সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

“আমার রাজ্য এ জগতের নয়”

“আমার রাজ্য এ জগতের নয়”

“আমি . . . এই জন্য জগতে আসিয়াছি, যেন সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দিই।”—যোহন ১৮:৩৭.

গান সংখ্যা: ৫, ২৮

১, ২. (ক) কীভাবে এই জগৎ আরও বেশি বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে? (খ) এই প্রবন্ধে আমরা কোন প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে পারব?

ইউরোপের একজন বোন তার অতীতের বিষয়ে বলেন, ‘একেবারে ছোটো বয়স থেকেই আমি শুধু অবিচার দেখেছিলাম। তাই, আমি আমার দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম এবং এমন বিষয়গুলোকে সমর্থন করেছিলাম, যেগুলোকে অনেকে বিপ্লবী ধারণা বলে মনে করত। আমার এমনকী অনেক বছর ধরে একজন সন্ত্রাসীর সঙ্গে ভালোবাসা ছিল।’ আফ্রিকার একজন ভাই ব্যাখ্যা করেন যে, কেন তিনি একসময় খুবই দৌরাত্ম্যপূর্ণ ছিলেন: “আমি নিজের জাতিকে অন্যান্য জাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতাম আর তাই, আমি একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম। আমাদের বিরোধীদের আর এমনকী যারা আমার নিজের জাতির লোক হওয়া সত্ত্বেও অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করত, তাদের বর্শা দিয়ে হত্যা করতে শেখানো হয়েছিল।” ইউরোপে বসবাসকারী আরেকজন বোন স্বীকার করেন: “আমার মধ্যে ভেদাভেদের মনোভাব ছিল আর আমি ভিন্ন দেশের অথবা ধর্মের লোকেদের ঘৃণা করতাম।”

বর্তমানে, আরও বেশি লোকের মনোভাব ঠিক সেইরকমই, যেমনটা এই তিন জন ব্যক্তির একসময় ছিল। অনেক রাজনৈতিক দল স্বাধীনতা লাভ করার জন্য দৌরাত্ম্যের পথ বেছে নিচ্ছে। রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে লড়াই করা খুবই সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর অনেক দেশে লোকেরা আরও বেশি করে বিদেশিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে। ঠিক যেমনটা বাইবেলে ভবিষ্যদ্‌বাণী করা হয়েছিল, এই শেষকালে লোকেরা “ক্ষমাহীন [‘ঝগড়া করে আপোস না করার,’ বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারশন]” মনোভাব দেখায়। (২ তীম. ৩:১, ৩) জগৎ যেখানে আরও বেশি বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, সেখানে খ্রিস্টানরা কীভাবে একতাবদ্ধ থাকতে পারে? আমরা যিশুর উদাহরণ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি। তাঁর দিনের লোকেরাও তাদের মনের মধ্যে গেঁথে থাকা রাজনৈতিক মতামতের দ্বারা বিভক্ত ছিল। এই প্রবন্ধে আমরা তিনটে প্রশ্নের উত্তর জানতে পারব: কেন যিশু যেকোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত হওয়া প্রত্যাখ্যান করেছিলেন? কীভাবে যিশু দেখিয়েছিলেন যে, ঈশ্বরের লোকেদের রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে পক্ষ নেওয়া উচিত নয়? আর কীভাবে যিশু আমাদের শিখিয়েছিলেন যে, আমাদের কখনোই দৌরাত্ম্যের পথ বেছে নেওয়া উচিত নয়?

যিশু কি সেই লোকেদের সমর্থন করেছিলেন, যারা স্বাধীনতা লাভ করতে চেয়েছিল?

৩, ৪. (ক) যিশুর দিনে অনেক যিহুদি কী চেয়েছিল? (খ) কীভাবে লোকেদের এই অনুভূতি যিশুর শিষ্যদের প্রভাবিত করেছিল?

