সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

জীবনকাহিনি

‘আমি যিহোবার সেবা করতে চেয়েছিলাম’

‘আমি যিহোবার সেবা করতে চেয়েছিলাম’

সুরিনামের ঘন জঙ্গলের ভিতরে থাকা গ্রানবোরি গ্রামের পাশে কিছু লোকের সঙ্গে আমরা দেখা করতে গিয়েছিলাম। দেখা করার পর, আমরা কাঠের তৈরি একটা লম্বা নৌকায় উঠে তাপানাহোনি নদীর দিকে যেতে শুরু করি। আমরা এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছাই, যেখানে জলের স্রোত অনেক বেশি হওয়ায় নৌকার মোটরের একটা ছোটো অংশ একটা বড়ো পাথরে গিয়ে ধাক্কা লাগে। হঠাৎ নৌকার সামনের অংশ জলের তলায় চলে যায় এবং আমরা ডুবতে শুরু করি। ভয়ে আমার বুক ধুকধুক করতে শুরু করে! আমি অনেক বছর ধরে নদীর উপর দিয়ে যাত্রা করে ভ্রমণ অধ্যক্ষের কাজ করেছি, কিন্তু আমি সাঁতার কাটতে শিখিনি।

এর পরের ঘটনাগুলো বলার আগে, আসুন আমি আপনাদের বলি, কীভাবে আমি পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করি।

১৯৪২ সালে কুরাকাওয়া নামে একটা সুন্দর দ্বীপে আমার জন্ম হয়, যেটা ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোর মধ্যে একটা। যদিও আমার বাবা সুরিনাম দেশে থাকতেন, কিন্তু কাজের জন্য তিনি কুরাকাওয়া দ্বীপে চলে আসেন। আমার জন্ম হওয়ার কিছু বছর আগে বাবা বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন। সেই দ্বীপে যারা প্রথম যিহোবার সাক্ষি হয়েছিল, তাদের মধ্যে আমার বাবাও একজন ছিলেন। a বাবা আমার এবং আমার ভাই-বোনদের সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে বাইবেল অধ্যয়ন করতেন। কখনো কখনো আমরা একদমই অধ্যয়ন করতে চাইতাম না, কিন্তু তাও তিনি অধ্যয়ন করতেন। আমার বয়স যখন ১৪ বছর ছিল, তখন আমরা সবাই সুরিনামে ফিরে আসি কারণ ঠাকুমার অনেক বয়স হয়ে গিয়েছিল এবং তাকে দেখাশোনা করার প্রয়োজন ছিল।

বন্ধুদের ভালো প্রভাব

সুরিনামের মণ্ডলীতে আমি এমন অল্পবয়সি ভাই-বোনদের সঙ্গে মেলামেশা করি, যারা উদ্যোগের সঙ্গে যিহোবার সেবা করত। তারা আমার চেয়ে বয়সে বড়ো ছিল এবং অগ্রগামীর সেবা করছিল। তারা যখন প্রচারের বিষয়ে বলত কিংবা কোনো অভিজ্ঞতা শোনাত, তখন তাদের মুখে অনেক হাসি থাকত। প্রায় সভার পর, আমরা বাইরে গিয়ে খোলা আকাশের নীচে বসে মনোযোগ দিয়ে তারাগুলো দেখতাম এবং বাইবেল সম্বন্ধে কথা বলতাম। কিছু সময়ের মধ্যে আমি স্থির করি যে, আমি আমার বন্ধুদের মতো হব এবং তাদের মতো আমিও যিহোবার সেবা করব। এরপর, ১৬ বছর বয়সে আমি বাপ্তিস্ম নিই এবং ১৮ বছর বয়স থেকে নিয়মিত অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করি।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখি

