সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

যিহোবা আমার চোখ খুলে দিয়েছেন

যিহোবা আমার চোখ খুলে দিয়েছেন

যিহোবা আমার চোখ খুলে দিয়েছেন

বলেছেন প্যাট্রিস ওয়েকা

এটা ছিল এক বিকালবেলা। সারাদিন রেডিও শুনে এবং অন্ধত্ব ও একাকিত্বের কারণে হতাশাপূর্ণ আরেকটা দিন কাটানোর পর আমি আমার দুর্দশাগ্রস্ত জীবনটাকে শেষ করে দেব বলে ঠিক করেছিলাম। আমি এক কাপ জলে বিষাক্ত পাউডার ঢেলে সেটাকে আমার সামনে একটা টেবিলের ওপর রেখেছিলাম। সেই মারাত্মক মিশ্রণটা খেয়ে আমার জীবন শেষ করে দেওয়ার আগে আমি শেষবারের মতো স্নান করতে ও ভালো জামাকাপড় পরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেন আমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম? আর এই কাহিনি বলার জন্য কীভাবে আমি এখনও বেঁচে আছি?

আমি ১৯৫৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের কাসাই ওরিয়েন্টাল প্রদেশে জন্মগ্রহণ করি। আমার বয়স যখন নয় বছর, তখন আমি আমার বাবাকে হারাই আর আমার দাদা আমাকে বড়ো করে তোলে।

স্কুল শেষ করার পর, আমি এক রাবার বাগানে কাজ পাই। ১৯৮৯ সালের একদিন সকালে, আমি যখন আমার অফিসে রিপোর্ট তৈরি করছিলাম, তখন হঠাৎ করে আমি চোখে অন্ধকার দেখি। প্রথমে আমি মনে করেছিলাম যে, বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে কিন্তু আমি জেনারেটর চলার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম আর সেটা ছিল সকালবেলা! প্রচণ্ড ভয় পেয়ে, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, এমনকী আমার সামনের নোটটিও নয়!

আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার অধীনে যারা কাজ করে, তাদের একজনকে ডেকে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলি। আর সেই ডাক্তার আমাকে শহরের আরও অভিজ্ঞ একজন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। আমার রেটিনাগুলো ছিঁড়ে গিয়েছে ও আমার অবস্থা গুরুতর এটা লক্ষ করে তিনি আমাকে রাজধানী কিনশাসাতে পাঠান।

কিনশাসায় জীবন

কিনশাসায় আমি অনেক চক্ষু বিশেষজ্ঞকে দেখাই কিন্তু তাদের কেউ-ই আমাকে সাহায্য করতে পারেনি। হাসপাতালে ৪৩ দিন কাটানোর পর, ডাক্তারেরা এই উপসংহারে আসে যে, আমি বাকি জীবন অন্ধ হয়ে থাকব! এরপর আমার পরিবারের সদস্যরা অলৌকিক আরোগ্যসাধনের উদ্দেশে আমাকে বিভিন্ন গির্জায় নিয়ে যায় কিন্তু তাদের সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।

অবশেষে, আমি দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার জীবনের সমস্তকিছুই অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। আমি আমার দৃষ্টি হারিয়েছিলাম আর এর কারণে আমার চাকরিও চলে গিয়েছিল। এ ছাড়া, আমি আমার স্ত্রীকেও হারিয়েছিলাম, যে আমাদের ঘরের সমস্তকিছু নিয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমি বাইরে বের হতে অথবা অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করতে লজ্জা বোধ করতাম। আমি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতাম আর ঘরের ভিতরেই আমার দিন কাটত। আমি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলাম আর নিজেকে একেবারে অকেজো বলে মনে করেছিলাম।

দু-বার আমি আমার জীবন শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। দ্বিতীয় বারের কথাই এই কাহিনির শুরুতে বর্ণনা করা হয়েছে। আমাদের পরিবারের ছোট্ট একটা বাচ্চা আমাকে বাঁচিয়েছিল। আমি যখন স্নান করছিলাম, তখন সে না জেনেই সেই কাপটা নিয়ে মিশ্রণটা মাটিতে ফেলে দিয়েছিল। আনন্দের বিষয় যে, সে এটা খেয়ে ফেলেনি। কিন্তু কাপটা খুঁজে না পাওয়ায় আমি খুবই হতাশ হয়েছিলাম। এরপর আমি আমার পরিবারের সদস্যদের কাছে স্বীকার করেছিলাম যে, কেন আমি কাপটা খুঁজছিলাম আর আমি কী করতে চেয়েছিলাম।

আমার যত্ন নেওয়ার জন্য আমি ঈশ্বর ও আমার পরিবারকে ধন্যবাদ জানাই। আমি আত্মহত্যার পরিকল্পনা করা বন্ধ করি।

আবারও জীবনে আনন্দ খুঁজে পাওয়া

১৯৯২ সালের একটা রবিবারে, আমি যখন বাড়িতে বসে ধূমপান করছিলাম, তখন দু-জন যিহোবার সাক্ষি ঘরে ঘরে তাদের পরিচর্যা করার সময় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিল। আমি অন্ধ এটা লক্ষ করে তারা আমার কাছে যিশাইয় ৩৫:৫ পদটি পড়েছিল: “তৎকালে অন্ধদের চক্ষু খোলা যাইবে, আর বধিরদের কর্ণ মুক্ত হইবে।” সেই কথাগুলো শুনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম! যে-গির্জাগুলোতে আমি গিয়েছিলাম আর সেখানে আমি যা শুনেছিলাম, তার বিপরীতে সাক্ষিরা কোনো অলৌকিক আরোগ্যসাধনের প্রস্তাব দেয়নি। পরিবর্তে, তারা ব্যাখ্যা করেছিল যে, যদি আমি ঈশ্বরকে জানার চেষ্টা করি, তাহলে ঈশ্বর যে-নতুন জগতের প্রতিজ্ঞা করেছেন, সেখানে আমি আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে পারি। (যোহন ১৭:৩) তক্ষুণি আমি আপনি পরমদেশ পৃথিবীতে অনন্তকাল বেঁচে থাকতে পারেন বইটি ব্যবহার করে সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করা শুরু করেছিলাম। এ ছাড়া, আমি স্থানীয় কিংডম হলে প্রত্যেকটা খ্রিস্টীয় সভায় যোগদান করতে শুরু করেছিলাম এবং আমার জীবনে বিভিন্ন পরিবর্তন করেছিলাম। আমি ধূমপান করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

