সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

ষাট বছরের বন্ধুত্ব সত্ত্বেও মনে হয় যেন মাত্র শুরু হয়েছে

ষাট বছরের বন্ধুত্ব সত্ত্বেও মনে হয় যেন মাত্র শুরু হয়েছে

জীবনকাহিনি

ষাট বছরের বন্ধুত্ব সত্ত্বেও মনে হয় যেন মাত্র শুরু হয়েছে

১৯৫১ সালের গ্রীষ্মের এক বিকেলে, চার জন যুবক, যাদের সবার বয়স ২০-এর কোঠার প্রথম দিকে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ইথেকায় যে-সংলগ্ন ফোন বুথগুলো ছিল, সেগুলোতে দাঁড়িয়ে উল্লসিত হয়ে মিশিগান, আইওয়া এবং ক্যালিফোর্নিয়ার মতো দূরবর্তী স্থানে ফোন করছিল। তারা একটা সুখবর জানাতে চাচ্ছিল!

সেই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে, নিউ ইয়র্কের সাউথ ল্যানসিংয়ে গিলিয়েড-এর ১৭তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য ১২২ জন অগ্রগামী উপস্থিত হয়েছিল। সম্ভাব্য মিশনারিদের মধ্যে ছিল লোয়েল টার্নার, উইলিয়াম (বিল) ক্যাস্টেন, রিচার্ড কেলসি এবং রেমন টেমপ্লেটন। মিশিগান থেকে আসা লোয়েল এবং বিল, আইওয়া থেকে আসা রিচার্ড এবং ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আসা রেমন খুব শীঘ্র ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিল।

প্রায় পাঁচ মাস পর, তাদের এই উল্লাস আরও বেড়ে গিয়েছিল, যখন ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল যে, বিশ্ব প্রধান কার্যালয় থেকে ভাই নেথেন নর ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলার জন্য আসছেন। সেই চার জন ভাই যদি সম্ভব হয়, তাহলে একসঙ্গে একই দেশে সেবা করার আকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধে ইঙ্গিত দিয়েছিল। সেই সময়ে তারা কি বিদেশে মিশনারি কার্যভার সম্বন্ধে আরও কিছু জানতে যাচ্ছিল? হ্যাঁ, অবশ্যই!

ভাই নর যখন পুরো ক্লাসের উদ্দেশ্যে কথা বলে বিদেশে তাদের কার্যভার সম্বন্ধে ঘোষণা করা শুরু করেছিলেন, তখন তাদের উত্তেজনা আরও বেড়ে গিয়েছিল। প্রথমে যাদেরকে মঞ্চে ডাকা হয়েছিল, তারা ছিল সেই চার জন যুবক ভাই, যারা কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও স্বস্তি বোধ করেছিল কারণ পরিশেষে তারা জানতে পেরেছিল যে, তারা একত্রে থাকতে পারবে! কিন্তু কোথায়? যখন ঘোষণা করা হয়েছিল যে, তাদেরকে জার্মানিতে পাঠানো হবে, তখন তাদের সহছাত্র-ছাত্রীরা অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল এবং আনন্দে হাততালি দিয়েছিল।

১৯৩৩ সালে, হিটলারের শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে জার্মানির সাক্ষিদের দ্বারা প্রদর্শিত বিশ্বস্ততার নথি ইতিমধ্যেই সমস্ত জায়গার যিহোবার সাক্ষিদের অভিভূত করেছিল। অনেক ছাত্র-ছাত্রীর সেই সময়ের কথা মনে পড়ে যায়, যখন তারা ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে তাদের ভাইদের জন্য কাপড়চোপড় এবং কেয়ার-এর (CARE) প্যাকেটগুলো জাহাজে করে পাঠানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। জার্মানিতে ঈশ্বরের লোকেরা উল্লেখযোগ্য বিশ্বাস, দৃঢ়সংকল্প, সাহস এবং যিহোবার প্রতি তাদের নির্ভরতার উদাহরণ দেখিয়েছিল। ‘এখন আমরা আসলে এই প্রিয় ভাই ও বোনদেরকে ব্যক্তিগতভাবে জানতে পারব,’ ভাই লোয়েল সেই সময়ে যেভাবে চিন্তা করেছিলেন, সেটার কথা স্মরণ করে বলেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, প্রত্যেকেই অনেক উল্লসিত ছিলেন আর এই কারণেই সেই দিন বিকেলে তাদের টেলিফোন করার প্রয়োজন হয়েছিল!

