পবিত্র শক্তি কী?
বাইবেলের উত্তর
মূল ভাষায় পবিত্র শক্তি বলতে ঈশ্বরের সক্রিয় শক্তিকে বোঝায়। যদিও, বেশিরভাগ বাইবেলে ঈশ্বরের সক্রিয় শক্তিকে পবিত্র আত্মা হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে, কিন্তু মূল ভাষার অর্থের সঙ্গে তুলনা করলে পবিত্র শক্তি অনুবাদটা আরও সঠিক এবং সহজে বোঝা যায়। (মীখা ৩:৮; লূক ১:৩৫) ঈশ্বর তাঁর উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য তাঁর পবিত্র শক্তি কাজে লাগান। আর এভাবে তিনি আসলে নিজেরই শক্তি ব্যয় করেন।—প্রেরিত ১০:৩৮, ৪৫.
নতুন জগৎ অনুবাদ বাইবেলে যে-শব্দটাকে “শক্তি” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে, সেটার ইব্রীয় শব্দ হল রুয়াখ্ এবং গ্রিক শব্দ হল নিউমা। বেশিরভাগ সময়ই এই শব্দগুলো ঈশ্বরের সক্রিয় শক্তি বা পবিত্র শক্তিকে বোঝায়। (আদিপুস্তক ১:২) তবে, কখনো কখনো বাইবেলে এই শব্দগুলোকে অন্য অর্থেও ব্যবহার করা হয়েছে, যেমন:
শ্বাসবায়ু বা নিশ্বাস।—হবক্কূক ২:১৯; প্রকাশিত বাক্য ১৩:১৫, পাদটীকা।
বাতাস।—আদিপুস্তক ৮:১; যোহন ৩:৮.
প্রাণ।—আদিপুস্তক ৬:১৭.
প্রবৃত্তি বা স্বভাব।—যাত্রাপুস্তক ৩৫:২১.
সমস্ত অদৃশ্য ব্যক্তি, যাদের মধ্যে ঈশ্বর ও স্বর্গদূতেরা রয়েছেন।—যোহন ৪:২৪.
এগুলোর মধ্যে কোনোটাই মানুষ দেখতে পারে না, তবে এদের অস্তিত্ব বা কাজ বুঝতে পারে। একইভাবে, ঈশ্বরের শক্তি ‘বাতাসের মতোই অদৃশ্য ও শক্তিশালী।’—ডব্লু. ই. ভাইনের অ্যান এক্সপোজিটরি ডিকশনারি অভ্ নিউ টেস্টামেন্ট ওয়ার্ডস্।
এ ছাড়া, বাইবেলে ঈশ্বরের পবিত্র শক্তিকে তাঁর ‘হস্ত’ বা ‘অঙ্গুলি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (গীতসংহিতা ৮:৩; ১৯:১; লূক ১১:২০, পাদটীকা; তুলনা করুন মথি ১২:২৮.) একজন কারিগর যেমন বিভিন্ন কাজ করার জন্য তার হাত ও আঙুল ব্যবহার করেন, তেমনই ঈশ্বর বিভিন্ন কাজ করার জন্য তাঁর পবিত্র শক্তি ব্যবহার করেন। আর এই শক্তি ব্যবহার করে কী কী সম্ভব হয়েছে, তা লক্ষ করুন:
নিখিলবিশ্বের সৃষ্টি।—গীতসংহিতা ১০৪:৩০; যিশাইয় ৬৬:১, ২.
বাইবেল লেখা।—২ পিতর ১:২০, ২১.
অতীতে তাঁর দাসদের করা বিভিন্ন অলৌকিক কাজ এবং উদ্যোগের সঙ্গে করা তাদের প্রচার কাজ।—লূক ৪:১৮; প্রেরিত ১:৮; ১ করিন্থীয় ১২:৪-১১.
তাঁর বাধ্য লোকদের দেখানো উত্তম গুণাবলি।—গালাতীয় ৫:২২, ২৩.
পবিত্র শক্তি কোনো ব্যক্তি নয়
বাইবেলে ঈশ্বরের পবিত্র শক্তিকে তাঁর ‘হস্ত,’ ‘অঙ্গুলি,’ ‘নিশ্বাস’ বা “বায়ু” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা দেখায় যে, পবিত্র শক্তি কোনো ব্যক্তি নয়। (যাত্রাপুস্তক ১৫:৮, ১০) একজন কারিগরের হাত ও আঙুল যেমন তার শরীর থেকে আলাদা হয়ে বা তার মস্তিষ্ক ছাড়া কাজ করতে পারে না, তেমনই ঈশ্বরের পরিচালনা ছাড়া পবিত্র শক্তি কাজ করতে পারে না। (লূক ১১:১৩) এ ছাড়া, বাইবেলে ঈশ্বরের পবিত্র শক্তিকে জলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে আর কখনো কখনো এই শক্তিকে বিশ্বাস ও জ্ঞানের সঙ্গেও উল্লেখ করা হয়েছে। (যিশাইয় ৪৪:৩; প্রেরিত ৬:৫; ২ করিন্থীয় ৬:৬) এই তুলনাগুলো থেকে বোঝা যায়, পবিত্র শক্তি কোনো ব্যক্তি নয়।
আরেকটা উদাহরণ লক্ষ করুন। বাইবেল বলে, ঈশ্বরের নাম হল যিহোবা এবং তাঁর পুত্রের নাম হল যিশু খ্রিস্ট। কিন্তু, বাইবেলে কোথাও পবিত্র শক্তির কোনো নাম পাওয়া যায় না। (যাত্রাপুস্তক ৩:১৫; লূক ১:৩১) এ ছাড়া, খ্রিস্টের একজন শিষ্য স্তিফান মারা যাওয়ার আগে কী ঘটেছিল, তা লক্ষ করুন। তাকে অলৌকিকভাবে স্বর্গের একটা দর্শন দেখানো হয়েছিল। বাইবেল বলে: “স্তিফান পবিত্র শক্তিতে পূর্ণ হয়ে স্বর্গের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন এবং ঈশ্বরের মহিমা আর সেইসঙ্গে ঈশ্বরের ডান দিকে যিশুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন।” (প্রেরিত ৭:৫৫) এই দর্শনে তিনি শুধুমাত্র দু-জন ব্যক্তিকে দেখেছিলেন, তিন জনকে নয়। এই শাস্ত্রপদও ইঙ্গিত দেয় যে, পবিত্র শক্তি কোনো ব্যক্তি নয়, বরং ঈশ্বরের সক্রিয় শক্তি। এই শক্তি স্তিফানের উপর কাজ করছিল এবং এইজন্যই তিনি এই দর্শনটা দেখতে পেয়েছিলেন।
