সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

বাইবেল পাঠ আমার শক্তির চিরন্তন উৎস

বাইবেল পাঠ আমার শক্তির চিরন্তন উৎস

বাইবেল পাঠ আমার শক্তির চিরন্তন উৎস

বলেছেন মারসো লারওয়া

“আদিতে ঈশ্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি করিলেন,” আমি নিজের রুমে গোপনে বসে পড়তে শুরু করি। আপনারা কি জানেন যে, কেন আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে হয়েছিল? কারণ নিশ্চিতভাবেই একজন গোঁড়া নাস্তিকবাদী হিসেবে আমার বাবা আমার হাতের এই বইটিকে—বাইবেলকে—কখনোই পছন্দ করতেন না।

আমি আগে কখনো বাইবেল পড়িনি আর আদিপুস্তকের সেই শুরুর কথাগুলো আমাকে বজ্রপাতের মতোই আঘাত করেছিল। আমার মনে হয়েছিল, ‘এই তো সেই ভৌত নিয়মগুলোর মধ্যে থাকা সংগতির ব্যাখ্যা, যা সবসময়ই আমাকে অবাক করেছে!’ অভিভূত হয়ে, আমি রাত আটটা থেকে ভোর চারটে পর্যন্ত পড়তে থাকি। এভাবেই আমার ঈশ্বরের বাক্য পড়ার চিরন্তন অভ্যাসের শুরু হয়। এখন আমি আপনাদের বলছি যে, কীভাবে বাইবেল পড়া আমার সারাজীবনের শক্তির উৎস হয়ে এসেছে।

“তোমাকে প্রতিদিনই এটি পড়তে হবে”

১৯২৬ সালে, উত্তর ফ্রান্সের ভারমেল নামে এক গ্রামে আমার জন্ম হয় আর সেখানে কয়লাখনি ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কয়লা ছিল এমন এক দ্রব্য, যেটার জাতীয় গুরুত্ব ছিল। আর তাই, একজন খনিশ্রমিক হওয়ায় আমাকে সেনাবাহিনীর কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, আরও ভালোভাবে জীবনযাপন করার জন্য আমি বেতার ও বিদ্যুৎশক্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করি, যা আমাকে ভৌত নিয়মগুলোর মধ্যে থাকা সংগতি সম্বন্ধে বুঝতে সাহায্য করেছে। আমার বয়স যখন ২১ বছর, তখন আমার একজন সহপাঠী আমাকে একটি বাইবেল দিয়ে বলেছিল, “এটি সত্যিই পড়ার মতো একটি বই।” এটি পড়ে শেষ করার পর আমি এই বিষয়ে দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়েছিলাম যে, বাইবেল হল ঈশ্বরের বাক্য, মানবজাতির জন্য প্রকাশিত এক বাক্য।

আমার প্রতিবেশীরাও বাইবেল পড়তে আগ্রহী হবে ভেবে, আমি আটটি কপি নিয়েছিলাম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, আমাকে উপহাস ও বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কুসংস্কারাচ্ছন্ন আত্মীয়স্বজন আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল, “একবার যদি তুমি এই বই পড়তে শুরু করো, তাহলে তোমাকে প্রতিদিনই এটি পড়তে হবে!” আমি বইটি পড়েছিলাম আর এর জন্য আমি কখনোই আক্ষেপ করিনি। এটা আমার চিরন্তন অভ্যাস হয়ে উঠেছিল।

বাইবেলের প্রতি আমার আগ্রহ বুঝতে পেরে কিছু প্রতিবেশী আমাকে এমন সব প্রকাশনা দিয়ে গিয়েছিল, যেগুলো তারা যিহোবার সাক্ষিদের কাছ থেকে পেয়েছিল। বিভিন্ন পুস্তিকা যেমন একটা জগৎ, একটাই সরকার * (ইংরেজি) (ফ্রেঞ্চ ভাষায় দেখানো হয়েছে) পুস্তিকাটির মধ্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল যে, কেন বাইবেল ঈশ্বরের রাজ্যকে মানবজাতির একমাত্র আশা হিসেবে নির্দেশ করে। (মথি ৬:১০) এই আশা সম্বন্ধে অন্যদেরকে জানানোর জন্য আমি আগের চেয়ে আরও বেশি দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হয়ে উঠেছিলাম।