কিন্তু আমি অন্ধ ছিলাম বলে আধ্যাত্মিকভাবে উন্নতি করতে পারছিলাম না। তাই ব্রেইল লিখতে-পড়তে শেখার জন্য আমি অন্ধ ব্যক্তিদের একটা প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। এটা আমাকে কিংডম হলে প্রদান করা মিনিস্টিরিয়াল ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে সমর্থ করেছিল। শীঘ্র আমি আমার প্রতিবেশী এলাকায় প্রচার কাজে অংশ নিতে শুরু করেছিলাম। আমি আবারও জীবনে আনন্দ খুঁজে পেতে শুরু করেছিলাম। আমি ক্রমাগত উন্নতি করে চলেছিলাম এবং যিহোবার কাছে আমার জীবন উৎসর্গ করেছিলাম। আমি ১৯৯৪ সালের মে মাসের ৭ তারিখে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম।

যিহোবা ও লোকেদের প্রতি আমার ভালোবাসা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি পূর্ণসময়ের পরিচর্যা শুরু করার এক আকাঙ্ক্ষা গড়ে তুলেছিলাম। ১৯৯৫ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে আমি একজন নিয়মিত অগ্রগামী অর্থাৎ পূর্ণসময়ের পরিচারক হিসেবে সেবা করছি। এ ছাড়া, ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আমি আমার মণ্ডলীতে একজন প্রাচীন হিসেবে সেবা করারও বিশেষ সুযোগ পেয়েছি। কখনো কখনো আমি আমার এলাকার অন্যান্য মণ্ডলীতে বাইবেলভিত্তিক বক্তৃতা দেওয়ার জন্য একজন অতিথি বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়ে থাকি। এই সমস্তই আমার জন্য অনেক আনন্দ নিয়ে আসে ও আমাকে এটা মনে রাখতে সাহায্য করে যে, কোনো অক্ষমতাই যিহোবা ঈশ্বরকে সেবা করার জন্য আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণ করা থেকে আমাদেরকে বাধা দিতে পারবে না।

যিহোবা আমাকে “চোখ” দিয়েছেন

আগে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, আমার অন্ধত্বের কারণে আমার স্ত্রী আমাকে পরিত্যাগ করেছিল। কিন্তু যিহোবার কাছ থেকে আমি আরও একটা আশীর্বাদ লাভ করেছি। এক বিশেষ অর্থে তিনি দেখার জন্য আমাকে চোখ দিয়েছেন। অ্যানি মাভাম্বু, যে আমার অক্ষমতা সত্ত্বেও আমাকে তার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছে, সে আমার চোখ হয়ে উঠেছে। যেহেতু সে-ও পূর্ণসময়ের প্রচারক, তাই সে সবসময়ই আমাকে তার সঙ্গে করে পরিচর্যায় নিয়ে যায়। এ ছাড়া, সে আমার বক্তৃতাগুলোর উৎস বিষয়বস্তু আমার কাছে পড়ে, যাতে আমি আমার নোটগুলো ব্রেইলে লিখতে পারি। সে আমার কাছে এক বিশেষ আশীর্বাদ। তার কারণেই, আমি হিতোপদেশ ১৯:১৪ পদের কথাগুলোকে সত্য হতে দেখেছি: “বাটী ও ধন পৈত্রিক অধিকার; কিন্তু বুদ্ধিমতী স্ত্রী সদাপ্রভু হইতে পাওয়া যায়।”

এ ছাড়া, যিহোবা অ্যানি ও আমাকে দুটি সন্তান—একটি ছেলে ও একটি মেয়ে—দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন। আমি পরমদেশে তাদের মুখ দেখার জন্য আকুল হয়ে আছি! আরেকটা আশীর্বাদ হল যে, আমার দাদা, যে দয়া করে আমাদেরকে তার জায়গায় থাকতে দিয়েছে, সে বাইবেলের সত্যকে গ্রহণ করেছে এবং বাপ্তাইজিত হয়েছে! আমরা সকলে একই মণ্ডলীতে রয়েছি।

আমার অক্ষমতা সত্ত্বেও, আমার আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা হল আরও বেশি করে ঈশ্বরকে সেবা করা কারণ তিনি আমাকে প্রচুর আশীর্বাদ করেছেন। (মালাখি ৩:১০) তাঁর রাজ্য আসার ও পৃথিবী থেকে সমস্ত দুঃখকষ্ট দূর করার জন্য আমি প্রতিদিন প্রার্থনা করি। যিহোবাকে জানার পর আমি সত্যি সত্যিই বলতে পারি: “সদাপ্রভুর আশীর্ব্বাদই ধনবান করে, এবং তিনি তাহার সহিত মনোদুঃখ দেন না।”—হিতোপদেশ ১০:২২. (w১২-E ০৬/০)

[৩০ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

বাইবেলভিত্তিক একটা বক্তৃতা দিচ্ছি; আমার পরিবার ও আমার দাদার সঙ্গে