পবিত্র শক্তি সম্বন্ধে কিছু ভুল ধারণা
ভুল ধারণা: মথি ২৮:১৯, ২০ পদ অনুযায়ী “পবিত্র শক্তি” অথবা “পবিত্র আত্মা” হল একজন ব্যক্তি এবং ত্রিত্বের অংশ।
সঠিক তথ্য: এই শাস্ত্রপদে পিতা, পুত্র ও পবিত্র শক্তির বিষয়ে একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ কেউ দাবি করে, এই পদগুলো ত্রিত্বকে নির্দেশ করে। তবে, পদগুলো আরেক বার পড়ে দেখুন। এই পদগুলোতে কি এমন কিছু বলা হয়েছে, যেটা ইঙ্গিত দেয়, পিতা, পুত্র ও পবিত্র শক্তি এক ঈশ্বর আর “পবিত্র শক্তি” ক্ষমতায়, অবস্থানে ও প্রজ্ঞায় পিতা বা পুত্রের সমান? না, এখানে এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। অন্যান্য শাস্ত্রপদের বিষয়েও একই কথা বলা যায়, যেখানে পিতা, পুত্র ও পবিত্র শক্তির বিষয়ে একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভুল ধারণা: বাইবেলে পবিত্র শক্তিকে একজন ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে আর তাই পবিত্র শক্তি হল একজন ব্যক্তি।
সঠিক তথ্য: এটা ঠিক যে, বাইবেলে কখনো কখনো পবিত্র শক্তিকে একজন ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, যিশু এক বার পবিত্র শক্তিকে “সাহায্যকারী” (গ্রিক শব্দ পারাক্লিট) হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, এই সাহায্যকারী প্রমাণ দেবে, পথ দেখাবে, কথা বলবে, শুনবে, ঘোষণা করবে এবং মহিমান্বিত করবে। (যোহন ১৬:৭-১৫) কিন্তু তার মানে এই নয় যে, পবিত্র শক্তি আসলেই একজন ব্যক্তি। এর জন্য কিছু উদাহরণ লক্ষ করুন। বাইবেলে প্রজ্ঞা, মৃত্যু ও পাপকেও ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, যদিও এগুলো আসলে কোনো ব্যক্তি নয়। (হিতোপদেশ ১:২০; রোমীয় ৫:১৭, ২১) যেমন, বাইবেলে প্রজ্ঞার বিষয়ে বলা হয়েছে যে, এর ‘কাজ’ ও ‘সন্তান‘ রয়েছে আর পাপ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটা লোভ জাগিয়ে তোলে, প্রতারণা করে, এবং হত্যা করে।—মথি ১১:১৯; লূক ৭:৩৫, ফুটনোট; রোমীয় ৭:৮, ১১.
ভুল ধারণা: পবিত্র শক্তি হল একজন ব্যক্তি কারণ বাইবেলে পবিত্র শক্তির নামে বাপ্তিস্ম দিতে বলা হয়েছে।
সঠিক তথ্য: বাইবেলে কখনো কখনো “নাম” শব্দটা ব্যবহার করার মাধ্যমে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বোঝানো হয়েছে। (দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:৫, ১৯-২২; ইষ্টের ৮:১০, NW) বাংলাতেও নাম শব্দটার একইরকম ব্যবহার প্রচলিত রয়েছে। যেমন, “ধর্মের নামে ...,” এই অভিব্যক্তিটা আমরা অনেকেই ব্যবহার করে থাকি, যদিও এর মানে এই নয় যে, ধর্ম একজন ব্যক্তি। তাই, একজন ব্যক্তি যখন পবিত্র শক্তির “নামে” বাপ্তিস্ম নেন, তখন সেটার অর্থ হল, তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছা সম্পাদন করার ক্ষেত্রে এটার ক্ষমতা ও ভূমিকাকে স্বীকার করেন।—মথি ২৮:১৯.
ভুল ধারণা: যিশুর প্রেরিতেরা এবং সেই সময়ের অন্যান্য শিষ্যেরা বিশ্বাস করত যে, পবিত্র শক্তি হল একজন ব্যক্তি।
সঠিক তথ্য: এই কথা না বাইবেলের কোথাও লেখা আছে, না ইতিহাসের কোনো বইয়ে লেখা আছে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলে: “পবিত্র শক্তি যে আলাদা একজন ব্যক্তি এবং এই শক্তির উপাসনা করতে হবে, এই বিষয়টা ... ৩৮১ খ্রিস্টাব্দে কন্সট্যান্টিনোপলের পরিষদে প্রথম বার উত্থাপন করা হয়েছিল।” এটা যিশুর ১২ জন প্রেরিতের মধ্যে একেবারে শেষ প্রেরিতের মৃত্যুর ২৫০ বছরেরও বেশি সময় পরের ঘটনা।