সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

জীবনকাহিনি

আমি যিহোবা সম্বন্ধে শিখতে ও শেখাতে পেরে খুবই আনন্দিত হয়েছি

আমি যিহোবা সম্বন্ধে শিখতে ও শেখাতে পেরে খুবই আনন্দিত হয়েছি

যুক্তরাষ্ট্রে পেনসিলভানিয়ার ইস্টন নামে এক শহরে আমি বড়ো হই। ছোটোবেলা থেকে আমার ইচ্ছা ছিল, আমি বড়ো হয়ে অনেক নাম কামাব আর কিছু করে দেখাব। তাই, আমি কলেজে যেতে চেয়েছিলাম। আমার পড়াশোনা করতে খুব ভালো লাগত আর অঙ্কে ও বিজ্ঞানে আমি খুব ভালো নাম্বার পেতাম। ১৯৫৬ সালে আমি হাই স্কুল পাশ করি। সমস্ত কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে-মেয়েদের মধ্য থেকে আমিই সবচেয়ে বেশি নাম্বার পেয়েছিলাম। তাই, একটা সংস্থা আমাকে ২৫ ডলার (প্রায় ১২০ টাকা) পুরস্কার হিসেবে দিয়েছিল। কিন্তু, আমি কখনো কলেজে যেতে পারিনি। আসুন আপনাদের জানাই, কেন যেতে পারিনি।

আমি যিহোবা সম্বন্ধে শিখি

১৯৪০ সালের শুরুর দিকে আমার মা-বাবা যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। তাদের অধ্যয়ন খুব বেশি দিন চলেনি। কিন্তু, মায়ের কাছে প্রহরীদুর্গ আর সচেতন থাক! পত্রিকা আসতে থাকে। ১৯৫০ সালে আমাদের নিউ ইয়র্কে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় আর আমরা সবাই মিলে সেখানে যাই।

সম্মেলনের পর থেকে এক ভাই আমাদের বাড়িতে আসতে শুরু করেন। তার নাম ছিল লরেন্স জেফরিজ। তিনি প্রায়ই আমার সঙ্গে বাইবেল নিয়ে কথা বলতেন। কিন্তু, কিছু কিছু বিষয়ে আমার চিন্তাধারা তার চেয়ে একেবারে আলাদা ছিল। আমার মনে হত, যিহোবার সাক্ষিদের রাজনীতিতে অংশ নেওয়া উচিত আর সেনায় ভরতি হওয়া উচিত। একদিন আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেউই সেনায় ভরতি না হয়, তা হলে শত্রুরা এসে আমাদের দেশ দখল করে নেবে না?’ তখন ভাই জেফরিজ আমাকে খুবই ধৈর্যের সঙ্গে বোঝান। তিনি বলেন: “তুমি নিজেই চিন্তা করো। যদি যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত লোক যিহোবার সাক্ষী হত আর শত্রুরা আমাদের উপর আক্রমণ করতে আসত, তা হলে যিহোবা কি কিছুই করতেন না?” ভাই এই ধরনের অন্যান্য অনেক বিষয়ই আমাকে বুঝতে সাহায্য করেন। আমি তখন বুঝতে পেরে যাই যে, আমার চিন্তাধারা ভুল। আর আমার বাইবেল সম্বন্ধে জানার ইচ্ছা আরও বেড়ে যায়।

আমার বাপ্তিস্মের দিন

মাকে যে-প্রহরীদুর্গ আর সচেতন থাক! পত্রিকা দেওয়া হত, তিনি সেগুলো খুবই যত্ন করে রাখতেন। এইজন্যই আমি ওগুলো পড়তে শুরু করি। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেগুলো পড়ি আর এভাবে আমি নিশ্চিত হই যে, এটাই সত্য। আমি ভাই জেফরিজের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করার জন্য রাজি হই। আমি নিয়মিতভাবে সভাতে যেতে শুরু করি। আমি যা-কিছু শিখছিলাম, সেগুলো আমার খুব ভালো লাগছিল আর কিছু সময়ের মধ্যেই আমি একজন প্রকাশক হই। আমি যখন বুঝতে পারি যে, “সদাপ্রভুর মহাদিন [কতটা] নিকটবর্তী,” তখন আমার লক্ষ্য পালটে যায়। (সফ. ১:১৪) ছোটোবেলা থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল আমি যেন কলেজে যেতে পারি, কিন্তু এখন আমি লোকদের বাইবেল সম্বন্ধে শেখাতে চেয়েছিলাম।

