জীবনকাহিনি
যিহোবার সেবায় এক পরিতৃপ্তিদায়ক জীবন
আমি ১৯৫১ সালে সবেমাত্র কানাডার কুইবেকের এক ছোটো শহর রুয়েনে এসে পৌঁছাই। আমাকে যে-ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল, সেখানে গিয়ে দরজায় নক করি। মার্সেল ফিলটো a নামে একজন গিলিয়েড মিশনারি এসে দরজা খোলেন। তার বয়স ২৩ বছর এবং তিনি খুব লম্বা; আমার বয়স ১৬ বছর এবং আমি লম্বায় তার চেয়ে অনেক ছোটো। আমি তাকে আমার অগ্রগামী কার্যভারের চিঠিটা দেখাই। তিনি সেটা পড়েন এবং আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, “তোমার মা কি জানেন, তুমি এখানে এসেছ?”
আমার পরিবারের সবাই একই ধর্মের ছিল না
আমার জন্ম হয় ১৯৩৪ সালে। আমরা বাবা-মা সুইজারল্যান্ড থেকে টিমিন্সে আসেন। এটা কানাডার ওন্টারিওর একটা শহর, যেখানে অনেক খনি রয়েছে। ১৯৩৯ সালের দিকে আমার মা প্রহরীদুর্গ পত্রিকা পড়তে এবং যিহোবার সাক্ষিদের সভাগুলোতে যোগ দিতে শুরু করে। সে আমাদের সাত ভাই-বোনকে নিয়ে সভাতে যেত। শীঘ্রই, সে একজন যিহোবার সাক্ষি হয়।
বাবা এতে মোটেও খুশি ছিল না। কিন্তু, সত্যের প্রতি মায়ের ভালোবাসা ছিল আর সে যিহোবার প্রতি অনুগত থাকার ব্যাপারে দৃঢ় ছিল। ১৯৪০ সালের শুরুর দিকে কানাডায় যিহোবার সাক্ষিদের কাজের উপর যখন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, এমনকী তখনও মা হাল ছেড়ে দেয়নি। যদিও বাবা মায়ের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করত, তবুও মা সবসময় বাবার প্রতি দয়া ও সম্মান দেখাত। তার চমৎকার উদাহরণ আমাকে এবং আমার ভাই-বোনদের সত্যকে আপন করে নিতে সাহায্য করে। আনন্দের বিষয় হল, বাবার মনোভাব পরিবর্তন হয় আর সে আমাদের সবার সঙ্গে ভালো আচরণ করতে শুরু করে।
আমি পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করি
১৯৫০ সালের আগস্ট মাসে আমি নিউ ইয়র্ক শহরে ঈশতান্ত্রিক বৃদ্ধি সম্মেলনে যোগ দিই। সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে ভাই-বোনেরা এসেছিল। তাদের সঙ্গে মেলামেশা করে এবং গিলিয়েড স্কুল থেকে যারা গ্র্যাজুয়েট করেছিল, তাদের চমৎকার সাক্ষাৎকার শুনে আমি আরও বেশি করে যিহোবার সেবা করার জন্য উৎসাহিত হই! আমি ঠিক করি, আমি পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করবই। তাই, বাড়ি ফেরার সঙ্গেসঙ্গে আমি নিয়মিত অগ্রগামী হওয়ার জন্য আবেদন করি। কানাডার শাখা অফিস থেকে আমাকে বলা হয় যেন আমি প্রথমে বাপ্তিস্ম নিই। ১৯৫০ সালের ১ অক্টোবর আমি বাপ্তিস্ম নিই। এর এক মাস পরেই আমি নিয়মিত অগ্রগামীর কাজ শুরু করি এবং কাপুসকেসিংয়ে প্রথম কার্যভার পাই। এই শহর আমার বাড়ি থেকে অনেক দূরে ছিল।
১৯৫১ সালের বসন্ত কালে শাখা অফিস থেকে বলা হয় যে, যারা ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলতে পারে, তারা চাইলে কুইবেকের ফ্রেঞ্চভাষী এলাকায় যেতে পারে। কারণ সেখানে