যিশু যে-যিহুদিদের কাছে প্রচার করেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকে রোমীয়দের হাত থেকে সত্যিই স্বাধীন হতে চেয়েছিল। জেলট নামে যিহুদিদের এক অত্যন্ত গোঁড়া রাজনৈতিক দল লোকেদের মধ্যে স্বাধীনতা পাওয়ার এই অনুভূতিকে আরও প্রবল করে তোলার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। জেলটদের মধ্যে অনেকে গালীলীয় যিহূদাকে অনুসরণ করেছিল, যিনি প্রায় যিশুর সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন। যিহূদা একজন ভাক্ত মশীহ ছিলেন, যিনি অনেক লোককে ভুল পথে পরিচালিত করেছিলেন। যিহুদি ইতিহাসবেত্তা জোসিফাস বলেছিলেন যে, যিহূদা রোমীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সেইসময়কার যিহুদিদের প্ররোচিত করেছিলেন এবং যারা রোমীয় সরকারকে কর দিতে রাজি হয়েছিল, তাদের “কাপুরুষ” বলে উল্লেখ করেছিলেন। রোমীয়রা পরিশেষে যিহূদাকে হত্যা করেছিল। (প্রেরিত ৫:৩৭) জেলটদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এমনকী দৌরাত্ম্যপূর্ণ কাজ করেছিল।

বেশিরভাগ যিহুদি মশীহের আগমনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিল। তারা ভেবেছিল যে, মশীহ এসে রোমীয়দের হাত থেকে তাদের স্বাধীন করবেন এবং ইস্রায়েলকে আবারও এক মহৎ জাতি করে তুলবেন। (লূক ২:৩৮; ৩:১৫) অনেকে মনে করেছিল যে, মশীহ পৃথিবীতে একটা রাজ্য স্থাপন করবেন আর তিনি সেটা ইস্রায়েলে করবেন। এমনটা হলে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় থাকা সমস্ত যিহুদি ইস্রায়েলে ফিরে আসবে। এমনকী যোহন বাপ্তাইজকও একবার যিশুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “যাহার আগমন হইবে, সেই ব্যক্তি কি আপনি? না আমরা অন্যের অপেক্ষায় থাকিব?” (মথি ১১:২, ৩) হতে পারে, যোহন এই বিষয়টা নিয়ে ভেবেছিলেন যে, যিহুদিদের স্বাধীন করার জন্য অন্য কেউ আসবে কি না। পরবর্তী সময়ে যিশুর পুনরুত্থানের পর, ইম্মায়ূতে যাওয়ার পথে যিশুর সঙ্গে তাঁর দু-জন শিষ্যের দেখা হয়েছিল। তারা বলেছিলেন, তাদের এই আশা ছিল যে, যিশুই ইস্রায়েলকে স্বাধীন করবেন। (পড়ুন, লূক ২৪:২১.) এর অল্পসময় পরই, প্রেরিতরা যিশুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “প্রভু, আপনি কি এই সময়ে ইস্রায়েলের হাতে রাজ্য ফিরাইয়া আনিবেন?”—প্রেরিত ১:৬.

৫. (ক) কেন গালীলের লোকেরা চেয়েছিল যে, যিশু তাদের রাজা হোক? (খ) কীভাবে যিশু তাদের চিন্তাভাবনাকে সংশোধন করেছিলেন?