জার্মানি যাওয়ার পথে

১৯৫১ সালের ২৭ জুলাই, হোমল্যান্ড নামের বাষ্পচালিত জাহাজটা নিউ ইয়র্কের ইস্ট রিভারের জেটি ছেড়ে যায় এবং সেই চার বন্ধু জার্মানির উদ্দেশে ১১ দিনের সমুদ্রযাত্রা শুরু করে। ভাই অ্যালবার্ট শ্রোডার, যিনি তাদের একজন গিলিয়েড নির্দেশক ছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে পরিচালকগোষ্ঠীর একজন সদস্য হয়েছিলেন, তিনি তাদেরকে জার্মান ভাষায় প্রথম কয়েকটা বাক্য শিখিয়েছিলেন। আর জাহাজে যেহেতু বেশ কয়েক জন জার্মান যাত্রী রয়েছে, তাই তারা হয়তো সেই ভাষা সম্বন্ধে আরও শিখতে পারবে। কিন্তু, আসলে যাত্রীরা জার্মানির বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিল। কী বিভ্রান্তিকর!

কয়েক দফায় অসুস্থ হওয়ার পর, ৭ আগস্ট মঙ্গলবার সকালে, ভাইয়েরা অবশেষে জার্মানির হামবুর্গের মাটিতে পা রেখেছিল। তারা চারিদিকে, সবেমাত্র ছয় বছর আগে শেষ হওয়া যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন দেখতে পেয়েছিল। এগুলো দেখে দুঃখিত হয়ে তারা সেই রাতেই একটা ট্রেন ধরে ভিসবাডেনের উদ্দেশে রওনা দেয়, যেখানে সেই সময়ে শাখা অফিস অবস্থিত ছিল।

বুধবার ভোরে, এই প্রথম জার্মানিতে একজন সাক্ষির সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়—আর তার নামটা জার্মান ভাষায় খুবই পরিচিত ছিল! হান্স তাদেরকে গাড়িতে করে ট্রেন স্টেশন থেকে বেথেলে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তাদেরকে এমন একজন দৃঢ় বয়স্ক বোনের কাছে রেখে গিয়েছিলেন, যিনি কোনো ইংরেজিই বলতে পারতেন না। স্পষ্টতই, তিনি এইরকমটা মনে করেছিলেন যে, তিনি যদি জোরে জোরে কথা বলেন, তাহলে তারা হয়তো তার কথা বুঝতে পারবে। কিন্তু, যতই তিনি তার আওয়াজ বাড়িয়ে চলছিলেন, ততই তিনি নিজে এবং সেই চার ভাই কেবল আরও হতাশই হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে, শাখা থেকে এরিক ফ্রস্ট নামে একজন ভাই এসে তাদেরকে ইংরেজিতে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। এরপর, ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হতে থাকে।

আগস্ট মাসের শেষের দিকে, ফ্রাঙ্কফুর্ট অ্যাম মেইনে অনুষ্ঠিত “বিশুদ্ধ উপাসনা” নামক সম্মেলনে চার ভাই তাদের প্রথম জার্মান সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল। সর্বোচ্চ উপস্থিতি ছিল, ৪৭,৪৩২ জন এবং সেখানে ২,৩৭৩ জন বাপ্তাইজিত হওয়ায় এই ভাইদের মিশনারির উদ্যোগ এবং প্রচার করার আকাঙ্ক্ষা পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। কিন্তু, কয়েক দিন পর ভাই নর বলেন যে, তাদেরকে বেথেলে থাকতে হবে এবং সেখানে কাজ করার জন্য নিযুক্ত করা হবে।

যেহেতু রেমনের ধ্যানজ্ঞানই ছিল মিশনারির কাজ করা, তাই একবার যুক্তরাষ্ট্রের বেথেলে সেবা করার সুযোগ পেয়েও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। রিচার্ড অথবা বিলও বেথেল পরিচর্যার কথা কখনো চিন্তা করেনি। কিন্তু, কার্যভার সম্পন্ন করতে গিয়ে পরে তারা যে-আনন্দ লাভ করেছিল, সেটা তাদেরকে এই বিষয়ে পুরোপুরি দৃঢ়প্রত্যয়ী করেছিল যে, যিহোবা সবসময়ই জানেন, কোনটা সবচেয়ে উত্তম। তাই, ব্যক্তিগত ইচ্ছার ওপর নির্ভর করার পরিবর্তে তাঁর পরিচালনার ওপর নির্ভর করা কতই না বিজ্ঞতার কাজ! যে-ব্যক্তি এই শিক্ষা লাভ করেছেন, তিনি যেকোনো স্থানে যিহোবার সেবা করে এবং যেকোনো কার্যভার পালন করে সুখী হবেন।

ফারবোটেন!

