সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

জীবনকাহিনি

যিহোবার সেবায় এক নতুন মোড় আসে আর আমি অনেক কিছু শিখি

যিহোবার সেবায় এক নতুন মোড় আসে আর আমি অনেক কিছু শিখি

ছোটোবেলায় আমি যখন দেখতাম, আকাশে প্লেন যাচ্ছে, তখন আমার ইচ্ছে হত, আমিও একদিন প্লেনে করে অন্য দেশে যাব। তারপর মনে হত, এমনটা তো কখনোই হবে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমার বাবা-মা এস্টোনিয়া ছেড়ে জার্মানিতে চলে যান এবং সেখানে আমার জন্ম হয়। আমার জন্মের সময়ে বাবা-মা জার্মানি ছেড়ে কানাডায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিছুসময় পর, আমরা কানাডায় চলে যাই এবং সেখানে অটোয়া শহরের পাশে থাকতে শুরু করি। আমরা যেখানে থাকতে শুরু করি, সেই জায়গাটা খুবই ছোটো ছিল এবং সেখানে অনেক মুরগি রাখা হত। আমরা খুবই গরিব ছিলাম। কিন্তু, খাওয়ার জন্য আমরা অন্ততপক্ষে কিছু ডিম পেয়ে যেতাম!

একদিন, যিহোবার সাক্ষিরা আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করে এবং তারা তাকে প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪ পদ পড়ে শোনায়। সেই কথাগুলো আমার মায়ের হৃদয় ছুঁয়ে যায় এবং তার চোখে জল চলে আসে। আমার বাবা-মা বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করেন এবং কিছুসময় পর তারা বাপ্তিস্ম নেন।

বাবা-মা ইংরেজি ভাষা খুব-একটা জানতেন না। তবে, তারা উদ্যোগের সঙ্গে যিহোবার সেবা করতেন। বাবা অন্টারিওর সাডবেরি শহরে ধাতু গলানোর একটা কারখানায় কাজ করতেন। তা সত্ত্বেও, প্রতি শনিবার তিনি আমাকে এবং আমার ছোটো বোন সিলভিয়াকে প্রচারে নিয়ে যেতেন। আর প্রতি সপ্তাহে আমরা পরিবারগতভাবে প্রহরীদুর্গ অধ্যয়ন করতাম। বাবা-মা আমাকে যিহোবা সম্বন্ধে শেখানোর জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন, তাই আমিও যিহোবাকে ভালোবাসতে শুরু করি। ১৯৫৬ সালে আমার বয়স যখন ১০ বছর ছিল, তখন আমি আমার জীবন যিহোবার কাছে উৎসর্গ করি। যখনই আমি এই বিষয়ে চিন্তা করি, আমার বাবা-মা যিহোবাকে কত ভালোবাসেন, তখন আমিও যিহোবাকে সেবা করে চলার জন্য উৎসাহিত হই।

স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার পর, আমার মধ্যে যিহোবাকে সেবা করার ইচ্ছা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। আমি চিন্তা করতে শুরু করি, আমি যদি একজন অগ্রগামী হয়ে যাই, তা হলে আমি বেশি টাকাপয়সা রোজকার করতে পারব না আর প্লেনে করে পুরো পৃথিবী ঘোরার আমার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। আমাদের পাশে একটা রেডিও স্টেশন ছিল আর সেখানে আমি গান চালানোর কাজ পাই। আমি আমার কাজকে খুব ভালোবাসতাম। কিন্তু, আমাকে সন্ধ্যে বেলায় এই কাজ করতে হত। তাই, আমি সভাগুলোতে যোগ দিতে পারতাম না। আর এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল, যারা যিহোবাকে ভালোবাসত না। তবে, কিছুসময় পর আমার বিবেক আমাকে দংশন করতে শুরু করে। আমি বাইবেল থেকে যা শিখেছিলাম, সেই অনুযায়ী আমাকে কিছু পরিবর্তন করতে হবে।

