জীবনকাহিনি
যিহোবা ‘আমার পথ সকল সরল করিয়াছেন’
একবার এক যুবক ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “আপনার প্রিয় শাস্ত্রপদ কোনটা?” কোনোরকম দ্বিধা না করে আমি উত্তর দিই, “হিতোপদেশ ৩ অধ্যায় ৫ ও ৬ পদ, যেটি বলে: ‘তুমি সমস্ত চিত্তে সদাপ্রভুতে বিশ্বাস কর; তোমার নিজ বিবেচনায় নির্ভর করিও না; তোমার সমস্ত পথে তাঁহাকে স্বীকার কর; তাহাতে তিনি তোমার পথ সকল সরল করিবেন।’” যিহোবা সত্যিই আমার সমস্ত পথ সরল করেছেন। কীভাবে?
বাবা-মা আমাকে সঠিক পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করেন
১৯২০-র দশকে আমার বাবা-মা তাদের বিয়ের আগে সত্য শেখেন। আমি ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করি। আমার বয়স যখন অল্প ছিল, তখন আমরা ইংল্যান্ডে বাস করতাম। আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে সভায় যোগ দিতাম আর পরে, আমি ঐশিক পরিচর্যা বিদ্যালয়-এ নাম দিই। এখনও আমার সেই সময়ের কথা মনে আছে, যখন আমি প্রথম বার বিদ্যালয়ে অংশ নিই। আমাকে একটা বাক্সের উপর দাঁড়াতে হয়েছিল, যাতে আমি পোডিয়াম থেকে শ্রোতাদের দেখতে পারি। সেই সময় আমার বয়স ছিল ছয় বছর আর আমি শ্রোতাদের মধ্যে আমার চেয়ে বয়স্ক ব্যক্তিদের দেখে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
বাবা আমার জন্য একটা কার্ডে এক সহজ উপস্থাপনা টাইপ করে দিয়েছিলেন, যাতে আমি ক্ষেত্রের পরিচর্যায় সেটা ব্যবহার করতে পারি। আট বছর বয়সে আমি প্রথম বার একা একটা বাড়ির দরজায় যাই। গৃহকর্তা যখন আমার কার্ডটা পড়েন আর সঙ্গেসঙ্গে “ঈশ্বরকে সত্য বলিয়া স্বীকার করা যাউক” (ইংরেজি) শিরোনামের বইয়ের একটা কপি গ্রহণ করেন, তখন আমি খুব খুশি হই! বাবাকে এই অভিজ্ঞতার বিষয়ে বলার জন্য আমি দৌড়ে তার কাছে যাই। প্রচারে ও সভাগুলোতে যোগ দিয়ে আমি অনেক আনন্দ লাভ করি আর এভাবে আমার মধ্যে যিহোবাকে পূর্ণসময় সেবা করার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে।
বাবা আমার জন্য প্রহরীদুর্গ পত্রিকার গ্রাহক হওয়ার ব্যবস্থা করেন আর এরপর থেকে বাইবেলের সত্য আমার উপর আরও গভীরভাবে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। ডাকবাক্সে নতুন পত্রিকা আসার সঙ্গেসঙ্গে আমি প্রচুর আগ্রহ নিয়ে সেটা পড়ি। যিহোবার উপর আমার বিশ্বাস বা আস্থা আরও বৃদ্ধি পায় আর একসময় আমি তাঁর কাছে নিজেকে উৎসর্গ করি।
১৯৫০ সালে আমরা পরিবারগতভাবে নিউ ইয়র্ক সিটিতে ঈশতন্ত্রের বৃদ্ধি সম্মেলন-এ যোগ দিই। ৩ আগস্ট, বৃহস্পতিবার সম্মেলনের মূলভাব ছিল, “মিশনারির দিন।” সেই দিন ভাই কেরি বারবার, যিনি পরবর্তী সময় পরিচালকগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে সেবা করেন, বাপ্তিস্মের বক্তৃতা দেন। যখন তিনি তার বক্তৃতার শেষে বাপ্তিস্মপ্রার্থীদের দুটো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন,