প্যারামারিবো শহরে অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার সময়

অগ্রগামীর সেবায় আমি এমন অনেক কিছু শিখি, যেগুলোপরে গিয়ে আমার কাজে আসে। যেমন, আমি শিখি যে, অন্যদের ট্রেনিং দেওয়া কিংবা শেখানো কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি যখন অগ্রগামীর সেবা শুরু করি, তখন ভাই উইলিয়াম ভ্যান স্যায়েল আমাকে অনেক কিছু শেখান। b তিনি একজন মিশনারি ছিলেন এবং আমাকে ভালোভাবে শিখিয়েছিলেন, কীভাবে আমি মণ্ডলীর দায়িত্বগুলো পালন করতে পারি। সেইসময় আমি বুঝতে পারিনি, এই ট্রেনিং আমার কতটা কাজে আসবে। কিন্তু, পরের বছর আমাকে যখন সুরিনামের একটা ঘন জঙ্গলে এক বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে পাঠানো হয়, তখন সেই ট্রেনিং আমার খুব কাজে আসে। সেখানে ভাই-বোনেরা ছোটো ছোটো দলে মিলিত হত আর আমাকে তাদের পরিচালনা করতে বলা হয়েছিল। তাই, এই ট্রেনিঙের বিষয়গুলো কাজে লাগিয়ে আমি তাদের ভালোভাবে সাহায্য করতে পারি। আমি উইলিয়াম এবং তার মতো অন্যান্য ভাইয়ের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ কারণ তারা সঠিক সময়ে আমাকে ট্রেনিং দিয়েছিল। তাদের মতো আমিও চেষ্টা করি যেন সময় বের করে অন্যদের ট্রেনিং দিই।

দ্বিতীয় যে-বিষয়টা আমি শিখি, তা হল সাধারণভাবে জীবনযাপন করা এবং আগে থেকে পরিকল্পনা করা অনেক উপকার নিয়ে আসে। প্রতি মাসে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য আমাদের অল্প কিছু টাকা দেওয়া হত, যেটা আমাদের পুরো মাস ভেবে-চিন্তে খরচ করতে হত। তাই, আমি এবং যে-ভাই আমার সঙ্গে অগ্রগামী হিসেবে সেবা করছিল, আমরা দু-জন মিলে প্রত্যেক মাসের শুরুতে পরিকল্পনা করতাম যে, সেই মাসে আমাদের কোন বিষয়গুলোর প্রয়োজন হবে। এরপর, আমাদের মধ্যে কেউ একজন জঙ্গল থেকে অনেক দূর যাত্রা করে শহরে যেত আর সেখান থেকে খাবারদাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনত। আমরা এই বিষয়টা খেয়াল রাখতাম যেন সেই জিনিসগুলো পুরো মাস চলে, তা না হলে এই ঘন জঙ্গলে আমরা কোথায় সেগুলো খুঁজতে বের হব! সাধারণভাবে জীবনযাপন করার ফলে এবং আগে থেকে পরিকল্পনা করার ফলে আমি সারাজীবন ধরে কোনো বিক্ষেপ ছাড়াই যিহোবার উপাসনা করতে পেরেছিলাম।

তৃতীয় যে-বিষয়টা আমি শিখি, সেটা হল আমরা যদি লোকদের কাছে তাদের নিজেদের ভাষায় প্রচার করি, তা হলে আমরা তাদের হৃদয়ে পৌঁছাতে পারব। আমি ডাচ, ইংরেজি, পাপিয়ামেন্টো ও সেইসঙ্গে স্রানানটাঙ্গো (এটাকে স্রানান ভাষাও বলা হয়) ভাষাও জানতাম, যেটা সাধারণত সুরিনাম দেশের লোকেরা বলত। কিন্তু আমি দেখি, আমরা যখন জঙ্গলে থাকা লোকদের কাছে তাদের নিজেদের ভাষায় প্রচার করতাম, তখন তারা আমাদের কথা মন দিয়ে শুনত। কিন্তু, আমার জন্য তাদের কিছু ভাষা শেখা খুব কঠিন ছিল, যেমন সামারাক্কান ভাষা। এই ভাষাতে তীক্ষ্ণতা একটু বাড়ালে বা কমালে শব্দের অর্থ পুরোপুরি পালটে যেত। তবে আমি খুশি যে, তাদের ভাষাগুলো শেখার জন্য আমি অনেক পরিশ্রম করেছি। এর ফলে, আমি আরও অনেক লোককে সত্য শিখতে সাহায্য করেছি।