সবচেয়ে প্রথমে যে আমার কাছ থেকে একটি বাইবেল নিয়েছিল, সে ছিল আমার ছেলেবেলার এক বন্ধু নয়েল। একজন ক্যাথলিক হওয়ায় সে আমাদের দুজনের সঙ্গে এমন এক ব্যক্তির সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিল, যিনি একজন যাজক হওয়ার জন্য পড়াশোনা করছিলেন। যদিও আমি ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু গীতসংহিতা ১১৫:৪-৮ এবং মথি ২৩:৯, ১০ পদ থেকে আমি জানতে পেরেছিলাম যে, উপাসনায় মূর্তি ব্যবহার করাকে এবং পাদরিদের কোনো ধর্মীয় উপাধি দিয়ে সম্বোধন করাকে ঈশ্বর সমর্থন করেন না। এটা আমাকে আমার নতুন বিশ্বাসের পক্ষসমর্থন করার জন্য সাহস প্রদান করেছিল। ফল স্বরূপ, নয়েল সত্য গ্রহণ করেছিল এবং এখন পর্যন্ত একজন বিশ্বস্ত সাক্ষি হিসেবে সেবা করছে।

এ ছাড়া, আমি আমার দিদির সঙ্গেও দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার স্বামীর কাছে প্রেতচর্চা সংক্রান্ত বইপত্র ছিল এবং তিনি মন্দদূতদের হয়রানির শিকার হচ্ছিলেন। যদিও প্রথম প্রথম আমি নিজেকে দুর্বল বলে মনে করতাম কিন্তু বাইবেলের বিভিন্ন পদ যেমন, ইব্রীয় ১:১৪ পদ আমাকে নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, আমার সঙ্গে যিহোবার দূতদের সমর্থন রয়েছে। আমার দাদাবাবু যখন বাইবেলের নীতিগুলো কাজে লাগিয়েছিলেন এবং জাদুমন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সমস্তকিছু দূর করে দিয়েছিলেন, তখন তিনি মন্দদূতদের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলেন। তিনি এবং আমার দিদি, দুজনেই উদ্যোগী সাক্ষি হয়ে উঠেছিলেন।

১৯৪৭ সালে, আর্থার ইমিয়ট নামে আমেরিকার একজন সাক্ষি আমার বাড়িতে এসেছিলেন। অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, সাক্ষিরা কোথায় মিলিত হয়ে থাকে। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, প্রায় দশ কিলোমিটার (৬ মাইল) দূরে লিয়েভিঁতে একটা দল রয়েছে। সেই সময়ে, এমনকী একটা সাইকেল পাওয়াও দুষ্কর ছিল আর তাই বেশ কয়েক মাস ধরে আমাকে হেঁটে হেঁটে সভাতে যাওয়া-আসা করতে হয়েছিল। ফ্রান্সে আট বছর ধরে যিহোবার সাক্ষিদের কাজ নিষিদ্ধ ছিল। পুরো দেশে মাত্র ২,৩৮০ জন সাক্ষি ছিল—যাদের মধ্যে অনেকেই ছিল পোলিশ অভিবাসী। কিন্তু, ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সে আমাদের কাজকে আবারও বৈধ স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছিল। প্যারিসের ভিল্লা গিবারে একটা শাখা অফিস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। যেহেতু ফ্রান্সে এমনকী এক জন অগ্রগামীও ছিল না, তাই ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ইন্‌ফরম্যান্ট-এ (বর্তমানে আমাদের রাজ্যের পরিচর্যা-য়) নিয়মিত অগ্রগামীদের জন্য একটা আবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল, যাদের মাসে ১৫০ ঘন্টা প্রচার করতে হবে। (১৯৪৯ সালে এই ঘন্টা কমিয়ে ১০০ ঘন্টা করা হয়েছিল।) “[ঈশ্বরের] বাক্যই সত্যস্বরূপ,” যোহন ১৭:১৭ পদে প্রাপ্ত যিশুর এই কথাগুলোর সঙ্গে পুরোপুরি একমত হয়ে, আমি ১৯৪৮ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম এবং ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে একজন অগ্রগামী হয়েছিলাম।

