সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

সঠিক ভবিষ্যদ্‌বাণীর এক নীরব সাক্ষি

সঠিক ভবিষ্যদ্‌বাণীর এক নীরব সাক্ষি

ইতালির মধ্যরোমে এক বিজয়স্তম্ভ রয়েছে, যেটা পৃথিবীব্যাপী দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে। এই স্তম্ভটা রোমের একজন জনপ্রিয় সম্রাটের সম্মানে নির্মাণ করা হয়েছে, যার নাম টাইটাস।

টাইটাসের বিজয়স্তম্ভ ক্ষোদাই করা দুটো বিশাল ভাস্কর্য নিয়ে গঠিত, যেটা আমাদের এক সুপরিচিত ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু অনেকে জানে না, বাইবেল ও এই স্তম্ভের মধ্যে এক চমৎকার মিল রয়েছে। বাইবেলের ভবিষ্যদ্‌বাণী যে কতটা উল্লেখযোগ্যভাবে সঠিক, টাইটাসের এই বিজয়স্তম্ভ সেটার এক নীরব সাক্ষি।

এক নিন্দনীয় নগর

প্রথম শতাব্দীর শুরুর দিকে, রোমীয় সাম্রাজ্য ব্রিটেন ও গল (বর্তমানে ফ্রান্স) থেকে শুরু করে মিশর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যেখানে লোকেরা শান্তি ও শৃঙ্খলা উপভোগ করত। কিন্তু রোমের কাছে এক প্রত্যন্ত এলাকা বরাবরই উদ্‌বিগ্নতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যেটা ছিল অশান্ত যিহূদিয়া প্রদেশ।

এনসাইক্লোপিডিয়া অভ্‌ এনসিয়েন্ট রোম বলে: “রোম ও যিহূদিয়ার লোকেরা একে অন্যকে প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা করত আর সারা রোমীয় সাম্রাজ্যের অধীনে যিহূদিয়ার মতো এলাকা খুব কমই ছিল। যিহুদিরা সেই সমস্ত বিদেশি শাসকদের একেবারেই পছন্দ করত না, যারা তাদের রীতিনীতি অবজ্ঞা করত আর অপর দিকে রোমীয়রা যিহুদিদের জেদি মনোভাবকে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারত না।” অনেক যিহুদি এমন একজন রাজনৈতিক মশীহ আসবেন বলে আশা করেছিল, যিনি ঘৃণ্য রোমীয়দের সরিয়ে দিয়ে ইস্রায়েলে স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু ৩৩ খ্রিস্টাব্দে যিশু খ্রিস্ট ঘোষণা করেন যে, যিরূশালেম আসন্ন এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।

যিশু বলেন: “তোমার উপরে এমন সময় উপস্থিত হইবে, যে সময়ে তোমার শত্রুগণ তোমার চারিদিকে জাঙ্গাল বাঁধিবে, তোমাকে বেষ্টন করিবে, তোমাকে সর্ব্বদিকে অবরোধ করিবে, এবং তোমাকে ও তোমার মধ্যবর্ত্তী তোমার বৎসগণকে ভূমিসাৎ করিবে, তোমার মধ্যে প্রস্তরের উপরে প্রস্তর থাকিতে দিবে না।”লূক ১৯:৪৩, ৪৪.

যিশুর কথা স্পষ্টতই তাঁর শিষ্যদের হতবাক করে দেয়। এই কথা বলার দুই দিন পর, যিরূশালেম মন্দির দেখে তাদের মধ্যে একজন বলে ওঠেন: “হে গুরু, দেখুন, কেমন পাথর ও কেমন গাঁথনি!” বাস্তবিকই এমনটা অনুমান করা হয়, মন্দিরের কোনো কোনো পাথর দৈর্ঘ্যে ১১ মিটার (৩৬ ফুট), প্রস্থে ৫ মিটার (১৬ ফুট) ও উচ্চতায় ৩ মিটার (১০ ফুট) ছিল! কিন্তু উত্তরে যিশু বলেন: “তোমরা এই যে সকল দেখিতেছ, এমন সময় আসিতেছে, যখন ইহার একখানি পাথর অন্য পাথরের উপরে থাকিবে না, সমস্তই ভূমিসাৎ হইবে।”মার্ক ১৩:১; লূক ২১:৬.

যিশু তাদের আরও বলেন: “যখন তোমরা যিরূশালেমকে সৈন্যসামন্ত দ্বারা বেষ্টিত দেখিবে, তখন জানিবে যে, তাহার ধবংস সন্নিকট। তখন যাহারা যিহূদিয়ায় থাকে, তাহারা পাহাড় অঞ্চলে পলায়ন করুক, এবং যাহারা নগরের মধ্যে থাকে, তাহারা বাহিরে যাউক; আর যাহারা পল্লীগ্রামে থাকে, তাহারা নগরে প্রবেশ না করুক।” (লূক ২১:২০, ২১) যিশুর কথা কি সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল?

