি আমাদের উদ্দেশ্য ও আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো সম্বন্ধে আমাদের চেয়ে আরও ভালো করে জানেন! (গীতসংহিতা ১০৩:১৩, ১৪) সেই খাবার থেকে এলিয় কতটা উপকৃত হয়েছিলেন?

আমরা পড়ি: “তিনি উঠিয়া ভোজন পান করিলেন, এবং সেই খাদ্যের প্রভাবে চল্লিশ দিবারাত্র গমন করিয়া ঈশ্বরের পর্ব্বত হোরেবে উপস্থিত হইলেন।” (১ রাজাবলি ১৯:৮) তার চেয়ে ছয় শতাব্দী আগে মোশির এবং প্রায় দশ শতাব্দী পরে যিশুর মতো, এলিয়ও ৪০ দিন ও ৪০ রাত উপবাস করেছিলেন। (যাত্রাপুস্তক ৩৪:২৮; লূক ৪:১, ২) সেই একবারের খাবার তার সমস্ত সমস্যাকে সমাধান করেনি কিন্তু এটা এক অলৌকিক উপায়ে তাকে শক্তি জুগিয়েছিল। কল্পনা করুন যে, সেই বয়স্ক ব্যক্তিটি পথহীন প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, প্রায় দেড় মাস ধরে কষ্ট করে হাঁটছেন!

আজকের দিনেও যিহোবা তাঁর দাসদেরকে শক্তি জুগিয়ে থাকেন, তবে অলৌকিকভাবে আক্ষরিক খাবার জুগিয়ে নয় কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ এক উপায়ে। তিনি তাঁর দাসদের আধ্যাত্মিকভাবে যত্ন নিয়ে থাকেন। (মথি ৪:৪) তাঁর বাক্য ও পুরোপুরিভাবে বাইবেলের ওপর ভিত্তি করা প্রকাশনাদি থেকে ঈশ্বর সম্বন্ধে জানা আমাদেরকে আধ্যাত্মিকভাবে শক্তি জোগায়। এই ধরনের আধ্যাত্মিক পুষ্টি লাভ করা হয়তো আমাদের সমস্ত সমস্যাকে দূর করবে না, কিন্তু এটা আমাদেরকে সেই সমস্যাগুলো সহ্য করতে সাহায্য করতে পারে যেগুলো হয়তো অসহনীয়। এ ছাড়া, এটা ‘অনন্ত জীবনের’ দিকে পরিচালিত করে।—যোহন ১৭:৩.

শেষ পর্যন্ত হোরেব পর্বতে, যেখানে অনেক পূর্বে যিহোবা ঈশ্বর একজন দূতের মাধ্যমে জ্বলন্ত ঝোপের মধ্যে মোশির কাছে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং যেখানে পরে যিহোবা ইস্রায়েলীয়দের সঙ্গে ব্যবস্থা চুক্তি করেছিলেন, সেখানে পৌঁছানোর জন্য এলিয়কে প্রায় ৩২০ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয়েছিল। এলিয় একটা গুহার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

যিহোবা যেভাবে তাঁর ভাববাদীকে সান্ত্বনা ও শক্তি প্রদান করেছিলেন

হোরেবে যিহোবার “বাক্য”—স্পষ্টতই যেটা একজন স্বর্গদূত প্রদান করেছিলেন—এই সাধারণ প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছিলেন: “এলিয়, তুমি এখানে কি করিতেছ?” খুব সম্ভবত এই প্রশ্নটা কোমলভাবে করা হয়েছিল, কারণ এলিয় এটাকে নিজের হৃদয় উজাড় করে দেওয়ার এক আমন্ত্রণ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আর তিনি সত্যিই তার হৃদয় উজাড় করে দিয়েছিলেন! তিনি বলেছিলেন: “আমি বাহিনীগণের ঈশ্বর সদাপ্রভুর পক্ষে অতিশয় উদ্যোগী হইয়াছি; কেননা ইস্রায়েল-সন্তানগণ তোমার নিয়ম ত্যাগ করিয়াছে, তোমার যজ্ঞবেদি সকল উৎপাটন করিয়াছে, ও তোমার ভাববাদিগণকে খড়্গ দ্বারা বধ করিয়াছে; আর আমি, কেবল একা আমিই অবশিষ্ট রহিলাম; আর তাহারা আমার প্রাণ লইতে চেষ্টা করিতেছে।” (১ রাজাবলি ১৯:৯, ১০) এলিয়ের কথাগুলো তার হতাশ হওয়ার বিষয়ে অন্ততপক্ষে তিনটে কারণ প্রকাশ করে।

