সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

জীবনকাহিনি

আমি যিহোবার দেখানো পথে চলি

আমি যিহোবার দেখানো পথে চলি

কিশোর বয়স থেকেই ভেবে নিয়েছিলাম, আমি জগতে নিজের কেরিয়ার গড়ে তুলব। তাই, আমি যে-কাজটা করতাম, সেটাকে খুব পছন্দও করতাম। কিন্তু পরে, যিহোবা আমাকে এক ভিন্ন পথ দেখান। তিনি আমাকে বলেন: “আমি তোমাকে বুদ্ধি দিব, ও তোমার গন্তব্য পথ দেখাইব, তোমার উপরে দৃষ্টি রাখিয়া তোমাকে পরামর্শ দিব।” (গীত. ৩২:৮) আমি যখন তাঁর দেখানো পথে চলতে শুরু করি, তখন আমি বিভিন্ন উপায়ে যিহোবার সেবা করার সুযোগ পাই। আমি ৫২ বছর ধরে আফ্রিকাতেও সেবা করি। তাঁর সেবাকে কেরিয়ার হিসেবে বাছাই করে আমি অনেক আশীর্বাদ পেয়েছি।

ইংল্যান্ড থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত যাত্রা

আমার জন্ম ১৯৩৫ সালে ইংল্যান্ডের ডার্লাস্টন শহরে হয়েছিল। এই শহর যে-এলাকার মধ্যে ছিল, সেটাকে “কালো দেশ” বলা হয়ে থাকে কারণে সেখানে এত কল-কারখানা ছিল যে, বাতাসে সবসময় কালো ধোঁয়া ছেয়ে থাকত। আমার বয়স যখন প্রায় চার বছর ছিল, তখন আমার বাবা-মা যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করে। আমার বয়স যখন ১৪-১৫ বছর হয়, তখন আমি নিশ্চিত হয়ে যাই, এটাই হল সত্য আর ১৯৫২ সালে আমার বয়স যখন ১৬ বছর হয়, তখন আমি বাপ্তিস্ম নিই।

সেইসময় আমি একটা বড়ো কারখানায় যেতে শুরু করি, যেখানে বিভিন্ন হাতিয়ার এবং গাড়ির পার্টস্‌ তৈরি করা হত। আমি সেখানকার অফিসে একটা বড়ো পোস্টের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি। সেই কাজকে আমি অনেক উপভোগ করছিলাম।

পরে, একদিন একজন সীমা অধ্যক্ষ সপ্তাহের মাঝে উইলেনহলে আমাদের মণ্ডলীর বই অধ্যয়ন পরিচালনা করার জন্য আমাকে বলেন। কিন্তু, একটা সমস্যা ছিল। সপ্তাহের মাঝে আমি উইলেনহলে সভাগুলোতে যেতাম না। আমি আমার বাড়ি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) দূরে ব্রমস্‌গ্রোভে কাজ করতাম আর সপ্তাহের মাঝে সেখানে সভাগুলোতে যোগ দিতাম। কিন্তু, সপ্তাহের শেষে আমি পুনরায় উইলেনহলে আমার বাড়িতে এসে যেতাম আর সেখানকার সভাগুলোতে যোগ দিতাম।

আমি যিহোবার আরও বেশি সেবা করতে চেয়েছিলাম। তাই, আমি সীমা অধ্যক্ষকে হ্যাঁ বলে দিই। সেইজন্য আমাকে আমার কাজ ছাড়তে হয়েছিল, যেটাকে আমি খুব পছন্দ করতাম। কিন্তু, এরজন্য আমার কোনো আপশোস নেই। সেইসময় আমি যিহোবার দেখানো পথে চলা সিদ্ধান্ত নিই আর এর ফলে, আমার জীবন আনন্দে ভরে ওঠে।

যখন আমি ব্রমস্‌গ্রোভ মণ্ডলীতে যেতাম, তখন অ্যান নামে একজন বোনের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি দেখতে অনেক সুন্দরী ছিলেন আর উদ্যোগের সঙ্গে যিহোবার সেবা করছিলেন। ১৯৫৭ সালে আমরা বিয়ে করি। আমরা একসঙ্গে বিভিন্ন উপায়ে যিহোবার সেবা করি। যেমন, আমরা একসঙ্গে অগ্রগামী এবং বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করি। শুধু তা-ই নয়, আমরা ভ্রমণের কাজ আর সেইসঙ্গে বেথেলেও সেবা করি। অ্যান আমার জীবন আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছিল।