১৯৫৬ সালের ১৩ জুন আমার হাই স্কুলের পড়াশোনা শেষ হয় আর তার তিন দিন পর একটা সীমা সম্মেলনে আমি বাপ্তিস্ম নিই। সেই সময় আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে, যিহোবা সম্বন্ধে শিখে এবং অন্যদের তাঁর সম্বন্ধে শেখাতে পেরে আমি কত আশীর্বাদ লাভ করতে চলেছি!

অগ্রগামীর কাজ করার সময় অনেক কিছু শিখি আর অন্যদেরও শেখাই

১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি অগ্রগামীর কাজ শুরু করি। সেই মাসের রাজ্যের পরিচর্যা-য় (ইংরেজি) একটা প্রবন্ধ এসেছিল, যেটার শিরোনাম ছিল “যেখানে বেশি প্রয়োজন, সেখানে গিয়ে কি সেবা করতে পারবেন?” সেটা পড়ার পর আমি ভাবি, এটা তো আমিও করতে পারব।—মথি ২৪:১৪.

আমি দক্ষিণ ক্যারোলাইনার এজফিল্ড শহরে চলে যাই আর সেখানে সেবা করতে শুরু করি। সেখানকার মণ্ডলীতে শুধুমাত্র চার জন প্রকাশক ছিল, আমি যাওয়ার পর আমরা পাঁচ জন হই। আমরা এক ভাইয়ের বাড়িতে সভা করতাম। আমি প্রতি মাসে প্রচারে ১০০ ঘণ্টা করে ব্যয় করতাম। সভাতে আমাকে বেশ কয়েকটা অংশ তুলে ধরতে হত আর প্রচারের জন্য সভা পরিচালনা করতে হত। আমি এই কাজগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। আমি যতবেশি এই কাজগুলো করেছি, ততবেশি যিহোবা সম্বন্ধে শিখতে পেরেছি।

আমি একজন মহিলাকে বাইবেল অধ্যয়ন করাতাম। পাশেই এক শহরে তার একটা জমি ছিল, যেখানে মৃত ব্যক্তিদের কবর দেওয়া হত। তিনি আমাকে কাজে রাখেন আর আমি সপ্তাহে কয়েক দিন সেখানে কাজ করতে শুরু করি। সেই মহিলার একটা বিল্ডিংও ছিল, যেটা তিনি আমাদের সভা করার জন্য দিয়ে দেন।

ভাই জেফরিজ, যিনি আমাকে বাইবেল অধ্যয়ন করাতেন, তার ছেলে জলি ব্রুকলিন থেকে এজফিল্ডে চলে আসেন। সেখানে আমরা দু-জনে মিলে অগ্রগামীর কাজ করি। সেখানকার এক ভাই আমাদের থাকার জন্য তার একটা ছোটো ট্রেলার (ভ্রাম্যমাণ গাড়ি) দিয়ে দেন।

সেখানে খরচ মেটানো খুবই কঠিন ছিল। সারাদিন কাজ করার পর বেতনের নামে মাত্র দু-তিন ডলার দেওয়া হত। একবার আমার কাছে শুধুমাত্র খাবার কেনার টাকা ছিল। আর দোকান থেকে খাবার কিনে বেরোনোর সময় একজন ব্যক্তি আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন: “তুমি কি আমার জন্য কাজ করবে? আমি তোমাকে ঘণ্টায় এক ডলার করে দেব।” তিনি আমাকে তিন দিনের জন্য এমন একটা জায়গায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ দেন, যেখানে নির্মাণ চলছিল। তখন আমি বুঝতে পারি যে, যিহোবা আমাকে সাহায্য করছেন। আমি এও বুঝতে পারি, তিনি চান আমি এজফিল্ডেই থাকি। ১৯৫৮ সালে নিউ ইয়র্কে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন হতে যাচ্ছিল। সেই সময় আমার কাছে বেশি টাকা ছিল না, কিন্তু তারপরও আমি সেখানে যেতে পারি।