আমি অন্টারিওর ওসাবা শহরে গিয়ে থাকতে শুরু করি। সেখানে ভাই রে নরম্যান আর লেসলির সঙ্গে এবং আরও অন্যান্য অগ্রগামীর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তারা সবাই হৃদয় থেকে আমাকে স্বাগত জানিয়েছিল এবং আমরা ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। তারা সবসময় আনন্দে থাকত, তাই আমি চিন্তা করতে শুরু করি, আমি জীবনে কী করতে চাই এবং আমি কোন কোন লক্ষ্য রাখতে পারি। তারা আমাকে অগ্রগামীর সেবা করার জন্য উৎসাহিত করে। আর আমি ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অগ্রগামীর সেবা করতে শুরু করি। আমি খুশি ছিলাম কারণ আমার জীবনে সব কিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু আমি জানতাম না, আমার জীবনে একটা নতুন মোড় আসবে।

যিহোবা যখন কিছু করতে বলেন, তখন সেটা করে দেখুন

আমি যখন স্কুলে পড়াশোনা করছিলাম, তখনই আমি কানাডার বেথেলে সেবা করার জন্য আবেদনপত্র পূরণ করেছিলাম। পরে, আমি যখন অগ্রগামী হিসেবে সেবা করছিলাম, তখন আমাকে চার বছরের জন্য বেথেলে সেবা করার জন্য ডাকা হয়। কিন্তু, আমি লেসলিকে খুব পছন্দ করতাম। আর আমার ভয় ছিল, বেথেলে চলে যাওয়ার পর তার সঙ্গে আমার হয়তো আর দেখা হবে না। তাই, আমি যিহোবার কাছে অনেক প্রার্থনা করি। শেষে আমি বেথেলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই আর মনে কষ্ট নিয়ে লেসলিকে বিদায় জানাই।

প্রথম প্রথম আমি বেথেলের লন্ড্রি বিভাগে কাজ করতে শুরু করি, যেখানে কাপড় ধোয়া হত। পরে, আমি একজন সেক্রেটারি (সচিব) হিসেবেও কাজ করি। একইসময়ে লেসলিকে কিউবেকের গ্যাটিনিউতে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে পাঠানো হয়। আমার প্রায়ই ওর কথা মনে পড়ত, ও কেমন আছে, কী করছে আর আমি বেথেলে এসে ঠিক করেছি কি না। তারপর এমন কিছু হয়, যেটা আমি আশাই করিনি। লেসলির ভাই রে নরম্যানকে বেথেলে ডাকা হয়। আর সে আমার রুমমেট হয়। এর ফলে, লেসলির সঙ্গে আমার আবারও কথা হতে শুরু হয়। আর আমার বেথেলে সেবা করার শেষ দিনে, ১৯৭১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আমরা বিয়ে করি।

১৯৭৫ সালে আমরা যখন সীমার কাজ শুরু করি

লেসলি এবং আমাকে কিউবিক শহরে একটা ফ্রেঞ্চ ভাষার মণ্ডলীতে সেবা করার জন্য পাঠানো হয়। আর কয়েক বছর পর আমাকে একজন সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করার জন্য নিযুক্ত করা হয়, যখন আমার বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর। এটা জানতে পেরে আমি খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম কারণ আমার মনে হয়েছিল, এই দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে আমি খুবই ছোটো আর আমার খুব-একটা দক্ষতাও নেই। তবে, যিরমিয় ১:৭, ৮ পদ পড়ে আমি খুব উৎসাহিত হই। দুঃখের বিষয় হল, কয়েক বার গাড়ি দুর্ঘটনা হওয়ার ফলে লেসলির চোট লেগেছিল এবং ও ঠিক করে ঘুমাতে পারত না। তাই, আমরা চিন্তা করছিলাম, আমরা সীমার কাজ করতে পারব কি না। এত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও লেসলি বলে, “যিহোবা যখন আমাদের কিছু করতে বলছেন, তখন আমাদের কি সেটা করে দেখা উচিত নয়?” আমরা সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করি এবং আনন্দের সঙ্গে ১৭ বছর ধরে সীমার কাজ করে যাই।