১৯৬৬ সালে যখন আমাদের গিলিয়েডের ৪২তম ক্লাসের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন আমাদের খুশির সীমা ছিল না। স্কুল শেষ হওয়ার পর আমাদের মালাউইতে পাঠানো হয়। আমরা শুনেছিলাম, সেখানকার লোকেরা অনেক ভালো আর অতিথিদের খুব ভালোভাবে যত্ন নেয়। কিন্তু, আমরা জানতাম না যে, এত তাড়াতাড়ি আমাদের সেই দেশ ছাড়তে হবে।

মালাউইতে উত্তেজনার সৃষ্টি

মালাউইতে ভ্রমণের কাজ করার সময় আমরা এই জিপে যাওয়া-আসা করতাম

১৯৬৭ সালে ১ ফেব্রুয়ারি, আমরা মালাউইতে পৌঁছাই। প্রথম একটা মাস তো ভাষা শিখতেই চলে গিয়েছিল। এরপর, আমি জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করতে শুরু করি। আমাদের কাছে যাতায়াত করার জন্য একটা বড়ো জিপ ছিল। লোকেরা বলত: ‘আপনার জিপ তো যেকোনো জায়গায় যেতে পারে, এমনকী নদীও পার করতে পারে।’ এমনটা তো ছিল না, কিন্তু আমরা মাঝে মাঝে অল্প একটু জলের উপর দিয়ে সেটাকে নিয়ে যেতাম। কখনো কখনো আমাদের কুঁড়ে ঘরে থাকতে হত আর বৃষ্টির সময় সেটার উপর ত্রিপল টাঙাতে হত, যাতে বৃষ্টির জল ভিতরে না আসে। এভাবে আমাদের মিশনারি সেবার শুরুটা বেশ আগ্রহজনক হয়।

প্রায় দু-মাস পর এপ্রিলের দিকে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করে। মনে হচ্ছিল যেন সরকার যিহোবার সাক্ষিদের বিরুদ্ধে হয়ে যাচ্ছে। আমি রেডিওতে মালাউইয়ের রাষ্ট্রপতি ডক্টর হেস্টিংস বান্দার ভাষণ শুনি, যেখানে তিনি যিহোবার সাক্ষিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা কথা বলেন। তিনি বলেন, যিহোবার সাক্ষিরা ট্যাক্স দেয় না আর সেইসঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করে। এই কথাগুলো সত্য ছিল না। আসলে, তিনি আমাদের উপর রেগে ছিলেন কারণ আমরা রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে অংশ নিচ্ছিলাম না আর তাদের পার্টির কার্ডও কিনছিলাম না।

সেপ্টেম্বর মাসে আমরা পেপারে পড়ি, রাষ্ট্রপতি যিহোবার সাক্ষিদের উপর অভিযোগ এনেছেন যে, তারা পুরো দেশের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি করছে। তিনি একটা রাজনৈতিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন, সরকার খুব শীঘ্রই যিহোবার সাক্ষিদের সমস্ত কাজ বন্ধ করে দেবে। তারপর, ১৯৬৭ সালের ২০ অক্টোবর আমাদের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিছুসময় পর, পুলিশ এবং কিছু অফিসার শাখা অফিসে পৌঁছায়, যাতে তারা সেটাকে বন্ধ করতে পারে আর মিশনারি ভাই-বোনদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে।

১৯৬৭ সালে আমাদের এবং আমাদের সঙ্গে মিশনারি সেবা করতেন ভাই জ্যাক ইয়োহানসন এবং তার স্ত্রী লিন্ডাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে আর মালাউই থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে

আমাদের তিন দিন পর্যন্ত জেলে রাখা হয়। তারপর আমাদের মরিশাসে পাঠানো হয়, যেখানে সেই সময় ব্রিটেন শাসন করছিল। কিন্তু, সেখানকার আধিকারিকরা আমাদের বলে, আমরা সেখানে মিশনারি হিসেবে থাকতে পারব না। তখন সংগঠন আমাদের জিম্বাবোয়ে যেতে বলে, যেটাকে সেই সময় রোডেশিয়া বলা হত। যখন আমরা সেখানে পৌঁছাই, তখন একজন রাগী অফিসার আমাদের দেশে ঢুকতে বাধা দেন। তিনি বলেন: “মালাউই থেকে তোমাদের বের করে দেওয়া হয়েছে আর মরিশাসে থাকতে দেওয়া হয়নি, তাই এখন এখানে চলে এসেছে?” এই কথা শুনে অ্যান কাঁদতে শুরু করে। সেইসময় মনে হচ্ছিল যেন আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। একবার তো মনে হয়েছিল যেন সব কিছু ছেড়ে দিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যাই, কিন্তু পরে আধিকারিকরা রাজি হয়ে যায় আর আমাদের এক রাত শাখা অফিসে থাকার জন্য অনুমতি দিয়ে দেয়। কিন্তু তারা বলে, পরের দিন আমাদের তাদের অফিসে যেতে হবে। আমরা প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের আস্থা ছিল, যিহোবা আমাদের যত্ন নেবেন। তাই, আমরা সমস্ত কিছু তাঁর হাতে ছেড়ে দিই। আর পরের দিন দুপুর বেলায় এক অলৌকিক বিষয় ঘটে! অফিসাররা বলে, আমরা জিম্বাবোয়েতে থাকতে পারি। সেই দিনটা আমি কোনো দিনও ভুলতে পারব না! আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যাই, যিহোবাই আমাদের পথ দেখাচ্ছেন।

জিম্বাবোয়ে থেকে মালাউইর দেখাশোনা

১৯৬৮ সালে অ্যানের সঙ্গে জিম্বাবোয়ের বেথেলে

জিম্বাবোয়ের শাখা অফিসে আমাকে সেবা বিভাগ-এ কাজ করার জন্য বলা হয়। আমি সেখানে মালাউই ও মোজাম্বিকে হওয়া কাজগুলোর দেখাশোনা করতাম। সেইসময় মালাউইতে ভাইদের উপর প্রচণ্ড অত্যাচার করা হচ্ছিল। সেখানকার সীমা অধ্যক্ষ যে-রিপোর্ট পাঠাতেন, আমি সেটার অনুবাদও করতাম। একবার আমি অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করছিলাম আর ঠিক এইরকমই একটা রিপোর্ট তৈরি করছিলাম। যখন আমি রিপোর্টে পড়ি যে, মালাউইয়ের ভাই-বোনদের কত খারাপভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে, তখন আমি আমার চোখের জল আর ধরে রাখতে পারিনি। * কিন্তু, এই সমস্ত কিছু ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও, তারা যিহোবার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছিল আর যিহোবার প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেছিল। এই বিষয়টা আমার হৃদয় স্পর্শ করেছিল।—২ করি. ৬:৪, ৫.

এই সমস্ত অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেক ভাই-বোন মোজাম্বিকে পালিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আমাদের কঠোর প্রচেষ্টা ছিল যেন তাদের কাছে আর সেইসঙ্গে মালাউইতে বসবাসকারী ভাই-বোনদের কাছে প্রকাশনা পৌঁছাতে থাকে। মালাউইতে চিচেওয়া ভাষায় লোকেরা বেশি কথা বলে, তাই এই ভাষার অনুবাদ কাজ ক্রমাগত বজায় রাখার জন্য চিচেওয়া ভাষার অনুবাদকদের জিম্বাবোয়েতে ডেকে আনা হয়। জিম্বাবোয়ে একজন ভাইয়ের কাছে একটা বড়ো জমি ছিল। সেখানে তিনি অনুবাদ দলের জন্য অফিস এবং ঘর তৈরি করেছিলেন আর এভাবে চিচেওয়া ভাষায় প্রকাশনাগুলো ক্রমাগত অনুবাদ করা হচ্ছিল।

আমরা প্রতি বছর ব্যবস্থা করতাম, যাতে মালাউইয়ের সীমা অধ্যক্ষ জিম্বাবোয়ে আসতে পারেন আর চিচেওয়া ভাষার জেলা সম্মেলনে অংশ নিতে পারেন। সেখানে তাকে সম্মেলনের বক্তৃতাগুলোর আউটলাইন দেওয়া হত, যাতে তিনি মালাউইয়ে ফিরে এসে ভাই-বোনদের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো বলতে পারেন। একবার যখন সীমা অধ্যক্ষ সম্মেলনের জন্য জিম্বাবোয়ে এসেছিলেন, তখন আমরা তার সাহস বৃদ্ধি করার জন্য রাজ্যের পরিচর্যা বিদ্যালয়-এর ব্যবস্থাও করেছিলাম।