যিহুদিরা আশা করেছিল যে, মশীহ এসে তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান করবেন। সম্ভবত এই কারণেই গালীলের লোকেরা চেয়েছিল যে, যিশু তাদের রাজা হোক। তারা নিশ্চয়ই ভেবেছিল, তিনি সবচেয়ে ভালো নেতা হবেন। তিনি একজন চমৎকার বক্তা ছিলেন আর তিনি অসুস্থদের সুস্থ করতে ও এমনকী ক্ষুধার্তদের জন্য খাবার জোগাতে পারতেন। একবার যিশু প্রায় ৫,০০০ জন পুরুষকে খাওয়ানোর পর লোকেরা খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিল। যিশু বুঝেছিলেন যে, তারা কী করতে চেয়েছিল। বাইবেল বলে: “যীশু বুঝিতে পারিলেন যে, তাহারা আসিয়া রাজা করিবার জন্য তাঁহাকে ধরিতে উদ্যত হইয়াছে, তাই আবার নিজে একাকী পর্ব্বতে চলিয়া গেলেন।” (যোহন ৬:১০-১৫) পরের দিন, লোকেরা হয়তো অনেকটা শান্ত হয়ে গিয়েছিল। তখন যিশু তাদের কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, তিনি তাদের বস্তুগত প্রয়োজনগুলো মেটানোর জন্য নয় বরং ঈশ্বরের রাজ্যের বিষয়ে তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য এসেছেন। তিনি তাদের বলেছিলেন: “নশ্বর ভক্ষ্যের নিমিত্ত শ্রম করিও না, কিন্তু সেই ভক্ষ্যের জন্য শ্রম কর, যাহা অনন্ত জীবন পর্য্যন্ত থাকে।”—যোহন ৬:২৫-২৭.

৬. কীভাবে যিশু এটা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, তিনি পৃথিবীতে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করতে চাননি? (শুরুতে দেওয়া ছবিটা দেখুন।)

যিশু তাঁর মৃত্যুর কিছুসময় আগে বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর অনুসারীদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে, তিনি রাজা হিসেবে যিরূশালেমে শাসন করতে শুরু করবেন। কিন্তু এমনটা যে হবে না, তা বুঝতে সাহায্য করার জন্য যিশু তাদের মুদ্রার দৃষ্টান্ত সম্বন্ধে বলেছিলেন। সেই দৃষ্টান্তে “ভদ্রবংশীয় এক ব্যক্তি” অর্থাৎ যিশুকে দীর্ঘ সময়ের জন্য অনেক দূরে এক জায়গায় যেতে হবে। (লূক ১৯:১১-১৩, ১৫) এ ছাড়া, যিশু রোমীয় আধিকারিক পন্তীয় পীলাতকে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, তিনি এই জগতের রাজনীতিতে কোনো পক্ষ নেন না। পীলাত যিশুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “তুমিই কি যিহূদীদের রাজা?” (যোহন ১৮:৩৩) পীলাত হয়তো এই ভেবে ভয় পেয়েছিলেন যে, যিশু রোমীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য লোকেদের পরিচালিত করবেন। কিন্তু উত্তরে যিশু বলেছিলেন: “আমার রাজ্য এ জগতের নয়।” (যোহন ১৮:৩৬) যিশু রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়া প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কারণ তাঁর রাজ্য স্বর্গে স্থাপিত হবে। তিনি বলেছিলেন যে, পৃথিবীতে তাঁর কাজ হল ‘সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়া।’—পড়ুন, যোহন ১৮:৩৭.

আপনার মনোযোগ কি জগতের সমস্যাগুলোর উপর কেন্দ্রীভূত, না কি ঈশ্বরের রাজ্যের উপর কেন্দ্রীভূত? (৭ অনুচ্ছেদ দেখুন)

৭. কেন এমনকী মনে মনেও রাজনৈতিক দলগুলোকে সমর্থন করা এড়িয়ে চলা কঠিন হতে পারে?

যিশু বুঝেছিলেন যে, তাঁর কার্যভার আসলে কী। আমরা যখন বুঝি যে, আমাদের কার্যভার আসলে কী, তখন আমরাও যেকোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করা এড়িয়ে চলি আর তা এমনকী মনে মনেও। এমনটা করা সবসময় সহজ নয়। একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ বলেন যে, তার এলাকার লোকেরা দিন দিন আরও বেশি উগ্র হয়ে উঠছে। তারা নিজেদের জাতির বিষয়ে খুবই গর্বিত আর তারা মনে করে যে, তাদের নিজেদের লোকেরা যদি তাদের উপর শাসন করে, তা হলে তাদের জীবন আরও ভালো হবে। তিনি আরও বলেন: “আনন্দের বিষয় হল, ভাইয়েরা ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার মাধ্যমে খ্রিস্টান হিসেবে তাদের একতাকে সুরক্ষিত রেখেছে। তারা আশা করে, তারা যে-অবিচার ও অন্যান্য সমস্যার মুখোমুখি হয়, সেগুলোর সমাধান ঈশ্বর করবেন।”

কীভাবে যিশু রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে নিরপেক্ষ থেকেছিলেন?