প্রকাশকদের খুব প্রয়োজন। আমি যেহেতু ছোটোবেলা থেকেই ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারি, তাই আমি সেখানে যাওয়ার জন্য রাজি হই আর আমাকে রুয়েনে কার্যভার দেওয়া হয়। আমি সেখানে কাউকে চিনতাম না। আমার কাছে কেবল ঠিকানা ছাড়া আর কিছুই ছিল না, যে-বিষয়ে আমি শুরুতে বলেছি। তবে, সব কিছু ভালোভাবেই চলছিল। মার্সেল এবং আমি খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠি আর আমরা আনন্দের সঙ্গে চার বছর কুইবেকে সেবা করি। শেষের দিকে আমি একজন বিশেষ অগ্রগামী হই।আমি গিলিয়েডে যোগ দিই এবং আমার আশা পূর্ণ হতে দেরি হয়
কুইবেকে থাকার সময় আমি যখন নিউ ইয়র্কের দক্ষিণ ল্যানসিংয়ে গিলিয়েড স্কুলের ২৬তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পাই, তখন আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। ১৯৫৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আমি গ্র্যাজুয়েট হই আর আমাকে পশ্চিম আফ্রিকার ঘানাতে b কার্যভার দেওয়া হয়। কিন্তু, সেখানে যাওয়ার আগে আমাকে কানাডায় ফিরে যেতে হয়, কারণ আমার কাগজপত্র তখনও ঠিক হয়নি। আমি মনে করেছিলাম, আমাকে হয়তো দুই-তিন সপ্তাহ সেখানে থাকতে হবে।
কিন্তু, সেই কাগজপত্রের জন্য আমাকে সাত মাস টরেন্টোতে অপেক্ষা করতে হয়। ওই সময়টাতে ভাই ক্রিপ্সের পরিবার আমাকে তাদের বাড়িতে থাকতে দেয় আর সেখানে তাদের মেয়ে শিলার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমরা প্রেমে পড়ে যাই। আমি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেব বলে ঠিক করি আর এমন সময় আমার ভিসা চলে আসে। শিলা ও আমি প্রার্থনা করে ঠিক করি, আমি ঘানায় যাব। তবে, আমরা সিদ্ধান্ত নিই, আমরা একে অপরকে চিঠি লিখব এবং অপেক্ষা করে দেখব, আমরা ভবিষ্যতে দু-জনে বিয়ে করব কি না। এই সিদ্ধান্ত সহজ ছিল না, কিন্তু পরে আমরা বুঝতে পারি, এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।
আমি ট্রেনে, মালবাহী জাহাজে এবং প্লেনে এক মাস ধরে যাত্রা করে অবশেষে ঘানার আক্রাতে আসি। সেখানে আমাকে জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমাকে ঘানার সমস্ত জায়গায় আর সেইসঙ্গে আইভরি কোস্ট (বর্তমানে কোট ডিভর) ও টোগোল্যান্ডে (বর্তমানে টোগো) যেতে হয়। বেশির ভাগ সময়ই আমাকে একা শাখা অফিসের জিপে করে যেতে হত। সেই সময়টাতে আমি প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করেছি!
প্রতি সপ্তাহের শেষে সীমা সম্মেলনগুলোতে আমার কার্যভার থাকত। আমাদের কোনো সম্মেলন হল ছিল না। তাই, ভাইয়েরা বাঁশ দিয়ে একটা ছাদ তৈরি করত আর রোদের গরম থেকে বাঁচার জন্য সেটার উপর গাছের পাতা দিয়ে দিত। সেখানে খাবারের জায়গায় কোনো রেফ্রিজারেটার ছিল না। তাই, ভাইয়েরা হাতের কাছে জীবিত পশুপাখি রাখত এবং সম্মেলনে উপস্থিত ব্যক্তিদের সেগুলো কেটে রান্না করে খেতে দিত।
সেই সম্মেলনগুলোতে মাঝে মাঝে হাস্যকর ঘটনা ঘটত। একবার ভাই হার্ব জেনিংগস্, c একজন সহ-মিশনারী, বক্তৃতা দিচ্ছিলেন আর এমন সময় একটা গরু ছুটে যায়। এটা মঞ্চ ও শ্রোতাদের মাঝখানে দৌড়াদৌড়ি করতে শুরু করে। ভাই হার্ব কথা বলা বন্ধ করে দেন। সেই গরুটাকে দেখে মনে হচ্ছিল যে, এটা বুঝতে পারছে না, কী করবে। তবে, চার জন শক্তিশালী ভাই সেটাকে কাবু করে আবার খাবারের জায়গায় নিয়ে যায়। এটা দেখে শ্রোতারা অনেক খুশি হয়।