জিম্বাবোয়েতে চিচেওয়া ও সোনা ভাষার সম্মেলনে চিচেওয়া ভাষায় বক্তৃতা দেওয়া হচ্ছে

১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি মোজাম্বিকে সেই ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, যারা মালাউই থেকে পালিয়ে সেখানে চলে এসেছিল। তারা সংগঠনের কাছ থেকে পাওয়া সমস্ত নির্দেশনা অনুসরণ করছিল। আর কিছুসময় আগে প্রাচীনগোষ্ঠী গঠন করার জন্য যে-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তারা সেটাও অনুসরণ করেছিল। কিছু প্রাচীন সম্প্রতি নিযুক্ত হয়েছিলেন আর তারা ভাই-বোনদের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা করেছিলেন। যেমন, তারা জনভাষণ দিতেন, ভাই-বোনদের সঙ্গে প্রতিদিন দৈনিক শাস্ত্রপদ পাঠ করতেন আর সেইসঙ্গে প্রহরীদুর্গ নিয়ে আলোচনা করতেন, এমনকী সম্মেলনের আয়োজনও করতেন। যদিও সেই ভাই-বোনদের কাছে পাকা ঘরবাড়ি ছিল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও, তারা সুসংগঠিত উপায়ে থাকতেন। ঠিক যেমনটা সম্মেলনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের জন্য, খাবার বিতরণের জন্য আর নিরাপত্তার জন্য আলাদা আলাদা বিভাগ থাকত, একইভাবে তারা এইরকমই কিছু ব্যবস্থা করে রেখেছিল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, যিহোবা এই বিশ্বস্ত ভাই-বোনদের কত আশীর্বাদ করছিলেন। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না, তাদের সঙ্গে দেখা করে আমি কতটা উৎসাহিত হয়েছিলাম।

১৯৮০-র দশকের মধ্যে জাম্বিয়ার শাখা অফিস মালাউইতে হওয়া কাজকর্ম দেখাশোনা করতে শুরু করে। কিন্তু, তখনও আমি প্রায়ই মালাউইর ভাই-বোনদের স্মরণ করতাম আর তাদের জন্য প্রার্থনা করতাম। অন্য ভাই-বোনেরাও এমনটা করত। সেইসময় আমি জিম্বাবোয়ে শাখা কমিটি-র সদস্য হয়ে গিয়েছিলাম। তাই, মাঝে মাঝে যখন বিশ্বপ্রধান কার্যালয় থেকে প্রতিনিধিরা পরিদর্শন করতে আসতেন, তখন মালাউই, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং জাম্বিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইদের সঙ্গে আমার দেখা হত। প্রতি বার আমরা এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতাম, মালাউইর ভাই-বোনদের জন্য আর কী করা যেতে পারে।

সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মালাউইর ভাই-বোনদের উপর যে-অত্যাচার করা হচ্ছিল, সেটা কম হতে শুরু করে আর যে-সমস্ত ভাই-বোন সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, তারা আবার ফিরে আসতে শুরু করে। আশেপাশের কিছু দেশে সাক্ষিদের বৈধ স্বীকৃতি দিয়ে দেয় আর আমাদের কাজের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ১৯৯১ সালে আমরা মোজাম্বিকে উপাসনা করার স্বাধীনতা লাভ করি। তবে, আমরা এই বিষয়ে চিন্তা করতে থাকি যে, মালাউইতে কবে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে।

পুনরায় মালাউইতে

কিছুসময় পর মালাউইর পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় আর ১৯৯৩ সালে সরকার যিহোবার সাক্ষিদের কাজের উপর থাকা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। একদিন একজন মিশনারি ভাইয়ের সঙ্গে আমি কথা বলছিলাম আর সেই ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “তাহলে, এখন আপনি কি পুনরায় মালাউইতে ফিরে যাবেন?” সেইসময় আমার বয়স ছিল ৫৯ বছর। আমি বলি: “এখন আর কোথায় যাব, এখন তো আমার বয়স হয়ে গিয়েছে!” কিন্তু, সেই দিনই আমরা পরিচালকগোষ্ঠীর কাছ থেকে একটা ফ্যাক্স পাই, যেখানে লেখা ছিল, আমরা মালাউইতে পুনরায় ফিরে যেতে পারি।