প্রথমত, এলিয় মনে করেছিলেন যে, তার কাজ ব্যর্থ হয়েছে। ঈশ্বরের পবিত্র নাম এবং উপাসনাকে সর্বোচ্চ স্থানে রাখার দ্বারা বছরের পর বছর ধরে যিহোবার সেবায় “অতিশয় উদ্যোগী” হওয়া সত্ত্বেও এলিয় দেখেছিলেন যে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে বলে মনে হয়েছিল। লোকেরা তখনও অবিশ্বাসী ও বিদ্রোহী ছিল এবং মিথ্যা উপাসনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল। দ্বিতীয়ত, এলিয় একাকী বলে অনুভব করেছিলেন। “আমি, কেবল একা আমিই অবশিষ্ট রহিলাম,” তিনি বলেছিলেন, যেন তিনিই ছিলেন শেষ ব্যক্তি যিনি সেই জাতির মধ্যে যিহোবাকে সেবা করছিলেন। তৃতীয়ত, এলিয় ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তার অনেক সহভাববাদীকে ইতিমধ্যেই হত্যা করা হয়েছিল আর তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, এবার তাকে হত্যা করা হবে। এই ধরনের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করা হয়তো এলিয়ের পক্ষে সহজ ছিল না কিন্তু তিনি গর্ব ও অস্বস্তির কারণে পিছিয়ে পড়েননি। প্রার্থনায় তার ঈশ্বরের কাছে নিজের হৃদয় উজাড় করে দেওয়ার দ্বারা তিনি সমস্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তির জন্য এক উত্তম উদাহরণ স্থাপন করেছেন।—গীতসংহিতা ৬২:৮.

যিহোবা কীভাবে এলিয়ের ভয় ও উদ্‌বেগের প্রতি সাড়া দিয়েছিলেন? সেই স্বর্গদূত তাকে গুহার প্রবেশদ্বারে দাঁড়াতে বলেছিলেন। কী ঘটতে চলেছে তা না জেনেই তিনি তার কথা শুনেছিলেন। এক প্রবল ঝোড়ো হাওয়া বয়ে গিয়েছিল! এর ফলে নিশ্চয়ই কানে তালা লাগার মতো প্রচণ্ড শব্দ হয়েছিল কারণ এটা এত শক্তিশালী ছিল যে, তা পর্বতমালা ও শৈলকে বিদীর্ণ করেছিল। কল্পনা করুন যে, ঝোড়ো হাওয়ায় যখন তার ভারী ও সাধারণ মানের লোমশ জামাটা খুলে যাচ্ছিল, তখন সেটা ধরে রাখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজের চোখ ঢাকার চেষ্টা করছেন। এরপর তার শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যও তাকে সংগ্রাম করতে হচ্ছিল কারণ ভূখণ্ড কাঁপতে শুরু করেছিল—সেই অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়েছিল! এগুলো কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই, বিরাট আগুন বয়ে যায় এবং প্রচণ্ড তাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তিনি গুহার মধ্যে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।—১ রাজাবলি ১৯:১১, ১২.

প্রতিটা ক্ষেত্রেই, বিবরণ আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে, প্রাকৃতিক শক্তির এই বিস্ময়কর প্রদর্শনগুলোর মধ্যে যিহোবা ছিলেন না। এলিয় জানতেন যে, যিহোবা কোনো পৌরাণিক প্রাকৃতিক দেবতা ছিলেন না, যেমনটা ছিল বাল দেবতা যাকে তার প্রবঞ্চক উপাসকরা “মেঘের চালক” অথবা বৃষ্টি আনয়নকারী হিসেবে উপাসনা করত। প্রকৃতিতে যেসমস্ত বিস্ময়কর শক্তি দেখতে পাওয়া যায়, যিহোবাই হলেন সেগুলোর প্রকৃত উৎস কিন্তু তিনি যা-কিছু সৃষ্টি করেছেন সেগুলোর থেকে তিনি অতি মহান। এমনকী ‘মহাকাশও’ তাঁকে ধারণ করতে পারে না! (১ রাজাবলি ৮:২৭, বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন) কিন্তু এইসমস্তই কীভাবে এলিয়কে সাহায্য করেছিল? তার ভয়ের বিষয়টা স্মরণ করুন। অপ্রতিরোধ্য শক্তি যাঁর নখদর্পণে সেই যিহোবার মতো একজন ঈশ্বরকে পাশে পেয়ে, এলিয়ের আহাব ও ঈষেবলকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণই ছিল না!—গীতসংহিতা ১১৮:৬.