সপ্তাহের দিনগুলোতে আমি কাছের গ্রামগুলোতে গিয়ে যিহোবার সংগঠন যেভাবে কাজ করে (ইংরেজি) শিরোনামের সিনেমা দেখাতাম। এটা দেখানোর জন্য আমাকে দুটো খুঁটি অথবা গাছের মাঝখানে একটা সাদা চাদর টাঙাতে হত। গ্রামের লোকেরা সেই সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসত! অনেকের কাছে এটাই ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে প্রথম সিনেমা। তারা যখন লোকদের বাপ্তিস্ম নেওয়ার দৃশ্য দেখত, তখন আনন্দের সঙ্গে জোরে জোরে হাততালি দিত। যারা এই সিনেমা দেখত, তারা বুঝতে পারত যে, যিহোবার সাক্ষিরা একতাবদ্ধ লোক এবং তারা সারা পৃথিবীতে রয়েছে।
আফ্রিকায় প্রায় দু-বছর থাকার পর আমি ১৯৫৮ সালের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে পেরে অনেক আনন্দিত হই, যেটা নিউ ইয়র্ক শহরে হয়েছিল। শিলা কুইবেকে বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করছিল। সে-ও ওই সম্মেলনে আসে আর তার সঙ্গে দেখা করতে পেরে আমি ভীষণ খুশি হই। আমরা এতদিন চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করেছি, তবে এবার সামনাসামনি দেখে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিই আর সে রাজি হয়। আমি ভাই নরকে d চিঠি লিখে জিজ্ঞেস করি, শিলা গিলিয়েড স্কুলে যোগ দিতে এবং পরে আমার সঙ্গে আফ্রিকায় সেবা করতে পারবে কি না। তিনি হ্যাঁ বলেন। অবশেষে শিলা ঘানায় আসে। আমরা ১৯৫৯ সালের ৩ অক্টোবর আক্রায় বিয়ে করি। আমরা বুঝতে পারি, যিহোবাকে জীবনে প্রথমে রেখেছি বলে তিনি সত্যিই আমাদের আশীর্বাদ করেছেন।
আমরা একসঙ্গে ক্যামেরুনে সেবা করি
১৯৬১ সালে আমাদের ক্যামেরুনে কার্যভার দেওয়া হয়। আমাকে নতুন শাখা অফিস তৈরি করার জন্য সাহায্য করতে বলা হয়, তাই আমি অনেক ব্যস্ত থাকি। যেহেতু আমাকে ক্যামেরুনের
কাজ দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়, এইজন্য আমাকে অনেক কিছু শিখতে হয়। এরপর ১৯৬৫ সালে আমরা জানতে পারি, শিলা গর্ভবতী। আমাদের কাছে বাবা-মা হওয়ার কথা কল্পনা করা অনেক কঠিন ছিল। আমরা যখন আনন্দের সঙ্গে আমাদের নতুন দায়িত্বের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি এবং কানাডায় ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করি, ঠিক তখনই একটা দুর্ঘটনা ঘটে।শিলার গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। ডাক্তার বলেন, আমাদের অজাত সন্তান ছেলে ছিল। যদিও এটা প্রায় ৫০ বছর আগের কথা, কিন্তু আমরা এখনও এটা ভুলতে পারিনি। এই ঘটনার কারণে যদিও আমরা খুব দুঃখ পেয়েছিলাম, কিন্তু আমরা বিদেশে সেবা করার কার্যভার চালিয়ে গিয়েছিলাম, যেটা আমাদের খুব ভালো লাগত।
রাজনৈতিক ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকার কারণে ক্যামেরুনের ভাই-বোনেরা প্রায়ই তাড়নার মুখোমুখি হত। বিশেষভাবে ভোটের সময় পরিস্থিতি অনেক কঠিন হয়ে পড়ত। ১৯৭০ সালের ১৩ মার্চ ঠিক সেটাই ঘটে, যেটা আমরা আশা করিনি; যিহোবার সাক্ষিদের কাজের উপর সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সরকার আমাদের নতুন শাখা অফিস বাজেয়াপ্ত করে, যেটা খুবই সুন্দর ছিল এবং যেখানে মাত্র পাঁচ মাস আগে আমরা এসেছিলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্ত মিশনারিকে—যাদের মধ্যে আমি আর শিলাও ছিলাম—সেই দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়। যেহেতু আমরা ভাই-বোনদের অনেক ভালোবাসতাম, তাই তাদের ছেড়ে চলে যাওয়া আমাদের জন্য কঠিন ছিল। আর সামনের দিনগুলোতে তাদের অবস্থা কেমন হবে, সেটা নিয়েও আমাদের অনেক চিন্তা হচ্ছিল।
