সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

জীবনকাহিনি

একে অন্যের প্রতি ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখালে প্রচুর আশীর্বাদ লাভ করা যায়

একে অন্যের প্রতি ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখালে প্রচুর আশীর্বাদ লাভ করা যায়

১৯৪৮ সালে মা আর আমার বোন প্যাটের সঙ্গে

“অ্যাংলিক্যান চার্চে সত্য শেখানো হয় না। তুমি সত্যের খোঁজ করে যেও।” এই কথাটা আমার দিদা আমার মাকে বলেছিলেন, যিনি অ্যাংলিক্যান চার্চে যেতেন। তখন থেকে আমার মা সত্য খুঁজতে থাকেন। কিন্তু, তিনি যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন না। তারা যখন ঘরে আসত, তখন আমার মা আমাকে বলতেন, আমি যেন লুকিয়ে পড়ি। সেই সময় আমরা কানাডার টরোন্টো শহরে থাকতাম। কিন্তু, ১৯৫০ সালে আমার মাসি যখন যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করেন, তখন আমার মাও তার সঙ্গে অধ্যয়নে বসতেন। পরে, আমার মাসি এবং আমার মা দু-জনেই বাপ্তিস্ম নেন।

আমার বাবা কানাডার ইউনাইটেড চার্চের একজন পাদরি ছিলেন। বাবা প্রতি রবিবার সকালে আমাকে এবং আমার বোনকে সান্ডে স্কুলে পাঠাতেন, যেখানে ছোটো বাচ্চাদের বাইবেলের গল্প শেখানো হত। ১১টার সময় আমরা তার সঙ্গে চার্চে যেতাম। আর বিকেল বেলায় আমরা মায়ের সঙ্গে যিহোবার সাক্ষিদের কিংডম হলে যেতাম। আমরা স্পষ্ট দেখতে পেরেছিলাম, এই দুটো ধর্ম কতটা আলাদা।

১৯৫৮ সালে ‘ঈশ্বরীয় ইচ্ছা আন্তর্জাতিক সম্মেলন’-এ হ্যাচেসন পরিবারের সঙ্গে

বব হাচেসন এবং তার স্ত্রী মেরিয়ন অনেক বছর ধরে আমার মায়ের খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। আর আমার মা বাইবেল থেকে যা শিখেছিলেন, সেই বিষয়ে তাদের বলেছিলেন এবং পরে তারাও যিহোবার সাক্ষি হয়েছিলেন। এরপর, ১৯৫৮ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে ‘ঈশ্বরীয় ইচ্ছা আন্তর্জাতিক সম্মেলন’-এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই সম্মেলন আট দিনের ছিল আর বব ও মেরিয়ন তাদের তিন ছেলের সঙ্গে আমাকেও সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। আজ আমি যখন সেই সময়ের কথা চিন্তা করি, তখন আমি বুঝতে পারি, তাদের জন্য আমাকে নিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না। তবে, সেই সময়কার মধুর স্মৃতিগুলো এখনও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

ভাই-বোনেরা আমার প্রতি ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখায় এবং আমি জীবনে সঠিক পথ খুঁজে পাই

আমি যখন কিশোরবয়সি ছিলাম, তখন কিছুসময়ের জন্য আমরা একটা ফার্মে থাকতাম, যেখানে আমরা বিভিন্ন ধরনের পশুপাখির দেখাশোনা করতাম। তাদের যত্ন নিতে আমার খুব ভালো লাগত। তাই আমি ভেবেছিলাম, বড়ো হয়ে আমি পশুপাখির ডাক্তার হব। আমার মা এই বিষয়টা আমাদের মণ্ডলীর একজন প্রাচীনকে বলেন। সেই ভাই আমাকে প্রেমের সঙ্গে বোঝান যে, আমরা “শেষকালে” রয়েছি। আর আমাকে এটা চিন্তা করতে বলেন, আমি যদি কিছু বছরের জন্য কলেজে পড়াশোনা করতে যাই, তা হলে সেটা যিহোবার সঙ্গে আমার সম্পর্কের উপর কোন প্রভাব ফেলবে। (২ তীম. ৩:১) আমি এই বিষয়ে চিন্তা করি এবং সিদ্ধান্ত নিই যে, আমি কলেজে পড়াশোনা করব না।