তবে, তাদের ভাষা বলতে গিয়ে আমি অনেক ভুলও বলেছিলাম। যেমন, একসময় সামারাক্কান ভাষায় কথা বলে এমন একজন বাইবেল ছাত্রী পেট ব্যথার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম, ‘আপনি কি ঠিক আছেন?’ এর পরিবর্তে, আমি তাকে জিজ্ঞেস করে ফেলি, ‘আপনি কি প্রেগনেন্ট?’ আপনারা বুঝতেই পারছেন, তিনি কতটা লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলেন। তবে, এইরকম ভুলগুলো করা সত্ত্বেও আমি হাল ছেড়ে দিইনি। আমি যেখানেই যেতাম, সেখানকার লোকদের ভাষায় কথা বলার কঠোর প্রচেষ্টা করতাম।

আরও কিছু দায়িত্ব পাই

১৯৭০ সালে আমাকে একজন সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। সেই বছরেই আমি সুরিনামের জঙ্গলে ছোটো ছোটো দলের পরিদর্শন করি এবং তাদের বিশ্বপ্রধান কার্যালয়ের একটা সিনেমা দেখাই। এতে অনেক ছবি ছিল এবং এটাকে স্লাইড প্রোগ্রাম বলা হত। এটার শিরোনাম ছিল: “যিহোবার সাক্ষিদের বিশ্বপ্রধান কার্যালয় পরিদর্শন।” সেই দলের কাছে পৌঁছানোর জন্য আমি এবং কয়েক জন ভাই কাঠের তৈরি একটা লম্বা নৌকা করে যাত্রা করতাম। সেই ছোটো নৌকায় আমরা আমাদের সঙ্গে স্লাইড শো চালানোর একটা প্রজেক্টর, জেনারেটর, হ্যারিকেন এবং পেট্রোলের একটা জাড় সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম। পৌঁছানোর পর আমরা এগুলো নিয়ে সেখানে যেতাম, যেখানে প্রোগ্রামটা দেখানো হবে। সেই দলের লোকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য আমাদের অনেক পরিশ্রম করতে হত। সেই পরিদর্শনের একটা বিশেষ স্মৃতি আমার এখনও মনে আছে। যখন আমরা সেই লোকদের প্রোগ্রামটা দেখাতাম, তখন তাদের খুব ভালো লাগত। আমি অনেক খুশি কারণ আমি যিহোবা এবং তাঁর সংগঠন সম্বন্ধে তাদের শেখানোর সুযোগ পেয়েছি। যদিও আমি অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম, কিন্তু আমি যে-সমস্ত আশীর্বাদ পেয়েছিলাম, সেগুলোর সামনে এই সমস্যাগুলো কিছুই নয়।

ত্রিগুণ সূত্রের বন্ধন

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি ও এথেল বিয়ে করি

আমি জানতাম, যদি আমি বিয়ে না করি, তা হলে আরও ভালোভাবে যিহোবার সেবা করতে পারব, কিন্তু আমার মনে হয়, এখন একজন জীবনসঙ্গীর প্রয়োজন। তাই, আমি যিহোবার কাছে এই বিষয়ে প্রার্থনা করি যেন আমি এমন একজন স্ত্রী খুঁজে পাই, যে আনন্দের সঙ্গে সুরিনামের জঙ্গলে পূর্ণসময়ের সেবা করবে। প্রায় এক বছর পর এথেল নামে একজন অগ্রগামী বোনকে আমার পছন্দ হয় আর আমরা একে অপরকে জানতে শুরু করি। এথেলের মধ্যে যিহোবাকে সেবা করার অনেক উদ্যোগ ছিল আর সে অনেক পরিশ্রমী ছিল। ছোটোবেলা থেকেই এথেল প্রেরিত পৌলের মতো হতে চেয়েছিল এবং যতবেশি সম্ভব লোকের কাছে প্রচার করতে চেয়েছিল। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমরা বিয়ে করি এবং তারপর আমরা দু-জনে সীমার কাজ করতে শুরু করি।