তখন আমি দাঁড়িয়ে “হ্যাঁ” বলি। সেই সময় আমার বয়স ছিল ১১ বছর কিন্তু আমি বুঝতে পারি, আমি এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছি। যেহেতু আমি তখনও সাঁতার কাটতে পারতাম না, তাই আমার জলে নামতে খুব ভয় লাগে। আমার কাকা আমার সঙ্গে সঙ্গে বাপ্তিস্মের পুলে যান আর তিনি আমাকে আশ্বাস দেন যে, কোনো সমস্যা হবে না। আর সত্যিই, সব কিছু এত দ্রুত হয়ে যায় যে, আমার পা বাপ্তিস্মের পুলের নীচ পর্যন্ত পৌঁছাইনি। আমাকে একজন ভাইয়ের হাত থেকে আরেকজন ভাইয়ের হাতে দেওয়া হয়; একজন আমাকে বাপ্তিস্ম দেন আর অন্য জন আমাকে পুল থেকে তুলে নেন। সেই গুরুত্বপূর্ণ দিন থেকে যিহোবা ক্রমাগত আমার সমস্ত পথ সরল করে এসেছেন।আমি যিহোবার উপর আস্থা রাখা বেছে নিই
আমার স্কুল শেষ হওয়ার পর আমি অগ্রগামী সেবা করতে চাই কিন্তু আমার শিক্ষকেরা আমাকে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। তাদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। শীঘ্রই আমি বুঝতে পারি, আমি একইসঙ্গে সত্যে স্থির থাকতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারব না। তাই, আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমি বিষয়টা নিয়ে যিহোবার কাছে প্রার্থনা করি আর তারপর সম্মানপূর্বক একটা চিঠি লিখে শিক্ষকদের জানাই যে, আমি প্রথম বছরের শেষেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেব। যিহোবার উপর পূর্ণ আস্থা রেখে আমি দেরি না করেই অগ্রগামীর সেবা শুরু করি।
১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে আমি ওয়েলিংবারা শহরে পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করি। আমি লন্ডন বেথেলের ভাইদের অনুরোধ করি, যেন তারা এমন একজন অভিজ্ঞ অগ্রগামী ভাইয়ের সুপারিশ করেন, যার সঙ্গে আমি সেবা করতে পারব। ভাই বার্ট ভয়েজি আমার সঙ্গী হন এবং আমাকে অনেক কিছু শেখান। তিনি একজন উদ্যোগী প্রচারক ছিলেন আর তিনি আমাকে প্রচারকাজের এক উত্তম তালিকা বজায় রাখতে শেখান। সেখানকার মণ্ডলীতে কেবল ছয় জন বয়স্ক বোন এবং ভাই ভয়েজি ও আমি ছিলাম। সমস্ত সভার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার এবং সেগুলোতে অংশ নেওয়ার ফলে আমি যিহোবার উপর আস্থা গড়ে তোলার এবং আমার বিশ্বাস সম্বন্ধে অন্যদের জানানোর অনেক সুযোগ লাভ করি।
আমি সামরিক বাহিনীতে অংশ নিতে প্রত্যাখ্যান করি বলে কিছু সময়ের জন্য আমাকে জেলে বন্দি হয়ে থাকতে হয়। এরপর, বার্ব্রা নামে একজন বিশেষ অগ্রগামী বোনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমরা ১৯৫৯ সালে বিয়ে করি। আমরা যেকোনো জায়গায় গিয়ে সেবা করার জন্য ইচ্ছুক ছিলাম। প্রথমে আমাদের উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশিরে পাঠানো হয়। এরপর ১৯৬১ সালের জানুয়ারি মাসে আমাকে লন্ডন বেথেলে রাজ্যের পরিচর্যা বিদ্যালয়-এ যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, যেটা এক মাসের কার্যক্রম ছিল। কার্যক্রমের শেষের দিকে আমাকে যখন ভ্রমণকাজে নিযুক্ত করা হয়, তখন আমি খুবই অবাক হই! দুই সপ্তাহ ধরে আমি বারমিঙ্গাম শহরে একজন অভিজ্ঞ সীমা অধ্যক্ষের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ লাভ করি আর বার্ব্রাকে আমার সঙ্গে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর, আমরা আমাদের কার্যভারের এলাকায় অর্থাৎ ল্যাঙ্কাশিরে ও চেশারে চলে যাই।