৮. যিশুর দিনে অনেক যিহুদি কোন অবিচার ভোগ করেছিল?

লোকেরা যখন তাদের চারিদিকে অবিচার ঘটতে দেখে, তখন প্রায়ই তারা আরও বেশি করে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়। যিশুর দিনে কর দেওয়া এমন এক বিতর্কিত বিষয় ছিল, যেটার কারণে রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে অনেকে ভিন্ন ভিন্ন পক্ষ নিয়েছিল। আসলে, গালীলীয় যিহূদা যে-কারণে রোমীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, সেটা হল রোমীয়রা লোকেদের নাম নথিভুক্ত করাচ্ছিল, যাতে তারা এই বিষয়টা নিশ্চিত করতে পারে যে, সবাই যেন কর দেয়। আর লোকেদের অনেক কিছুর জন্য কর দিতে হতো যেমন, বিষয়সম্পত্তি, জমি ও বাড়ি। এ ছাড়া, করগ্রাহীরা অত্যন্ত দুর্নীতিপরায়ণ ছিল আর এর ফলে, সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠেছিল। কখনো কখনো তারা অর্থ দিয়ে সরকারি আধিকারিকদের কাছ থেকে কোনো পদ কিনত আর তারপর, তাদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে অনেক অর্থ উপার্জন করত। যিরীহোর প্রধান করগ্রাহী সক্কেয় খুবই ধনী হয়ে উঠেছিলেন কারণ তিনি জোর করে লোকেদের কাছ থেকে বেশি অর্থ আদায় করতেন।—লূক ১৯:২, ৮.

৯, ১০. (ক) কীভাবে যিশুর শত্রুরা তাঁকে একটা রাজনৈতিক বিষয়ে জড়িত করার চেষ্টা করেছিল? (খ) যিশুর উত্তর থেকে আমরা কী শিখি? (শুরুতে দেওয়া ছবিটা দেখুন।)

যিশুর শত্রুরা তাঁকে কর দেওয়ার এই বিতর্কিত বিষয়ে জড়িত করার চেষ্টা করেছিল। তারা তাঁকে এক দীনারের একটা “কর” সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিল, যেটা সমস্ত যিহুদিকে দিতে হতো। (পড়ুন, মথি ২২:১৬-১৮.) যিহুদিরা এই কর দেওয়াকে সত্যিই ঘৃণা করত কারণ এটা তাদের স্মরণ করিয়ে দিত যে, রোমীয় সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণ করে। ‘হেরোদীয়রা’ অর্থাৎ হেরোদের রাজনৈতিক ধারণা সমর্থনকারী ব্যক্তিরা আশা করেছিল যে, যিশু যদি বলেন, তাদের সেই কর দেওয়া উচিত নয়, তা হলে তারা তাঁকে রোমীয় সাম্রাজ্যের শত্রু বলে অভিযুক্ত করতে পারবে। আবার অন্যদিকে যিশু যদি বলেন, তাদের সেই কর দিতে হবে, তা হলে লোকেরা হয়তো তাঁকে অনুসরণ করা বন্ধ করে দেবে। তাই, যিশু কী করেছিলেন?