আমাদের বিয়ের দিন

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন আমার জন্য খুবই বিশেষ একটা দিন ছিল। সে-দিন আমার রুবি ওয়াডলিংটানের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি টেনেসির গ্যালাটিন শহরে অগ্রগামীর কাজ করতেন। সেই সম্মেলনে যারা গিলিয়েডে যোগ দিতে চায়, তাদের জন্য একটা সভা রাখা হয়েছিল। আমরা দু-জনেই মিশনারি সেবা করতে চেয়েছিলাম, তাই আমরা সেই সভায় যোগ দিই। তারপর, আমরা একে অন্যকে চিঠি লিখতে শুরু করি। পরে, আমাকে গ্যালাটিন শহরে জনসাধারণের বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডাকা হয়। সেই সুযোগেই আমি রুবিকে বিয়ের প্রস্তাব দিই। তারপর, আমি রুবির মণ্ডলীতে চলে যাই আর ১৯৫৯ সালে আমরা বিয়ে করে নিই।

মণ্ডলীতে সেবা করার সময় অনেক কিছু শিখি আর অন্যদেরও শেখাই

২৩ বছর বয়সে আমাকে গ্যালাটিনে মণ্ডলীর দাস হিসেবে নিযুক্ত করা হয় (যাকে এখন প্রাচীনগোষ্ঠীর কোঅর্ডিনেটর বলা হয়)। সেইসময় আমাদের মণ্ডলীতে একজন নতুন সীমা অধ্যক্ষ আসেন, যার নাম চার্লস থম্পসন। সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর, তিনি সবচেয়ে প্রথমে আমাদের মণ্ডলীতে ভ্রমণ করতে এসেছিলেন। তার অনেক অভিজ্ঞতা ছিল, কিন্তু তারপরও তিনি আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন, কীভাবে ভাই-বোনদের সাহায্য করা যেতে পারে আর কীভাবে অন্যান্য সীমা অধ্যক্ষ তা করে। আমি তার কাছ থেকে একটা ভালো কথা শিখেছিলাম যে, কোনো কিছু করার আগে অথবা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের জিজ্ঞেস করা উচিত আর সেই সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য নিয়ে রাখা উচিত।

১৯৬৪ সালের মে মাসে আমাকে রাজ্যের পরিচর্যা বিদ্যালয়-এ যোগ দেওয়ার জন্য ডাকা হয়। এটা এক মাসের কোর্স ছিল আর নিউ ইয়র্কের দক্ষিণ ল্যানসিং শহরে হয়েছিল। সেখানকার প্রশিক্ষকেরা আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন যেন আমি যিহোবা সম্বন্ধে আরও শিখি আর তাঁর আরও নিকটবর্তী হই।

জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করার সময় অনেক কিছু শিখি আর অন্যদেরও শেখাই

১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে আমাদের সীমার কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমাদের সীমার এলাকা অনেক বড়ো ছিল, টেনিসির নক্সভিল শহর থেকে শুরু করে ভার্জিনিয়ার রিচমন্ড শহর পর্যন্ত। আমরা উত্তর ক্যারোলাইনা, কেন্টাকি এবং পশ্চিম ভার্জিনিয়ার মণ্ডলীগুলোতে ভ্রমণ করেছিলাম। তখনকার দিনে দক্ষিণ আমেরিকায় একটা আইন ছিল যে, শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ লোকেরা একসঙ্গে মিলিত হতে পারবে না। সেই কারণে আমি শুধুমাত্র সেই মণ্ডলীগুলোতে যেতাম, যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ ভাই-বোনেরা ছিল। সেই ভাই-বোনেরা খুবই গরিব ছিল। তাদের দেখে আমাদের মনে হত, আমাদের কাছে যা আছে, আমরা সেটা থেকে তাদের কিছু দিই। একজন অভিজ্ঞ সীমা অধ্যক্ষ আমাকে একটা দারুণ কথা শিখিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “কখনো মণ্ডলীতে ভাই-বোনদের কাছে তাদের বস হিসেবে যাবেন না। আপনি তাদের বস নন, আপনি তাদের ভাই। যদি তারা আপনাকে তাদের ভাই হিসেবে দেখে, তবেই আপনি তাদের সাহায্য করতে পারবেন।”

