তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন | মগ্দলীনী মরিয়ম
“আমি প্রভুকে দেখেছি!”
মগ্দলীনী মরিয়ম আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছছেন। তার প্রিয় প্রভুকে একটা দণ্ডের উপর ঝোলানো হয়েছে। এটা ছিল বসন্তকালের এক দুপুরবেলা, “তারপরও সারা দেশে অন্ধকার নেমে এল”! (লূক ২৩:৪৪, ৪৫) মরিয়ম তার কাপড়টা কাঁধের উপর টেনে নিলেন আর তার কাছাকাছি থাকা মহিলাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। সূর্যগ্রহণ হলে তা মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য হয়, কিন্তু তিন ঘন্টা ধরে এমন অন্ধকার, সূর্যগ্রহণ হতে পারে না। সম্ভবত, মরিয়ম ও অন্যান্য ব্যক্তি যারা যিশুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, তারা এমন সব প্রাণীর আওয়াজ শুনতে শুরু করেছিল, যা সাধারণত দিনের বেলায় শোনা যায় না। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েক জন “ভীষণ ভয় পেয়ে গেল এবং বলল: ‘ইনি সত্যিই ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন!’” (মথি ২৭:৫৪) যিশুর অনুসারীরা ও অন্যেরা হয়তো ভেবেছিল, যিহোবা তাঁর পুত্রের প্রতি ঘটা নিষ্ঠুর আচরণের জন্য যে-কতটা দুঃখিত ও অসন্তুষ্ট, তা প্রকাশ করছেন।
মগ্দলীনী মরিয়মের পক্ষে যিশুর দিকে তাকিয়ে থাকা এবং তাঁকে কষ্ট পেতে দেখা খুবই কঠিন ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কাছে থাকতে চেয়েছিলেন। (যোহন ১৯:২৫, ২৬) যিশু নিশ্চয়ই এক নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করছিলেন! আর যিশুর মায়েরও সান্ত্বনা ও সাহায্যের প্রয়োজন ছিল।
মরিয়মের জন্য যিশু অনেক কিছু করেছিলেন আর তাই মরিয়ম তাঁর জন্য যথাসাধ্য করতে চেয়েছিলেন। একসময় মরিয়মের জীবন দুঃখে ভরা ছিল এবং তাকে তুচ্ছ মহিলা হিসেবে দেখা হত। কিন্তু, যিশু তার জীবন পুরোপুরিভাবে পালটে দিয়েছিলেন। তিনি মরিয়মের জীবন মর্যাদাপূর্ণ ও উদ্দেশ্যপূর্ণ করে তুলেছিলেন। পরে, মরিয়ম একজন বিশ্বস্ত নারী হিসেবে প্রমাণিত হন। কীভাবে? আর বর্তমানে, তার বিশ্বাস থেকে আমরা কী শিখতে পারি?
‘তারা সকলে নিজেদের সম্পদ ব্যবহার করে [তাঁদের] সেবা করতেন‘
বাইবেলে, মগ্দলীনী মরিয়মের গল্পটা শুরু হয় একটা উপহার দিয়ে। যিশু তাকে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করেন, যেটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। সেই সময় ভূতদের অনেক বেশি প্রভাব ছিল আর এই মন্দ স্বর্গদূতেরা অনেক লোককে আক্রমণ করত, এমনকী কোনো কোনো ব্যক্তির মধ্যে প্রবেশ করে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করত। মগ্দলীনী মরিয়মের উপর ভূতেরা কোন প্রভাব ফেলেছিল, তা আমরা জানি না, শুধু জানি যে, তার মধ্যে সাতটা মন্দ স্বর্গদূত প্রবেশ করেছিল, কিন্তু যিশু তার মধ্যে থেকে সেই ভূতদের বের করে দেন। আর তাই তিনি যিশুকে ধন্যবাদ জানান!—লূক ৮:২.