পরের ছয় মাস আমরা ফ্রান্সের শাখা অফিসে থাকি। সেখান থেকে ক্যামেরুনের ভাই-বোনদের যত্ন নেওয়ার জন্য আমি আমার যথাসাধ্য করতে থাকি। সেই বছর ডিসেম্বর মাসে আমাদের নাইজেরিয়ার শাখা অফিসে কার্যভার দেওয়া হয়। নাইজেরিয়া শাখা অফিস তখন ক্যামেরুনের কাজ দেখাশোনা করতে শুরু করে। নাইজেরিয়ার ভাই-বোনেরা আমাদের আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করে আর আমরা আনন্দের সঙ্গে কয়েক বছর সেখানে সেবা করি।
আমাদের এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়
১৯৭৩ সালে আমাদের খুব কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শিলা গুরুতর অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করছিল। আমরা যখন এক আঞ্চলিক সম্মেলনের জন্য নিউ ইয়র্কে ছিলাম, তখন শিলা একেবারে ভেঙে পড়ে এবং আমাকে বলে: “আমি আর আমার কাজ চালিয়ে যেতে পারব না! আমি একেবারে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি এবং অসুস্থ হয়ে পড়েছি।” সে আমার সঙ্গে পশ্চিম আফ্রিকায় ১৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছিল। আমি তার বিশ্বস্ত সেবার জন্য অনেক গর্বিত, কিন্তু এখন আমাদের কিছু পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার পর এবং আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, আমরা কানাডায় ফিরে যাব। সেখানে আমরা আরও ভালো চিকিৎসা পাব। আমাদের মিশনারি কার্যভার এবং পূর্ণসময়ের সেবা ছেড়ে যাওয়া আমাদের জন্য সত্যিই সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল।
কানাডায় ফিরে যাওয়ার পর আমি আমার এক পুরোনো বন্ধুর গাড়ির দোকানে একটা কাজ পাই। উত্তর টরেন্টোর একটা শহরে তার এই দোকানে সে গাড়ি বিক্রি করত। আমরা একটা ঘর ভাড়া নিই এবং ব্যবহার করা কিছু আসবাবপত্র কিনি। এতে করে আমরা কোনোরকম ঋণ না করেই নতুন জীবন শুরু করতে পারি। আমরা আমাদের জীবনকে সাদাসিধে রাখি, এই আশায় যে, একদিন হয়তো আমরা আবারও পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করতে পারব। খুব শীঘ্রই আমাদের সেই আশা পূর্ণ হয়।
আমরা এতে অনেক অবাক হয়ে যাই কারণ আমরা এতটা তাড়াতাড়ি আশা করিনি।আমি প্রতি শনিবার অন্টারিওর নরভালে নতুন সম্মেলন হল নির্মাণের কাজে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে শুরু করি। পরে আমাকে সম্মেলন হল দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। যেহেতু শিলার স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে থাকে, তাই আমরা মনে করি যে, এখন সে এই নতুন কার্যভার পালন করতে পারবে। আমরা ১৯৭৪ সালের জুন মাসে সম্মেলন হলে যে-ঘর আছে, সেখানে থাকার জন্য যাই। আবার পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করতে পেরে আমরা ভীষণ খুশি হই!