স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার পরে, আমি চিন্তা করছিলাম, এখন আমি কী করব। এটা ঠিক যে, আমি শনিবার ও রবিবার প্রচারে যেতাম। কিন্তু, সেই কাজ করে আমি আনন্দ পেতাম না। আর আমার মনে হচ্ছিল, আমি অগ্রগামী সেবা করতে পারব না। আমার বাবা ও কাকা সত্যে ছিলেন না। তারা আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন টরোন্টো শহরে একটা বড়ো বীমা কোম্পানিতে চাকরি করি। আমার কাকা সেই কোম্পানিতে একটা বড়ো পদে ছিলেন। আর তাই আমি সেখানে চাকরি করতে শুরু করি।

টরোন্টোতে আমার বেশিরভাগ সময় অফিসের কাজ করে কেটে যেত। আর বাকি সময়টা আমি জগতের লোকদের সঙ্গে কাটাতাম। আর এই কারণে আমি নিয়মিতভাবে সভাতে এবং প্রচারে যেতে পারতাম না। প্রথম প্রথম আমি আমার ঠাকুরদার সঙ্গে থাকতাম, যিনি যিহোবার সাক্ষি ছিলেন না। পরে, তিনি মারা যান। এই কারণে থাকার জন্য আমাকে অন্য একটা জায়গা খুঁজতে হত।

বব ও মেরিয়ন ১৯৫৮ সালে আমাকে সম্মেলনে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারা আমার কাছে আমার বাবা-মায়ের মতো ছিলেন। তারা আমাকে বলেন যে, আমি তাদের বাড়িতে থাকতে পারি। আর যিহোবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মজবুত করতে তারা আমাকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। আর ১৯৬০ সালে তাদের ছেলে জনের বাপ্তিস্ম নেওয়ার সময়ে আমিও বাপ্তিস্ম নিই। এরপর, জন অগ্রগামী সেবা করতে শুরু করে। তাকে দেখে আমিও প্রচারে আরও বেশি করে অংশ নিতে চাইতাম। মণ্ডলীর ভাইয়েরা যখন দেখেছিল, আমি খুব ভালোভাবে উন্নতি করছি, তখন তার কিছুসময় পরে তারা আমাকে ঐশিক পরিচর্যা বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করেন। a

এক সুন্দরী সাথি পাই এবং অগ্রগামী সেবা শুরু করি

১৯৬৬ সালে আমাদের বিয়ের দিনে

১৯৬৬ আমি পালমের বার্গ নামে একজন বোনকে বিয়ে করি। ও একজন উদ্যোগী অগ্রগামী ছিল এবং এমন একটা জায়গায় গিয়ে সেবা করতে চেয়েছিল, যেখানে বেশি প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের সীমা অধ্যক্ষ আমাদের প্রতি ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখান এবং আমাদের উৎসাহিত করেন, আমরা যেন অন্টারিওর অরেলিয়া শহরের একটা মণ্ডলীতে গিয়ে সেবা করি। এরপর আমরা প্যাকিং শুরু করি এবং রওনা দিই।

আমরা যখন অরেলিয়াতে যাই, তখন আমিও অগ্রগামী সেবা করতে শুরু করি। পালমেরের উদ্যোগ দেখে আমারও উদ্যোগ বেড়ে যায়! আমি যখন মনপ্রাণ দিয়ে অগ্রগামী সেবা করতে শুরু করি, তখন আমি এক অন্য ধরনের আনন্দ পাই। আমি যখন বাইবেল থেকে লোকদের কিছু শেখাতাম এবং তারা সেগুলো বুঝে যেত, তখন আমি যে-আনন্দ পেতাম, সেটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। সেখানে আমরা এক দম্পতির সঙ্গে দেখা করি এবং তাদের বাইবেল থেকে শেখাতে শুরু করি। আমরা দেখেছিলাম, তারা কীভাবে তাদের জীবনে বিভিন্ন পরিবর্তন করেছিল আর যিহোবার উপাসক হয়ে উঠেছিল। এটা আমাদের জন্য এক বড়ো আশীর্বাদ ছিল।

