সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আমাদের আর্কাইভ থেকে

জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতাগুলোর মাধ্যমে আয়ার্ল্যান্ডে সুসমাচার ছড়িয়ে যায়

জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতাগুলোর মাধ্যমে আয়ার্ল্যান্ডে সুসমাচার ছড়িয়ে যায়

সময়টা হল ১৯১০ সালের মে মাস। একটা জাহাজ বেলফাস্ট লাক নামে এক সমুদ্র খাঁড়িতে প্রবেশ করে আর এর ফলে সেই এলাকাটা ধোঁয়ায় ভরে যায়। জাহাজটার ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা অল্প কয়েক জন যাত্রী দেখতে পায়, সেখানকার সবুজ পাহাড়গুলো ভোরের আলোয় ঝলমল করছে। তাদের মধ্যে একজন ব্যক্তি, চার্লস্‌ টেজ রাসেল, এই নিয়ে পঞ্চম বার আয়ার্ল্যান্ডে আসছেন। ভাই রাসেল দেখতে পান যে, বিশাল আকৃতির দুটো জাহাজ নির্মিত হচ্ছে, একটা হল টাইটানিক, যেটা পরে দুর্ঘটনার শিকার হয় আর অন্যটা হল অলিম্পিক, যেটা টাইটানিকের মতোই আরেকটা জাহাজ। * জাহাজনির্মাণের সেই জায়াগার ওপাশে প্রায় বারো জন বাইবেল ছাত্র জেটিতে দাঁড়িয়ে থেকে ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে।

এর প্রায় ২০ বছর আগে, ভাই রাসেল বিশ্বব্যাপী সুসমাচার ছড়িয়ে দেওয়ার সর্বোত্তম উপায়ের অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমেরিকার বাইরে ধারাবাহিকভাবে কয়েকটা ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৯১ সালের জুলাই মাসে আয়ার্ল্যান্ড থেকে তার প্রথম ভ্রমণ শুরু হয়েছিল। সিটি অভ্‌ শিকাগো জাহাজে চড়ে কুইন্সটাউনের উপকূলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়, তিনি সূর্যকে ধীরে ধীরে ডুবে যেতে দেখেছিলেন এবং হয়তো সেই এলাকার বিষয়ে বলা তার বাবা-মায়ের কথাগুলো মনে করেছিলেন, যারা আগে সেখানেই বাস করতেন। ভাই রাসেল ও তার সঙ্গে আসা যাত্রীরা যখন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহরগুলোর ও সৌন্দর্যপূর্ণ গ্রামের এলাকাগুলোর পাশ দিয়ে গিয়েছিলেন, তখন তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, সেখানে এমন খেত রয়েছে, যেটা “শস্যচ্ছেদনের জন্য একেবারে প্রস্তুত হয়ে আছে ও অপেক্ষা করে রয়েছে।”

ভাই রাসেল মোট সাত বার আয়ার্ল্যান্ডে ভ্রমণ করেছিলেন। প্রথম বার ভ্রমণ করার ফলে লোকেদের মধ্যে এমন আগ্রহ জেগে উঠেছিল যে, পরের পরিদর্শনগুলোর সময়ে শত শত লোক আর কখনো কখনো এমনকী হাজার হাজার লোক তার বক্তৃতাগুলো শুনতে এসেছিল। তিনি যখন ১৯০৩ সালের মে মাসে দ্বিতীয় বার আয়ার্ল্যান্ডে ভ্রমণ করেছিলেন, তখন বেলফাস্ট ও ডাবলিনের স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে জনসাধারণের উদ্দেশে সভাগুলোর বিষয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। ভাই রাসেল পরে স্মরণ করে বলেছিলেন, অব্রাহামের বিশ্বাস ও মানবজাতির ভবিষ্যতের আশীর্বাদগুলোর বিষয়ে দেওয়া “এক শপথযুক্ত প্রতিজ্ঞা” মূলভাবের বক্তৃতা শোনার সময় “শ্রোতারা পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছিল।”