জিম্বাবোয়ে ছেড়ে যাওয়া আমাদের জন্য সহজ ছিল না। কারণ সেখানে আমরা অনেক বছর ধরে সেবা করছিলাম আর অনেক বন্ধুও তৈরি করেছিলাম। আমরা সেখানে অনেক আনন্দে ছিলাম। আর পরিচালকগোষ্ঠীও বলেছিল, আমরা যদি চাই, তা হলে জিম্বাবোয়ে থেকেই সেবা করতে পারি। তাই, আমরা সেখানে থাকতে পারতাম। কিন্তু, আমরা আমাদের পথ বাছাই করতে চাইনি। আমরা চিন্তা করি, অব্রাহাম ও সারাও যিহোবার কথা শুনেছিলেন আর বৃদ্ধ বয়সে নিজেদের ঘরবাড়ি ত্যাগ করেছিলেন।—আদি. ১২:১-৫.

আমরা যিহোবার সংগঠনের নির্দেশনা অনুসরণ করি আর ১৯৯৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মালাউইতে পৌঁছাই। ২৮ বছর আগে আমরা ঠিক এই দিনে মালাউইতে প্রথম বার পা রেখেছিলাম। সেখানে একটা শাখা কমিটি গঠন করা হয়েছিল, যে-কমিটিতে আমি এবং আরও দু-জন ভাই ছিলেন। খুব শীঘ্রই আমরা যিহোবার উপাসনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সমস্ত কাজ আবারও শুরু করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই।

যিহোবার আশীর্বাদের কারণে হওয়া উন্নতি

যিহোবার আশীর্বাদের কারণে মালাউইতে প্রচারকদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৯৯৩ সালে সেখানে ৩০,০০০, প্রচারক ছিল, কিন্তু ১৯৯৮ সালে সেটা বেড়ে ৪২,০০০ হয়ে যায়। * এই বৃদ্ধির বিষয়টা মাথায় রেখে পরিচালকগোষ্ঠী একটা নতুন শাখা অফিস তৈরি করার অনুমতি দেয়। আমরা লিলংওয়ে শহরে ৩০ একরের (১২ হেক্টর) একটা জমি কিনি আর আমাকে নির্মাণ কমিটি-র সঙ্গে কাজ করতে বলা হয়।

কিছু সময়ের মধ্যেই নতুন শাখা অফিস তৈরি হয়ে যায় আর ২০০১ সালের মে মাসে পরিচালকগোষ্ঠীর সদস্য ভাই গায় পিয়ার্স উৎসর্গীকরণের বক্তৃতা দিতে আসেন। সেইসময় ২,০০০-এর বেশি ভাই-বোন উপস্থিত হয়েছিল, যাদের মধ্যে কেউ কেউ ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যিহোবার সেবা করছিল। একটা সময় যখন আমাদের কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, তখন এই ভাই-বোনেরা অনেক বছর ধরে অত্যাচার সহ্য করেছিল। যদিও তাদের কাছে টাকাপয়সা কম ছিল, কিন্তু আশীর্বাদের কোনো অভাব ছিল না! যিহোবার সঙ্গে তাদের এক দৃঢ় সম্পর্ক ছিল। নতুন বেথেল পরিদর্শন করে তারা অনেক আনন্দিত হচ্ছিল। তারা প্রত্যেকে তাদের নিজেদের ভাষায় যিহোবার প্রশংসার উদ্দেশে উচ্চস্বরে গান গাইছিল। আমি আজ পর্যন্ত এইরকম দৃশ্য কখনো দেখিনি। সত্যিই, যারা কঠিন সময়ে যিহোবার প্রতি বিশ্বস্ত থাকে, তাদের তিনি প্রচুররূপে আশীর্বাদ করেন।

মালাউইতে শাখা অফিস নির্মাণ করার পাশাপাশি অনেক কিংডম হল নির্মাণ করা হচ্ছিল। আর আমাকে অনেক কিংডম হলের জন্য উৎসর্গীকরণের বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। আমাদের সংগঠন ব্যবস্থা করে, যে-দেশগুলোতে ভাই-বোনদের কাছে কম টাকাপয়সা রয়েছে, সেখানে কম জিনিসপত্র ব্যবহার করে আর কম সময়ের মধ্যে কিংডম হল নির্মাণ করা যেতে পারে। মালাউইতে এভাবে কিংডম হল নির্মাণের কাজ চলছিল। প্রথমে সেখানে ইউক্যালিপ্টাস গাছ দিয়ে কিংডম হল তৈরি করা হত এবং সেটার ছাদ ঘাস বা নাড়া দিয়ে তৈরি করা হত আর সেখানে বসার জন্য মাটির বেঞ্চ থাকত। কিন্তু, এখন ভাইয়েরা ইটভাটায় ইট তৈরি করতে শুরু করে। তারা কঠোর পরিশ্রম করে আরও সুন্দর সুন্দর কিংডম হল তৈরি করে। কিন্তু, বসার জন্য তাদের বেঞ্চই পছন্দ ছিল। তারা বলত, ‘বেঞ্চে তো জায়গা কখনো কম হয় না!’