আমি সীমার কাজে খুবই ব্যস্ত থাকতাম, তাই লেসলির সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারতাম না। এই বিষয়ের উপর আমাকে কাজ করতে হত। একদিন সোমবার সকাল সকাল আমাদের কলিং বেল বেজে ওঠে। আমি বাইরে গিয়ে দেখি, কেউ নেই শুধু একটা ঝুড়ি রাখা আছে। সেই ঝুড়িতে একটা মাদুর, কিছু ফল, ব্রেড, চিজ এবং ওয়াইনের বোতল ছিল। তাতে একটা কাগজও ছিল, যেখানে লেখা ছিল, “তোমার স্ত্রীকে আজ কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাও।” সেই দিনটা বাইরে কোথাও যাওয়ার জন্য একেবারে উপযুক্ত ছিল। রোদ ঝলমল করছিল এবং আবহাওয়াটাও খুব ভালো ছিল। কিন্তু আমি লেসলিকে বলি, আজ আমার অনেক কাজ আছে, অনেক বক্তৃতা প্রস্তুত করতে হবে। তাই, আজ হবে না। এটা শুনে ওর মন খারাপ হয়ে যায়, তবে ও বিষয়টা মেনে নেয়। আমি যখন কাজ করতে বসি, তখন আমার মনে হয়, আমি এটা ঠিক করিনি। আমার ইফিষীয় ৫:২৫, ২৮ পদে লেখা কথাগুলো মনে পড়ে যায়। আমি চিন্তা করি, এই পদ অনুযায়ী যিহোবা আমার কাছ থেকে কী চাইছেন? আমি কি আমার স্ত্রীর অনুভূতির বিষয়টা খেয়াল রাখছি? আমি এই বিষয়ে প্রার্থনা করি আর লেসলিকে বলি, “চলো একটু ঘুরে আসি!” এটা শুনে ও খুব খুশি হয়ে যায়। আমরা একটা নদীর ধারে যাই এবং সেখানে একসঙ্গে সময় কাটাই। সেই দিনটা আমরা কখনো ভুলতে পারব না। আর হ্যাঁ, পরে আমি আমার বক্তৃতাগুলোও প্রস্তুত করতে পারি।

আমরা ব্রিটিশ কলম্বিয়া ও নিউফাউন্ড ল্যান্ডের মধ্যে বিভিন্ন শহরে সেবা করার সুযোগ পাই। সীমার কাজ করে আমরা অনেক আনন্দ পাচ্ছিলাম। আমি বুঝতে পারি, ছোটোবেলায় আমার বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার যে-স্বপ্ন ছিল, আজ তা পূরণ হচ্ছে। আমি গিলিয়েড স্কুলে যাওয়ার বিষয়ে চিন্তা তো করি, কিন্তু অন্য কোনো দেশে গিয়ে সেবা করার আমার ইচ্ছা ছিল না। আমি এও চিন্তা করতাম, মিশনারির কাজ শুধু বিশেষ লোকেরাই করতে পারে এবং আমি এটার যোগ্য নই। আর আমার ভয় ছিল, আমাকে আফ্রিকার এমন কোনো দেশে পাঠানো হবে না তো, যেখানে বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে রয়েছে এবং যেখানে যুদ্ধ চলছে? আমি কানাডাতেই খুশি ছিলাম।

এস্টোনিয়া এবং আশেপাশের দেশগুলোতে যাওয়ার আমন্ত্রণ

এস্টোনিয়া এবং এর আশেপাশের দেশগুলোতে ভ্রমণ করার সময়ে

১৯৯২ সালে যিহোবার সাক্ষিরা আবারও সেই সমস্ত দেশে খোলাখুলিভাবে প্রচার করতে শুরু করে, সেগুলো আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। ভাইয়েরা আমাদের জিজ্ঞেস করে, আমরা এস্টোনিয়ায় গিয়ে মিশনারি সেবা করতে চাই কি না। এটা শুনে আমরা অনেক চিন্তিত হয়ে যাই। তবে, পরে আমরা এই বিষয়ে প্রার্থনা করি। আমরা আবারও নিজেদের মনে করাই, “যিহোবা যখন আমাদের কিছু করতে বলছেন, তখন আমাদের কি সেটা করে দেখা উচিত নয়?” আমরা মনে মনেই চিন্তা করি, ‘যাক ভালোই হয়েছে, আমাদের তো আর আফ্রিকায় পাঠানো হচ্ছে না!’ তাই, আমরা সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করি।