যিহোবার উপর আস্থা রাখা সবসময় সঠিক
১৯৬২ সালের আগস্ট মাসে ছুটি কাটানোর সময় আমরা শাখা অফিসের কাছ থেকে একটা চিঠি পাই। চিঠির সঙ্গে ছিল গিলিয়েড স্কুল-এ যোগ দেওয়ার আবেদনপত্র! বিষয়টা নিয়ে প্রার্থনা করার পর বার্ব্রা ও আমি আমাদের আবেদনপত্রগুলো পূরণ করি আর যেমনটা অনুরোধ করা হয়েছিল, তেমনই সেগুলো তাড়াতাড়ি শাখা অফিসে পাঠিয়ে দিই। পাঁচ মাস পর আমরা নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে গিয়ে গিলিয়েড-এর ৩৮তম ক্লাসে যোগ দিই, যেখানে দশ মাস ধরে বাইবেল সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া হয়।
গিলিয়েড-এ দেওয়া প্রশিক্ষণ আমাদের কেবল ঈশ্বরের বাক্য এবং তাঁর সংগঠন সম্বন্ধেই নয় কিন্তু আমাদের ভ্রাতৃসমাজ সম্বন্ধেও শিক্ষা দেয়। আমাদের বয়স তখন ২০-র কোঠার মাঝের দিকে আর আমরা ক্লাসের অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখি। প্রতিদিন আমাদের একজন নির্দেশক ভাই ফ্রেড রাস্কের সঙ্গে আমার বেথেলের কাজ করার সুযোগ থাকত। তিনি একটা যে-উল্লেখযোগ্য শিক্ষার উপর জোর দিতেন, তা হল সবসময় সঠিকভাবে পরামর্শ দেওয়া অর্থাৎ এই বিষয়ে নিশ্চিত করা যে, যে-পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, সেটা পুরোপুরি শাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের ক্লাস চলাকালীন যে-অভিজ্ঞ ভাইয়েরা বক্তৃতা দিতেন, তাদের মধ্যে কয়েক জনের নাম হল ভাই নেথেন নর, ফ্রেডরিক ফ্রাঞ্জ এবং কার্ল ক্লাইন। আর আমরা একজন নম্র ভাই, এ. এইচ. ম্যাকমিলানের উদাহরণ থেকে অনেক কিছু শিখি, যিনি আমাদের শেখান যে, ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৯ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত সংগঠনের ভাইয়েরা যখন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়, তখন কীভাবে যিহোবা সেই কঠিন সময় তাঁর লোকদের সাহায্য করেন।
আমাদের কার্যভার পরিবর্তন হয়
গিলিয়েড-এর প্রশিক্ষণের শেষের দিকে ভাই নর আমাকে ও বার্ব্রাকে জানান, আমাদের আফ্রিকার বুরুন্ডিতে কার্যভার দেওয়া হবে। আমরা তাড়াতাড়ি করে বেথেলের লাইব্রেরিতে গিয়ে বর্ষপুস্তক (ইংরেজি) থেকে খুঁজে বের করি যে, বুরুন্ডিতে কত জন প্রকাশক রয়েছে। অবাক করার মতো বিষয় হল আমরা কোথাও সেই দেশের প্রকাশকদের সংখ্যা খুঁজে পাই না! এর অর্থ হল আমরা এমন এক দেশে যাচ্ছি, যেখানে তখনও প্রচার কাজ করা হয়নি আর তা এমন এক মহাদেশে অবস্থিত, যেটার বিষয়ে আমরা খুব কমই জানি। আমরা খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি! কিন্তু, আন্তরিক প্রার্থনা আমাদের শান্ত হতে সাহায্য করে।
আমাদের নতুন কার্যভারের এলাকায় সব কিছু আমাদের জন্য একেবারে নতুন ছিল—সেখানকার আবহাওয়া, সংস্কৃতি ও ভাষা। আমরা বুঝতে পারি, আমাদের ফ্রেঞ্চ ভাষা শিখতে হবে। এ ছাড়া, আমাদের থাকার জায়গা খুঁজে বের করতে অসুবিধা হয়। আমরা সেখানে পৌঁছানোর দুই দিন পর গিলিয়েড ক্লাসের একজন সহপাঠী, ভাই হ্যারি আরনাট জাম্বিয়াতে তার কার্যভারের এলাকায় ফিরে যাওয়ার সময় আমাদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি আমাদের একটা অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে পেতে সাহায্য করেন, যেটা আমাদের প্রথম মিশনারি হোম হয়ে ওঠে। শীঘ্রই, আমরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হই, যারা যিহোবার সাক্ষিদের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। আমরা সবেমাত্র আমাদের কার্যভার উপভোগ করতে শুরু করেছিলাম কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের জানান, কাজ করার বৈধ অনুমতিপত্র ছাড়া আমরা সেখানে থাকতে পারব না। দুঃখের বিষয় হল আমাদের সেই দেশ ছাড়তে হয় আর এক নতুন দেশ উগান্ডায় গিয়ে আবার সব কিছু শুরু করতে হয়।
আমরা কোনো ভিসা ছাড়াই উগান্ডায় যাওয়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম কিন্তু আমরা যিহোবার উপর আস্থা রাখি। কানাডার
একজন ভাই যেখানে বেশি প্রয়োজন, সেখানে সেবা করার জন্য উগান্ডায় সেবা করছিলেন। তিনি একজন ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে আমাদের পরিস্থিতি সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করেন আর তাই, আমাদের কয়েক মাসের সময় দেওয়া হয়, যাতে সেই সময়ের মধ্যে আমরা সেই দেশে থাকার অনুমতিপত্র লাভ করতে পারি। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, যিহোবা আমাদের সাহায্য করছেন।এই নতুন এলাকার পরিস্থিতি বুরুন্ডির চেয়ে একেবারে ভিন্ন ছিল। এই দেশে ইতিমধ্যেই প্রচার কাজ করা হচ্ছিল কিন্তু সারা দেশে মাত্র ২৮ জন সাক্ষি ছিল। আমরা প্রচারের এলাকায় এমন অনেককে খুঁজে পাই, যারা ইংরেজি বলতে পারত। তবে, শীঘ্রই আমরা বুঝতে পারি, আগ্রহী ব্যক্তিদের উন্নতি করার জন্য সাহায্য করতে হলে আমাদের সেখানকার বিভিন্ন স্থানীয় ভাষার মধ্যে অন্তত একটা ভাষা শিখতে হবে। আমরা কাম্পালা এলাকায় প্রচার করতে শুরু করি, যেখানে অনেকে লুগান্ডা ভাষায় কথা বলত আর তাই, আমরা সেই ভাষা শেখার সিদ্ধান্ত নিই। এটা ঠিক যে, সাবলীলভাবে এই ভাষায় কথা বলার জন্য আমাদের বেশ কয়েক বছর লেগে যায়, তবে এটা আমাদের প্রচারের ক্ষেত্রে আরও কার্যকারী হতে সাহায্য করে। আমরা আরও ভালো করে বুঝতে সক্ষম হই যে, আমাদের বাইবেল ছাত্রদের কী শেখার প্রয়োজন রয়েছে। ফলে, তারাও হৃদয় খুলে আমাদের সঙ্গে কথা বলে এবং জানায় যে, তারা যে-বিষয়গুলো শিখছে, সেই সম্বন্ধে তারা কেমন অনুভব করে।
আমরা বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করি
আমরা লোকদের সত্য শেখার জন্য সাহায্য করে অনেক আনন্দ লাভ করি। আর এই আনন্দ সেইসময় আরও বৃদ্ধি পায়, যখন আমাদের সারা দেশে ভ্রমণ কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়। কেনিয়ার শাখা অফিসের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সারা দেশে ভ্রমণ করে এমন এলাকাগুলো খুঁজে বের করি, যেখানে বিশেষ অগ্রগামীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রয়েছে। বেশ কয়েক বার এমন ব্যক্তিরা আমাদের প্রতি উল্লেখযোগ্য আতিথেয়তা দেখায়, যাদের সঙ্গে আগে কখনো কোনো সাক্ষির দেখা হয়নি। তারা আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে সাহায্য করে আর এমনকী আমাদের জন্য খাবার প্রস্তুত করে।