জার্মানি বেথেলের অনেকে তাদের মাঝে আমেরিকার ভাইদের পেয়ে খুশি হয়েছিল, যাদের সঙ্গে তারা ইংরেজি ভাষা চর্চা করতে পারবে। কিন্তু, একদিন ডাইনিং রুমে এই আশা অপ্রত্যাশিত ভাবে ভেঙে গিয়েছিল। ভাই ফ্রস্ট তার চিরাচরিত উদ্যমী ভঙ্গিমায় জার্মান ভাষায় এমন কিছু বলতে শুরু করেছিলেন, যা বেশ গুরুতর ছিল বলেই মনে হচ্ছিল। বেথেল পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিল, তাদের চোখ তাদের প্লেটের ওপর আটকে গিয়েছিল। নতুন ভাইয়েরা যদিও বুঝতে পারেনি যে, কী বলা হচ্ছে কিন্তু ধীরে ধীরে তারা আঁচ করতে শুরু করেছিল যে, তাদের সম্পর্কেই কিছু বলা হচ্ছে। তাই, ভাই ফ্রস্ট যখন উচ্চরবে “ফারবোটেন!” (“নিষিদ্ধ!”) শব্দটা বলেছিলেন এবং জোর দেওয়ার জন্য শব্দটা পুনরাবৃত্তি করছিলেন, তখন তারা অস্বস্তিবোধ করেছিল। তারা এমন কী করেছে যে, এর জন্য তিনি এভাবে কথা বলেছিলেন?

খাবার শেষ হওয়ার পর, তারা দ্রুত নিজ নিজ রুমে চলে গিয়েছিল। পরে, এক জন ভাই ব্যাখ্যা করেছিলেন: “আপনারা যদি আমাদের সাহায্য করতে চান, তাহলে আপনাদের অবশ্যই জার্মান ভাষায় কথা বলতে হবে। এই কারণেই ভাই ফ্রস্ট বলেছিলেন যে, যতদিন পর্যন্ত না আপনারা জার্মান ভাষা শেখেন, ততদিন আপনাদের সঙ্গে ইংরেজি বলা ফারবোটেন

বেথেল পরিবার অবিলম্বে এই কথা অনুযায়ী কাজ করেছিল। এই বিষয়টা এই নতুন ব্যক্তিদের কেবল জার্মান ভাষা শিখতেই সাহায্য করেনি কিন্তু সেইসঙ্গে তাদেরকে এই শিক্ষাও প্রদান করেছিল যে, একজন প্রেমময় ভাইয়ের পরামর্শ, প্রথমে কাজে লাগানো কঠিন বলে মনে হলেও প্রায়ই আমাদের জন্য উপকারজনক। ভাই ফ্রস্টের পরামর্শ, যিহোবার সংগঠনের মঙ্গলের প্রতি তার আগ্রহকে এবং ভাইদের প্রতি তার প্রেমকে প্রতিফলিত করেছিল। * তাই, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এই চার ভাই তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল!

