জীবনকাহিনি
আমি খ্রিস্টকে অনুসরণ করার জন্য বিভিন্ন বিষয় ত্যাগ করেছি
“তুমি যদি প্রচারে যাও, তা হলে আর ফিরে আসবে না। ফিরে এলে পা ভেঙে দেব।” আমার বাবা আমাকে হুমকি দিয়ে এই কথাগুলো বলেছিলেন। তার কথা শুনে আমি বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। খ্রিস্টকে অনুসরণ করার জন্য বিভিন্ন বিষয় ত্যাগ করার ক্ষেত্রে সেটাই ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। সেইসময় আমার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর।
কীভাবে আমি এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম? আসুন, আমি আপনাদের নিজের জীবন সম্বন্ধে বলি। আমার জন্ম হয় ১৯২৯ সালের জুলাই মাসের ২৯ তারিখে আর আমি ফিলিপিনসের বুলাকান প্রদেশের একটা গ্রামে বড়ো হয়ে উঠি। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সেইসময় জীবন খুবই সাদাসিধে ছিল। আমি যখন অল্পবয়সি ছিলাম, তখন যুদ্ধ শুরু হয়। জাপানের সেনাবাহিনী ফিলিপিনসে প্রবেশ করে আক্রমণ করতে শুরু করে। তবে, আমাদের গ্রামটা যেহেতু তুলনামূলকভাবে একটা প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত ছিল, তাই আমরা সেই সংঘর্ষের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হইনি। আমাদের কাছে কোনো রেডিও কিংবা টেলিভিশন ছিল না এবং আমাদের এলাকায় খবরের কাগজও এসে পৌঁছাত না। তাই, আমরা কেবল লোকেদের মুখে মুখেই যুদ্ধের বিষয়ে জানতে পারতাম।
আমার বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে আমি হলাম দ্বিতীয় সন্তান। আমার বয়স যখন আট বছর, তখন আমার দাদু-দিদা আমাকে তাদের সঙ্গে থাকার জন্য নিয়ে যান। যদিও আমরা ক্যাথলিক ছিলাম কিন্তু তা সত্ত্বেও, আমার দাদু অন্যান্য ধর্মের বিষয়েও আগ্রহী ছিলেন এবং তিনি তার বন্ধুদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধর্মীয় সাহিত্য গ্রহণ করতেন। আমার এখনও মনে আছে, তিনি আমাকে টাগালগ ভাষায় সুরক্ষা, নিরাপত্তা এবং উন্মোচিত শিরোনামের পুস্তিকাগুলো * ও সেইসঙ্গে একটা বাইবেল দেখিয়েছিলেন। আমার বাইবেল পড়তে, বিশেষভাবে সুসমাচারের চারটে বই পড়তে খুব ভালো লাগত। সেগুলো পড়ার দ্বারা আমার মধ্যে যিশুর উদাহরণ অনুসরণ করার জন্য আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে।—যোহন ১০:২৭.