যেহেতু আয়ার্ল্যান্ডে অনেক আগ্রহী ব্যক্তি পাওয়া গিয়েছিল, তাই ভাই রাসেল তার তৃতীয় বার ইউরোপভ্রমণের সময়েও সেখানে গিয়েছিলেন। ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসের এক ভোরে তিনি যখন বেলফাস্টে জাহাজ থেকে নেমেছিলেন, তখন পাঁচ জন ভাই তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। সেদিন বিকেলে “শয়তানের সাম্রাজ্যের অবসান” শিরোনামের একটা বক্তৃতা তুলে ধরা হয়েছিল, যেটার বিষয়ে আগে থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। সেই বক্তৃতা শোনার জন্য “প্রায় ৩০০ জন বুদ্ধিমান শ্রোতা” উপস্থিত হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ব্যক্তি যখন প্রতিবাদ করেছিলেন, তখন ভাই রাসেল দক্ষতার সঙ্গে শাস্ত্র ব্যবহার করে দ্রুত তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছিলেন। ডাবলিনে এইরকম একটা সভায়, আরও নাছোড়বান্দা একজন বিরোধী—ওয়াইএমসিএ-র (যুবক পুরুষদের খ্রিস্টান দল) সচিব মিস্টার ও’কানার—উপস্থিত ১,০০০ জনেরও বেশি শ্রোতাকে বাইবেল ছাত্রদের বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তারপর কী হয়েছিল?

আসুন, আমরা সেই সময়ে ফিরে গিয়ে নিজেদের মনে কল্পনা করার চেষ্টা করি যে, সেখানে হয়তো কী হয়েছিল। একজন ব্যক্তি, যিনি বাইবেলের সত্য খোঁজার বিষয়ে আগ্রহী, তিনি জনসাধারণের উদ্দেশে একটা বক্তৃতা শোনার সিদ্ধান্ত নেন, যেটার বিষয়ে দি আইরিশ টাইমস্‌ সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। তিনি সেই হল-ভরতি লোকের মাঝে কোনোরকমে একটা বসার আসন পান। তিনি একটা লম্বা কালো রঙের কোট পরা একজন দাড়িওয়ালা বক্তার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেন, যার চুল একেবারে সাদা হয়ে গিয়েছে। সেই বক্তা তার বক্তৃতা তুলে ধরার সময়ে মঞ্চের এক দিক থেকে অন্য দিকে চলাফেরা করছেন, অঙ্গভঙ্গি করছেন, একের-পর-এক শাস্ত্রপদ তুলে ধরে যুক্তি করছেন এবং বাইবেলের সত্যের প্রতি এই ব্যক্তির মন খুলে দিচ্ছেন যেন তিনি বোধগম্যতা লাভ করতে পারেন। এমনকী সাউন্ডের কোনো সরঞ্জাম ছাড়াই, সেই বক্তার আওয়াজ প্রতিটা শ্রোতার কানে পৌঁছায় এবং তারা দেড় ঘণ্টা ধরে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে বক্তার কথা শোনে। এরপর প্রশ্নোত্তরের একটা পর্ব চলাকালীন, মিস্টার ও’কানার ও তার বন্ধুরা সেই বক্তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কিন্তু বক্তা দক্ষতার সঙ্গে বাইবেলের বার্তার পক্ষ সমর্থন করেন। শ্রোতারা হাততালি দিয়ে ভাইয়ের প্রতি তাদের সম্মতি প্রকাশ করে। পরিস্থিতি যখন শান্ত হয়ে যায়, তখন সেই আগ্রহী ব্যক্তি আরও জানার জন্য ভাইদের কাছে এগিয়ে যান। সেই সভায় উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা অনুযায়ী, অনেকেই এভাবে সত্য সম্বন্ধে শিখতে পেরেছিল।

ভাই রাসেল ১৯০৯ সালের মে মাসে তার চতুর্থ ভ্রমণ শুরু করেছিলেন। মাওরেটিনিয়া জাহাজে চড়ে নিউ ইয়র্ক শহর ছাড়ার সময়, তিনি তার সঙ্গে করে একজন স্টেনোগ্রাফার (সাংকেতিক লিপিকার), ভাই হান্টসিঙ্গারকে নিয়ে গিয়েছিলেন, যাতে মহাসাগরের উপর দিয়ে যাওয়ার সময়টা প্রহরীদুর্গ পত্রিকার প্রবন্ধ লেখার জন্য ব্যবহার করা যায়। ভাই রাসেল বেলফাস্টে জনসাধারণের উদ্দেশে যে-বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেটা শোনার জন্য ৪৫০ জন স্থানীয় ব্যক্তি উপস্থিত হয়েছিল আর তাদের মধ্যে প্রায় ১০০ জনকে বসার আসনের অভাবের কারণে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল।