আমাদের বন্ধুদের কাছ থেকে শেখা

ঈশ্বরভয়শীল বন্ধুদের কাছ থেকে আমরা মূল্যবান শিক্ষা লাভ করতে পারি, যা আমাদের যিহোবার আরও উত্তম বন্ধু হয়ে উঠতে সাহায্য করে। যদিও এই চার ভাই বিশ্বস্ত জার্মান ভাইবোনদের কাছ থেকে—যাদের নাম গুণে শেষ করা যাবে না—অনেক কিছু শিখেছে কিন্তু তারা পরস্পরের কাছ থেকেও শিখেছে। রিচার্ড ব্যাখ্যা করেন: “লোয়েলের জার্মান ভাষা সম্বন্ধে কিছুটা জ্ঞান ছিল আর সে এই ব্যাপারে উন্নতি করছিল কিন্তু আমরা বাকিরা এই ভাষা শিখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম। এ ছাড়া, সে যেহেতু আমাদের দলের মধ্যে বয়সেও সবচেয়ে বড়ো ছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই ভাষাগত সমস্যা নিয়ে আমরা তার কাছে যেতাম এবং তাকেই নেতৃত্ব নিতে বলতাম।” রেমন স্মরণ করে বলেন: “সেই সময় আমি কত রোমাঞ্চিতই না হয়েছিলাম, যখন একজন সুইস ভাই আমাদেরকে জার্মানিতে এক বছর কাটানোর পর, আমাদের প্রথম ছুটিতে সুইজারল্যান্ডে তার অবকাশ যাপনের বাড়িটা ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন! এই দুই সপ্তাহ পুরোপুরি আমাদের নিজেদের এবং জার্মান ভাষা নিয়ে কোনো চিন্তাই করতে হবে না! কিন্তু, সমস্যা ছিল লোয়েল। সে বলেছিল যে, রোজ সকালে আমাদেরকে জার্মান ভাষাতেই প্রতিদিনের শাস্ত্রপদ পড়তে এবং আলোচনা করতে হবে! আমার শত বিরক্তি সত্ত্বেও সে তার সিদ্ধান্তে অটল ছিল। কিন্তু, আমরা এক মূল্যবান শিক্ষা লাভ করেছিলাম। সেই ব্যক্তির নেতৃত্ব অনুসরণ করুন, যিনি আপনার মঙ্গল চান, এমনকী মাঝে মাঝে আপনি যদি তার সঙ্গে একমত না-ও হন। এই মনোভাব আমাদেরকে বছরের পর বছর ধরে উপকৃত করেছে এবং আমাদের পক্ষে ঈশতান্ত্রিক নির্দেশনার প্রতি বশীভূত থাকাকে সহজ করে তুলেছে।”

এ ছাড়া, এই চার বন্ধু পরস্পরের জোরালো দিকগুলোর প্রতি উপলব্ধি দেখাতেও শিখেছে, যেমনটা ফিলিপীয় ২:৩ পদে বলা আছে: “নম্রভাবে প্রত্যেক জন আপনা হইতে অন্যকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান কর।” তাই, অন্যেরা প্রায়ই বিলকে সেই কাজগুলো সম্পন্ন করতে দেওয়ার মাধ্যমে তার প্রতি সম্মান দেখাত, যেগুলো সে তাদের তিন জনের চেয়ে আরও ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারবে বলে তারা মনে করত। “বিভিন্ন কঠিন বিষয় সমাধান করার জন্য যখন জটিল অথবা অপ্রীতিকর পদক্ষেপগুলো নিতে হতো,” লোয়েল স্মরণ করে বলেন, “তখন আমরা সাহায্যের জন্য বিলের কাছে যেতাম। সে অপ্রীতিকর পরিস্থিতিগুলোকে এমনভাবে সামাল দেওয়ায় দক্ষ ছিল, যেভাবে তা দেওয়া উচিত বলে আমরা একমত হতাম ঠিকই কিন্তু সাহস অথবা সামর্থ্যের অভাবে সেভাবে করতে পারতাম না।”

সুখী বিবাহ

এক এক করে চার জনই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। যেহেতু তাদের বন্ধুত্বের ভিত্তি ছিল যিহোবা এবং পূর্ণসময়ের পরিচর্যার প্রতি প্রেম, তাই তারা এমন সাথি খোঁজার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিল, যিনি যিহোবাকে প্রথমে রাখতে ইচ্ছুক। পূর্ণসময়ের পরিচর্যা তাদের এই শিক্ষা প্রদান করেছিল যে, গ্রহণ করার চেয়ে দান করা আরও পরিতৃপ্তিদায়ক এবং ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাগুলোর চেয়ে উপযুক্তভাবেই রাজ্যের বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাই, তারা এমন বোনদের বাছাই করেছিল, যারা ইতিমধ্যেই নিজেদের উদ্যোগে পূর্ণসময়ের পরিচর্যাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। এর ফলে তাদের চার জনের বিয়ে দৃঢ় এবং সুখী বলে প্রমাণিত হয়েছিল।