অবশেষে, মরিয়ম মুক্ত হয়ে যে-কতটা স্বস্তি লাভ করেন, তা আমরা কল্পনা করতে পারব না। এখন মরিয়মের সামনে একটা নতুন জীবন রয়েছে। কীভাবে তিনি যিশুর প্রতি তার কৃতজ্ঞতা দেখাতে পারেন? তিনি যিশুর একজন অনুগত অনুসারী হয়ে ওঠেন। এ ছাড়া, তিনি প্রয়োজনের সময়ে সাহায্য জোগান। তিনি যিশু ও তাঁর প্রেরিতদের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার, পোশাক ও থাকার জায়গার ব্যবস্থা করেন। তাঁরা ধনী ছিলেন না এবং সেই সময়ে কোনো উপার্জনও করতেন না। তাই, তাঁদের বস্তুগত সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছিল, যাতে তাঁরা প্রচার ও শিক্ষাদানের কাজে মনোযোগ দিতে পারেন।
মরিয়ম ও অন্য মহিলারা এই প্রয়োজনগুলো মেটাতে সাহায্য করতেন। এই মহিলারা “নিজেদের সম্পদ ব্যবহার করে যিশু ও প্রেরিতদের সেবা করতেন।” (লূক ৮:১, ৩) এই মহিলাদের মধ্যে কয়েক জন ধনী ছিলেন। বাইবেল বলে না যে, সেই মহিলারা যিশু ও তাঁর শিষ্যদের জন্য রান্না করতেন, কাপড় ধুতেন কিংবা প্রতিটা গ্রামে গ্রামে থাকার ব্যবস্থা করতেন। তবে, আমরা জানি তারা স্বেচ্ছায় এই ভ্রমণকারী দলকে সাহায্য করতেন আর এই দলে সম্ভবত ২০ জন সদস্য ছিল। এই মহিলাদের সেবামূলক কাজ নিশ্চয়ই যিশু ও তাঁর প্রেরিতদের পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে প্রচার কাজ করতে সাহায্য করেছিল। মরিয়ম জানতেন যে, যিশু তার জন্য যা করেছেন, তিনি সেটা পরিশোধ করতে পারবেন না। তবে, তিনি তাঁর জন্য যথাসাধ্য করার মাধ্যমে কতই-না আনন্দিত হয়েছিলেন!
বর্তমানে, যারা অন্যদের জন্য ভালো কাজ করে থাকে, তাদের হয়তো নীচু চোখে দেখা হয়। কিন্তু, ঈশ্বর এভাবে চিন্তা করেন না। কল্পনা করুন, ঈশ্বর যখন মরিয়মকে যিশু ও তাঁর প্রেরিতদের সাহায্য করার জন্য যথাসাধ্য করতে দেখেছিলেন, তখন তিনি কতই-না খুশি হয়েছিলেন! বর্তমানেও, অনেক বিশ্বস্ত খ্রিস্টানরা আনন্দের সঙ্গে অন্যদের প্রতি ভালো কাজগুলো করে থাকে। কোনো কোনো সময়ে ব্যাবহারিক সাহায্য করা আর এমনকী সদয়ভাবে কথা বলা আরও ভালো ফল নিয়ে আসে। যিহোবা এই ধরনের কাজকে মূল্যবান হিসেবে দেখেন।—হিতোপদেশ ১৯:১৭; ইব্রীয় ১৩:১৬.
‘যিশুর যাতনাদণ্ডের পাশে’
৩৩ খ্রিস্টাব্দে, জেরুসালেমে নিস্তারপর্বের সময় যিশুর সঙ্গে থাকা মহিলাদের মধ্যে মগ্দলীনী মরিয়মও ছিলেন। (মথি ২৭:৫৫, ৫৬) তিনি যখন শোনেন যিশুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং সেই রাতেই তাঁর বিচার হবে, তখন তিনি নিশ্চয়ই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। আর এর পরের খবরগুলো আরও খারাপ ছিল। রাজ্যপাল পন্তীয় পীলাত, যিহুদি ধর্মীয় নেতা এবং জনতার চাপে পড়ে, যিশুকে নির্মম মৃত্যু দণ্ডের আদেশ দেন। মরিয়ম হয়তো তাঁর প্রভুকে রক্তাক্ত ও ক্লান্ত অবস্থায় রাস্তা দিয়ে তাঁর যাতনাদণ্ড টানতে টানতে নিয়ে যেতে দেখেন।—যোহন ১৯:৬, ১২, ১৫-১৭.
