সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

জীবনকাহিনি

আমি দান করার মধ্যে সুখ খুঁজে পেয়েছি

আমি দান করার মধ্যে সুখ খুঁজে পেয়েছি

বারো বছর বয়সে আমি প্রথম উপলব্ধি করি, আমার কাছে দান করার মতো মূল্যবান কিছু রয়েছে। একটা সম্মেলনের সময় একজন ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি প্রচার করতে চাই কি না। আগে আমি কখনোই প্রচার করিনি। তা সত্ত্বেও, আমি তাকে “হ্যাঁ” বলি। আমরা প্রচার এলাকায় যাই আর সেই ভাই আমাকে ঈশ্বরের রাজ্য সম্বন্ধে কিছু পুস্তিকা দেন। তিনি আমাকে বলেন: “তুমি রাস্তার ওই পাশের লোকেদের ঘরে যাও আর আমি এই পাশে যাই।” আমি ভয়ে ভয়ে একেকটা ঘরে যেতে শুরু করি আর আশ্চর্যের বিষয়টা হল, অল্পসময়ের মধ্যেই আমি সব পুস্তিকা অর্পণ করে ফেলি। স্পষ্টতই, আমি যা দান করছিলাম, তা অনেক লোকের প্রয়োজন ছিল।

ইংল্যান্ডের কেন্টের চ্যাটহ্যাম শহরে ১৯২৩ সালে আমার জন্ম হয় আর আমি এমন এক সময়ে বড়ো হই, যখন আমার আশেপাশের লোকেরা হতাশাগ্রস্ত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লোকেরা আরও উন্নত এক বিশ্ব গড়ে উঠবে বলে আশা করেছিল, কিন্তু তাদের সেই আশা পূরণ হয়নি। আমার বাবা-মাও ব্যাপটিস্ট পাদরিদের আচরণে হতাশ হয়েছিলেন, কারণ সেই পাদরিরা শুধু নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারেই আগ্রহী ছিল। আমার বয়স যখন প্রায় নয় বছর, তখন আমার মা আন্তর্জাতিক বাইবেল ছাত্র সংঘ-এর সদস্যরা যেখানে “ক্লাস” বা সভা করত, সেই হলে যেতে শুরু করেছিলেন। এই লোকেরা পরে যিহোবার সাক্ষি নাম গ্রহণ করেছিল। সেখানে একজন বোন উপস্থিত বাচ্চাদেরকে বাইবেল এবং ঈশ্বরের বীণা (ইংরেজি) বইয়ের উপর ভিত্তি করে বাইবেলভিত্তিক বিভিন্ন শিক্ষা দিয়েছিলেন। আমি যা শিখেছিলাম, সেগুলো আমার খুব ভালো লেগেছিল।

অভিজ্ঞ ভাইদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করি

কিশোর বয়সে, আমি ঈশ্বরের বাক্য থেকে লোকেদেরকে আশার বার্তা দান করে আনন্দ পেতাম। যদিও প্রায় সময়ই আমি একা একাই ঘরে ঘরে প্রচার করতাম, তবে আমি অন্যদের সঙ্গে প্রচার করার মাধ্যমে অনেক কিছু শিখেছি। উদাহরণ স্বরূপ, একদিন একজন অভিজ্ঞ ভাই ও আমি সাইকেল চালিয়ে প্রচারের এলাকায় যাওয়ার সময়, আমরা একজন পাদরির পাশ দিয়ে যাই। আমি তখন বলেছিলাম, “ওই যে, একটা ছাগ।” সেই ভাই তখন সাইকেল থেকে নেমে আমাকে তার সঙ্গে একটা গাছের গুঁড়িতে বসতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “কোন ব্যক্তি ছাগ, তা বিচার করার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে? লোকেদেরকে সুসমাচার জানিয়েই আমাদের সুখী থাকা উচিত আর বিচারের ভার যিহোবার উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।” অল্পবয়সেই আমি দান করার সুখ সম্বন্ধে অনেক কিছু শিখেছিলাম।—মথি ২৫:৩১-৩৩; প্রেরিত ২০:৩৫.