নতুন ভাষা এবং নতুন চিন্তাধারা

একবার আমরা যখন টরোন্টোতে গিয়েছিলাম, তখন সেখানে ভাই আর্নল্ডের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল, যিনি বেথেলে বিভিন্ন দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন। তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করেন, আমরা বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে পারব কি না। আমি সঙ্গেসঙ্গে বলি: “হ্যাঁ, অবশ্যই পারব। আমাদের আপনি যেকোনো জায়গায় পাঠাতে পারেন, শুধুমাত্র কিউবেকে পাঠাবেন না।” কারণ সেই সময় কিউবেকে ফ্রেঞ্চভাষী লোকেরা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল এবং তারা চেয়েছিল যেন কিউবেককে একটা আলাদা দেশ করে দেওয়া হয়। তাই, কানাডার যে-এলাকাগুলোতে লোকেরা ইংরেজি ভাষায় কথা বলত, তাদের এবং কিউবেকের ফ্রেঞ্চভাষী লোকদের মধ্যে ভেদাভেদ ছিল। সেইজন্য, আমিও সেই ইংরেজিভাষী লোকদের মতো চিন্তা করতে শুরু করেছিলাম, তাই আমি সেখানে যেতে চাইনি।

আর্নল্ড বলেন, “এখন তো শাখা অফিস বিশেষ অগ্রগামীদের কিউবেকেই পাঠাচ্ছে।” পালমেরের আগে থেকেই সেখানে গিয়ে সেবা করার ইচ্ছা ছিল, তাই আমি সঙ্গেসঙ্গে হ্যাঁ বলে দিই। পরে আমি বুঝতে পারি, এটা সত্যিই এক ভালো সিদ্ধান্ত ছিল!

আমরা পাঁচ সপ্তাহ ধরে ফ্রেঞ্চ ভাষা শিখি। এরপর আমাকে এবং পালমেরকে একটা দম্পতির সঙ্গে রিমোস্কি শহরে পাঠানো হয়। এই শহরটা মন্ট্রিল থেকে ৫৪০ কিলোমিটার (৩৩৬ মাইল) উত্তরপূর্বে রয়েছে। তবে, আমরা এখনও এই ভাষা পুরোপুরিভাবে শিখতে পারিনি। আমাকে একটা সভায় যখন কিছু ঘোষণা করতে বলা হয়েছিল, তখন আমি বিষয়টা বুঝতে পারি। আমাকে বলতে হত, “সামনেই যে-সম্মেলন হবে, সেখানে অস্ট্রিয়া থেকে অনেক ভাই-বোন আসবে।” কিন্তু, আমি বলে ফেলেছিলাম, “অস্ট্রিচ (উটপাখি) থেকে অনেক ভাই-বোন আসবে।” আসলে, ফ্রেঞ্চ ভাষায় অস্ট্রিয়া এবং উটপাখির জন্য যে-শব্দ রয়েছে, সেটার উচ্চারণ অনেকটা একই।

রিমোস্কিতে আমাদের বাড়ি, “হোয়াইট হাউস”