দুপুরবেলায়, যিশুকে যাতনাদন্ডে দেওয়ার পর চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসে, সেই সময় মগ্দলীনী মরিয়ম ও অন্য মহিলারা ‘যিশুর যাতনাদণ্ডের পাশে’ দাঁড়িয়েছিলেন। (যোহন ১৯:২৫) মরিয়ম শেষ পর্যন্ত সেখানে ছিলেন আর যিশু যখন তাঁর প্রিয় প্রেরিত যোহনকে তাঁর মায়ের যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব দিচ্ছিলেন, তখন তিনি তা লক্ষ করেন। যিশু যখন তাঁর পিতার কাছে উচ্চস্বরে কাঁদছিলেন, তখন মরিয়ম তা শোনেন। এরপর, যিশু মারা যাওয়ার ঠিক আগে, মরিয়ম তাঁর বলা জয়লাভের শেষ কথাটা শোনেন, “পূর্ণ হল!” মরিয়ম অনেক কষ্ট পান। তবুও, যিশু মারা যাওয়ার পরে তিনি সেখানে ছিলেন। এরপর, মরিয়ম সেই নতুন কবরের কাছে বেশ কিছুক্ষণ থাকেন, যেখানে যোষেফ নামে অরিমাথিয়ার একজন ধনী ব্যক্তি, যিশুর দেহ রেখেছিলেন।—যোহন ১৯:৩০; মথি ২৭:৪৫, ৪৬, ৫৭-৬১.
মরিয়মের উদাহরণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন আমাদের সহবিশ্বাসীরা বিভিন্ন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়, তখন আমরা কীভাবে তাদের সাহায্য করতে পারি। আমরা হয়তো তাদের প্রতি ঘটা দুঃখজনক ঘটনাগুলো রোধ করতে পারি না কিংবা তাদের কষ্ট সরিয়ে দিতে পারি না। তবে, আমরা সহমর্মিতা ও সাহস দেখাতে পারি। কঠিন পরিস্থিতিতে একজন বন্ধুর পাশে থাকাটাই বড়ো সাহায্য। প্রয়োজনের সময় একজন বন্ধুর সঙ্গে থাকা বিশ্বাস দেখাতে সাহায্য করে এবং প্রচুর সান্ত্বনা নিয়ে আসে।—হিতোপদেশ ১৭:১৭.
“আমি তাঁকে নিয়ে যাব”
যিশুর দেহ কবরে রাখার পরে, মরিয়ম ও অন্য মহিলারা কিছু সুগন্ধিদ্রব্য কেনেন, যাতে পরে গিয়ে সেগুলো তাঁর দেহে মাখাতে পারেন। (মার্ক ১৬:১, ২; লূক ২৩:৫৪-৫৬) বিশ্রামবার শেষ হওয়ার পরের দিন মরিয়ম খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। কল্পনা করুন, মরিয়ম ও অন্য মহিলারা অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। যেতে যেতে তারা চিন্তা করছেন, কবরের মুখে যে-ভারী পাথরটা ঢাকা দেওয়া আছে, সেটা কীভাবে সরাবেন। (মথি ২৮:১; মার্ক ১৬:১-৩) তবুও, তারা সেখানে যান। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল, তারা যা করতে পারে তা করবেন আর বাকিটা যিহোবার উপর ছেড়ে দেবেন।
মরিয়ম হয়তো সবার আগেই কবরের সামনে পৌঁছান। সেখানে গিয়ে মরিয়ম অবাক হয়ে যান। পাথরটা সরানো ছিল আর কবরটা খালি! এরপর, তিনি যা দেখেন, তা পিতর ও যোহনকে বলার জন্য দৌড়ে যান। কল্পনা করুন, মরিয়ম দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলছেন: “প্রভুকে কবর থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আর আমরা জানি না, তাঁকে কোথায় রাখা হয়েছে”! তাই, পিতর ও যোহন দৌড়ে কবরের কাছে যান আর দেখেন কবরটা সত্যিই খালি রয়েছে। তারপর তারা বাড়ি ফিরে যান। a—যোহন ২০:১-১০.