এরপর এক ভিন্ন ধরনের ভ্রমণ করতে হয়। কাম্পালা থেকে ট্রেন ধরে দু-দিন যাত্রা করে আমি কেনিয়ার মামবাসা নামে এক বন্দরে যাই আর তারপর জাহাজে চড়ে ভারত মহাসাগরে অবস্থিত সেশেলজ্ নামে এক দ্বীপপুঞ্জে যাই। পরে ১৯৬৫ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বার্ব্রা আমার সঙ্গে নিয়মিতভাবে সেশেলজ্ দ্বীপপুঞ্জে যায়। শুরুতে সেখানে মাত্র দু-জন প্রকাশক ছিলেন কিন্তু পরে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রথমে একটা দল এবং পরবর্তী সময় একটা মণ্ডলী গঠিত হয়। অন্যান্য ভ্রমণে আমার এরিট্রিয়া, ইথিওপিয়া ও সুদানের ভাইদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়।
উগান্ডায় এক সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পালটে যায়। পরবর্তী বছরগুলোতে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি দেখা দেয় আর আমি এটা শিখি যে, ‘কৈসরের যা, তা কৈসরকে দেওয়ার’ নির্দেশনা পালন করা সবচেয়ে ভালো। (মার্ক ১২:১৭) একবার, উগান্ডায় বসবাসরত সমস্ত বিদেশিকে তাদের বাড়ির সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থিত পুলিশ স্টেশনে নাম লেখাতে বলা হয়। আমরা সঙ্গেসঙ্গে সেই অনুযায়ী কাজ করি। কয়েক দিন পর কাম্পালা এলাকায় গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় কয়েক জন পুলিশ আমাকে এবং আরেকজন মিশনারি ভাইকে থামান। আমরা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই! তারা এই অভিযোগ করেন যে, আমরা গুপ্তচর আর তারা আমাদের প্রধান পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যান। সেখানে আমরা ব্যাখ্যা করি, আমরা মিশনারি আর আমরা শান্তিপ্রবণ ব্যক্তি। আমরা জানাই যে, আমরা ইতিমধ্যেই পুলিশ স্টেশনে নাম লিখিয়েছি, কিন্তু তারা আমাদের কথা শুনতে চায় না। আমাদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং মিশনারি হোমের সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থিত পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার কর্তৃপক্ষ, যিনি এটা জানতেন যে, আমরা আগেই নাম লিখিয়েছি, আমাদের চিনতে পারেন আর রক্ষীকে আমাদের ছেড়ে দিতে বলেন। আমরা অনেক স্বস্তি লাভ করি!
সেই দিনগুলোতে আমাদের প্রায়ই উদ্বিগ্নতার মুখোমুখি হতে হত কারণ সেনাবাহিনী রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি থামাত। আমরা বিশেষ করে সেইসময় ঘাবড়ে যেতাম, যখন তারা মাতাল হয়ে থাকত। তবে, প্রত্যেক বার আমরা প্রার্থনা করতাম আর
আমাদের যখন নিরাপদে চলে যেতে দেওয়া হত, তখন মনের শান্তি অনুভব করতাম। দুঃখের বিষয় হল ১৯৭৩ সালে উগান্ডার সমস্ত বিদেশি মিশনারিকে দেশ ছাড়তে বলা হয়।এরপর, আমাদের কার্যভার আবারও পরিবর্তন হয় আর এবার আমাদের পশ্চিম আফ্রিকার কোট ডিভোরে পাঠানো হয়। এটা আমাদের জন্য আরেকটা বড়ো পরিবর্তন ছিল। আমাদের পুরোপুরি নতুন এক সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়, আবারও সারাক্ষণ ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলতে হয় এবং বিভিন্ন পটভূমির মিশনারির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়! কিন্তু আবারও আমরা বুঝতে পারি, এই কাজের পিছনে যিহোবার হাত রয়েছে কারণ সেই এলাকার অনেক নম্র ও আন্তরিক ব্যক্তি সুসমাচারের প্রতি দ্রুত সাড়া দেয়। আমরা দু-জনেই দেখতে পাই যে, কীভাবে যিহোবার প্রতি আমাদের আস্থা আমাদের সমস্ত পথ সরল করে তুলেছে।
পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়
এরপর হঠাৎই বার্ব্রার ক্যান্সার ধরা পড়ে। আমরা বহু বার ইউরোপে ফিরে গিয়ে ওর চিকিৎসা করাই আর ১৯৮৩ সালে আমরা বুঝতে পারি, আমরা আর আফ্রিকায় আমাদের কার্যভার চালিয়ে যেতে পারব না। এটা আমাদের দু-জনের জন্য খুবই হতাশাজনক ছিল।
লন্ডন বেথেলে সেবা করার সময় বার্ব্রার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায় আর পরিশেষে ও মারা যায়। বেথেল পরিবার আমাকে অনেক উপায়ে সাহায্য করে। তাদের মধ্যে বিশেষ করে একটা দম্পতি আমাকে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে এবং যিহোবার উপর ক্রমাগত আস্থা রাখতে সাহায্য করে। পরবর্তী সময়, অ্যান নামে বেথেলের একজন কমিউটার বোনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি একসময় বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতেন এবং যিহোবার প্রতি তার গভীর ভালোবাসা ছিল। ১৯৮৯ সালে আমি ও অ্যান বিয়ে করি আর সেই সময় থেকে আমরা বেথেলেই সেবা করছি।
১৯৯৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমি বিশ্বপ্রধান কার্যালয়ের প্রতিনিধি (আগে আঞ্চলিক অধ্যক্ষ বলা হত) হিসেবে সেবা করার সুযোগ পেয়েছি আর এভাবে আমি প্রায় ৬০টা দেশে ভ্রমণ করেছি। প্রতিটা ভ্রমণে আমি দেখতে পেরেছি, কীভাবে যিহোবা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তাঁর লোকদের যত্ন নেন।
২০১৭ সালে একটা ভ্রমণের সময় আমি আবারও আফ্রিকায় যাই। আমি অ্যানকে প্রথম বার বুরুন্ডিতে নিয়ে যেতে পেরে খুবই আনন্দিত হই আর সেখানে কত লোক যে সত্যে এসেছে, তা দেখে আমরা দু-জনেই খুবই অবাক হয়ে যাই! ১৯৬৪ সালে আমি যে-রাস্তায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করেছিলাম, সেই রাস্তায়ই এখন একটা সুন্দর বেথেল রয়েছে। আর এখন সারা দেশে ১৫,৫০০-এরও বেশি প্রকাশক রয়েছে।
আমি যখন ২০১৮ সালের জন্য আমার ভ্রমণতালিকা পাই, তখন আমি অত্যন্ত খুশি হই। সেই তালিকায় বিভিন্ন দেশের নামের মধ্যে কোট ডিভোরও ছিল। আমরা যখন কোট ডিভোরের সবচেয়ে বড়ো শহর আবিজানে আসি, তখন মনে হয় যেন আমি বাড়ি ফিরে এসেছি। আমি বেথেলের ভাইদের টেলিফোন নম্বরের তালিকায় দেখি যে, আমরা যে-গেস্ট রুমে রয়েছি, সেটার পাশে যে-ভাই রয়েছেন, তার নাম হল ভাই সোসু। আমার মনে পড়ে, আমি যখন আবিজানে ছিলাম, তখন এই ভাই শহর অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করতেন। কিন্তু, পরে আমি জানতে পারি, বেথেলের এই ভাই আসলে সেই সোসু নয় বরং তার ছেলে।
যিহোবা তাঁর প্রতিজ্ঞা রেখেছেন। বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আমি শিখেছি যে, আমরা যখন যিহোবার উপর আস্থা রাখি, তখন তিনি সত্যিই আমাদের সমস্ত পথ সরল করে দেন। এখন আমি ক্রমাগত সেই পথে চলতে চাই, যেটা নতুন জগতে আরও দেদীপ্যমান অর্থাৎ উজ্জ্বল হবে।—হিতো. ৪:১৮.