কারাগার থেকে আবারও ডানকার্কে

দক্ষিণ ফ্রান্সের আঝেঁ শহরে আমার প্রথম কার্যভারে আমি খুব অল্পসময়ই কাজ করতে পেরেছিলাম। যেহেতু আমি খনিতে কাজ করা ছেড়ে দিয়েছিলাম, তাই আমি সেনাবাহিনীতে কাজ করতে বাধ্য ছিলাম। কিন্তু, আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার বিষয়টা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম আর ফল স্বরূপ আমাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। যদিও আমাকে বাইবেল রাখার অনুমতি দেওয়া হয়নি, তবুও আমার কাছে গীতসংহিতা বইয়ের কয়েকটি পৃষ্ঠা ছিল। সেগুলো পড়ে আমি উৎসাহিত হয়েছিলাম। আমাকে যখন ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল: আমি কি সংসারী হওয়ার জন্য পূর্ণসময়ের সেবা করা বন্ধ করে দেব? আবারও, বাইবেলে পড়া বিষয়বস্তু আমাকে সাহায্য করেছিল। আমি ফিলিপীয় ৪:১১-১৩ পদে প্রাপ্ত পৌলের এই কথাগুলো নিয়ে ধ্যান করেছিলাম: “যিনি আমাকে শক্তি দেন, তাঁহাতে আমি সকলই করিতে পারি।” আমি অগ্রগামীর কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ১৯৫০ সালে, আমি একটা নতুন কার্যভার লাভ করেছিলাম আর তা ছিল ডানকার্কে, যে-শহরে আমি আগে প্রচার করেছি।

আমি যখন সেখানে পৌঁছাই, তখন আমার কাছে কিছুই ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সেই শহর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আর তাই সেখানে থাকার জায়গা খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমি সেই পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যাদের কাছে আমি আগে প্রচার করতাম আর সেই ঘরের গৃহকর্ত্রী আমাকে দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বলে উঠেছিলেন: “ওহ্‌, মিস্টার লারওয়া, আপনি ছাড়া পেয়েছেন দেখে খুবই ভালো লাগছে! আমার স্বামী বলে যে, যদি আপনার মতো আরও মানুষ থাকত, তাহলে আর কখনোই যুদ্ধ হতো না।” তাদের একটা গেস্টহাউজ ছিল আর তাই ট্যুরিস্ট সিজন না আসা পর্যন্ত তারা আমাকে সেখানে থাকার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই একই দিনে আর্থার ইমিয়টের দাদা ইভান্জ আমাকে কাজের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। * তিনি বন্দরে একজন দোভাষী হিসেবে কাজ করতেন এবং রাতের বেলা একটা জাহাজ পাহারা দেওয়ার জন্য একজন নৈশপ্রহরী খুঁজছিলেন। তিনি আমাকে সেই জাহাজের একজন বড়ো কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কারাগারে থাকার কারণে আমি শুকিয়ে কাঠির মতো হয়ে গিয়েছিলাম। ইভান্জ যখন এর কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন, তখন সেই কর্মকর্তা আমাকে ফ্রিজ থেকে নিজের ইচ্ছেমতো খাবার নিয়ে খেতে বলেছিলেন। একই দিনে আমি থাকার জায়গা, কাজ এবং খাবার পেয়েছিলাম! মথি ৬:২৫-৩৩ পদে লিপিবদ্ধ যিশুর কথাগুলোর প্রতি আমার আস্থা সত্যিই বৃদ্ধি পেয়েছিল।

যখন ট্যুরিস্ট সিজন শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন আমার অগ্রগামী সঙ্গী সিমোঁ আপলিনারস্কি ও আমাকে অন্য কোথাও থাকার জায়গা খুঁজতে হয়েছিল, তবে আমরা আমাদের কার্যভার চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। আমাদেরকে একটা পুরোনো ঘোড়ার আস্তাবলে থাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যেখানে আমরা খড় দিয়ে তোশক বানিয়ে ঘুমাতাম। দিনের বেলায় আমরা পরিচর্যায় রত থাকতাম। আমরা সেই আস্তাবলের মালিকের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম আর তিনিও আরও অনেকের মতোই সত্য গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। এর অল্প কয়েক দিন পরই স্থানীয় একটা সংবাদপত্রে একটা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল, যেখানে ডানকার্কের অধিবাসীদের সাবধান করা হয়েছিল, “এলাকায় যিহোবার সাক্ষিদের কার্যকলাপের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে।” কিন্তু, সেখানে সাক্ষি বলতে কেবল সিমোঁ এবং আমি আর অল্প কয়েক জন প্রকাশক ছিল! সমস্যার মুখোমুখি হলে, আমরা আমাদের খ্রিস্টীয় আশা নিয়ে ধ্যান করার এবং যিহোবা যেভাবে আমাদের যত্ন নিয়ে এসেছেন, তা বিবেচনা করার মাধ্যমে উৎসাহ লাভ করতাম। ১৯৫২ সালে যখন আমার কার্যভার পরিবর্তন হয়েছিল, তখন ডানকার্কে প্রায় ৩০ জন নিয়মিত প্রকাশক ছিল।