আমাদের চার জনের সঙ্গে আরও চার জন অবিবাহিত বোন যোগ দেয়, যারা খুবই উদ্যোগী ছিলেন। এ ছাড়া, আমাদের সঙ্গে ভাই হিউবার্ডো এবং তার স্ত্রী আর তাদের দুই মেয়ে সেবা করতে শুরু করেন। ভাই হিউবার্ডো এবং তার স্ত্রী একটা বড়ো বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন, যেটাতে সাতটা ঘর ছিল। আমরা সবাই সেই বাড়িতে থাকতে শুরু করি এবং আমরা সেই বাড়ির ভাড়াটা ভাগ করে দিতাম। আমরা সেই বাড়িটাকে হোয়াইট হাউস বলতাম, কারণ সেটা সামনে থেকে ধবধবে সাদা ছিল এবং সেটার পিলারগুলোও সাদা ছিল। প্রায়ই, সেই বাড়িতে ১২ থেকে ১৪ জন লোক থাকত। আমি এবং পালমের বিশেষ অগ্রগামী ছিলাম, তাই আমরা সকালে, দুপুরে এবং সন্ধ্যায় প্রচার করতে বেরিয়ে পড়তাম। আর আনন্দের বিষয় হল, কেউ-না-কেউ আমাদের সঙ্গে প্রচারে যেত, এমনকী শীতের সন্ধ্যায় কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যেও।

এই উদ্যোগী ভাই-বোনদের সঙ্গে আমাদের এত ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল যে, তারা আমাদের পরিবারের মতো হয়ে গিয়েছিল। কখনো কখনো আমরা আগুন জ্বালিয়ে একসঙ্গে সবাই বসতাম এবং কোনো কোনো দিন আমরা বিভিন্ন ধরনের পিরোগী (এটা আটার লেচি বানিয়ে সেটার মধ্যে আলাদা আলাদা পুর দিয়ে তৈরি করা হয়) বানিয়ে খেতাম। একজন ভাই মিউজিক বাজাতে জানতেন আর তাই শনিবার রাতে আমরা প্রায়ই নাচ-গান করতাম।

রিমোস্কিতে আমাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছিল! পাঁচ বছরের মধ্যেই আমাদের অনেক বাইবেল অধ্যয়ন উন্নতি করেছিল এবং বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। দেখতে দেখতেই সেখানকার মণ্ডলীতে ৩৫ জন প্রকাশক হয়ে গিয়েছিল।

কিউবেকে রাজ্যের প্রচারক হিসেবে আমরা অনেক প্রশিক্ষণ পেয়েছিলাম। আমরা স্পষ্ট দেখতে পেরেছিলাম যে, যিহোবা কীভাবে প্রচার কাজে আমাদের সাহায্য করছেন এবং প্রয়োজনীয় বিষয় জুগিয়ে দিচ্ছেন। আমরা ফ্রেঞ্চভাষী লোকদের, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে শিখেছিলাম। এই কারণে আমরা পরবর্তী সময়েও অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির লোকদের ভালোবাসতে শিখেছি।—২ করি. ৬:১৩.

কিন্তু হঠাৎ, শাখা অফিস আমাদের নিউ ব্রন্সউইকের পূর্ব উপকূলে থাকা ট্র্যাকেডি শহরে গিয়ে সেবা করতে বলে। তবে, একটা সমস্যা দেখা দেয়। আমরা সবেমাত্র একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার জন্য কাগজপত্রে সই করেছিলাম। আমি একটা স্কুলেও কথা বলে রেখেছিলাম যে, সপ্তাহে কিছু ঘণ্টা আমি সেখানে পড়াব। এ ছাড়া, আমাদের কিছু বাইবেল ছাত্র সবেমাত্র প্রকাশক হয়েছিল আর আমাদের এখানে কিংডম হল নির্মাণের কাজও চলছিল।

আরও দু-দিন ধরে আমরা ট্র্যাকেডি যাওয়ার বিষয়ে অনেক প্রার্থনা করি এবং সেই শহরটাও দেখে আসি। সেই শহরটা রিমোস্কি থেকে অনেক আলাদা ছিল। এরপর আমরা চিন্তা করি, যিহোবা যখন আমাদের সেখানে পাঠাচ্ছেন, তখন আমরা না বলার কে। আমরা যিহোবাকে আস্বাদন করে দেখেছি এবং তিনি এক এক করে আমাদের সমস্ত সমস্যা দূর করে দিয়েছেন। (মালাখি ৩:১০) যিহোবার সঙ্গে পালমেরের এক দৃঢ় সম্পর্ক ছিল। ও সবসময় ত্যাগস্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল এবং ও মজা করতে খুব ভালোবাসত। এই কারণে ট্র্যাকেডি যাওয়া আমাদের জন্য কিছুটা সহজ হয়ে গিয়েছিল।