আরেকজন অভিজ্ঞ ভাই আমাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, দান করার মধ্যে সুখ খুঁজে পাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে আমাদের কষ্টের মধ্যে ধৈর্য বজায় রাখতে হবে। সেই ভাইয়ের স্ত্রী যিহোবার সাক্ষিদের পছন্দ করতেন না। একবার, ভাই আমাকে তার ঘরে চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ভাই প্রচারে গিয়েছেন বলে তার স্ত্রী এতটাই রেগে ছিলেন যে, তিনি আমাদের দিকে টি ব্যাগগুলো ছুড়ে মেরেছিলেন। স্ত্রীকে বকাঝকা করার পরিবর্তে ভাই হাসিমুখে টি ব্যাগগুলো জায়গামতো রেখে দিয়েছিলেন। এই ঘটনার অনেক বছর পর, ভাইয়ের স্ত্রী যখন একজন যিহোবার সাক্ষি হয়েছিলেন, তখন সেই ভাই তার ধৈর্যের পুরস্কার লাভ করেছিলেন।

অন্যদেরকে ভবিষ্যতের আশা সম্বন্ধে জানানোর বিষয়ে আমার আকাঙ্ক্ষা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে ডোভারে আমার মা ও আমি বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম। ব্রিটেন ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। সেই সময়ে আমার বয়স ছিল ১৬ বছর। ১৯৪০ সালের জুন মাসে আমাদের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আমি হাজার হাজার হতবিহ্বল সৈন্যকে ট্রাকে করে যেতে দেখেছিলাম। তারা ডানকির্ক যুদ্ধ থেকে রক্ষা পেয়েছিল। আমি তাদের দৃষ্টিতে আশার কোনো চিহ্ন দেখতে পাইনি। তাই, আমার মধ্যে তখন তাদের কাছে ঈশ্বরের রাজ্যের বিষয়ে জানানোর আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল। সেই বছরের শেষের দিকে, জার্মানরা ব্রিটেনে বোমা ফেলতে শুরু করেছিল। প্রতি রাতে আমি দেখতাম, জার্মান সামরিক বাহিনীর বোমারু বিমানগুলো আমাদের এলাকার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। বোমার শোঁ শোঁ আওয়াজ আর সেগুলো ফাটার প্রচণ্ড শব্দে ভয়ে বুক কেঁপে উঠত। পরদিন সকালে আমরা যখন ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে যেতাম, তখন দেখতাম, পুরো এলাকার ঘরবাড়ি তছনছ হয়ে গিয়েছে। এসব দেখে আমি আরও বেশি উপলব্ধি করেছিলাম, রাজ্যই আমার ভবিষ্যতের একমাত্র আশা।

আমি দান করার এক জীবন শুরু করি

১৯৪১ সালে আমি এমন এক জীবনযাপন করতে শুরু করেছিলাম, যা আমাকে সত্যিকার অর্থেই সুখী হতে সাহায্য করেছিল। আমি চ্যাটহ্যামের রয়াল ডকইয়ার্ড-এ জাহাজ নির্মাণের শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছিলাম। এই কাজে দারুণ সুযোগসুবিধা ছিল। যিহোবার দাসেরা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল, খ্রিস্টানদের অন্যান্য জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা উচিত নয়। ১৯৪১ সালের মধ্যে আমরা এটা বুঝতে পারি, আমাদের অস্ত্র কারখানায় কাজ করা উচিত নয়। (যোহন ১৮:৩৬) যেহেতু ডকইয়ার্ডে বা জাহাজঘাটায় সাবমেরিন নির্মাণ করা হতো, তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পূর্ণসময়ের পরিচর্যা শুরু করব। আমার প্রথম কার্যভার ছিল কাটস্‌ওয়োল্ডজের সাইরেনসেস্টার নামে ছবির মতো সুন্দর এক শহরে।

আমার বয়স যখন ১৮ বছর, তখন আমি সামরিক বাহিনীতে কাজ করতে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। তাই, আমাকে নয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আমাকে যখন প্রথম বার একটা কক্ষে একাকী রেখে সেই কক্ষের দরজা সজোরে বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু শীঘ্রই কারারক্ষী ও অন্যান্য বন্দিরা আমাকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করেছিল, কেন আমাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমি তখন আনন্দের সঙ্গে আমার বিশ্বাস সম্বন্ধে তাদের কাছে ব্যাখ্যা করেছিলাম।

কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর, আমাকে ভাই লেনার্ড স্মিথের * সঙ্গে আমার নিজের এলাকা কেন্টের বিভিন্ন শহরে প্রচার করতে বলা হয়েছিল। ১৯৪৪ সাল থেকে, বোমা বোঝাই করা এক হাজারেরও বেশি চালকবিহীন জেট প্লেন কেন্টের উপর এসে পড়েছিল। আমরা ঠিক সেই জায়গায় থাকতাম, যেখান দিয়ে নাতসিদের দখলে থাকা ইউরোপ ও লন্ডনের মধ্যে এই প্লেনগুলো চলাচল করত। এগুলোকে উড়ুক্কু বোমা বলা হতো। এটা এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা ছিল কারণ যখনই আপনি শুনতে পাবেন, ইঞ্জিনটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে—যা আমরা প্রায়ই শুনতাম—তখনই আপনি বুঝে যাবেন, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্লেনটা মাটিতে পড়ে বোমা বিস্ফোরণ হবে। সেই সময়ে, আমরা পাঁচ সদস্যের একটা পরিবারের সঙ্গে অধ্যয়ন করতাম। কখনো কখনো, আমরা একটা লোহার টেবিলের নীচে বসে অধ্যয়ন করতাম। সেই টেবিলটা এমনভাবে বানানো হয়েছিল, যেন বাড়ি ভেঙে পড়লেও তারা সুরক্ষিত থাকে। সেই পরিবারের সকলে অবশেষে বাপ্তিস্ম নিয়েছিল।

বিদেশে সুসমাচার জানাই

আয়ার্ল্যান্ডে অগ্রগামী সেবা করার শুরুর দিকে একটা সম্মেলনের বিজ্ঞাপন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি (নীচে)

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, আমি আয়ার্ল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে দু-বছর অগ্রগামী সেবা করেছিলাম। ইংল্যান্ড থেকে আয়ার্ল্যান্ড কতটা আলাদা সেই বিষয়ে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে বলতাম, আমরা মিশনারি আর অনুরোধ করতাম, তাদের ঘরে আমরা থাকতে পারব কি না। এ ছাড়া, আমরা রাস্তায় লোকেদেরকে আমাদের পত্রিকা দিতাম। অনেকে মনে করেছিল, ক্যাথলিক প্রধান একটা দেশে এইরকম কাজ করা একেবারেই “অর্থহীন!” একজন ব্যক্তি যখন মারমুখী আচরণ করেছিলেন, তখন আমরা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছিলাম। সেই পুলিশ বলেছিলেন, “আপনারা আর কী আশা করেন?” যাজকদের যে প্রচুর ক্ষমতা ছিল, তা আমরা বুঝতে পারিনি। লোকেরা যদি আমাদের কাছ থেকে বই নিত, তা হলে যাজকরা তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করার ব্যবস্থা করত। এ ছাড়া, আমরা যেখানে ভাড়া থাকতাম, সেখান থেকেও তারা আমাদের বের করে দিয়েছিল।

শীঘ্রই আমরা বুঝতে পারি, নতুন কোনো এলাকায় পৌঁছানোর পর, আমরা যেখানে থাকি, সেখান থেকে সাইকেল চালিয়ে যথেষ্ট দূরে গিয়ে এমন কোনো এলাকায় প্রচার করা ভালো, যে-এলাকাটা অন্য যাজকের অধীনে রয়েছে। সব শেষে, আমরা নিজেদের এলাকার কাছাকাছি ঘরে যেতাম। কিলকেনিতে উগ্র জনতার হুমকি সত্ত্বেও আমরা একজন যুবকের সঙ্গে সপ্তাহে তিন বার অধ্যয়ন করতাম। বাইবেলের সত্য শিক্ষা দিতে আমার খুব ভালো লাগত আর তাই আমি ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অভ্‌ গিলিয়েড-এ একজন মিশনারি হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলাম।

পালতোলা নৌকা সিবিয়া ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত আমাদের মিশনারি হোম ছিল (ডানে)