নতুন নতুন দায়িত্বের জন্য শক্তি লাভ করা

এমিয়েন্স শহরে অল্পসময় থাকার পর আমাকে প্যারিসের উপকণ্ঠে বুলোন-বিয়াঁকুরে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল। আমার অনেক বাইবেল অধ্যয়ন ছিল আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে পূর্ণসময়ের পরিচর্যা ও মিশনারির কাজকে গ্রহণ করে নিয়েছিল। গি মাবিলা নামে একজন যুবক সত্য গ্রহণ করে নিয়েছিল এবং পরে একজন সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে আর তারও পরে একজন জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছিল। পরবর্তী সময়ে, সে প্যারিস থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত লুভিয়েতে বর্তমান বেথেলের ছাপাখানার নির্মাণকাজের তত্ত্বাবধান করেছিল। পরিচর্যায় বার বার বাইবেল থেকে আলোচনা করার ফলে আমার মনের মধ্যে ঈশ্বরের বাক্য আরও বেশি করে গেঁথে গিয়েছিল আর এতে করে একদিকে যেমন আমার মন আনন্দে ভরে যেত, আবার একইসঙ্গে আমার শিক্ষাদানের ক্ষমতাও উন্নত হতো।

এরপর, ১৯৫৩ সালে হঠাৎ করে আমাকে অ্যালস্যাস-লোরেনে একজন সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল, যে-এলাকাকে জার্মানি ১৮৭১ ও ১৯৪৫ সালের মধ্যে দু-বার দখল করে নিয়েছিল। তাই, আমাকে কিছুটা জার্মান ভাষা শিখতে হয়েছিল। আমি যখন সীমার কাজ শুরু করেছিলাম, তখন যদিও সেই এলাকায় অল্পসংখ্যক গাড়ি, টেলিভিশন অথবা টাইপরাইটার ছিল, তবে কোনো ট্রানজিস্টার অথবা ব্যক্তিগত কম্পিউটার ছিল না। কিন্তু, আমার জীবনটা বিষাদময় ছিল না কিংবা একেবারে নীরসও ছিল না। বরং, এটা ছিল সবচেয়ে আনন্দময় এক সময়। কারণ সেই সময়ে যিহোবার সেবা থেকে বিক্ষিপ্ত করার মতো সামগ্রী বর্তমান সময়ের চেয়ে কম ছিল বলে, তা আমাকে এক ‘সরল চক্ষু’ বজায় রাখার ব্যাপারে বাইবেলের উপদেশ অনুসরণ করতে সাহায্য করেছিল।—মথি ৬:১৯-২২.

১৯৫৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত “বিজয়ী রাজ্য” নামক সম্মেলনটা আমার জীবনের এক স্মরণীয় ঘটনা ছিল। সেখানে আমার ভাবী স্ত্রী ইরেন কোলানস্কির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, যে আমার চেয়ে এক বছর আগে পূর্ণসময়ের কাজ শুরু করেছিল। তার বাবা-মা ছিল পোলিশ, যারা দীর্ঘসময় ধরে উদ্যোগী সাক্ষি হিসেবে কাজ করছিল। ফ্রান্সে অ্যাডল্ফ ওয়েবার তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। তিনি ভাই রাসেলের মালী হিসেবে কাজ করতেন এবং ইউরোপে সুসমাচার ঘোষণা করার জন্য এসেছিলেন। ইরেন এবং আমি ১৯৫৬ সালে বিয়ে করি এবং সে-ও আমার সঙ্গে সীমার কাজে যোগ দেয়। বছরের পর বছর ধরে সে আমাকে কত চমৎকারভাবেই না সমর্থন করে এসেছে!

দু-বছর পর, আমার জন্য আরেকটা অপ্রত্যাশিত বিষয় অপেক্ষা করছিল—আমাকে একজন জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তবে, যোগ্য ভাইদের অভাব পূরণ করার জন্য আমাকে একজন সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে ক্রমাগত কয়েকটা মণ্ডলী পরিদর্শন করতে হয়েছিল। সেই সময়টা কতই না ব্যস্ততাপূর্ণ ছিল! আমাকে মাসে ১০০ ঘন্টা প্রচার করা ছাড়াও বিভিন্ন কাজ করতে হতো আর এর মধ্যে ছিল প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন বক্তৃতা দেওয়া, তিনটে বাইবেল অধ্যয়ন দল পরিদর্শন করা, রেকর্ড চেক করা এবং রিপোর্ট প্রস্তুত করা। তাহলে, কীভাবে ঈশ্বরের বাক্য পড়ার জন্য সময় কিনে নেওয়া সম্ভব? আমার কাছে কেবল একটাই সমাধান ছিল—আমি একটি পুরোনো বাইবেলের পৃষ্ঠা কেটে আমার কাছে রেখে দিতাম। যখনই আমাকে নির্ধারিত সময়ে কারো সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করতে হতো, তখনই আমি সেই পৃষ্ঠাগুলো বের করে পড়তাম। আধ্যাত্মিক সতেজতার সেই সংক্ষিপ্ত মুহূর্তগুলো আমাকে আমার কার্যভার চালিয়ে যাওয়ার সংকল্পকে শক্তিশালী করত।