আমরা দেরি না করে এস্টোনিয়ান ভাষা শিখতে শুরু করে দিই। এস্টোনিয়াতে কিছু মাস থাকার পর, আমাদের সীমার কাজ করতে বলা হয়। আমাদের এস্টোনিয়া, ল্যাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া আর ক্যালিনিনগ্রাডে যেতে বলা হয়, যেটা রাশিয়ার অংশ ছিল। এই এলাকাগুলোতে থাকা ৪৬টা মণ্ডলী এবং কয়েকটা দলকে আমাদের পরিদর্শন করতে হত। এর মানে ছিল, আমাদের ল্যাটভিয়ান, লিথুয়ানিয়ান এবং রাশিয়ান ভাষাও শিখতে হত। যদিও এটা অনেক কঠিন ছিল, তবে ভাই-বোনেরা যখন দেখত যে, তাদের ভাষা শেখার জন্য আমরা কত প্রচেষ্টা করছি, তখন তারা খুব খুশি হত এবং আমাদের সাহায্যও করত। এরপর, ১৯৯৯ সালে এস্টোনিয়ায় শাখা অফিস খোলা হয় এবং আমাকে সেখানকার শাখা কমিটির একজন সদস্য হিসেবে কাজ করতে বলা হয়। শাখা কমিটিতে আমার সঙ্গে টমাস এডুর, লেমবিট রেইল এবং টমি কাউকো ছিলেন।

বাঁ-দিক: লিথুয়ানিয়ার একটা সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার সময়ে

ডান দিক: ১৯৯৯ সালে এস্টোনিয়ার শাখা কমিটি, যখন সেখানে শাখা অফিস খোলা হয়েছিল

আমাদের এমন অনেক ভাই-বোনকে জানার সুযোগ হয়, যারা জেল খেটে সাইবেরিয়ায় এসেছে। জেলে থাকার সময়ে তাদের উপর অনেক তাড়না করা হয়েছিল এবং পরিবারের কাছ থেকে তাদের অনেক দূরে রাখা হয়েছিল। এই সমস্ত কিছু হওয়া সত্ত্বেও তারা হতাশ হয়ে পড়েনি। তারা তাদের আনন্দ বজায় রাখতে পেরেছিল এবং প্রচার কাজেও উদ্যোগ বজায় রেখেছিল। তাদের কাছ থেকে আমরা শিখেছিলাম, কীভাবে সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমরা স্থির থাকতে পারি এবং আনন্দ বজায় রাখতে পারি।

আমরা আমাদের কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকতাম যে, আমরা বুঝতেই পারিনি, কীভাবে এতগুলো বছর কেটে গিয়েছে। আমরা দু-জনে বিশ্রাম নেওয়ার খুব-একটা সময় পেতাম না। কিছুসময় পর, লেসলি প্রায়ই ক্লান্ত হয়ে পড়ত। প্রথম প্রথম আমরা বুঝতে পারিনি, ও কেন এত ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। তাই, আমরা আবারও কানাডায় ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করি। কিন্তু, তখনই আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের প্যাটারসনের শাখা অফিসে একটা স্কুলে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমার মনে হচ্ছিল, আমরা সেখানে যেতে পারব না। তবে, এই বিষয়ে আমরা অনেক প্রার্থনা করি এবং সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই। আর যিহোবা আমাদের এই সিদ্ধান্তের উপর আশীর্বাদ করেছিলেন। সেখানে গিয়ে আমরা জানতে পারি, লেসলির ফাইব্রোমায়ালজিয়া রোগ রয়েছে। স্কুল চলাকালীন ওর ভালোভাবে চিকিৎসা হয়েছিল। এর ফলে, আমরা আমাদের সেবা চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম।