নিউ ইয়র্কে পাঁচ মাসের কোর্স করার পর, আমাদের চার জন গিলিয়েড গ্র্যাজুয়েটকে ক্যারিবিয়ান সাগরের ছোটো ছোটো দ্বীপে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের নভেম্বর মাসে আমরা নিউ ইয়র্ক সিটি ছেড়ে ১৮ মিটার (৫৯ ফুট) লম্বা একটা পালতোলা নৌকায় চড়ে বিদেশে যাত্রা করেছিলাম। সেই নৌকার নাম ছিল সিবিয়া। এর আগে আমি কখনো সমুদ্রে ভ্রমণ করিনি আর তাই আমি খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম। গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে একজন ছিলেন গাস্ট মেকি, যিনি একজন অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি আমাদেরকে নাবিকের কাজ সম্বন্ধে কিছু মৌলিক ধারণা দিয়েছিলেন যেমন, কীভাবে বিভিন্ন ধরনের পাল তুলতে ও নামাতে হয়, কীভাবে কম্পাস ব্যবহার করে অবস্থান ঠিক রাখতে হয় আর কীভাবে বাতাসের বিপরীতে নৌকা চালাতে হয়। গাস্ট দক্ষতার সঙ্গে ৩০ দিন ধরে আমাদের নৌকাটা চালিয়েছিলেন আর মারাত্মক ঝড় সত্ত্বেও আমরা বাহামাতে পৌঁছেছিলাম।

“উপকূল সমূহে তাহা প্রচার কর”

বাহামার ছোটো ছোটো দ্বীপে কয়েক মাস ধরে প্রচার করার পর, আমরা লিওয়ার্ড দ্বীপপুঞ্জ ও উইন্ডওয়ার্ড দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলাম। এই দ্বীপগুলো পুয়ের্টো রিকোর কাছাকাছি ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ থেকে ত্রিনিদাদের কাছাকাছি পর্যন্ত প্রায় ৮০০ কিলোমিটার (৫০০ মাইল) এলাকাজুড়ে প্রসারিত ছিল। আমরা পাঁচ বছর ধরে মূলত বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতে প্রচার করেছিলাম, যেখানে কোনো সাক্ষি ছিল না। মাঝে মাঝে এমন হয়েছে, আমরা কয়েক সপ্তাহ ধরে কোনো চিঠি পাইনি অথবা পাঠাতেও পারিনি। কিন্তু, বিভিন্ন উপকূলে বা দ্বীপে যিহোবার বাক্য প্রচার করতে পেরে আমরা কতই-না আনন্দিত ছিলাম!—যির. ৩১:১০.

সিবিয়া-র উপর মিশনারি নাবিকরা (বাম দিক থেকে ডান দিকে): রোনাল্ড পারকিন, ডিক রাইড, গাস্ট মেকি এবং স্ট্যানলি কার্টার

যখন আমরা কোনো উপসাগরে নোঙর ফেলতাম, তখন আমাদের দেখে দ্বীপবাসীরা বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠত এবং আমরা কারা তা জানার জন্য ঘাটে এসে জড়ো হতো। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কখনো পালতোলা নৌকা অথবা শ্বেতাঙ্গ মানুষ দেখেনি। দ্বীপবাসীরা বন্ধুত্বপরায়ণ ও ধর্মপ্রাণ ছিল আর বাইবেল সম্বন্ধে তাদের ভালো জ্ঞান ছিল। প্রায়ই তারা আমাদের তাজা মাছ, আভোকাডো আর বাদাম দিত। আমাদের ছোটো নৌকায় যদিও ঘুমানো, রান্না করা অথবা কাপড় কাচার জন্য যথেষ্ট জায়গা ছিল না, তবে আমরা কোনো-না-কোনোভাবে চালিয়ে নিতাম।

আমরা উপকূল ধরে এগিয়ে যেতাম এবং সারা দিন লোকেদের সঙ্গে দেখা করতাম। আমরা তাদের বলতাম, সেখানে একটা বাইবেলভিত্তিক বক্তৃতা দেওয়া হবে। তারপর, সন্ধ্যা বেলা আমরা নৌকার ঘণ্টা বাজাতাম। দ্বীপের অধিবাসীদের আসতে দেখে খুব ভালো লাগত। হাতে তেলের বাতি নিয়ে তারা যখন হেঁটে আসত, তখন তা দেখে মনে হতো, পাহাড় থেকে মিট মিট করে জ্বলা তারা নেমে আসছে। কখনো কখনো এক-শো লোক চলে আসত আর তারা রাত পর্যন্ত সেখানে থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করত। তারা গান গাইতে পছন্দ করত আর তাই আমরা কয়েকটা রাজ্যের গানের কথা টাইপ করে তাদের দিতাম। আমরা চার জন যখন যথাসম্ভব সুর করে গান গাওয়ার চেষ্টা করতাম, তখন লোকেরাও আমাদের সঙ্গে গলা মেলাত আর তা শুনতে খুবই ভালো লাগত। এটা কত আনন্দদায়ক এক সময়ই-না ছিল!