এথেলের পরিবার গরিব ছিল এবং তারা কম টাকাপয়সাতেই জীবনযাপন করতে জানত। তাই, এথেলের জন্য নিজেকে সীমার কাজে মানিয়ে নেওয়া খুব-একটা কঠিন ছিল না। আমরা যখন জঙ্গলের মণ্ডলীগুলোর পরিদর্শন করতে যেতাম, তখন আমরা নিজেদের সঙ্গে বেশি জিনিসপত্র নিতাম না। আমরা নদীতে স্নান করতাম আর সেখানেই আমাদের কাপড়চোপড় ধুতাম। ভাই-বোনেরা জঙ্গল থেকে যা-কিছু শিকার করে আনত, আমরা তা-ই খেতাম। যেমন, অনেকসময় আমরা ইগুয়ানা নামে এক প্রকার জন্তু এবং পিরানা নামে এক প্রকার মাছও খেয়েছিলাম। যখন খাবারের জন্য কোনো প্লেট থাকত না, তখন আমরা কলাপাতাতে খেতাম। কাঁটা-চামচ না থাকলে আমরা হাত দিয়েই খেতাম। আমি এবং এথেল এটা অনুভব করেছি যে, যিহোবার সেবায় আমরা যা-কিছু ত্যাগস্বীকার করেছি, সেগুলো আমাদের একে অন্যের এবং যিহোবার প্রতি নিকটবর্তী করে তুলেছে। সত্যিই, ত্রিগুণ সূত্রের বন্ধন আরও মজবুত হয়ে গিয়েছে। (উপ. ৪:১২) আমাদের কেউ যদি পৃথিবীর সমস্ত ধনসম্পদ দিয়ে এই কাজ ছাড়তে বলে, তা হলেও জীবনে আমরা এই কাজ ছাড়ব না!

একবার যখন আমরা জঙ্গলে থাকা ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসছিলাম, তখন আমাদের প্রতি সেই ঘটনা ঘটে, যেটার বিষয়ে আমি শুরুতে আপনাদের বলেছিলাম। নদীর স্রোত যখন বেড়ে যায়, তখন আমাদের নৌকা জলের তলায় চলে যায়। কিন্তু, খুব তাড়াতাড়ি সেটা আবারও উপরে ভেসে ওঠে। তবে এটা ভালো যে, আমরা সবাই লাইফ জ্যাকেট পরে ছিলাম আর আমরা কেউই নৌকা থেকে জলে পড়ে যাইনি। কিন্তু, আমাদের নৌকায় জল ঢুকে একেবারে ভরে গিয়েছিল। তাই, আমরা সঙ্গেসঙ্গে আমাদের বাসনগুলোতে যে-খাবার ছিল, সেগুলো নদীতে ফেলে দিই এবং খালি বাসনগুলো দিয়ে নৌকার জল বাইরে ফেলতে শুরু করি।

এখন আমাদের কাছে খাবারের জন্য কিছুই ছিল না, তাই আমরা মাছ ধরতে শুরু করি। কিন্তু, আমরা একটাও মাছ ধরতে পারিনি। এরপর, আমরা যিহোবার কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদের সেই দিনের জন্য খাবার দিয়ে দেন। প্রার্থনা শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে একজন ভাই ছিপ ফেলেন এবং একটা বড়ো মাছ ওঠে। সেই মাছ এত বড়ো ছিল যে, আমরা পাঁচ জন পেট ভরে সেটা খেতে পারতাম।