কোনো বন্ধুত্ব অথবা বিয়েকে যদি সত্যিই দীর্ঘস্থায়ী হতে হয়, তাহলে সেই সম্পর্কের মধ্যে অবশ্যই যিহোবাকে রাখতে হবে। (উপ. ৪:১২) যদিও বিল এবং রেমন পরবর্তী সময়ে মৃত্যুতে তাদের সাথি হারানোর কষ্ট ভোগ করেছিল, কিন্তু তারা দুজনেই সেই আনন্দ এবং সমর্থন লাভ করতে পেরেছিল, যা একজন বিশ্বস্ত স্ত্রী প্রদান করতে পারেন। লোয়েল এবং রিচার্ড এখনও এই সমর্থন উপভোগ করছে এবং বিল, যিনি পুনরায় বিয়ে করেছেন, তিনি সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এক বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যেন তিনি পূর্ণসময়ের পরিচর্যা চালিয়ে যেতে পারেন।

পরবর্তী বছরগুলোতে কার্যভারের জন্য তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায়—বিশেষভাবে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, লুক্সেমবার্গ, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রে—যেতে হয়েছিল। এর ফলে, এই চার বন্ধুর আর একসঙ্গে আগের মতো করে এত বেশি সময় কাটানোর সুযোগ ছিল না। কিন্তু, দূরে থাকা সত্ত্বেও তারা সবসময় যোগাযোগ রাখত, তাদের আশীর্বাদগুলোর জন্য পরস্পর আনন্দ করত এবং দুঃখের সময়গুলোতে একত্রে রোদন করত। (রোমীয় ১২:১৫) এই ধরনের বন্ধুত্ব অত্যন্ত মূল্যবান এবং এটাকে কখনোই হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। তারা যিহোবার কাছ থেকে এক মূল্যবান উপহার। (হিতো. ১৭:১৭) বর্তমান জগতে প্রকৃত বন্ধুদের খুঁজে পাওয়া কতই না দুর্লভ! কিন্তু প্রত্যেক সত্য খ্রিস্টান এইরকম অসংখ্য বন্ধু লাভ করতে পারে। যিহোবার সাক্ষি হিসেবে, আমরা সমগ্র পৃথিবীতে সহবিশ্বাসীদের সঙ্গে এবং সর্বোপরি যিহোবা ও যিশু খ্রিস্টের সঙ্গে বন্ধুত্ব উপভোগ করি।

আমাদের সকলের মতো এই চার বন্ধুকেও মাঝে মাঝে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে—হোক তা সাথিকে হারানোর বেদনার কারণে, গুরুতর অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করার চাপের কারণে, বয়স্ক বাবা-মার যত্ন নেওয়ার উদ্‌বিগ্নতার কারণে, পূর্ণসময়ের পরিচর্যা করার পাশাপাশি সন্তানদের মানুষ করে তোলার সমস্যার কারণে, বিভিন্ন নতুন ঈশতান্ত্রিক কার্যভার গ্রহণ করার সময় দুশ্চিন্তার কারণে অথবা বার্ধক্যের বিভিন্ন সমস্যার কারণে। কিন্তু, নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে তারা এটাও জানতে পেরেছে যে, বন্ধুরা—কাছের এবং দূরের সকলেই—যিহোবার প্রেমিকদেরকে প্রতিটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা সফলভাবে মোকাবিলা করার জন্য সাহায্য করে।

চিরকালের জন্য বন্ধুত্ব

এই বিষয়টা কতই না চমৎকার ছিল যে, লোয়েল, রেমন, বিল এবং রিচার্ড যথাক্রমে ১৮, ১২, ১১ এবং ১০ বছর বয়সে নিজেদেরকে যিহোবার কাছে উৎসর্গ করেছিল এবং ১৭ থেকে ২১ বছর বয়সের মধ্যে, সকলেই পূর্ণসময়ের পরিচর্যা বেছে নিয়েছিল। তারা ঠিক তা-ই করেছিল, যা উপদেশক ১২:১ পদ তাদেরকে করার জন্য উৎসাহিত করেছিল: “তুমি যৌবনকালে আপন সৃষ্টিকর্ত্তাকে স্মরণ কর।”