আমি খ্রিস্টকে অনুসরণ করতে শিখি
১৯৪৫ সালে জাপানের সেনাবাহিনী আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যায়। প্রায় সেইসময়ই আমার বাবা-মা আমাকে বাড়ি ফিরে আসতে বলেন। আমার দাদুও আমাকে তাদের কাছে ফিরে যেতে বলেন। তাই, আমি বাড়ি ফিরে যাই।
এর অল্প কিছুসময় পরই, ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আঙ্গাট শহর থেকে একদল যিহোবার সাক্ষি আমাদের গ্রামে প্রচার করতে আসে। একজন বয়স্ক সাক্ষি আমাদের বাড়িতে আসেন এবং ‘শেষ কাল’ সম্বন্ধে বাইবেল কী বলে, তা আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করেন। (২ তীম. ৩:১-৫) তিনি আমাদের পাশের এক গ্রামে একটা বাইবেল অধ্যয়নে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আমার বাবা-মা সেখানে যাননি, কিন্তু আমি গিয়েছিলাম। সেখানে প্রায় ২০ জন ব্যক্তি উপস্থিত ছিল এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাইবেলের বিষয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল।
যেহেতু আমি আলোচনার সমস্ত বিষয়বস্তু বুঝতে পারিনি, তাই আমি সেখান থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু, ঠিক সেইসময়ই সেখানে উপস্থিত সকলে রাজ্যের একটা গান গাইতে শুরু করে। সেই গানটা শুনে আমার খুব ভালো লাগে। তাই, আমি বাকি কার্যক্রমটা শোনার জন্য সেখানে
থেকে যাই। গান ও প্রার্থনার পর উপস্থিত সকলকে পরবর্তী রবিবারে আঙ্গাট শহরে অনুষ্ঠিত একটা সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।সেই সভা ক্রুস পরিবারের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমরা কয়েক জন মিলে প্রায় আট কিলোমিটার (পাঁচ মাইল) পথ পায়ে হেঁটে সেখানে উপস্থিত হই। সেখানে ৫০ জন ব্যক্তি উপস্থিত ছিল। আমি এটা দেখে খুবই অভিভূত হয়ে যাই যে, এমনকী ছোটো ছোটো সন্তানেরাও বাইবেলের গভীর বিষয়গুলোর উপর মন্তব্য করছে। বেশ কয়েকটা সভায় উপস্থিত হওয়ার পর ডামিয়ান সানটোস নামে একজন বয়স্ক অগ্রগামী ভাই, যিনি একসময় মেয়র হিসেবে কাজ করতেন, আমাকে রাতে তার বাড়িতে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আমরা অনেক রাত পর্যন্ত বাইবেলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করি।
সেই সময়, অনেকেই বাইবেলের মৌলিক সত্যগুলো শেখামাত্র দ্রুত উন্নতি করত। তাই, মাত্র কয়েকটা সভায় উপস্থিত হওয়ার পরই ভাইয়েরা আমাকে ও আরও কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করেন, “আপনারা কি বাপ্তিস্ম নিতে চান?” উত্তরে আমি বলি, “হ্যাঁ, চাই।” আমি জানতাম, আমি ‘প্রভু খ্রীষ্টেরই দাসত্ব করিতে’ চাই। (কল. ৩:২৪, ২৫ক) তাই, ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে আমাকে ও আরেকজন ভাইকে পাশেই একটা নদীতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বাপ্তিস্ম দেওয়া হয়।