আমি এটা দেখে অনেক আনন্দিত হই যে, ভাই-বোনেরা কীভাবে যিহোবার সেবাকে জীবনে প্রথম স্থানে দিয়েছে আর যিহোবা তাদের সাহায্য করছেন। বিশেষ করে, আমার সেখানকার যুবক ভাইদের দেখে খুব ভালো লাগে, যারা নিজে থেকে এগিয়ে এসে যিহোবার সেবা করছিল। তাদের সংগঠন থেকে যা প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল, তারা সঙ্গেসঙ্গে সেগুলো মেনে চলছিল। এভাবে, তারা বেথেল এবং মণ্ডলীতে আরও দায়িত্ব পালন করার জন্য যোগ্য হয়ে ওঠে। অনেক ভাইকে সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল, যেটার ফলে মণ্ডলী অনেক উপকৃত হয়েছিল। তাদের মধ্যে অনেকে বিবাহিত ছিল আর অনেকের পরিবার এবং সমাজের লোকেরা তাদের উপর চাপ দিত, যেন তারা পরিবার বৃদ্ধি করে। কিন্তু, তারা যিহোবার আরও সেবা করতে চেয়েছিল। তাই, তারা সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

সঠিক পথ বাছাইয়ের ফলে পাওয়া আনন্দ

অ্যানের সঙ্গে ব্রিটেনের বেথেলে

আমরা ৫২ বছর ধরে আফ্রিকায় সেবা করছিলাম। পরে, আমার শরীর একটু খারাপ হতে শুরু করে। তাই, শাখা কমিটি পরিচালকগোষ্ঠীকে জিজ্ঞেস করে যে, আমরা পুনরায় ব্রিটেনে ফিরে যেতে পারি কি না। পরিচালকগোষ্ঠী এটার অনুমোদন দেয়। তাই, আমরা পুনরায় ব্রিটেনে ফিরে আসি। আফ্রিকা ছেড়ে আসার সময় আমাদের অনেক দুঃখ হচ্ছিল কারণ সেই জায়গা এবং সেখানকার লোকদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু, ব্রিটেন বেথেলের ভাই-বোনেরা আমাদের অনেক ভালোভাবে দেখাশোনা করছে।

আমি যিহোবার দেখানো পথে চলা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর এই বিষয়ে আমার কোনো আপশোস নেই। কিন্তু, আমি যদি নিজ বিবেচনার উপর নির্ভর করতাম আর জগতে আমার কেরিয়ার বাছাই করতাম, তা হলে জানি না এখন আমার কী হত। কিন্তু, যিহোবা জানতেন, আমার কোন পথে চলা উচিত আর তিনি আমাকে সেই ‘পথ’ দেখিয়েছেন। (হিতো. ৩:৫, ৬) একেবারে শুরুর দিকে যখন আমি একটা বড়ো কোম্পানিতে কাজ শিখছিলাম, তখন আমি সেটা খুব উপভোগ করছিলাম। কিন্তু আমি দেখি, আমাদের সংগঠন তো সেই কোম্পানির থেকেও অনেক বড়ো। আর আমি যখন যিহোবার সেবাকে আমার কেরিয়ার হিসেবে বাছাই করি, তখন আমি আরও বেশি আনন্দ পাই। যিহোবার দেখানো পথে চলার ফলে আমি প্রতিটা পদক্ষেপে আশীর্বাদ লাভ করি!

^ মালাউইর যিহোবার সাক্ষিদের ইতিহাস সম্বন্ধে যিহোবার সাক্ষিদের বর্ষপুস্তক ১৯৯৯ (ইংরেজি) বইয়ের ১৪৮-২২৩ পৃষ্ঠায় তুলে ধরা হয়েছে।

^ বর্তমানে মালাউইতে ১,০০,০০০-রও বেশি প্রচারক রয়েছে।