এক নগরের ধ্বংস

তেত্রিশ বছর অতিবাহিত হয়ে যায় কিন্তু তখনও যিহূদিয়া ও রোমীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে যে-ঘৃণা ছিল, তা বিন্দুমাত্র কমেনি। এরপর, ৬৬ খ্রিস্টাব্দে যিহূদিয়ার রোমীয় দেশাধ্যক্ষ গেসিয়াস ফ্লোরাস যখন পবিত্র মন্দিরের কোষাগার থেকে তহবিল বাজেয়াপ্ত করেন, তখন যিহুদিদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। শীঘ্রই দলে দলে যিহুদি যোদ্ধারা যিরূশালেমে ঢুকে পড়ে ও স্থানীয় রোমীয় সৈন্যদের হত্যা করে এবং রোমের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

প্রায় তিন মাস পর, সেস্টিয়াস গ্যালাসের নেতৃত্বে ৩০,০০০-রেরও বেশি রোমীয় সৈন্য বিদ্রোহ দমন করার জন্য যিরূশালেমের দিকে এগিয়ে আসে। রোমীয়রা দ্রুত নগরের মধ্যে প্রবেশ করে এবং মন্দিরের এলাকার বাইরে থাকা প্রাচীরকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। কিন্তু এরপর কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই সৈন্যরা ফিরে যায়। যিহুদি বিদ্রোহীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় ও তাদের পিছু ধাওয়া করে। রোমীয় সৈন্য ও বিদ্রোহী যিহুদিরা নগর ছেড়ে চলে যাওয়ার ফলে খ্রিস্টানরা যিশুর পরামর্শ কাজে লাগানোর সুযোগ পায় আর যিরূশালেম ছেড়ে যর্দন নদীর অপর প্রান্তে পাহাড় অঞ্চলে পালিয়ে যায়।—মথি ২৪:১৫, ১৬.

পরের বছর রোম পুনরায় যিহুদিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে। এই বার নেতৃত্ব দেন প্রধান সেনাপতি ভেস্পাসিয়ান এবং তার ছেলে টাইটাস। কিন্তু ৬৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট নিরো মারা যান আর এই খবর শোনামাত্র ভেস্পাসিয়ান রাজসিংহাসন দখল করার জন্য রোমে ফিরে যান। তিনি যিহূদিয়ার সামরিক অভিযান তার ছেলে টাইটাসের তত্ত্বাবধানে রেখে যান আর সেই অভিযানে প্রায় ৬০,০০০ রোমীয় সৈন্য ছিল।

৭০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে টাইটাস তার সৈন্যবাহিনীকে যিহূদিয়ার গ্রামাঞ্চল থেকে বড়ো বড়ো গাছ কাটার নির্দেশ দেন। যিরূশালেমের চারপাশে জাঙ্গাল বা খুঁটি স্থাপন করে ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ (৪.৫ মাইল) প্রাচীর তৈরি করার কাজে এই গাছগুলোকে ব্যবহার করা হয়। তিন মাসের মধ্যে রোমীয় সৈন্যরা নগর ও এর মধ্যস্থিত মন্দিরে লুটপাট চালায় এবং পুড়িয়ে দেয়। তারা এমনভাবে মন্দির ধ্বংস করে যে, একটা পাথরের উপর আরেকটা পাথর অবশিষ্ট ছিল না, ঠিক যেমন যিশু ভবিষ্যদ্‌বাণী করেছিলেন। (লূক ১৯:৪৩, ৪৪) এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী “যিরূশালেম ও বাকি অঞ্চলে কমপক্ষে আড়াই থেকে পাঁচ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।”

এক মহান বিজয়

৭১ খ্রিস্টাব্দে টাইটাস ইতালিতে ফিরে যান আর রোমীয় নাগরিকরা আনন্দে উল্লাসিত হয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানায়। রাজধানীতে এক বড়ো বিজয় উৎসব উদ্‌যাপন করা হয় আর সৈন্যদের এই বিশাল বিজয় মিছিল দেখার জন্য নগরের সমস্ত লোক একত্রিত হয়।

রোমের রাস্তায় এত বিপুল ধনদৌলত নিয়ে করা মিছিল দেখে জনতা আশ্চর্য হয়ে যায়। তারা যুদ্ধে অধিকৃত জাহাজ, চাকার উপর বসানো বিশাল বিশাল পাটাতনে আঁকা যুদ্ধের দৃশ্য ও যিরূশালেম মন্দির থেকে লুট করা বিভিন্ন সামগ্রী দেখে চোখ ফেরাতে পারছিল না।

৭৯ খ্রিস্টাব্দে টাইটাস তার পিতা ভেস্পাসিয়ানের উত্তরাধিকারী হিসেবে রোমের সিংহাসনে বসেন। কিন্তু মাত্র দুই বছর পর, টাইটাস হঠাৎ করে মারা যান। তার ভাই ডমিশিয়ান সিংহাসনে বসেন এবং টাইটাসের সম্মানে একটা বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেন।

বর্তমানে সেই বিজয়স্তম্ভ

বর্তমানে রোমে অবস্থিত টাইটাসের বিজয়স্তম্ভ

বর্তমানে, প্রতি বছর হাজার হাজার লোক যারা রোমান ফোরাম দেখতে যায়, তারা টাইটাসের বিজয়স্তম্ভ দেখে মুগ্ধ হয়। কেউ কেউ এটাকে এক রাজকীয় শিল্পকলা হিসেবে, কেউ কেউ রোমীয় ক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক হিসেবে আবার কেউ কেউ যিরূশালেম ও এর মধ্যস্থিত মন্দিরের পরাজয়ের স্মৃতি হিসেবে দেখে থাকে।

যারা বাইবেল মনোযোগ দিয়ে পড়ে, তাদের কাছে অবশ্য টাইটাসের বিজয়স্তম্ভ আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এটা এক নীরব সাক্ষি, যেটা বাইবেলের ভবিষ্যদ্‌বাণীর বিশ্বাসযোগ্যতা ও সঠিকতা নিশ্চিত করে আর এই বিষয়টা প্রমাণ করে যে, বাইবেলের ভবিষ্যদ্‌বাণী ঈশ্বরের দ্বারা অনুপ্রাণিত।—২ পিতর ১:১৯-২১.