ভাই চার্লস্‌ টেজ রাসেল লুসিটেনিয়া জাহাজে

ভাই রাসেল যখন আয়ার্ল্যান্ডে তার পঞ্চম ভ্রমণে এসেছিলেন, যেটার বিষয়ে শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে, তখনও তিনি বিরোধীদের শাস্ত্রীয় উত্তর প্রদান করেছিলেন। ডাবলিনে জনসাধারণের উদ্দেশে একটা বক্তৃতা তুলে ধরার পর, একজন সুপরিচিত ঈশ্বরতত্ত্ববিদ, যাকে মিস্টার ও’কানার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, তার বিভিন্ন প্রশ্নের শাস্ত্রীয় উত্তর লাভ করেছিলেন আর শ্রোতারা এতে খুবই আনন্দিত হয়েছিল। পরের দিন, সেই ভ্রমণে আসা যাত্রীরা দ্রুতগতিতে চলা ডাকবাহী জাহাজে করে লিভারপুলে গিয়েছিলেন এবং নিউ ইয়র্কে যাওয়ার জন্য লুসিটেনিয়া নামক একটা বিখ্যাত জাহাজে উঠেছিলেন। *

দি আইরিশ টাইমস্‌ সংবাদপত্রে জনসাধারণের উদ্দেশে একটা বক্তৃতার বিজ্ঞাপন, ২০ মে, ১৯১০

১৯১১ সালে ভাই রাসেলের ষষ্ঠ ও সপ্তম ভ্রমণের সময়ও জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতাগুলো তুলে ধরা হয়েছিল, যেগুলোর বিষয়ে আগে থেকে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। সেই বছর বসন্ত কালে, বেলফাস্টে ২০ জন বাইবেল ছাত্র একটা সভায় ২,০০০ জন শ্রোতাকে স্বাগত জানিয়েছিল, যারা “মৃত্যুর পর জীবন” শিরোনামের বক্তৃতাটা শুনেছিল। মিস্টার ও’কানার আবারও ডাবলিনে একজন পরিচারককে নিয়ে এসেছিলেন, যিনি সভার সময় প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু, সেই ব্যক্তিকে যখন শাস্ত্রীয় উত্তরগুলো দেওয়া হয়েছিল, তখন শ্রোতারা আনন্দে হাততালি দিয়েছিল। সেই একই বছরের শরৎ কালে, অন্যান্য শহরে ভ্রমণ করা হয়েছিল এবং অনেকে বক্তৃতাগুলো শুনতে এসেছিল। ডাবলিনের একটা সভায় মিস্টার ও’কানার আবারও সমস্যা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তিনি ১০০ জন উচ্ছৃঙ্খল লোককে নিয়ে সভায় গণ্ডগোল বাধানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু শ্রোতারা উদ্যমের সঙ্গে বক্তাকে সমর্থন করেছিল।

যদিও সেইসময় মূলত ভাই রাসেল জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, সংগঠনের কাজ “কোনো একজন মানুষের উপর নির্ভর করে চলে না” কারণ “এটা মানুষের নয় বরং ঈশ্বরের কাজ।” জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতাগুলো, যেগুলোর বিষয়ে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো, সেগুলো জনসাধারণের জন্য প্রস্তুতকৃত সভার এক অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেছিল। সেগুলো বিভিন্ন শাস্ত্রীয় সত্য তুলে ধরার চমৎকার সুযোগ করে দিয়েছিল। এর ফল কী হয়েছিল? জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতাগুলোর মাধ্যমে আয়ার্ল্যান্ডে সুসমাচার ছড়িয়ে গিয়েছিল এবং সমগ্র আয়ার্ল্যান্ডে অসংখ্য শহরে মণ্ডলী গড়ে উঠেছিল।—আমাদের আর্কাইভ থেকে, ব্রিটেন।

^ অনু. 3 এর দু-বছরের মধ্যেই টাইটানিক ডুবে গিয়েছিল।

^ অনু. 9 ১৯১৫ সালের মে মাসে আয়ার্ল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে একটা টর্পেডো (জলবোমা) লুসিটেনিয়াকে আঘাত করে ধ্বংস করে দিয়েছিল।