আমাদের মণ্ডলীতে রবার্ট রস নামে শুধুমাত্র একজনই প্রাচীন ছিলেন। তিনি তার স্ত্রী লিন্ডার সঙ্গে সেখানে অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতেন। আর পরে তাদের একটা ছেলে হয়। তবে, তারা সেখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও তাদের ছোটো ছেলের যত্ন নিতে হত, তারপরও তারা আমার এবং পালমেরের প্রতি আতিথেয়তা দেখাতেন এবং উদ্যোগের সঙ্গে প্রচার করতেন। তারা দু-জনেই আমাদের অনেক উৎসাহিত করেছিলেন।

যেখানে বেশি প্রয়োজন, সেখানে সেবা করে আমরা অনেক আশীর্বাদ লাভ করেছি

শীত কালে আমাদের প্রথম সীমায় কাজ করার সময়ে

আমরা দু-বছর ধরে ট্র্যাকেডিতে অগ্রগামী হিসেবে সেবা করি। এরপর আমাদের এমন একটা দায়িত্ব দেওয়া হয়, যেটার বিষয়ে আমরা কখনো চিন্তাই করিনি। আমাকে ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করার জন্য বলা হয়। আমরা সাত বছর ধরে ইংরেজি ভাষার আলাদা আলাদা সীমায় কাজ করি। এরপর, আমাদের কিউবেকের ফ্রেঞ্চ ভাষার সীমায় সেবা করার জন্য পাঠানো হয়। সেই সময় আমাদের যিনি জেলা অধ্যক্ষ ছিলেন, ভাই লেওয়ন্স ক্রেপো তিনি আমার বক্তৃতার জন্য আমাকে অনেক প্রশংসা করতেন। তারপর তিনি সবসময় বলতেন, “তোমার বক্তৃতায় তুমি ব্যাবহারিক বিষয়গুলো কীভাবে বলতে পার?” b তিনি যখন আমার প্রতি ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, তখন আমি আমার শেখানোর দক্ষতাকে বাড়াতে পেরেছিলাম। আমি এমনভাবে বক্তৃতা দেওয়ার চেষ্টা করতাম, যাতে লোকেরা সহজেই তা বুঝতে পারে এবং সেখান থেকে কিছু ব্যাবহারিক বিষয় শিখতে পারে।

১৯৭৮ সালে আমাকে এমন একটা দায়িত্ব দেওয়া হয়, যেটা আমি কখনো ভুলব না। মন্ট্রিলে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়, যেটার মূলভাব ছিল, “বিজয়ী বিশ্বাস।” সেখানে ভাই-বোনদের খাওয়ানোর যে-ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তাতে আমাকে সাহায্য করতে বলা হয়। আমাদের বলা হয়েছিল, সেখানে প্রায় ৮০,০০০ লোক আসবে। প্রথম বার সম্মেলনে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সব কিছু নতুন ছিল, নতুন মেশিন, নতুন বাসনপত্র। আর আমাদের ঠিক করতে হত যে, খাবারের মেনুতে কী কী থাকবে এবং কীভাবে সেগুলো বানাতে হবে। আমাদের কাছে প্রায় ২০টা বড়ো বড়ো ফ্রিজ ছিল এবং অনেকসময় সেগুলো ঠিকমতো কাজ করত না। যে-দিন সম্মেলন ছিল, তার আগের দিন রাত ১২টার পর আমাদের স্টেডিয়ামে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়, কারণ স্টেডিয়ামে খেলা চলছিল। সূর্য ওঠার আগেই আমাদের তাড়াতাড়ি করে ওভেন অন করতে হত, যাতে আমরা ভাই-বোনদের ব্রেকফাস্টে কিছু খেতে দিতে পারি। আমরা সবাই খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু, ভাই-বোনেরা অনেক পরিশ্রমী ও অভিজ্ঞ ছিল এবং অনেক মজা করত। তাদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছিলাম। তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল যে, এখনও তারা আমার ভালো বন্ধু। কিউবেকের সেই সম্মেলনে যোগ দিয়ে আমরা অনেক আনন্দ পেয়েছিলাম। ১৯৪০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে যখন ভাই-বোনদের উপর তাড়না করা হচ্ছিল, সেই সময়ে এই ঐতিহাসিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল।