স্বামী, বাবা এবং ভ্রমণ অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করি

পাঁচ বছর ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করার পর আমরা এমন একটা বিষয় জানতে পারি, যেটা আমরা কখনো আশাই করিনি। সেটা হল, আমরা বাবা-মা হতে চলেছি। এটা শুনে আমরা অনেক খুশি হই, কিন্তু আবার চিন্তা করি, এরপর কী হবে। আমি এবং এথেল সারাজীবন ধরে মনপ্রাণ দিয়ে পূর্ণসময়ের সেবা করতে চেয়েছিলাম। ১৯৭৬ সালে আমাদের বড়ো ছেলে এথনিয়েলের জন্ম হয় এবং এর আড়াই বছর পর আমাদের ছোটো ছেলে জিয়োভানির জন্ম হয়।

১৯৮৩ সালে পূর্ব সুরিনামে গোডো হোলোর কাছে তাপানাহোনি নদীতে ভাই-বোনদের বাপ্তিস্মের সময়

সেই সময় সুরিনামে ভাইদের অনেক প্রয়োজন ছিল। তাই, শাখা অফিস আমাকে সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করে চলার জন্য বলে। আমাদের ছেলেরা যখন ছোটো ছিল, তখন আমাকে এমন সীমাতে কাজ করতে বলা হয়, যেখানে অনেক কম মণ্ডলী ছিল। তাই, প্রতি মাসে কয়েক সপ্তাহ আমি সীমার কাজ করতাম আর বাকি সপ্তাহ আমার মণ্ডলীতে অগ্রগামী হিসেবে কাজ করতাম। আমি যখন ঘরের পাশের মণ্ডলীগুলোর পরিদর্শন করতে যেতাম, তখন আমার স্ত্রী এবং ছেলেরাও আমার সঙ্গে যেত। কিন্তু, সুরিনামের ঘন জঙ্গলে থাকা মণ্ডলীগুলোতে পরিদর্শন করতে এবং সম্মেলনগুলোতে যোগ দিতে আমি একাই যেতাম।

আমি যখন একজন সীমা অধ্যক্ষ ছিলাম, তখন আমি নৌকা করে দূরদূরান্তে থাকা মণ্ডলীগুলোর পরিদর্শন করতাম

আমার সমস্ত দায়িত্ব পালন করার জন্য আমাকে ভালোভাবে পরিকল্পনা করতে হত। আমি এই বিষয়টা খেয়াল রাখতাম যেন প্রত্যেক সপ্তাহে পারিবারিক উপাসনা হয়। আমি যখন জঙ্গলের মণ্ডলীগুলোতে পরিদর্শন করতে যেতাম, তখন আমার স্ত্রী ছেলেদের সঙ্গে পারিবারিক উপাসনা করত। কিন্তু, একটা পরিবার হিসেবে আমরা যতটা করতে পারি, সেই সমস্ত করার চেষ্টা করতাম। এ ছাড়া, আমরা আমাদের ছেলেদের সঙ্গে সময় কাটাতাম। যেমন, তাদের সঙ্গে গেম খেলতাম অথবা বাইরে কোথাও ঘুরতে যেতাম। আমি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে আমার বক্তৃতাগুলো এবং অন্যান্য বিষয়ের প্রস্তুতি নিতাম। আর এথেল হিতোপদেশ ৩১:১৫ পদে বলা গুণবতী স্ত্রীর মতো খুব সকাল সকাল উঠত এবং সমস্ত কিছু প্রস্তুত করে রাখত। এভাবে আমরা ছেলেদের স্কুলে পাঠানোর আগে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করতে এবং ডেলি টেক্সট পড়তে পারতাম। এথেলের জন্যই আমি আমার সমস্ত দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করতে পারতাম। ওর মতো একজন স্ত্রীকে পেয়ে আমি খুব খুশি!