১৯৬৭ সালে, ইরেন ও আমাকে বুলোন-বিয়াঁকুরের বেথেল পরিবারের স্থায়ী সদস্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমি সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে শুরু করেছিলাম আর ৪০ বছরেরও বেশি সময় পর, এখনও আমি সেই বিশেষ সুযোগ লাভ করছি। আমার কাজের একটা উপভোগ্য দিক হচ্ছে, সেই চিঠিগুলোর উত্তর দেওয়া, যেগুলোতে বাইবেল সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্ন থাকে। ঈশ্বরের বাক্য খনন এবং ‘সুসমাচারের পক্ষসমর্থন’ করে আমি যে কত আনন্দ উপভোগ করি, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না! (ফিলি. ১:৭) এ ছাড়া, প্রতিদিন জলখাবারের আগে সকালের উপাসনায় বাইবেল আলোচনা পরিচালনা করেও আমি আনন্দ লাভ করি। ১৯৭৬ সালে, আমাকে ফ্রান্সের শাখা কমিটির একজন সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল।

জীবনের সর্বোত্তম পথ

যদিও আমাকে অনেক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে কিন্তু বর্তমান সময়টাই আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়, কারণ বার্ধক্য ও স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলো ইরেন এবং আমি যা যা করতে পারি, সেগুলোকে সীমিত করে দেয়। তা সত্ত্বেও, একসঙ্গে বাইবেল পড়া ও অধ্যয়ন করা আমাদের আশাকে জীবন্ত রেখেছে। বাসে করে আমাদের মণ্ডলীর এলাকায় যাওয়ার সময়, আমরা এই আশা সম্বন্ধে অন্যদেরকে জানাতে পেরে আনন্দিত হই। আমরা দুজনে মিলে মোট ১২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পূর্ণসময়ের সেবায় রত আছি আর আমাদের এই অভিজ্ঞতা আমাদেরকে সর্বান্তঃকরণে এমন ব্যক্তিদের এই পথ গ্রহণ করার ব্যাপারে সুপারিশ করতে অনুপ্রাণিত করে, যারা এক রোমাঞ্চকর, আনন্দময় ও মূল্যবান জীবনের অনুধাবন করতে আকাঙ্ক্ষী। রাজা দায়ূদ যখন গীতসংহিতা ৩৭:২৫ পদের কথাগুলো লিখেছিলেন, তখন তিনিও ‘বৃদ্ধ হইয়াছিলেন’ কিন্তু তার মতো আমিও “ধার্ম্মিককে পরিত্যক্ত দেখি নাই।”

আমার জীবনে যখনই প্রয়োজন হয়েছে, তখনই যিহোবা তাঁর বাক্যের মাধ্যমে আমাকে শক্তিশালী করেছেন। ৬০ বছরেরও বেশি সময় আগে আমার আত্মীয়স্বজন ভবিষ্যদ্‌বাণী করেছিল যে, বাইবেল পড়া এক চিরন্তন অভ্যাস হয়ে উঠবে। তাদের কথাই ঠিক ছিল। সত্যিই এমনটা হয়েছে—এক রোজকার অভ্যাস হয়ে উঠেছে, যেটার জন্য আমি কখনোই আক্ষেপ করিনি!

[পাদটীকাগুলো]

^ ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত, তবে এখন আর ছাপানো হয় না।

^ ইভান্জ ইমিয়ট সম্বন্ধে আরও তথ্যের জন্য ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি প্রহরীদুর্গ পত্রিকার ২২ ও ২৩ পৃষ্ঠা দেখুন।

[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

সিমোঁ এবং আমি

[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করার সময়

[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমি একেবারে প্রথমে যে-বাইবেল পেয়েছিলাম, সেটার মতোই একটি বাইবেল

[৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমাদের বিয়ের দিন

[৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

ইরেন এবং আমি ঈশ্বরের বাক্য পড়া ও অধ্যয়ন করা উপভোগ করে থাকি