১০ যিশু এই বিতর্কিত বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকার ক্ষেত্রে সতর্ক ছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “কৈসরের যাহা যাহা, কৈসরকে দেও, আর ঈশ্বরের যাহা যাহা, ঈশ্বরকে দেও।” (মথি ২২:২১) যিশু জানতেন যে, অনেক করগ্রাহী দুর্নীতিপরায়ণ ছিল কিন্তু তিনি সেটার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেননি। এর পরিবর্তে, তিনি মানবজাতির সমস্যাগুলোর প্রকৃত সমাধান, ঈশ্বরের রাজ্যের উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। যিশু আমাদের জন্য উদাহরণ স্থাপন করেছেন। আমাদের কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে পক্ষ নেওয়া উচিত নয় আর তা এমনকী তখনও, যখন একটা পক্ষকে সঠিক ও ন্যায্য বলে মনে হয় আর অন্য পক্ষকে ভুল ও অন্যায্য বলে মনে হয়। খ্রিস্টানরা ঈশ্বরের রাজ্যের উপর ও ঈশ্বর যেটাকে সঠিক বলেন, সেটার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে। এই কারণে অবিচারগুলোর বিষয়ে আমাদের কোনো জোরালো মতামত থাকে না অথবা আমরা সেগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলি না।—মথি ৬:৩৩.

১১. কীভাবে আমরা অন্যদের প্রকৃত ন্যায়বিচার খুঁজে পাওয়ার জন্য সাহায্য করতে পারি?

১১ যিহোবার সাক্ষিদের মধ্যে অনেকে তাদের মনে গেঁথে থাকা রাজনৈতিক মতামতগুলো সফলভাবে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। উদাহরণ স্বরূপ, গ্রেট ব্রিটেনের একজন বোন সত্য শেখার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতেন এবং তার মনে চরম রাজনৈতিক মতামত গড়ে উঠেছিল। তিনি বলেন: “আমি কৃষ্ণাঙ্গ লোকেদের অধিকারগুলোর পক্ষ সমর্থন করতে চেয়েছিলাম কারণ আমরা অনেক অবিচার ভোগ করেছি। যদিও আমি তর্কে জয়ী হওয়ায় খুবই পটু ছিলাম কিন্তু তা সত্ত্বেও, শেষে মনে হতো যেন আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমি এটা উপলব্ধি করতে পারিনি যে, জাতিগত অবিচারের কারণগুলো লোকেদের হৃদয় থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। কিন্তু, আমি যখন বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করেছিলাম, তখন আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে, আমাকে প্রথমে নিজের হৃদয় থেকে এগুলো উপড়ে ফেলতে হবে।” আগ্রহজনক বিষয় হল একজন শ্বেতাঙ্গ বোনই তাকে তার হৃদয়ের অনুভূতি পরিবর্তন করতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি আরও বলেন: “এখন আমি একটা সাংকেতিক ভাষার মণ্ডলীতে একজন নিয়মিত অগ্রগামী হিসেবে সেবা করছি আর আমি সমস্ত ধরনের লোককে সাহায্য করতে শিখছি।”

“তোমার খড়্গ পুনরায় স্বস্থানে রাখ”

১২. যিশু তাঁর শিষ্যদের কোন ধরনের ‘তাড়ী’ এড়িয়ে চলতে বলেছিলেন?

১২ যিশুর সময়ে ধর্মীয় নেতারা প্রায়ই রাজনৈতিক দলগুলোকে সমর্থন করত। উদাহরণ স্বরূপ, খ্রিস্টের সময়কার প্যালেস্টাইনে দৈনন্দিন জীবন (ইংরেজি) শিরোনামের বইটা বলে যে, যিহুদিরা বিভিন্ন ধর্মীয় দলে বিভক্ত ছিল, যেগুলো অনেকটা রাজনৈতিক দলগুলোর মতোই ছিল। তাই, যিশু তাঁর শিষ্যদের সতর্ক করেছিলেন: “সাবধান, তোমরা ফরীশীদের তাড়ীর বিষয়ে ও হেরোদের তাড়ীর বিষয়ে সাবধান থাকিও।” (মার্ক ৮:১৫) যিশু যখন হেরোদের বিষয়ে উল্লেখ করেছিলেন, তখন তিনি সম্ভবত হেরোদীয়দের কথা বলছিলেন। আরেকটা দল অর্থাৎ ফরীশীরা চেয়েছিল যেন যিহুদিরা রোমীয় সাম্রাজ্যের হাত থেকে স্বাধীন হয়। মথির বিবরণ অনুযায়ী যিশু সদ্দূকীদের বিষয়েও তাঁর শিষ্যদের সতর্ক করেছিলেন। সদ্দূকীরা চেয়েছিল যেন রোমীয়রা শাসন করে চলে কারণ এমনটা হলে তারা তাদের ক্ষমতা বজায় রাখতে পারবে। যিশু তাঁর শিষ্যদের এই তিনটে দলের ‘তাড়ী’ বা শিক্ষা এড়িয়ে চলার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। (মথি ১৬:৬, ১২) আর আগ্রহজনক বিষয় হল লোকেরা যিশুকে রাজা করতে চাওয়ার অল্পসময় পরই তিনি এই সতর্কবাণী দিয়েছিলেন।