আমি এই বিষয়টা উপলব্ধি করি যে, বাপ্তাইজিত খ্রিস্টান হিসেবে আমার যিশুকে অনুকরণ করে নিয়মিতভাবে প্রচার করা উচিত। কিন্তু, আমার বাবা এতে খুবই অসন্তুষ্ট হন। তিনি আমাকে বলেন, “তোমার এখনও প্রচার করার মতো বয়স হয়নি, তুমি অনেক ছোটো। তা ছাড়া, তুমি জলে নিমজ্জিত হয়েছ বলেই একজন প্রচারক হতে পার না।” আমি বাবার কাছে ব্যাখ্যা করে বলি যে, ঈশ্বরই চান যেন আমরা তাঁর রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করি। (মথি ২৪:১৪) আমি বাবাকে আরও বলি, “আমি ঈশ্বরের কাছে যে-অঙ্গীকার করেছি, সেই অনুযায়ী আমাকে কাজ করতে হবে।” ঠিক তখনই আমার বাবা আমাকে হুমকি দিয়ে সেই কথাগুলো বলেছিলেন, যেগুলো আমি শুরুতে বর্ণনা করেছি। তিনি প্রচার কাজের বিষয়ে আমাকে বাধা দেওয়ার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। আর সেই দিনেই আমার যিহোবার সেবায় বিভিন্ন লক্ষ্যের অনুধাবন করার জন্য বিভিন্ন বিষয় ত্যাগ করার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
ক্রুস পরিবার আমাকে আঙ্গাট শহরে এসে তাদের সঙ্গে বাস করার আমন্ত্রণ জানান। এ ছাড়া, তারা আমাকে ও তাদের সবচেয়ে ছোটো মেয়ে নোরাকে অগ্রগামীর সেবা শুরু করা জন্য উৎসাহিত করেন। আমরা দু-জনেই ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসের ১ তারিখে অগ্রগামীর সেবা শুরু করি। নোরা অন্য একটা শহরে সেবা করতে শুরু করে এবং আমি আঙ্গাটে থেকে সেখানকার প্রচার কাজে সমর্থন জোগাতে থাকি।
আমি বিভিন্ন বিষয় ত্যাগ করার আরেকটা সুযোগ লাভ করি
আমার অগ্রগামী সেবার তৃতীয় বছরে শাখা অফিস থেকে আর্ল স্টুয়ার্ট নামে একজন ভাই এসে আঙ্গাট শহরের একটা খোলা জায়গায় ৫০০-রও বেশি লোকের উদ্দেশে একটা বক্তৃতা দেন। তিনি ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা দেন এবং পরে আমি টাগালগ ভাষায় তার বক্তৃতার সারাংশ তুলে ধরি। কীভাবে আমি ইংরেজি ভাষা থেকে অনুবাদ করতে পেরেছিলাম? যদিও আমি কেবল সাত বছর স্কুলে পড়াশোনা করেছিলাম, কিন্তু আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিয়মিতভাবে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতেন। আরেকটা যে-বিষয় আমাকে ইংরেজি ভাষায় উন্নতি করতে সাহায্য করেছিল, তা হল ইংরেজি ভাষায় বাইবেলভিত্তিক সাহিত্যাদি অধ্যয়ন করা কারণ সেইসময় টাগালগ ভাষায় খুব কম সাহিত্যাদি পাওয়া যেত। তাই, আমি সেই বক্তৃতা ও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বক্তৃতা অনুবাদ করার জন্য ইংরেজি ভাষা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম।
আমি যে-দিন ভাই স্টুয়ার্টের জন্য তার বক্তৃতা অনুবাদ করি, সেই দিনেই তিনি স্থানীয় মণ্ডলীকে জানান যে, শাখা অফিস একজন অথবা দু-জন অগ্রগামী ভাইকে বেথেলে গিয়ে সেবা করার আমন্ত্রণ জানাতে চায়। আসলে, সেইসময় মিশনারিরা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক সিটিতে ১৯৫০ সালের ঈশতন্ত্রের বৃদ্ধি সম্মেলন-এ যোগ দিচ্ছিল আর তাই, শাখা অফিস চেয়েছিল যেন সেই ভাইয়েরা বেথেলে গিয়ে সেখানকার কাজে সাহায্য করেন। আমাকেও সেখানে সেবা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। আবারও আমি পরিচিত জায়গা ত্যাগ করি, কিন্তু এ-বার বেথেলের কাজে সাহায্য করার জন্য।