একটা বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করার পর, আমরা যখন পরবর্তী পরিবারের সঙ্গে অধ্যয়ন করার জন্য যেতাম, তখন ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের সঙ্গে সেই পরিবারের অধ্যয়নে যোগ দেওয়ার জন্য যেত। নির্দিষ্ট একটা জায়গায় কয়েক সপ্তাহ থাকার পর আমাদের সেখান থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে হতো। তবে আমরা প্রায়ই সেখানকার সবচেয়ে আগ্রহী ব্যক্তিদের অনুরোধ করতাম, যেন আমরা আবার সেখানে না আসা পর্যন্ত তারা অন্যদের সঙ্গে অধ্যয়ন চালিয়ে যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অনেক গুরুত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করত। তা দেখে আমাদের খুব ভালো লাগত।

যদিও এসব দ্বীপের অধিকাংশই এখন ব্যস্ত পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, তবে তখন সেগুলো ছিল নিরিবিলি এলাকা, যেখানে শুধু সাগরের নীল জল, বালুকাময় সৈকত ও পাম গাছ ছিল। আমরা সাধারণত এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে রাতের বেলা নৌকা চালিয়ে যেতাম। তখন আমাদের নৌকার পাশ দিয়ে ডলফিন সাঁতার কাটত আর আমরা শুধু জল কেটে নৌকা এগিয়ে চলার সাঁই সাঁই আওয়াজ শুনতে পেতাম। এ ছাড়া, শান্ত সমুদ্রে চাঁদের আলো পড়ে দিগন্ত পর্যন্ত রূপালি এক পথ তৈরি হতো।

পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জে প্রচার করার পর, আমরা পুয়ের্টো রিকোর উদ্দেশ্য যাত্রা করেছিলাম, যাতে আমাদের পালতোলা নৌকার পরিবর্তে একটা ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিতে পারি। সেখানে পৌঁছানোর পর, ম্যাক্সিন বয়েড নামে একজন সুন্দরী মিশনারির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। ছোটো বেলা থেকেই সে একজন উদ্যোগী সুসমাচার প্রচারক ছিল। পরবর্তী সময়ে, সে ডমিনিকান রিপাবলিকে একজন মিশনারি হিসেবে সেবা করেছিল। ১৯৫০ সালে ক্যাথলিক সরকার তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করার আগে পর্যন্ত, সে সেখানেই সেবা করেছিল। একজন নাবিক হিসেবে আমার শুধুমাত্র এক মাস পুয়ের্টো রিকোতে থাকার অনুমতি ছিল। শীঘ্রই আমাকে বিভিন্ন দ্বীপে যাত্রা করতে হবে এবং আরও কয়েক বছর দূরদূরান্তে থাকতে হবে। তাই আমি নিজেকে বুঝিয়েছিলাম, ‘রোনাল্ড, তুমি যদি এই মেয়েকে চাও, তা হলে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’ তিন সপ্তাহ পর আমি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম আর ছয় সপ্তাহ পর আমরা বিয়ে করেছিলাম। ম্যাক্সিন আর আমাকে পুয়ের্টো রিকোতে মিশনারি হিসেবে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। তাই বুঝতেই পারছেন, আমাকে আর সেই নতুন নৌকায় করে যাত্রা করতে হয়নি।

১৯৫৬ সালে, আমরা সীমার কাজ করতে শুরু করেছিলাম এবং বিভিন্ন মণ্ডলী পরিদর্শন করেছিলাম। ভাই-বোনদের মধ্যে অনেকে দরিদ্র ছিল, কিন্তু তাদের সঙ্গে দেখা করতে পেরে আমাদের ভালো লাগত। উদাহরণ স্বরূপ, পোটালা পাসটিল্লো গ্রামে দুটো সাক্ষি পরিবার ছিল। তাদের বেশ কয়েক জন সন্তান ছিল আর আমি তাদের বাঁশি বাজিয়ে শোনাতাম। আমি ইলডা নামে একটা ছোটো মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে আমাদের সঙ্গে প্রচারে যেতে চায় কি না। সে বলেছিল: “আমি যেতে চাই, কিন্তু যেতে পারব না। কারণ আমার কোনো জুতো নেই।” আমরা তাকে এক জোড়া জুতো কিনে দিয়েছিলাম আর এরপর সে আমাদের সঙ্গে প্রচারে গিয়েছিল। এই ঘটনার অনেক বছর পর, ১৯৭২ সালে আমি আর ম্যাক্সিন যখন ব্রুকলিন বেথেল দেখতে গিয়েছিলাম, তখন গিলিয়েড স্কুল থেকে সদ্য গ্র্যাজুয়েট হওয়া একজন বোন আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। সে তার কার্যভারের এলাকা ইকুয়েডরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। সে আমাদের বলেছিল: “আপনারা আমাকে চিনতে পারেননি, তাই-না? পাসটিল্লোর সেই ছোটো মেয়েকে মনে আছে, যার কোনো জুতো ছিল না? আমিই সেই মেয়ে।” সেই মেয়েটি হচ্ছে ইলডা! তখন আনন্দে আমাদের চোখে জল এসে গিয়েছিল!