১৯৮৫ সালে মন্ট্রিলে সম্মেলনের আগে পালমেরের সঙ্গে সম্মেলনের কিছু কাজ করার সময়ে

মন্ট্রিলে যে-বড়ো বড়ো সম্মেলনগুলো হয়েছিল, সেখানে আমি অন্যান্য অধ্যক্ষদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলাম। একবার একটা সম্মেলনে ভাই ডেভিড স্প্লেন সম্মেলন অধ্যক্ষ ছিলেন, যিনি এখন পরিচালকগোষ্ঠীর একজন সদস্য। কিছুসময় পর, একটা সম্মেলনে আমাকে যখন এই দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন ডেভিড আমাকে অনেক সাহায্য করেন।

৩৬ বছর ধরে একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করার পর, আমাকে ২০১১ সালে “মণ্ডলীর প্রাচীনদের জন্য স্কুল”-এ ভাইদের শেখানোর জন্য বলা হয়। দু-বছর ধরে আমাকে এবং পালমেরকে ঘুমানোর জন্য আলাদা আলাদা ৭৫টা বিছানা ব্যবহার করতে হয়েছে। আমাদের একটু সমস্যা হত ঠিকই, কিন্তু স্কুল থেকে ভাইয়েরা যে-উপকার পেত, তা দেখে আমরা আমাদের কষ্ট ভুলে যেতাম। সপ্তাহের শেষে প্রাচীনেরা যখন দেখতেন, পরিচালকগোষ্ঠী এই ভাইদের জন্য কতটা চিন্তা করেন এবং চান যেন যিহোবার সঙ্গে তাদের এক দৃঢ় সম্পর্ক থাকে, তখন সেটা দেখে প্রাচীনদের মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠত।

পরে, আমাকে “রাজ্যের প্রচারকদের জন্য স্কুল”-এ শেখানোর জন্য বলা হয়। আমি প্রায়ই দেখতাম যে, ছাত্রেরা খুব চিন্তা করত, তারা খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়ত কারণ প্রত্যেক দিন তাদের সাত ঘণ্টা ধরে বসে থাকতে হত। আর সন্ধ্যা বেলায় তাদের তিন ঘণ্টা ধরে হোমওয়ার্ক করতে হত এবং সপ্তাহে চার-পাঁচ বার তাদের বিভিন্ন কার্যভার তুলে ধরতে হত। আমি এবং স্কুলের অন্য শিক্ষক ছাত্রদের বোঝাতাম যে, তারা নিজেদের দক্ষতায় নয় বরং যিহোবার সাহায্যে এই সমস্ত কিছু করতে পারবে। আর সবসময় এমনটাই হত! প্রথম দিকে, ছাত্রদের মনে হত যে, তারা এত কিছু করতে পারবে না। কিন্তু, তারা যখন দেখত, যিহোবার সাহায্যে তারা তাদের কল্পনার চেয়ে বেশি করতে পারছে, তখন তারা অবাক হয়ে যেত।

অন্যদের প্রতি ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখালে প্রচুর আশীর্বাদ লাভ করা যায়