আগুন নিভে যাওয়ার পর, সবকিছু শান্ত হয়ে গিয়েছিল এবং এলিয় “ঈষৎ শব্দকারী ক্ষুদ্র এক স্বর” শুনেছিলেন। এটা আবারও এলিয়কে মনের কথা বলতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এবং তিনি তা-ই করেছিলেন, দ্বিতীয়বার তার উদ্‌বেগগুলো সম্বন্ধে বলেছিলেন। * সম্ভবত এটা তাকে আরও স্বস্তি দিয়েছিল। কিন্তু, ‘ঈষৎ শব্দকারী ক্ষুদ্র স্বর’ পরে তাকে যা বলেছিল তা থেকে এলিয় নিঃসন্দেহে এমনকী আরও সান্ত্বনা লাভ করেছিলেন। যিহোবা এলিয়কে পুনরায় আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তিনি অযোগ্য নন। কীভাবে? ইস্রায়েলে বাল উপাসনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিষয়ে ঈশ্বর তাঁর ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অনেক কিছু প্রকাশ করেছিলেন। স্পষ্টতই, এলিয়ের কাজ ব্যর্থ হয়ে যায়নি, কারণ ঈশ্বরের উদ্দেশ্য অপ্রতিরোধ্যভাবে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছিল। অধিকন্তু, যিহোবা যেহেতু তাকে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা দিয়ে আবারও ফেরত পাঠিয়েছিলেন, তাই তখনও সেই উদ্দেশ্যে এলিয়ের ভূমিকা ছিল।—১ রাজাবলি ১৯:১২-১৭.

কিন্তু, এলিয়ের একাকীত্ব বোধ সম্বন্ধে কী বলা যায়? সেই বিষয়ে যিহোবা দুটো কাজ করেছিলেন। প্রথমত, তিনি এলিয়কে বলেছিলেন যেন ভাববাদী হিসেবে ইলীশায়কে অভিষেক করেন, যিনি পরিশেষে তার উত্তরাধিকারী হবেন। এই যুবক ব্যক্তিটি কয়েক বছরের জন্য এলিয়ের সাথি ও সাহায্যকারী হবেন। সেই সান্ত্বনা কতই না ব্যবহারিক ছিল! দ্বিতীয়ত, যিহোবা এই রোমাঞ্চকর সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন: “ইস্রায়েলের মধ্যে আমি আপনার জন্য সাত সহস্র লোককে অবশিষ্ট রাখিব, সেই সকলের জানু বালের সম্মুখে পাতিত হয় নাই, ও সেই সকলের মুখ তাহাকে চুম্বন করে নাই।” (১ রাজাবলি ১৯:১৮) এলিয় একা ছিলেন না। সেই হাজার হাজার বিশ্বস্ত ব্যক্তির বিষয়ে শোনা নিশ্চয়ই তার হৃদয়কে উষ্ণ করেছিল যারা বালের উপাসনা করা প্রত্যাখ্যান করেছিল। তারা চেয়েছিল যেন এলিয় তার বিশ্বস্ত সেবাকে বজায় রাখেন, সেই অন্ধকারময় সময়গুলোতে যিহোবার প্রতি অটল আনুগত্যের এক উদাহরণ স্থাপন করেন। এলিয় নিশ্চয় যিহোবার বার্তাবাহকের, তাঁর ঈশ্বরের ‘ঈষৎ শব্দকারী ক্ষুদ্র স্বরের’ কথাগুলো শুনে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