শিলার স্বাস্থ্যের অবস্থা দিন দিন আরও ভালো হতে থাকে। দু-বছর পর আমাদের সীমার কাজ করার কার্যভার দেওয়া হয় আর আমরা তা গ্রহণ করি। আমাদের সীমার এলাকা ছিল কানাডার ম্যানিটোভা। এই এলাকা হাড়-কাঁপানো শীতের জন্য পরিচিত ছিল। তবে, আমরা সেখানাকার ভাই-বোনদের উষ্ণ ভালোবাসা পুরোপুরিভাবে উপভোগ করি। আমরা শিখতে পেরেছি যে, আমরা কোথায় সেবা করি, সেটা বড়ো বিষয় নয়; কিন্তু, আমরা যেখানেই থাকি না কেন, সেখানে যিহোবার সেবা চালিয়ে যাওয়াই হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমি এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা লাভ করি
বেশ কয়েক বছর সীমার কাজ করার পর ১৯৭৮ সালে আমাদের কানাডার বেথেলে সেবা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। খুব শীঘ্রই আমি একটা কঠিন, তবে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা লাভ করি। মনট্রিলে এক বিশেষ সভায় আমাকে ফ্রেঞ্চ ভাষায় দেড় ঘণ্টার একটা বক্তৃতা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুঃখের বিষয় হল, আমার বক্তৃতা শ্রোতাদের জন্য বোঝা কঠিন ছিল। তাই, পরিচর্যা বিভাগের একজন ভাই এই বিষয়টা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেন। সত্যি বলতে কী, বিষয়টা আমি তখন বুঝতে পারিনি। তবে এখন বুঝতে পারছি যে, আমি আসলে খুব ভালো বক্তা নই। যাই হোক, তার পরামর্শ আমি ভালোভাবে নিইনি। আমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। আর আমার মনে হয়েছিল, তিনি অতিরিক্ত দোষ ধরেন এবং প্রশংসা করতে পারেন না। আসলে আমার ভুল ছিল যে, আমাকে কী পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করিনি; বরং আমাকে কীভাবে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এবং কে আমাকে পরামর্শ দিয়েছে, সেটা নিয়ে আমি বেশি চিন্তা করেছি।
কিছু দিন পরে, শাখা কমিটির একজন ভাই বিষয়টা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেন। আমি ভাইয়ের কাছে স্বীকার করি যে, সেই পরামর্শ আমি ভালোভাবে নিইনি আর তাই আমি দুঃখিত। পরে আমি সেই ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলি, যিনি আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে সদয়ভাবে ক্ষমা করেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি শিখতে পেরেছি যে, নম্র হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর এই শিক্ষা আমি কখনো ভুলব না। (হিতো. ১৬:১৮) আমি বিষয়টা নিয়ে অনেক বার যিহোবার কাছে প্রার্থনা করেছি আর আমি এই সংকল্প নিয়েছি যে, কেউ যখন আমাকে পরামর্শ দেবে, তখন আমি কখনো সেটাকে খারাপভাবে নেব না।
আমি ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কানাডার বেথেলে সেবা করছি আর ১৯৮৫ সাল থেকে শাখা কমিটিতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমার প্রিয় স্ত্রী শিলা মারা যায়। তাকে হারানোর বেদনার পাশাপাশি আমাকে আমার স্বাস্থ্যগত সমস্যার সঙ্গেও লড়াই করতে হচ্ছে। কিন্তু, যিহোবার সেবায় আমি এত ব্যস্ত এবং আনন্দিত যে, আমি ‘আয়ুর দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকাই না।’ (উপ. ৫:২০, বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারশন) যদিও আমাকে অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে কিন্তু সেগুলোর চেয়ে আমার আনন্দ আরও অনেক বেশি। যিহোবাকে জীবনে প্রথমে রাখা এবং ৭০ বছর ধরে পূর্ণসময়ের সেবা উপভোগ করা সত্যিই পরিতৃপ্তিদায়ক। আমি প্রার্থনা করি যেন আমাদের অল্পবয়সি ভাই-বোনেরাও যিহোবাকে জীবনে প্রথমে রাখে। কারণ আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, তারাও এক পরিতৃপ্তিদায়ক জীবন লাভ করবে, যা কেবল যিহোবাকে সেবা করার মাধ্যমেই পাওয়া যায়।
a ভাই মার্সেল ফিলটোর জীবনকাহিনি পড়ার জন্য ২০০০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রহরীদুর্গ পত্রিকায় “যিহোবা আমার আশ্রয় ও বল” শিরোনামের প্রবন্ধটা দেখুন।
b ১৯৭৫ সালের আগে পর্যন্ত আফ্রিকা ব্রিটিশ কলোনির গোল্ড কোষ্ট নামে পরিচিত ছিল।
c ভাই হার্বার্ট জেনিংগসের জীবনকাহিনি পড়ার জন্য ২০০০ সালের ১ ডিসেম্বর প্রহরীদুর্গ পত্রিকায় “তোমরা ত কল্যকার তত্ত্ব জান না; তোমাদের জীবন কি প্রকার?” শিরোনামের প্রবন্ধটা দেখুন।
d ভাই নেথেন এইচ. নর সেই সময় আমাদের কাজে নেতৃত্ব নিচ্ছিলেন।