১৯৬০ সালে, আমাদেরকে পুয়ের্টো রিকোর শাখা অফিসে সেবা করতে বলা হয়েছিল। সেই অফিসটা স্যানওয়ানের সানটুর্সে একটা ছোটো দোতলা বাড়িতে অবস্থিত ছিল। প্রথমে, লেনার্ট জনসন আর আমি অধিকাংশ কাজ করতাম। লেনার্ট ও তার স্ত্রী ছিলেন ডমিনিকান রিপাবলিকের প্রথম সাক্ষি। ১৯৫৭ সালে, তারা পুয়ের্টো রিকোতে এসেছিলেন। একটা সময়ে, ম্যাক্সিন সপ্তাহে এক হাজারেরও বেশি পত্রিকা, এর গ্রাহকদের কাছে পাঠানোর জন্য ব্যবস্থা করত। যারা পত্রিকা থেকে আধ্যাত্মিক খাদ্য পাবে, তাদের কথা চিন্তা করে সে এই কাজ উপভোগ করত।

আমি বেথেল সেবা উপভোগ করি কারণ এটা হচ্ছে নিজেকে দান করার এক জীবন। তবে এখানেও বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৬৭ সালে যখন পুয়ের্টো রিকোতে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়, তখন বিভিন্ন দায়িত্বের কারণে নিজেকে বিধ্বস্ত বলে মনে হয়েছিল। ভাই নেথেন নর, যিনি তখন যিহোবার সাক্ষিদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তিনি পুয়ের্টো রিকোতে এসেছিলেন। তিনি ভুলবশত এমনটা মনে করেছিলেন, আমি অতিথি মিশনারিদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করার বিষয়টাকে উপেক্ষা করেছি, যদিও আমি ইতিমধ্যে সেই কাজ করেছিলাম। পরে তিনি আমাকে সুশৃঙ্খল হওয়ার বিষয়ে দৃঢ়ভাবে পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, আমার কাজে তিনি হতাশ হয়েছেন। আমি তার সঙ্গে কোনো যুক্তিতর্ক করতে চাইনি, তবে আমার মনে হয়েছিল, আমাকে ভুলভাবে বিচার করা হয়েছে আর আমি কিছুটা সময় ধরে বিরক্ত হয়ে ছিলাম। কিন্তু, পরের বার যখন ভাই নরের সঙ্গে ম্যাক্সিন ও আমার দেখা হয়, তখন তিনি আমাদেরকে তার ঘরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং আমাদের জন্য খাবার রান্না করেছিলেন।

পুয়ের্টো রিকোতে থাকার সময় আমরা বেশ কয়েক বার ইংল্যান্ডে আমার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। মা এবং আমি যখন সত্য গ্রহণ করেছিলাম, তখন আমার বাবা সত্য গ্রহণ করেননি। তবে যখন বেথেল থেকে বক্তারা মণ্ডলীতে বক্তৃতা দিতে আসত, তখন আমার মা প্রায়ই তাদেরকে আমাদের ঘরে থাকতে দিতেন। আমার বাবা তখন বুঝতে পেরেছিলেন, অনেক বছর আগে যে-পাদরিদের আচরণের কারণে তিনি বিরক্ত হয়েছিলেন, তাদের বিপরীতে বেথেলের এই অধ্যক্ষরা খুবই নম্র। অবশেষে, ১৯৬২ সালে তিনি বাপ্তিস্ম নিয়ে একজন যিহোবার সাক্ষি হয়েছিলেন।

ম্যাক্সিনের সঙ্গে পুয়ের্টো রিকোতে আমাদের বিয়ের কিছুদিন পর এবং ২০০৩ সালে আমাদের ৫০তম বিবাহবার্ষিকীর সময়