এলিয়ের মতো আমরাও হয়তো সৃষ্টির মধ্যে প্রকাশিত বিপুল প্রাকৃতিক শক্তিগুলো দেখে অভিভূত হতে পারি আর তা হওয়া যথার্থই। সৃষ্টি স্পষ্টভাবেই সৃষ্টিকর্তার শক্তিকে প্রতিফলিত করে। (রোমীয় ১:২০) তাঁর বিশ্বস্ত দাসদেরকে সাহায্য করার জন্য যিহোবা এখনও তাঁর অসীম শক্তিকে ব্যবহার করতে ভালবাসেন। (২ বংশাবলি ১৬:৯) কিন্তু, ঈশ্বর তাঁর বাক্য বাইবেলের পাতায় পাতায় আমাদের সঙ্গে আরও বিস্তারিতভাবে কথা বলেন। (যিশাইয় ৩০:২১) আরেক কথায়, বাইবেল হল সেই ‘ঈষৎ শব্দকারী ক্ষুদ্র স্বরের’ মতো, যেটির দ্বারা যিহোবা আজকে আমাদেরকে নির্দেশনা দেন, সংশোধন করেন, উৎসাহ দেন এবং তাঁর প্রেম সম্বন্ধে পুনরায় আশ্বস্ত করেন।

হোরেব পর্বতে যিহোবা এলিয়কে যে-সান্ত্বনা প্রদান করেছিলেন, তিনি কি তা গ্রহণ করেছিলেন? হ্যাঁ করেছিলেন! শীঘ্র তিনি তার কাজ শুরু করেছিলেন, আবারও এমন এক সাহসী, বিশ্বস্ত ভাববাদী হয়ে উঠেছিলেন, যিনি মিথ্যা উপাসনার মধ্যে থাকা দুষ্টতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। একইভাবে, আমরা যদি ঈশ্বরের অনুপ্রাণিত কথাগুলোতে, ‘শাস্ত্রমূলক সান্ত্বনায়’ মনোযোগ দিই, তাহলে আমরা এলিয়ের বিশ্বাসকে অনুকরণ করতে পারব।—রোমীয় ১৫:৪. (w১১-E ০৭/০১)

[পাদটীকাগুলো]

^ ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রহরীদুর্গ পত্রিকায় “তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন”-এর অধীনে “তিনি বিশুদ্ধ উপাসনার পক্ষসমর্থন করেছিলেন” শিরোনামের প্রবন্ধটি দেখুন।

^ এই ‘ঈষৎ শব্দকারী ক্ষুদ্র স্বরের’ উৎস হয়তো সেই একই স্বর্গদূত, যিনি ১ রাজাবলি ১৯:৯ পদে উল্লেখিত “সদাপ্রভুর বাক্য” প্রদান করেছিলেন। ১৫ পদ “সদাপ্রভু” সম্বন্ধে উল্লেখ করে যাঁকে সেই স্বর্গদূত প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। আমরা হয়তো সেই স্বর্গদূতের বিষয়ে স্মরণ করতে পারি যাকে যিহোবা প্রান্তরে ইস্রায়েলীয়দেরকে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেছিলেন এবং যার বিষয়ে ঈশ্বর বলেছিলেন: “তাঁহার অন্তরে আমার নাম রহিয়াছে।” (যাত্রাপুস্তক ২৩:২১) অবশ্য, এই বিষয়ে আমরা একেবারে নিশ্চিত করে বলতে পারি না, তবে এটা লক্ষণীয় যে, তাঁর মনুষ্যপূর্ব অস্তিত্বে যিশু যিহোবার দাসদের জন্য “বাক্য” অর্থাৎ বিশেষ মুখপাত্র হিসেবে সেবা করেছিলেন।—যোহন ১:১.

[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

ভালো ও মন্দ উভয় সময়েই যিহোবা এলিয়কে প্রচুররূপে আশীর্বাদ করেছিলেন

[১৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

অত্যন্ত বিষণ্ণতার সময়ে এলিয় যিহোবার কাছে তার হৃদয় উজাড় করে দিয়েছিলেন

[১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

এলিয়কে সান্ত্বনা ও উৎসাহ প্রদান করতে যিহোবা তাঁর বিস্ময়কর শক্তিকে ব্যবহার করেছিলেন