আবারও একটা নতুন মোড়, আবারও একটা নতুন দেশ

২০০৮ সালে এস্টোনিয়াতে থাকার সময়ে এক সন্ধ্যা বেলায় বিশ্বপ্রধান কার্যালয় থেকে একটা ফোন আসে। তারা জিজ্ঞেস করে, আমরা দু-জন কঙ্গোতে গিয়ে সেবা করতে চাই কি না। এটা শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। আমাদের কাছে চিন্তা করার জন্য বেশি সময় ছিল না। কারণ পরের দিনই এর উত্তর দিতে হত। সেই রাতে আমি লেসলিকে কিছুই বলিনি। আমি জানতাম, ও এটা শুনে ঘুমাতে পারবে না। সেই রাতে ও ঠিক ঘুমিয়ে গিয়েছিল, তবে আমি ঘুমাতে পারিনি। আফ্রিকায় যাওয়ার বিষয়ে আমার মনে যে-ভয় ছিল, সেই বিষয়ে আমি যিহোবার কাছে সারারাত ধরে প্রার্থনা করেছিলাম।

পরের দিন আমি লেসলিকে এই বিষয়ে বলি। আমরা একে অন্যকে বোঝাই: “যিহোবা আমাদের আফ্রিকায় যেতে বলছেন। সেখানে না গিয়ে কীভাবে আমরা বলতে পারি, সেখানে সেবা করে আনন্দ পাব না আর সেটা উপভোগ করব না।” এস্টোনিয়ায় ১৬ বছর ধরে সেবা করার পর, আমরা কঙ্গোর কিনশাসা শহরের উদ্দেশে রওনা দিই। সেখানকার শাখা অফিস খুব সুন্দর ছিল এবং সেখানকার পরিবেশ মনোরম ও শান্ত ছিল। আমাদের রুমে ঢুকে প্রথমেই লেসলি একটা কার্ড বের করে, যেটা কানাডা ছেড়ে আসার পর থেকে ওর কাছে ছিল। তাতে লেখা ছিল, “একটা ফুল গাছের মতো তোমাদের যেখানেই লাগানো হোক না কেন, তোমরা সেখানেই ফুটে ওঠো।” আমরা যখন সেখানকার ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা করি, সেখানে বাইবেল অধ্যয়ন করাই এবং মিশনারি হিসেবে সেবা করি, তখন আমরা এক অদ্ভুত ধরনের আনন্দ লাভ করি। কিছুসময় পর, আমরা আফ্রিকারই আরও ১৩টা শাখা অফিস পরিদর্শন করার সুযোগ পাই। এই কারণে আমরা বিভিন্ন ধরনের লোকের সঙ্গে দেখা করতে পারি এবং তাদের আলাদা আলাদা জীবনধারা ও সংস্কৃতির বিষয়ে জানতে পারি। আগে যে-বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করতাম, সেগুলো এখন আর হয় না। এখন আমরা যিহোবাকে ধন্যবাদ দিই, তিনি আমাদের আফ্রিকায় পাঠিয়েছেন।

কঙ্গোর ভাই-বোনেরা পোকামাকড় খেত এবং আমাদেরও তা খেতে বলে। প্রথমে মনে হয়েছিল, আমরা কখনো সেগুলো খেতে পারব না। কিন্তু, আমরা যখন তাদের আনন্দের সঙ্গে পোকামাকড় খেতে দেখি, তখন আমরাও চেখে দেখি। সেগুলো খেতে আমাদেরও ভালো লাগে।

পূর্ব কঙ্গোতে কিছু বিদ্রোহী দল সেখানকার গ্রামগুলোর উপর হামলা করছিল এবং মহিলা ও বাচ্চাদের মারধর করছিল। সেই সময়ে সেখানকার ভাই-বোনদের কাছে গিয়ে তাদের উৎসাহিত করার এবং তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ আমরা পাই। সেখানকার বেশিরভাগ ভাই-বোনের কাছে সংসার চালানোর জন্য বেশি কিছু ছিল না। এত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তারা যিহোবাকে খুব ভালোবাসত, প্রতিটা ক্ষেত্রে সংগঠনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চাইত আর তারা পুরোপুরি নিশ্চিত ছিল যে, তারা যদি মারাও যায়, তা হলে তাদের পুনরুত্থিত করা হবে। তাদের দেখে আমরা এটা চিন্তা করতে বাধ্য হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমরা কেন যিহোবার সেবা করছি এবং আমাদের বিশ্বাস মজবুত করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিছু ভাই-বোন তো তাদের ঘর, ফসল সব কিছু হারিয়ে ফেলেছিল। এখান থেকে আমি বুঝতে পারি, আজ আমাদের কাছে যা-কিছু আছে, সেগুলোর উপর নির্ভর করা যায় না। সেগুলো আজ আছে তো কাল নেই। কিন্তু, যিহোবার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। সেই ভাই-বোনেরা কত সমস্যা সহ্য করছিল, তা সত্ত্বেও তারা দুঃখিত অথবা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েনি। তাদের কাছ থেকে আমরা শিখেছি, আমাদের বাধাগুলো এবং নিজেদের স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলো সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করা উচিত।