আমি ১৯৫০ সালের জুন মাসের ১৯ তারিখে বেথেলে আসি এবং সেখানে কাজ শুরু করি। সেইসময় বেথেল ছিল একটা বিশাল পুরোনো বাড়ি, যেটা আড়াই একর (এক হেক্টর) জায়গার উপর অবস্থিত ছিল এবং বড়ো বড়ো গাছ দিয়ে ঘেরা ছিল। প্রায় বারো জন অবিবাহিত ভাই সেখানে সেবা করতেন। ভোর বেলায় আমি কিচেনে রান্নার কাজে সাহায্য করতাম। এরপর প্রায় সকাল ন-টা থেকে আমি লন্ড্রিতে জামাকাপড় ইস্ত্রি করার কাজ করতাম। দুপুর বেলায়ও আমি সেই কাজগুলোই করতাম। এমনকী মিশনারিরা আন্তর্জাতিক সম্মেলন থেকে ফিরে আসার পরও আমি বেথেলে কাজ করা চালিয়ে যাই। আমি ডাকযোগে পত্রিকা পাঠানোর জন্য পত্রিকা প্যাকিং-এর কাজ করতাম, পত্রিকা গ্রাহকদের অনুরোধ অনুযায়ী পত্রিকা পাঠানোর কাজে সাহায্য করতাম এবং রিসেপশনিস্ট হিসেবে কাজ করতাম। সংক্ষেপে বললে, আমাকে যা করতে বলা হতো, আমি তা-ই করতাম।
আমি গিলিয়েড স্কুল-এ যোগ দেওয়ার জন্য ফিলিপিনস ত্যাগ করি
১৯৫২ সালে আমি ও সেইসঙ্গে ফিলিপিনস থেকে আরও ছ-জন ভাই গিলিয়েড স্কুলের ২০তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ লাভ করি। আমি খুবই রোমাঞ্চিত হয়ে যাই! যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আমরা এমন অনেক বিষয় দেখতে পাই, যেগুলো আমাদের কাছে একেবারে নতুন ও অপরিচিত ছিল। সেই এলাকাটা সত্যিই আমাদের ছোটো গ্রামের তুলনায় একেবারে আলাদা ছিল।
উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের এমন যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ব্যবহার করা শিখতে হয়েছিল, যেগুলো আমরা আগে কখনো দেখিনি। আর হ্যাঁ,
সেখানকার আবহাওয়া তো একেবারেই আলাদা ছিল! একদিন সকালে দরজা থেকে বেরিয়ে আমি এক অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাই: আশেপাশে সমস্ত কিছু একটা সাদা চাদরে ঢাকা। জীবনে প্রথম বার আমি তুষার দেখতে পাই। তারপর আমি বুঝতে পারি, সেটা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা!তবে, গিলিয়েড স্কুল-এ এক চমৎকার প্রশিক্ষণ লাভ করার আনন্দের তুলনায় এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া খুব-একটা বড়ো বিষয় ছিল না। সেখানকার শিক্ষকেরা শিক্ষাদানের বিভিন্ন কার্যকরী পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। আমরা অর্থপূর্ণ উপায়ে গবেষণা ও অধ্যয়ন করতে শিখি। গিলিয়েড-এ প্রশিক্ষণ লাভ করা আমাকে সত্যিই যিহোবার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
গিলিয়েড স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর আমাকে কিছু সময়ের জন্য নিউ ইয়র্ক সিটির ব্রন্স্কে বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়। তাই, ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে আমি নতুন জগৎ সমাজ সম্মেলন-এ যোগ দিতে পারি, যেটা ব্রন্স্কে অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনের পর আমি ফিলিপিনসে সেবা করার একটা কার্যভার লাভ করি আর তাই, সেখানে ফিরে আসি।
আমি শহরের আরামদায়ক জীবন ত্যাগ করি
একসময়, শাখা অফিসের ভাইয়েরা আমাকে বলেন, “এখন থেকে আপনাকে সীমার কাজ করতে হবে।” এটা আমাকে আক্ষরিকভাবে খ্রিস্টের পদচিহ্ন অনুসরণ করার একটা নতুন সুযোগ করে দেয়, যিনি যিহোবার মেষদের সাহায্য করার জন্য দূরদূরান্তের বিভিন্ন নগর ও শহরে ভ্রমণ করতেন। (১ পিতর ২:২১) আমাকে মধ্য লুজোনের বিশাল একটা এলাকায় সীমার কার্যভার দেওয়া হয়, যেটা হল ফিলিপিনসের সবচেয়ে বড়ো দ্বীপ। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল বুলাকান, নুয়েভা এসিহা, টার্লাক ও জামবালেস নামে প্রদেশগুলো। কোনো কোনো শহরে যাওয়ার জন্য আমাকে সিয়েরা মাদ্রে পর্বতের এবড়োখেবড়ো এলাকা অতিক্রম করতে হতো। সেই জায়গাগুলোতে যাওয়ার জন্য কোনো গণপরিবহণ ছিল না, তবে অনেক ট্রাকচালক তাদের বড়ো বড়ো ট্রাকে করে গাছের গুঁড়ি নিয়ে যেত। তাই, আমি ট্রাকচালকদের অনুরোধ করতাম যেন তারা আমাকে তাদের ট্রাকের সেই গুঁড়িগুলোর উপর বসে আমার গন্তব্য পর্যন্ত যেতে দেয়। প্রায়ই, তারা আমাকে ট্রাকে উঠতে দিত কিন্তু এভাবে যাত্রা করা খুব-একটা সহজ ছিল না।
বেশিরভাগ মণ্ডলী তুলনামূলকভাবে ছোটো ও নতুন ছিল। তাই, আমি যখন ভাইদের সভা ও ক্ষেত্রের পরিচর্যা আরও কার্যকরী উপায়ে সংগঠিত করতে সাহায্য করতাম, তখন তারা সেটাকে উপলব্ধি করত।
পরবর্তী সময়ে, আমাকে সম্পূর্ণ বিকোল এলাকায় সীমার কার্যভার দেওয়া হয়। সেই সীমা মূলত বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন দল নিয়ে গঠিত ছিল কারণ বিশেষ অগ্রগামীরা এমন এলাকাগুলোতে কাজ করছিল, যেখানে আগে প্রচার করা হয়নি। সেখানে একটা বাড়িতে একমাত্র যে-টয়লেট ছিল, সেটা হল মাটিতে তৈরি করা একটা গর্ত আর সেই গর্তের উপরে দুটো কাঠের টুকরো দেওয়া ছিল। আমি সেই কাঠের টুকরোগুলোর উপর পা দিতেই সেগুলো গর্তের মধ্যে পড়ে যায় আর এর ফলে, আমিও সেই গর্তে পড়ে যাই। বলা বাহুল্য, এরপর আমার নিজেকে পরিষ্কার করতে ও সকালের খাবারের জন্য প্রস্তুত হতে বেশ সময় লেগেছিল!
সেই সীমায় সেবা করার সময় আমি নোরার কথা ভাবতে শুরু করি। ও বুলাকানে অগ্রগামীর সেবা শুরু করেছিল। সেইসময়, ও ডুমাগেটে শহরে বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করছিল আর আমি ওর সঙ্গে দেখা করার জন্য সেখানে যাই। এরপর, আমরা কিছু সময়ের জন্য চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করি এবং ১৯৫৬ সালে আমরা বিয়ে করি। বিয়ের পর প্রথম সপ্তাহটা আমরা রাপু রাপু দ্বীপের একটা মণ্ডলী পরিদর্শন করে কাটাই। সেখানে আমাদের বিভিন্ন পর্বতে উঠতে হয় এবং প্রচুর হাঁটতে হয় কিন্তু তা সত্ত্বেও, আমরা এক বিবাহিত দম্পতি হিসেবে বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোতে ভাইদের সেবা করতে পেরে সত্যিই অনেক আনন্দিত হই!
আমি আবারও বেথেলে সেবা করার আমন্ত্রণ লাভ করি
প্রায় চার বছর ধরে আমার স্ত্রীর সঙ্গে ভ্রমণের কাজ করার পর আমরা শাখা অফিসে এসে সেবা করার আমন্ত্রণ লাভ করি। তাই, ১৯৬০ সালের জানুয়ারি মাসে আমাদের বেথেলে এক দীর্ঘ কেরিয়ারের শুরু হয়। সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এমন ভাইদের পাশে থেকে সেবা করে অনেক কিছু শিখেছি, যাদের প্রচুর দায়িত্ব রয়েছে। আর নোরাও বেথেলে বিভিন্ন কার্যভার লাভ করেছে।
আমি বেথেলে সেবা করার সময়, ফিলিপিনসে যিহোবার কাজে যে-বিশাল উন্নতি হয়েছে, তা দেখার আশীর্বাদ লাভ করেছি। আমি যখন প্রথম বার একজন অবিবাহিত তরুণ হিসেবে বেথেলে সেবা করার জন্য এসেছিলাম, তখন সারা দেশে প্রায় ১০,০০০ জন প্রকাশক ছিল। এখন ফিলিপিনসে ২,০০,০০০-রও বেশি প্রকাশক রয়েছে এবং শত শত ভাই-বোন প্রচারের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে সমর্থন জোগানোর জন্য বেথেলে সেবা করছে।