মরিয়ম আবারও কবরের কাছে ফিরে যান এবং একাই রয়ে যান। তখনও ভোর ছিল আর মরিয়ম সেই খালি কবরের সামনে বসে কাঁদতে থাকেন। আবারও তিনি একটু ঝুঁকে কবরের ভিতরে তাকান কারণ তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না, তার প্রভু সেখানে নেই। এরপর, তিনি হতবাক হয়ে যান। সেখানে সাদা কাপড় পরা দু-জন স্বর্গদূত বসে আছেন! তারা জিজ্ঞেস করেন, “কাঁদছ কেন?” আশ্চর্য হয়ে মরিয়ম তাদের সেই একই কথা বলেন, যা তিনি প্রেরিতদের বলেছিলেন: “কেউ আমার প্রভুকে নিয়ে গিয়েছে আর আমি জানি না, তারা আমার প্রভুকে কোথায় রেখেছে।”—যোহন ২০:১১-১৩.
মরিয়ম পিছন ঘুরে দেখেন একজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তাঁকে চিনতে পারলেন না। মরিয়ম ভাবলেন, তিনি বাগানের মালী। সেই ব্যক্তি সদয়ভাবে তাকে জিজ্ঞেস করেন: “হে নারী, কাঁদছ কেন? তুমি কাকে খুঁজছ?” মরিয়ম উত্তর দেন, “আপনি যদি তাঁকে নিয়ে গিয়ে থাকেন, তা হলে বলুন, তাঁকে কোথায় রেখেছেন, আমি তাঁকে নিয়ে যাব।” (যোহন ২০:১৪, ১৫) চিন্তা করুন, তিনি কী বললেন। এই একাকী মহিলার পক্ষে কি যিশুর দেহকে বহন করা সম্ভব হত, যিনি একজন শক্তিশালী ও সবল ব্যক্তি ছিলেন? মরিয়ম এই বিষয়গুলো নিয়ে বেশি চিন্তা করেননি। তিনি যা করতে পারেন, শুধু সেই নিয়েই চিন্তা করছিলেন।
আমরা যখন দুঃখকষ্ট এবং এমন পরীক্ষাগুলোর মুখোমুখি হই, যেগুলো সহ্য করা আমাদের জন্য কঠিন বলে মনে হয়, তখন কি মগ্দলীনী মরিয়মকে অনুকরণ করতে পারি? আমরা যদি শুধুমাত্র আমাদের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাগুলোর উপর মনোযোগ দিই, তা হলে আমরা ভয় ও অনিশ্চয়তার দ্বারা জর্জরিত হয়ে যেতে পারি। কিন্তু, আমরা যদি আমাদের যথাসাধ্য করি এবং আমাদের ঈশ্বরের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করি, তা হলে আমরা যা করার কথা ভাবছি, তার চেয়েও আরও বেশি করতে পারব। (২ করিন্থীয় ১২:১০; ফিলিপীয় ৪:১৩) আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমরা যিহোবাকে খুশি করতে পারব। মরিয়ম নিশ্চয়ই তা করেছিলেন আর যিহোবা তাকে এমন এক উপায়ে পুরস্কৃত করেছিলেন, যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
“আমি প্রভুকে দেখেছি!”