২০১১ সালে আমি আমার প্রিয় স্ত্রী ম্যাক্সিনকে মৃত্যুতে হারিয়েছি। এখন আমি অধীর আগ্রহে তাকে পুনরুত্থিত হতে দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছি। এই বিষয়টা চিন্তা করে আমি কতই-না আনন্দিত হই! ৫৮ বছর ধরে একসঙ্গে থাকার সময়, ম্যাক্সিন ও আমি পুয়ের্টো রিকোতে যিহোবার লোকেদের সংখ্যা ৬৫০ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৬,০০০ হতে দেখেছি! এরপর, ২০১৩ সালে পুয়ের্টো রিকো শাখা অফিস যুক্তরাষ্ট্রের শাখা অফিসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আর আমাকে নিউ ইয়র্কের ওয়ালকিলে সেবা করতে বলা হয়েছিল। ৬০ বছর ধরে পুয়ের্টো রিকো দ্বীপে জীবনযাপন করার পর, কোকি নামে সেই এলাকার এক সুপরিচিত গেছো ব্যাঙের মতো নিজেকে আমার সেখানকার অধিবাসী বলেই মনে হতো। এই ব্যাঙ সন্ধ্যা বেলা ক-কি, ক-কি করে ডাকে। আমি যদিও সেখানে আনন্দিত ছিলাম, কিন্তু অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার সময় এসে গিয়েছিল।

“ঈশ্বর হৃষ্টচিত্ত দাতাকে ভাল বাসেন”

আমি এখনও বেথেল সেবা উপভোগ করছি। এখন আমার বয়স নব্বইয়ের উপরে আর এখানে আমার কাজ হচ্ছে, একজন আধ্যাত্মিক পালক হিসেবে বেথেল পরিবারের সদস্যদের উৎসাহিত করা। আমাকে জানানো হয়েছে, ওয়ালকিলে আসার পর ইতিমধ্যে ৬০০-শোরও বেশি ভাই-বোনের সঙ্গে আমি পালকীয় সাক্ষাৎ করেছি। যারা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের ব্যক্তিগত অথবা পারিবারিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে চায়। অন্যেরা আবার বেথেল সেবায় সফল হওয়ার জন্য পরামর্শ চায়। এ ছাড়া, সদ্যবিবাহিত দম্পতিরা বিবাহিত জীবনের বিষয়ে উপদেশ চায়। কাউকে কাউকে পুনরায় ক্ষেত্রে কার্যভার দেওয়া হয়েছে, তারাও পরামর্শ চায়। যারা আমার সঙ্গে কথা বলতে আসে, তাদের সবার কথা আমি মনোযোগ দিয়ে শুনি আর যদি উপযুক্ত হয়, তা হলে প্রায়ই তাদের বলি: “‘ঈশ্বর হৃষ্টচিত্ত দাতাকে ভাল বাসেন।’ তাই তুমি যে-সেবা করছ, তাতে সুখী থাকবে। কারণ তুমি যিহোবার জন্য এই সেবা করছ।”—২ করি. ৯:৭.

অন্যান্য জায়গায় সেবা করার মতো, বেথেল সেবায় সুখী হওয়ার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। তাই, আপনি যা করছেন, তা করা কেন গুরুত্বপূর্ণ, সেটার উপর আপনার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে হবে। বেথেলে আমরা যা-কিছু করি, সেই সবই হল পবিত্র সেবা। এখানে সেবা করার মাধ্যমে, “বিশ্বস্ত ও বুদ্ধিমান্‌ দাস” বিশ্বব্যাপী ভ্রাতৃসমাজের জন্য যে-আধ্যাত্মিক খাদ্য জুগিয়ে থাকে, সেই খাদ্য প্রস্তুত করায় সাহায্য করা যায়। (মথি ২৪:৪৫) আমরা যেখানেই যিহোবার সেবা করি না কেন, তাঁর প্রশংসা করার বিভিন্ন সুযোগ আমাদের রয়েছে। তিনি আমাদের যা-কিছু করতে বলেন, আসুন আমরা তা করি কারণ “ঈশ্বর হৃষ্টচিত্ত দাতাকে ভাল বাসেন।”

^ অনু. 13 লেনার্ড স্মিথের জীবনকাহিনি ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল প্রহরীদুর্গ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।