বাঁ-দিক: একটা শরণার্থী দলের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার সময়ে

ডান দিক: কঙ্গোর দুঙ্গু শহরে লোকদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী এবং ওষুধপত্র নিয়ে যাওয়ার সময়ে

চলুন, এবার এশিয়ায় যাই

আমাদের জীবনে একটা মোড় আসে। আমাদের হংকং শাখা অফিসে যাওয়ার জন্য বলা হয়। কখনো চিন্তা করিনি, আমরা এশিয়ায় গিয়ে থাকব। আমরা জানতাম না, সেখানে আমাদের কী হবে। কিন্তু, এত বছর ধরে স্পষ্টভাবে দেখতে পেরেছিলাম, কীভাবে যিহোবা প্রতিটা পদক্ষেপে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন এবং যত্ন নিয়েছিলেন। তাই, সেখানে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে যাই। ২০১৩ সালে আফ্রিকায় আমাদের বন্ধুদের এবং সেখানকার সুন্দর দৃশ্যগুলো ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও, আমরা দুঃখের সঙ্গে তাদের বিদায় জানাই।

হংকং অনেক জনবহুল শহর ছিল এবং সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকেরা এসে থাকে। সেখানকার বেশিরভাগ লোকেরা চাইনিজ (ক্যানটোনিজ) ভাষায় কথা বলত আর এই ভাষা শেখা আমাদের জন্য অনেক কঠিন ছিল। সব কিছু আমাদের জন্য একেবারে নতুন ছিল। কিন্তু, সেখানকার ভাই-বোনেরা আমাদের অনেক ভালোভাবে স্বাগত জানিয়েছিল আর সেখানকার খাবারও আমাদের খুব ভালো লেগেছিল। সেখানকার শাখা অফিসে অনেক দ্রুত গতিতে কাজ এগোচ্ছিল এবং আমাদের আরও জায়গার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু, হংকংয়ে জমির দাম আকাশছোঁয়া ছিল। তাই, পরিচালকগোষ্ঠী সিদ্ধান্ত নেয়, সেখানকার কিছু কাজ অন্য কোনো জায়গায় করা হবে এবং শাখা অফিসের বেশিরভাগ বিল্ডিংগুলো বিক্রি করা হবে। কিছুসময় পর, ২০১৫ সালে আমাদের দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠানো হয়, যেখানে আজও আমরা সেবা করছি। আবারও আমাদের একটা কঠিন ভাষা শিখতে হয়, সেটা হল কোরিয়ান ভাষা। এখনও পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে আমরা এই ভাষা শিখতে পারিনি। তবে, এখানকার ভাই-বোনেরা যখন আমাদের উৎসাহিত করে এবং বলে, ধীরে ধীরে আমরা এই ভাষা শিখছি, তখন তা শুনে আমাদের খুব ভালো লাগে।

বাঁ-দিক: হংকংয়ে যিহোবাকে সেবা করার জন্য প্রস্তুত

ডান দিক: কোরিয়ার শাখা অফিস

অনেক কিছু শিখি

নতুন ব্যক্তিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সবসময় সহজ হয় না। কিন্তু, আমরা যখন অন্যদের আমাদের ঘরে ডাকি, তাদের সঙ্গে সময় কাটাই, তখন অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা তাদের ভালোভাবে জানতে পারি। উপর উপর দেখলে মনে হতে পারে, আমাদের ভাই-বোনেরা একে অন্যের চেয়ে কত আলাদা। কিন্তু আমরা দেখেছি, তাদের মধ্যে অনেক বিষয়ে মিল রয়েছে। যিহোবা আমাদের অনেক চমৎকার উপায়ে সৃষ্টি করেছেন, তাই আমরা অনেক বন্ধু তৈরি করতে পারি এবং তাদের ভালোবাসতে পারি।—২ করি. ৬:১১.