যে-ব্যক্তি মরিয়মের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি বাগানের মালী নন। একসময় তিনি একজন ছুতোর মিস্ত্রি ছিলেন, পরে শিক্ষক হলেন আর এখন মরিয়মের প্রিয় প্রভু। কিন্তু, মরিয়ম তাঁকে চিনতে পারেননি আর তিনি সেখান থেকে চলে যাচ্ছিলেন। মরিয়ম এই বিষয়টা কল্পনা করতে পারেননি যে, যিশু একজন শক্তিশালী আত্মিক ব্যক্তি হিসেবে পুনরুত্থিত হয়েছেন। যিশু মরিয়মের সামনে মানবরূপে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তা তাঁর আগের শরীরের মতো ছিল না। তাঁর পুনরুত্থানের পরের দিনগুলো রোমাঞ্চকর ছিল, তিনি সেই ব্যক্তিদের দেখা দেন, যারা তাঁকে ভালোভাবে জানতেন।—লূক ২৪:১৩-১৬; যোহন ২১:৪.
কীভাবে যিশু মরিয়মকে বলবেন যে, তিনি কে? তিনি যেভাবে তাকে ডাকতেন, সেভাবে ডেকে উঠলেন: “মরিয়ম!” এখন মরিয়মের আর কোনো সন্দেহ রইল না, তিনিও ঘুরে দাঁড়িয়ে একইভাবে ইব্রীয় ভাষায় ডেকে উঠলেন, “রব্বুনি!” তিনি ছিলেন তার প্রিয় শিক্ষক! মরিয়ম আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর হাত ধরেন, তাঁকে ছাড়তে চান না।—যোহন ২০:১৬.
যিশু তার মনের কথা বুঝতে পারেন। তিনি বলেন, “আমাকে আঁকড়ে ধরে রেখো না।” আমরা হয়তো তাঁর বলা সদয় কথাগুলো কল্পনা করতে পারি। তিনি উষ্ণ হাসি হেসে আলতো করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে আশ্বস্ত করে বলেন: “আমি এখনও পিতার কাছে যাইনি।” এখনও তাঁর স্বর্গে ফিরে যাওয়ার সময় হয়নি। পৃথিবীতে তাঁর এখনও কিছু কাজ করা বাকি রয়েছে এবং তিনি মরিয়মকে সাহায্য করতে চান। যিশুর প্রত্যেকটা কথা মরিয়ম মন দিয়ে শুনছিলেন। যিশু তাকে বলেন, “আমার ভাইদের গিয়ে বলো, ‘যিনি আমার পিতা এবং তোমাদের পিতা এবং যিনি আমার ঈশ্বর এবং তোমাদের ঈশ্বর, তাঁর কাছে আমি যাচ্ছি।’”—যোহন ২০:১৭.
তার প্রভুর কাছ থেকে কতই-না দারুণ এক কার্যভার! মরিয়মই হলেন সেই প্রথম শিষ্যা, যিনি পুনরুত্থিত যিশুকে দেখার সুযোগ পান আর এখন তার কাছে বিশেষ সুযোগ হয়েছে, এই সুখবর অন্যদের জানানো। কল্পনা করুন, সেই সময় মরিয়ম খুবই আনন্দিত ও উৎসুক হয়ে শিষ্যদের খুঁজছেন। আর শিষ্যদের দেখতে পেয়ে মরিয়ম এক নিঃশ্বাসে যে-কথাগুলো বলছিলেন, সেগুলো মরিয়ম ও শিষ্যদের কানে অনেক সময় ধরে বাজছিল: “আমি প্রভুকে দেখেছি!” যিশু যা যা বলেছিলেন, তিনি তাদের তা-ই বললেন এবং তিনি এতটা উত্তেজিত ছিলেন যে, খুব তাড়াহুড়ো করে কথাগুলো বললেন। (যোহন ২০:১৮) যিশুর খালি কবরে যাওয়া অন্য মহিলাদের কাছ থেকে শিষ্যেরা যে-কথাগুলো শুনেছিলেন, তার সঙ্গে মরিয়ম আরও কিছু বিষয় যুক্ত করেন।—লূক ২৪:১-৩, ১০.