১৩, ১৪. (ক) কীভাবে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়গুলো দৌরাত্ম্য ও অবিচারের দিকে পরিচালিত করেছিল? (খ) আমাদের প্রতি অবিচার করা হলেও কেন কখনোই দৌরাত্ম্যের পথ বেছে নেওয়া সঠিক নয়? (শুরুতে দেওয়া ছবিটা দেখুন।)

১৩ ধর্মগুলো যখন রাজনৈতিক বিষয়ে পক্ষ নেয়, তখন প্রায়ই তা দৌরাত্ম্যের দিকে পরিচালিত করে। যিশু তাঁর শিষ্যদের সম্পূর্ণরূপে নিরপেক্ষ থাকতে শিখিয়েছিলেন। এটা হল একটা কারণ যেজন্য প্রধান যাজক ও ফরীশীরা যিশুকে হত্যা করতে চেয়েছিল। তারা এই ভেবে ভয় পেয়েছিল যে, লোকেরা যিশুর কথা শুনবে এবং তাদের অনুসরণ করা বন্ধ করে দেবে। আর যদি এমনটা হয়, তা হলে তারা তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। তারা বলেছিল: “আমরা যদি ইহাকে এইরূপ চলিতে দিই, তবে সকলে ইহাতে বিশ্বাস করিবে; আর রোমীয়েরা আসিয়া আমাদের স্থান ও জাতি উভয়ই কাড়িয়া লইবে।” (যোহন ১১:৪৮) তাই, মহাযাজক কায়াফা যিশুকে হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিলেন।—যোহন ১১:৪৯-৫৩; ১৮:১৪.

১৪ কায়াফা রাত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন আর তারপর, যিশুকে গ্রেপ্তার করার জন্য সৈন্যদের পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু, যিশু এই ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে জানতেন। তাই, প্রেরিতদের সঙ্গে তাঁর শেষ ভোজের সময়ে তিনি তাদের কয়েকটা খড়্গ নিতে বলেছিলেন। তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেওয়ার জন্য দুটো খড়্গই যথেষ্ট হবে। (লূক ২২:৩৬-৩৮) পরে সেই রাতেই, এক দল লোক যিশুকে গ্রেপ্তার করতে এসেছিল এবং এই অবিচার দেখে পিতর এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে, তিনি খড়্গ বের করে সেই দলের মধ্যে একজনকে আঘাত করেছিলেন। (যোহন ১৮:১০) কিন্তু যিশু পিতরকে বলেছিলেন: “তোমার খড়্গ পুনরায় স্বস্থানে রাখ, কেননা যে সকল লোক খড়্গ ধারণ করে, তাহারা খড়্গ দ্বারা বিনষ্ট হইবে।” (মথি ২৬:৫২, ৫৩) যিশু তাঁর শিষ্যদের কোন জোরালো শিক্ষা দিয়েছিলেন? তারা যেন জগতের কোনো অংশ না হয়। যিশু সেই রাতে কিছুসময় আগেই এই বিষয়টা নিয়ে প্রার্থনা করেছিলেন। (পড়ুন, যোহন ১৭:১৬.) একমাত্র ঈশ্বরেরই অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার অধিকার রয়েছে।

১৫, ১৬. (ক) কীভাবে ঈশ্বরের বাক্য খ্রিস্টানদের দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলতে সাহায্য করেছে? (খ) যিহোবা যখন আজকের জগতের দিকে তাকান, তখন তিনি কোন পার্থক্য দেখতে পান?