বছর পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেথেলের কাজ অনেক বৃদ্ধি লাভ করে আর তাই, যে-বিল্ডিংগুলোতে বেথেলের কাজ হতো, সেগুলোকে ছোটো বলে মনে হতে শুরু করে। এরপর, পরিচালকগোষ্ঠী আমাদের জমি কেনার জন্য খোঁজখবর নিতে বলে, যাতে আমরা একটা নতুন ও বড়ো শাখা অফিস তৈরি করতে পারি। তাই, ছাপাখানা বিভাগের অধ্যক্ষ আর আমি শাখা অফিসের প্রতিবেশী এলাকায় বিভিন্ন লোকের বাড়িতে যাই, যেখানে অনেক চাইনিজ লোক বাস করত। আমরা গিয়ে তাদের জিজ্ঞেস করি যে, কেউ নিজের জমি বিক্রি করতে চায় কি না। কেউই সেইসময় জমি বিক্রি করতে চায়নি। একজন জমির মালিক আমাদের এও বলেছিলেন: “চাইনিজ লোকেরা বিক্রি করে না। আমরা শুধু কিনি।”
কিন্তু একদিন হঠাৎই, একজন জমির মালিক এসে আমাদের জিজ্ঞেস করেন যে, আমরা তার জমি কিনতে চাই কি না। আসলে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাস করার জন্য চলে যাচ্ছিলেন। এরপর, একের-পর-এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে, যেগুলো দেখে আমরা একেবারে অবাক হয়ে যাই। আরেকজন প্রতিবেশীও তার জমি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন এবং তিনি তার প্রতিবেশীদেরও একই কাজ করার জন্য উৎসাহিত করেন। আমরা এমনকী সেই ব্যক্তির কাছ থেকেও জমি কিনতে পেরেছিলাম, যিনি আগে বলেছিলেন, “চাইনিজ লোকেরা বিক্রি করে না।” অল্পসময়ের মধ্যে আমাদের শাখা অফিসের জমির পরিধি তিন গুণের চেয়েও বেশি হয়ে দাঁড়ায়। আমি এই বিষয়ে নিশ্চিত যে, এটা একমাত্র যিহোবা ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হয়েছে।
আমি যখন ১৯৫০ সালে বেথেল সেবা শুরু করেছিলাম, তখন আমি ছিলাম বেথেল পরিবারের সবচেয়ে কমবয়সি সদস্য। কিন্তু, এখন আমার স্ত্রী ও আমি হলাম বেথেল পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য। খ্রিস্ট আমাকে যেখানে যেখানে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন, আমি ঠিক সেখানে সেখানে যাওয়ার মাধ্যমে তাঁকে অনুসরণ করেছি আর এই বিষয়ে আমার কোনো আপশোস নেই। এটা ঠিক যে, আমার বাবা-মা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন কিন্তু যিহোবা আমাকে সহবিশ্বাসীদের এক বিশাল পরিবার দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন। আমার এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, যিহোবা আমাদের সমস্ত প্রয়োজনের যত্ন নেন, তা আমরা যে-কার্যভারই লাভ করি না কেন। যিহোবা সদয়ভাবে নোরা ও আমাকে যে-সমস্ত বিষয় জুগিয়েছেন, সেগুলোর জন্য আমরা তাঁর কাছে খুবই কৃতজ্ঞ আর আমরা অন্যদেরও যিহোবাকে পরীক্ষা করে দেখতে উৎসাহিত করি।—মালাখি ৩:১০.
একবার যিশু, মথি লেবি নামে একজন করগ্রাহীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছিলেন: “আমার পশ্চাৎ আইস।” তিনি কীভাবে সাড়া দিয়েছিলেন? বাইবেল বলে, “তিনি সকলই পরিত্যাগ করিয়া উঠিয়া [যিশুর] পশ্চাৎ গমন করিলেন।” (লূক ৫:২৭, ২৮) আমারও একই রকমের বিভিন্ন সুযোগ হয়েছিল আর আমি অন্যদেরও একই বিষয় করার ও প্রচুর আশীর্বাদ লাভ করার জন্য হৃদয় থেকে উৎসাহিত করি।
^ অনু. 6 যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত কিন্তু এখন আর ছাপানো হয় না।