একবার আমরা একটা ছোট্ট মণ্ডলীতে ভ্রমণ করতে গিয়েছিলাম। সেখানে রুবি একজন যুবতীকে বাইবেল অধ্যয়ন করাতে শুরু করে। তার এক বছরের একটা মেয়ে ছিল। কিন্তু তখন, সেই মণ্ডলীতে তাকে অধ্যয়ন করানোর মতো কেউই ছিল না। তাই, রুবি চিঠি লিখে লিখে বাইবেল অধ্যয়ন করায়। আমরা যখন আবার সেই মণ্ডলীতে ভ্রমণ করতে যাই, তখন সেই যুবতী প্রতিটা সভায় আসে। কিছুসময় পর, দু-জন বিশেষ অগ্রগামী বোনকে সেখানে পাঠানো হয় আর তারা সেই যুবতীকে বাইবেল অধ্যয়ন করাতে শুরু করেন। কিছু দিনের মধ্যেই সে বাপ্তিস্ম নেয়। প্রায় ৩০ বছর পর, ১৯৯৫ সালে আমরা যখন প্যাটারসন বেথেলে ছিলাম, তখন একজন বোন রুবির সঙ্গে দেখা করতে আসে। সে বলে যে, সে হল সেই মেয়েটি, যার মাকে রুবি বহু বছর আগে অধ্যয়ন করিয়েছিল। তার স্বামী ও তাকে গিলিয়েড স্কুলের ১০০তম ক্লাসে ডাকা হয়েছিল।

আমাদের আরেকটা সীমায় সেবা করার জন্য বলা হয়, যেখানে ফ্লোরিডার কিছু মণ্ডলী ছিল। সেইসময় আমাদের মনে হয়, যাতায়াত করার জন্য একটা গাড়ি কিনে নিলে ভালো হয়। তাই, আমরা খুব কম দামে একটা গাড়ি কিনি। কিন্তু, প্রথম সপ্তাহেই গাড়ির ইঞ্জিন খারাপ হয়ে যায়। সেটা ঠিক করার জন্য আমাদের কাছে টাকা ছিল না। তখন আমি একজন ভাইয়ের কাছে সাহায্য চাই। তিনি তার এক কর্মচারীকে আমাদের গাড়ি সারানোর জন্য পাঠিয়ে দেন। আমি যখন সেই ভাইকে জিজ্ঞেস করি, কত টাকা হল, তখন তিনি বলেন, “থাক থাক, ওটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।” তিনি আমাদের কাছ থেকে একটা টাকাও নিলেন না, উলটে আমাদেরই কিছু টাকা দিয়ে দিলেন। যিহোবা যেভাবে আমাদের সাহায্য করছিলেন, সেটা থেকে আমরা ভালোভাবে বুঝতে পারি যে, তিনি আমাদের জন্য কতটা চিন্তা করেন। আমরা শিখেছিলাম যে, আমাদেরও উদার হয়ে অন্যদের সাহায্য করা উচিত।

আমরা যখন বিভিন্ন মণ্ডলীতে ভ্রমণ করতে যেতাম, তখন ভাই-বোনদের বাড়িতেই থাকতাম। আজও তাদের মধ্যে অনেকেই আমাদের খুব ভালো বন্ধু। একবার আমরা একটা পরিবারের সঙ্গে ছিলাম আর আমি টাইপরাইটারে মণ্ডলীর একটা রিপোর্ট তৈরি করছিলাম। কোনো কারণে আমাকে মাঝখানেই সেটা ছেড়ে চলে যেতে হয় আর সন্ধ্যা বেলা বাড়ি ফিরে দেখি, তাদের তিন বছরের ছেলে টাইপরাইটারে অনেক কিছু উলটোপালটা টেপাটেপি করে রেখে দিয়েছে। তারপর থেকে আমি অনেক বছর ধরে সেটা নিয়ে তাকে রাগাতে থাকি যে, রিপোর্ট তৈরি করার জন্য সে আমাকে কত “সাহায্য” করেছিল।