আমরা চাইতাম যেন আমাদের ছেলেরাও পূর্ণসময়ের সেবা করে। এর কারণ এই নয় যে, আমরা তাদের বলছি বরং তারা নিজের ইচ্ছায় তা করতে চেয়েছিল। বাবা-মা হিসেবে আমরা এটাই চাইতাম যেন তারা যিহোবাকে ভালোবাসে এবং প্রচার কাজকে ভালোবাসে। আমরা প্রায়ই তাদের বলতাম, পূর্ণসময়ের সেবা করার ফলে আমরা কত আনন্দ পেয়েছি। কিন্তু, যে-সমস্যাগুলো এসেছিল, সেগুলো আমরা তাদের কাছ থেকে লুকাইনি। তবে, আমরা তাদের সবসময় এটাই বলতাম, কীভাবে যিহোবা আমাদের পরিবারকে সাহায্য এবং আশীর্বাদ করেছেন। আমরা এটাই চেষ্টা করতাম যেন আমাদের ছেলেরা এমন ভাই-বোনদের সঙ্গে মেলামেশা করে, যারা যিহোবাকে তাদের জীবনে প্রথম স্থানে রেখেছে।

একটা পরিবারের যত্ন নেওয়া সহজ নয়। কিন্তু, আমি আমার তরফ থেকে পুরো চেষ্টা করেছি যেন তাদের ভালোভাবে যত্ন নিতে পারি। আমি যখন অবিবাহিত ছিলাম এবং সুরিনামের জঙ্গলে এক বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করছিলাম, তখন আমি বুঝে-শুনে টাকাপয়সা খরচ করার ব্যাপারে অনেক কিছু শিখেছিলাম। সেই সময় আমি যা শিখেছিলাম, সেগুলো পরে আমার অনেক কাজে আসে। কিন্তু, অনেকসময় আমাদের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো হাতের কাছে থাকত না। এইরকম পরিস্থিতিতে আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পেরেছিলাম, কীভাবে যিহোবা আমাদের পরিবারের যত্ন নিয়েছিলেন এবং আমাদের সাহায্য করেছিলেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত যখন সুরিনামে গৃহযুদ্ধ চলছিল, তখন প্রত্যেক দিন আমাদের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়েছিল। সেই সময়ে যিহোবা আমাদের যত্ন নিয়েছিলেন এবং কোনো কিছুরই অভাব হতে দেননি।—মথি ৬:৩২.

যিহোবার সেবা করার চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না

বাঁ দিক থেকে ডান দিকে: আমার স্ত্রী এথেলের সঙ্গে

আমাদের বড়ো ছেলে এথনিয়েল তার স্ত্রী ন্যাটালির সঙ্গে

আমাদের ছোটো ছেলে জিয়োভানি তার স্ত্রী ক্রিস্টালের সঙ্গে

যিহোবা আমাদের খুব ভালোভাবে যত্ন নিয়েছেন এবং তাঁর সেবা করে আমরা অনেক আনন্দ পেয়েছি। যিহোবার সাহায্যেই আমরা আমাদের ছেলেদের ভালোভাবে বড়ো করে তুলতে পেরেছি এবং তাঁর বিষয়ে শেখাতে পেরেছি। আজ আমরা তাদের দেখে খুব খুশি কারণ তারা পূর্ণসময়ের সেবাকে নিজেদের কেরিয়ার হিসেবে বাছাই করেছে। এথনিয়েল ও জিয়োভানি রাজ্যের প্রচারকদের জন্য স্কুল-এ যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে এবং আজ তারা দু-জনেই তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সুরিনামের শাখা অফিসে সেবা করছে।

এখন আমার এবং এথেলের বয়স হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তারপরও আমরা মনপ্রাণ দিয়ে যিহোবার সেবা করে যাচ্ছি। আমরা এখন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করছি। আমরা এত ব্যস্ত থাকি যে, আমি এখনও পর্যন্ত সাঁতার কাটা শিখতে পারিনি। কিন্তু, আমি যখন আমার জীবন নিয়ে চিন্তা করি, তখন আমার কোনো আপশোস হয় না। বরং আমি খুব খুশি কারণ আমি অল্পবয়স থেকেই পূর্ণসময়ের সেবা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। সত্যিই, যিহোবার সেবা করার চেয়ে আর ভালো কিছুই হতে পারে না!

b ১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর সচেতন থাক! পত্রিকায় “বাস্তবতা আমার কল্পনাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে” শিরোনামের প্রবন্ধে ভাই উইলিয়াম ভ্যান স্যায়েলের জীবনকাহিনি রয়েছে।