“তারা সেই মহিলাদের কথা বিশ্বাস করলেন না”
তারা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখান? প্রথমে তারা বিশ্বাস করতে চাইলেন না। আমরা পড়ি: “প্রেরিতদের এবং অন্য শিষ্যদের কাছে এই কথাগুলো গল্প বলে মনে হল। আর তারা সেই মহিলাদের কথা বিশ্বাস করলেন না।” (লূক ২৪:১১) এই ব্যক্তিদের মনোভাব ভালো ছিল, কিন্তু তারা এমন এক সমাজে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন, যেখানে মহিলাদের বিশ্বাস করা হত না। রব্বিদের তৈরি পরম্পরাগত রীতি অনুযায়ী, একজন মহিলা আদালতে সাক্ষ্য দিতে পারত না। সম্ভবত, প্রেরিতরা তাদের সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু, যিশু ও তাঁর পিতা বৈষম্যের মনোভাব দেখান না। তাঁরা সেই বিশ্বস্ত মহিলাকে কতই-না বিশেষ এক সুযোগ দিয়েছিলেন!
মরিয়ম নিশ্চয়ই সেই ব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়া দেখে দুঃখিত হননি। তিনি জানেন, তার প্রভু তাকে বিশ্বাস করেন আর এটাই তার জন্য যথেষ্ট। একইভাবে, যারা যিশুকে অনুসরণ করে তাদের সবাইকে একটা বার্তা জানানোর জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাইবেল এই বার্তাকে বলে, “ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার।” (লূক ৮:১) যিশু তাঁর অনুসারীদের এমন প্রতিজ্ঞা করেননি যে, সবাই তাদের কথা বিশ্বাস করবে কিংবা তাদের কাজের প্রশংসা করবে। বরং, এর বিপরীতটাই বলেছেন। (যোহন ১৫:২০, ২১) তাই, খ্রিস্টানরা মগ্দলীনী মরিয়মকে স্মরণে রাখতে পারে। যদিও কয়েক জন শিষ্য সেই সময় মরিয়মের কথায় বিশ্বাস করেননি, কিন্তু তারপরও মরিয়ম যিশুর পুনরুত্থানের সুখবরটা জানানোর ক্ষেত্রে তার আনন্দকে হারিয়ে যেতে দেননি!
যিশু একে একে সবাইকে দেখা দেন, তাঁর প্রেরিতদের এবং তারপর তাঁর অনেক অনুসারীকে দেখা দেন। আর একবার ৫০০ জনেরও বেশি লোককে একসঙ্গে দেখা দেন! (১ করিন্থীয় ১৫:৩-৮) এই বিষয়গুলো মরিয়ম যতবেশি দেখেন ও শোনেন তার বিশ্বাস ততই বৃদ্ধি পায়। পঞ্চাশত্তমীর দিনে জেরূশালেমে যে-সভা হয়, যেখানে যিশুর অনুসারীদের উপর পবিত্র শক্তি বর্ষণ করা হয়, তাদের মধ্যে সম্ভবত মরিয়মও ছিলেন।—প্রেরিত ১:১৪, ১৫; ২:১-৪.
যাই হোক না কেন, একটি বিষয়ে আমাদের আস্থা রাখার যথেষ্ট কারণ রয়েছে: মগ্দলীনী মরিয়ম শেষ পর্যন্ত তার বিশ্বাস বজায় রেখেছিলেন। আমাদের সবারই কি একই বিষয় করা উচিত নয়! যিশু আমাদের জন্য যা-কিছু করেছেন, সেগুলোর প্রতি যদি আমরা কৃতজ্ঞতা দেখাই এবং ঈশ্বরের সাহায্যের উপর নির্ভর করে নম্রভাবে অন্যদের সেবা করি, তা হলে আমরা মগ্দলীনী মরিয়মের বিশ্বাস অনুকরণ করব।
a মরিয়ম কবরের কাছ থেকে চলে যাওয়ার পরেই, সেখানে থাকা অন্য মহিলাদের কাছে একজন স্বর্গদূত এসে বলেন যে, যিশু পুনরুত্থিত হয়েছেন। না হলে, মরিয়ম নিশ্চয়ই পিতর ও যোহনকে এটা বলতেন যে, একজন স্বর্গদূত এসে তাদের বলেছেন যে, কেন যিশুর দেহ সেখানে নেই।—মথি ২৮:২-৪; মার্ক ১৬:১-৮.