১৫ একেবারে শুরুতে উল্লেখিত ইউরোপের সেই বোন এই একই বিষয় শিখেছিলেন। তিনি বলেন: “আমি দেখেছি, দৌরাত্ম্যপূর্ণ কাজ কখনো ন্যায়বিচার নিয়ে আসে না আর যারা দৌরাত্ম্যের পথ বেছে নেয়, তারা প্রায়ই তাদের প্রাণ হারায়। আবার অনেকে তিক্তবিরক্ত হয়ে যায়। আমি বাইবেল থেকে এটা জেনে খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম যে, একমাত্র ঈশ্বর এই পৃথিবীতে প্রকৃত ন্যায়বিচার নিয়ে আসতে পারেন। বিগত ২৫ বছর ধরে আমি এই বার্তাই প্রচার করে চলেছি।” আফ্রিকার সেই ভাই তার বর্শার পরিবর্তে “আত্মার খড়্গ” অর্থাৎ ঈশ্বরের বাক্য ব্যবহার করতে শিখেছেন। (ইফি. ৬:১৭) এখন তিনি সমস্ত ধরনের লোকের কাছে শান্তির বার্তা প্রচার করেন, তা তারা যে-জাতির লোকই হোক না কেন। আর ইউরোপের সেই আরেকজন বোন যিহোবার সাক্ষি হওয়ার পর এমন এক জাতির ভাইকে বিয়ে করেছেন, যে-জাতির লোকেদের তিনি আগে ঘৃণা করতেন। এই তিন জন ব্যক্তিই সেই পরিবর্তনগুলো করেছিলেন কারণ তারা খ্রিস্টের মতো হতে চেয়েছিলেন।

১৬ এই ধরনের পরিবর্তন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ! বাইবেল বলে যে, মানবজাতি হল এক অস্থির সমুদ্রের মতো, যেটা কখনোই শান্ত থাকে না। (যিশা. ১৭:১২; ৫৭:২০, ২১; প্রকা. ১৩:১) রাজনৈতিক বিষয়গুলো লোকেদের উত্তেজিত করে, বিভক্ত করে ও দৌরাত্ম্যের দিকে পরিচালিত করে। কিন্তু, আমরা শান্তিপূর্ণ ও একতাবদ্ধ। যিহোবা যখন দেখেন, জগতের লোকেরা কতটা বিভক্ত, তখন তিনি এটা দেখে নিশ্চয়ই খুবই আনন্দিত হন যে, তাঁর লোকেরা কতটা একতাবদ্ধ।—পড়ুন, সফনিয় ৩:১৭.

১৭. (ক) আমরা কোন তিনটে উপায়ে একতা বৃদ্ধি করতে পারি? (খ) পরবর্তী প্রবন্ধে আমরা কী বিবেচনা করব?

১৭ এই প্রবন্ধে আমরা শিখেছি যে, আমরা তিনটে উপায়ে একতা বৃদ্ধি করতে পারি: (১) আমরা আস্থা রাখি যে, ঈশ্বরের রাজ্য সমস্ত অবিচার দূর করবে, (২) আমরা কখনোই রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে পক্ষ নিই না এবং (৩) আমরা দৌরাত্ম্যের পথ বেছে নেওয়াকে প্রত্যাখ্যান করি। কিন্তু আরেকটা বিষয় রয়েছে, যেটা আমাদের একতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। সেটা কী? ভেদাভেদের মনোভাব। পরবর্তী প্রবন্ধে আমরা শিখব যে, কীভাবে প্রথম শতাব্দীর খ্রিস্টানদের মতো আমরা ভেদাভেদের মনোভাব কাটিয়ে উঠতে পারি।