আমরা শিখি, অন্যদের যিহোবার মতো করে দেখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এও শিখি, এই বিষয়টার উপর মনোযোগ দেওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ যে, আজ কীভাবে যিহোবা আমাদের প্রতি ভালোবাসা দেখাচ্ছেন এবং সঠিক পথে নিয়ে যাচ্ছেন। যখনই আমরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়তাম কিংবা চিন্তা করতাম, অন্যেরা আমাদের পছন্দ করে কি না, তখনই আমরা সেই কার্ড এবং বিভিন্ন চিঠি পড়তাম, যেগুলো আমাদের বন্ধুরা দিয়েছিল। সেগুলো পড়ে আমরা অনেক উৎসাহিত হতাম। আমরা এটা অনুভব করেছি, যিহোবা আমাদের প্রার্থনার উত্তর দিয়েছেন, আমাদের সাহস জুগিয়েছেন আর এই আশ্বাস দিয়েছেন, তিনি আমাদের ভালোবাসেন।

বছর গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এবং লেসলি শিখি, আমরা যতই ব্যস্ত থাকি না কেন, একে অন্যের জন্য সময় বের করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আরেকটা বিষয় শিখি, আমরা যদি কোনো ভুল করে ফেলি, যেমন কোনো ভাষা শেখার সময়, তখন আমাদের সেই বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা উচিত নয় বরং নিজেদের উপর একটু হাসা উচিত। আর আমরা প্রতি রাতে এমন একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করতাম, যেটার জন্য আমরা যিহোবাকে ধন্যবাদ দিতে পারি।

সত্যি বলতে কী, কখনো ভাবিনি, আমি একজন মিশনারি হিসেবে সেবা করব অথবা অন্য একটা দেশে গিয়ে থাকব। কিন্তু, আমি লক্ষ করেছি, যিহোবার পক্ষে সব কিছু সম্ভব। যখন এই বিষয়ে চিন্তা করি, তখন আমার ভাববাদী যিরমিয়ের একটা কথা মনে পড়ে যায়: “হে সদাপ্রভু, তুমি আমাকে প্ররোচনা করিলে আমি প্ররোচিত হইলাম।” (যির. ২০:৭) যিহোবা আমাদের এমন আশীর্বাদ দিয়েছিলেন, যেগুলো আমরা কখনো কল্পনাও করিনি। তিনি আমার ছোটোবেলার প্লেনে চড়ার স্বপ্নও পূরণ করেছিলেন। ছোটোবেলায় আমি কখনো কল্পনাও করিনি, প্লেনে করে এত জায়গা ঘোরার সুযোগ পাব। আমরা বিভিন্ন দেশের শাখা অফিস পরিদর্শন করার সুযোগ পাই। আমাদের যেখানেই পাঠানো হয়েছিল, লেসলি সবসময় আমাকে সমর্থন করেছিল। আর এরজন্য আমি ওকে খুবই সম্মান করি।

আমরা সবসময় নিজেদের মনে করাই, আমরা যা-কিছুই করি, সব যিহোবার জন্য করি। আর তাঁকে ভালোবাসি বলে করি। বর্তমানে, আমরা যে-আশীর্বাদগুলো উপভোগ করছি, সেগুলো দেখায় যে, আমরা যখন চিরকাল বেঁচে থাকব, তখন আমাদের জীবন কতই-না সুন্দর হবে। সেই সময় যিহোবা তাঁর ‘হস্ত মুক্ত করবেন, সমুদয় প্রাণীর বাঞ্ছা পূর্ণ করবেন।’—গীত. ১৪৫:১৬.