১৯৭১ সালে আমার কাছে একটা চিঠি আসে। সেখানে লেখা ছিল, নিউ ইয়র্ক সিটিতে আমাকে একজন জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করার জন্য পাঠানো হবে। সেই কথাটা পড়ে আমরা বিশ্বাসই করতে পারিনি। সেই সময় আমার বয়স মাত্র ৩৪ বছর। আমি ছিলাম সেই এলাকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ জেলা অধ্যক্ষ। কিন্তু তারপরও, সেখানকার ভাই-বোনেরা খুবই প্রেমের সঙ্গে আমাকে স্বাগত জানায়।

সেই সময় থেকে একজন জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে আমি প্রতি সপ্তাহে সীমা সম্মেলনে বক্তৃতা দিতাম এবং লোকদের যিহোবা সম্বন্ধে শেখাতাম। আমি এমন অনেক সীমা অধ্যক্ষের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, যারা আমার চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। তাদের মধ্যে এক ভাই তো আমার বাপ্তিস্মের সময় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আরেকজন সীমা অধ্যক্ষ ছিলেন ভাই থিওডোর জারাস, যিনি পরে পরিচালকগোষ্ঠীর একজন সদস্য হন। অনেক ভাই ব্রুকলিন বেথেলে সেবা করত আর তাদের অনেক বছরের অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু তারা সবাই খুবই নম্র ছিল। এত অভিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও তারা কখনো আমার সঙ্গে বসের মতো আচরণ করেনি। তাই, আমি তাদের সঙ্গে খুব ভালোভাবে কাজ করতে পেরেছিলাম। আমি দেখেছিলাম, তারা এমন মেষপালক ছিল, যারা মেষদের খুবই ভালোবাসে, ঈশ্বরের বাক্য থেকে শিক্ষা দেয় এবং সংগঠনের নির্দেশনা অনুযায়ী চলে।

আবার সীমার কাজ করি

১৯৭৪ সালে পরিচালকগোষ্ঠী অন্যান্য সীমা অধ্যক্ষকে জেলার কাজ করার নির্দেশনা দেয় আর আমাকে সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দেয়। এবার, আমাকে দক্ষিণ ক্যারোলাইনার মণ্ডলীতে ভ্রমণ করার জন্য পাঠানো হয়। সেই সময় কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ ভাই-বোনেরা আলাদা আলাদা মণ্ডলীতে অথবা আলাদা আলাদা সীমাতে যেত না। তখন সমস্ত ভাই-বোন একসঙ্গে একত্রিত হতে পারত। আর এই কারণেই সবাই খুব আনন্দিত ছিল।

১৯৭৬ সালের শেষের দিকে আমাকে জর্জিয়ায় সীমার কাজ করার জন্য বলা হয়। আমি সেখানকার সেইসমস্ত মণ্ডলীতে ভ্রমণ করতে যেতাম, যেগুলো আটলান্টা ও কলম্বাসের মাঝামাঝি অবস্থিত। একবার এক কৃষ্ণাঙ্গ ভাইয়ের বাড়িতে কয়েক জন মিলে আগুন লাগিয়ে দেয়। ভাইয়ের স্ত্রী খুবই খারাপভাবে আহত হন আর তাকে হাসপাতালে ভরতি করা হয়। কিন্তু, তাদের পাঁচ সন্তান মারা যায়। তাদের মৃত্যুর পর আমাকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বক্তৃতা দেওয়ার জন্য বলা হয়। আমার আজও মনে আছে, সেই ভাই ও তার স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এক এক করে ভাই-বোন আসতেই থাকে, তাদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গরাও ছিল আর কৃষ্ণাঙ্গরাও ছিল। ভাই-বোনদের সেই ভালোবাসা দেখে আমার মন ছুঁয়ে যায়। এই প্রেমের কারণেই ভাই-বোনেরা কঠিন কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করার শক্তি পেয়ে থাকে।

বেথেলে অনেক কিছু শিখি আর অন্যদেরও শেখাই

১৯৭৭ সালে আমাকে ও রুবিকে একটা প্রজেক্টে সাহায্য করার জন্য ব্রুকলিন বেথেলে ডাকা হয়। কিছু মাস পর, সেই প্রজেক্টের শেষের দিকে পরিচালকগোষ্ঠীর দু-জন সদস্য আমাদের জিজ্ঞেস করেন যে, আমরা বেথেলে সেবা চালিয়ে যেতে চাই কি না। তখন আমরা হ্যাঁ বলে দিই।