তুমি যদি একজন খ্রিস্টান যুবক হয়ে থাকো, তাহলে সম্ভব হলে পূর্ণসময়ের পরিচর্যা শুরু করার ব্যাপারে যিহোবার আমন্ত্রণ গ্রহণ করো। তা করলে, তাঁর অযাচিত দয়ার কারণে তুমিও হয়তো সীমা, জেলা অথবা আঞ্চলিক কাজে সেবা করার; বেথেলে ও সেইসঙ্গে শাখা কমিটিতে সেবা করার; কিংডম মিনিস্ট্রি স্কুল ও অগ্রগামী পরিচর্যা বিদ্যালয়-এ নির্দেশক হিসেবে কাজ করার; এবং ছোটো-বড়ো যেকোনো সম্মেলনেই বক্তৃতা দেওয়ার আনন্দ লাভ করতে পারবে, যা সেই চার বন্ধু লাভ করেছে। চার জনই এই বিষয়টা জেনে কত আনন্দিতই না হয়েছে যে, লক্ষ লক্ষ ব্যক্তি তাদের কাজের ফলে উপকার লাভ করেছে! এই সমস্ত কিছু সম্ভব হয়েছিল কারণ যুবক বয়সে তারা মনপ্রাণ দিয়ে যিহোবাকে সেবা করার বিষয়ে তাঁর প্রেমময় আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছিল।—কল. ৩:২৩.

বর্তমানে, লোয়েল, রিচার্ড এবং রেমন আবারও একসঙ্গে জার্মানির সেল্টার্সের শাখা অফিসে সেবা করছে। দুঃখের বিষয় হল, বিল ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার সময় মারা যান। তাদের চার জনের প্রায় ৬০ বছরের এই অসাধারণ বন্ধুত্ব মৃত্যুতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে! কিন্তু আমাদের ঈশ্বর যিহোবা কখনোই তাঁর বন্ধুদের ভুলে যান না। আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, তাঁর রাজ্য শাসনের সময়ে প্রতিটা খ্রিস্টীয় বন্ধুত্ব, যা মৃত্যুতে অল্পসময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তা পুনর্স্থাপিত হবে।

বিল তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে লিখেছিলেন: “আমাদের বন্ধুত্বের ৬০ বছরের মধ্যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে বলে আমার মনে পড়ে না। আমাদের সম্পর্ক সবসময়ই আমার কাছে বিশেষ বলে মনে হয়েছে।” এই কথাগুলোর সঙ্গে তার তিন বন্ধু, নতুন জগতে তাদের চিরকালীন বন্ধুত্বের কথা স্পষ্ট মনে রেখে যোগ করে বলে, “আর আমাদের বন্ধুত্ব মাত্র শুরু হয়েছে।”

[পাদটীকা]

^ ভাই ফ্রস্টের রোমাঞ্চকর জীবনকাহিনি ১৯৬১ সালের ১৫ এপ্রিল প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) পত্রিকার ২৪৪-২৪৯ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে।

[১৮ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

তাদের কার্যভারে প্রাপ্ত আনন্দ তাদেরকে এই বিষয়ে পুরোপুরি দৃঢ়প্রত্যয়ী করেছিল যে, যিহোবা সবসময়ই জানেন, কোনটা সবচেয়ে উত্তম

[২১ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

“আমাদের বন্ধুত্বের ৬০ বছরের মধ্যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে বলে আমার মনে পড়ে না”

[১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

বাম দিক থেকে ডান দিকে: রিচার্ড, লোয়েল, রেমন এবং বিল গিলিয়েডের সময়ে বন্ধু হয়ে উঠেছিল

[১৮ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

ওপরে: রেমন একটা কিংডম মিনিস্ট্রি স্কুল-এর ক্লাস পরিচালনা করছেন; ডান দিকে: রিচার্ড ভিসবাডেনের বেথেলে এ্যড্রেসোগ্রাফ নিয়ে কাজ করছেন

[১৯ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

ওপরে: একটা পরিদর্শনের সময় ভাই নরের (বাম দিকে) সঙ্গে ভাই ফ্রস্ট (ডান দিকে) এবং অন্যেরা; ডান দিকে: ১৯৫২ সালে সুইজারল্যান্ডে ছুটি কাটানোর সময়

[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]

বাম দিক থেকে ডান দিকে: রিচার্ড, বিল, লোয়েল এবং রেমন ১৯৮৪ সালে নতুন শাখা অফিসের বিল্ডিংগুলো উৎসর্গ করার সময়ে সেল্টার্সে মিলিত হয়

[২১ পৃষ্ঠার চিত্র]

বাম দিক থেকে ডান দিকে: রেমন, রিচার্ড এবং লোয়েল