আমার মা বাইবেল ছাত্রদের প্রতি ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখিয়েছিলেন বলে তারা উন্নতি করতে পেরেছিল। মায়ের আচার-আচরণ দেখে বাবারও সত্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছিল। আমার মা মারা যাওয়ার তিন দিন পর, আমার বাবা কিংডম হলে পাবলিক টক শোনার জন্য আসেন। আর এটা দেখে আমরা সবাই অবাক হয়ে যাই। পরবর্তী ২৬ বছর ধরে আমার বাবা ক্রমাগত সভাতে আসতেন। আমার বাবা বাপ্তিস্ম নেননি, কিন্তু প্রাচীনেরা বলেছেন যে, তিনি সবার আগে কিংডম হলে আসতেন।

আমার মা আমাদের প্রত্যেকের জন্য এক উত্তম উদাহরণ স্থাপন করেছেন। বর্তমানে, আমার তিন বোন তাদের স্বামীদের সঙ্গে বিশ্বস্তভাবে যিহোবার সেবা করছে। আমার দুই বোন শাখা অফিসে সেবা করছে, একজন পোর্তুগালে আর একজন হাইতিতে।

আমি এবং পালমের এখন অন্টারিওর হ্যামিলটনে বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করছি। আমি যখন একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করতাম, তখন আমরা ভাই-বোনদের সঙ্গে তাদের পুনর্সাক্ষাতে এবং বাইবেল অধ্যয়নে যেতাম। কিন্তু, এখন আমাদের নিজেদের অনেক বাইবেল ছাত্র রয়েছে। আমরা যখন দেখি, তারা কীভাবে যিহোবাকে ভালোবাসতে শুরু করছে, তখন আমরা অনেক আনন্দ পাই। আমরা যখন নতুন মণ্ডলীতে যাই, তখন অনেক ভাই-বোনের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়। আর আমরা যখন দেখি যে, যিহোবা ভালো ও খারাপ সময়ে কীভাবে তাদের যত্ন নিচ্ছেন, তখন তা দেখে আমরা অনেক উৎসাহিত হই।

আজ, আমরা যখন পিছনে ফিরে দেখি, তখন লক্ষ করি যে, অনেক ভাই-বোন কীভাবে আমাদের প্রতি ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখিয়েছিল, তখন তা দেখে আমাদের হৃদয় কৃতজ্ঞতায় ভরে যায়। আর আমরাও চেষ্টা করি যেন আমরা ভাই-বোনদের প্রতি চিন্তা দেখাতে পারি। আমরা তাদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করি, যাতে তারা মনপ্রাণ দিয়ে যিহোবার সেবা করতে পারে। (২ করি. ৭:৬, ৭) একবার, আমরা একটা পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। সেই পরিবারে মা, ছেলে এবং মেয়ে তিন জনই পূর্ণসময়ের সেবা করছিল। আমি তাদের বাবাকে জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কি অগ্রগামী সেবা করার কথা চিন্তা করেছেন?’ তিনি বলেন, তিনি তার পরিবারকে সাহায্য করছেন, যাতে তারা অগ্রগামী হিসেবে সেবা চালিয়ে যেতে পারে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কি যিহোবার চেয়ে আরও ভালোভাবে তাদের সাহায্য করতে পারবেন?’ আমি তাকে উৎসাহিত করি যেন তিনিও সেই আনন্দ লাভ করেন, যেটা তার পরিবার উপভোগ করছে। আর ছয় মাসের মধ্যে তাদের বাবা অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করেন।

আমি এবং পালমের সবসময় পরের প্রজন্মকে যিহোবার ‘পরাক্রমের’ বিষয়ে বলে চলব। আর আমরা এই প্রার্থনা করি যেন তারা যিহোবাকে সেবা করার মাধ্যমে আমাদের মতোই আনন্দ লাভ করে!—গীত. ৭১:১৭, ১৮.

a বর্তমানে, যে-ভাই এই দায়িত্ব পালন করেন, তাকে জীবন ও পরিচর্যা সভা-র অধ্যক্ষ বলা হয়।