আমি ২৪ বছর ধরে পরিচর্যা বিভাগে কাজ করি। এই বিভাগে ভাইদের কাছে প্রায়ই খুব কঠিন কঠিন প্রশ্ন আসে, যেগুলোর উত্তর খুব চিন্তাভাবনা করে দিতে হয়। কখনো কখনো পরিচালকগোষ্ঠীর ভাইয়েরা পরিচর্যা বিভাগকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে থাকেন এবং বাইবেলের নীতিগুলো মনে করিয়ে দেন, যেগুলোর সাহায্যে ভাইয়েরা সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারে। এই নির্দেশনার উপর ভিত্তি করেই সীমা অধ্যক্ষদের, প্রাচীনদের এবং অগ্রগামী ভাই-বোনদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যাদের এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তারা খুবই ভালোভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারে আর সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই কারণেই সংগঠনে সবকিছু খুবই সুসংগঠিতভাবে হওয়া সম্ভব হয়েছে।

১৯৯৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমি একজন বিশ্বপ্রধান কার্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। আমি শাখা কমিটির ভাইদের, বেথেলকর্মীদের এবং মিশনারি ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা করতাম আর তাদের উৎসাহ দিতাম। তারা যদি কোনোরকম চিন্তার মধ্যে থাকত কিংবা তাদের মনে কোনো প্রশ্ন থাকত, তা হলে আমরা সেগুলো নিয়ে কথা বলতাম। আমরা তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য যেতাম ঠিকই, কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা শুনে আমরাই উৎসাহিত হয়ে যেতাম। যেমন, ২০০০ সালে আমরা রুয়ান্ডা শাখা কমিটিতে ভ্রমণ করতে গিয়েছিলাম। কিছু বছর আগে ১৯৯৪ সালে সেখানকার পুরো জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই সময় অনেক ভাই-বোনকে তাদের পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধবকে মৃত্যুতে হারাতে হয়েছিল। সেই ভাই-বোনেরা যদিও এত কিছু সহ্য করেছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা তাদের বিশ্বাস দুর্বল হতে দেয়নি, তারা তাদের আশার উপর মনোযোগ রাখে এবং আনন্দের সঙ্গে যিহোবাকে সেবা করতে থাকে। ভাই-বোনদের এবং বেথেলকর্মীদের এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের মনে গভীর ছাপ ফেলে।

আমাদের ৫০তম বিবাহবার্ষিকীর দিন

এখন আমাদের দু-জনেরই বয়স ৮০ পার হয়ে গিয়েছে। গত ২০ বছর ধরে আমি যুক্তরাষ্ট্রের শাখা কমিটির একজন সদস্য হিসেবে সেবা করছি। আমি কখনো কলেজে যাইনি কিন্তু যিহোবা ও তাঁর সংগঠন থেকে আমি এত কিছু শিখেছি যে, এর সামনে কলেজের পড়াশোনা কিছুই নয়। এই কারণেই আমি অন্যদের ভালোভাবে বাইবেলের সত্য শেখাতে পেরেছি। আর এটার ফলে তারা বর্তমানে ও ভবিষ্যতে চিরকালের জন্য উপকার পেতে পারে। (২ করি. ৩:৫; ২ তীম. ২:২) আমি নিজের চোখে দেখেছি, যখন লোকেরা বাইবেলের কথা অনুযায়ী চলে, তখন তাদের জীবন পুরোপুরি পালটে যায় আর তারা তাদের সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে এক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। (যাকোব ৪:৮) আমি ও রুবি ভাই-বোনদের সবসময় মনে করিয়ে দিই, যিহোবা সম্বন্ধে শেখা এবং অন্যদের তাঁর সম্বন্ধে শেখানো কোনো ছোটো বিষয় নয়। যিহোবার দাসদের জন্য এটা এমন এক বিশেষ সুযোগ, যেটার সঙ্গে আর কোনো কিছুরই তুলনা হয় না!