সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

জীবনকাহিনি

যিহোবা কখনো আমাকে হতাশ করেননি!

যিহোবা কখনো আমাকে হতাশ করেননি!

একবার, আমাকে ও আরও তিন জন মেয়েকে এডল্ফ হিটলারের একটা বক্তৃতার পর তাকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানানোর জন্য বাছাই করা হয়েছিল। কেন আমাকে সেই কাজের জন্য বাছাই করা হয়েছিল? কারণ আমার বাবা নাতসিদের কাজকর্মের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন আর সেইসঙ্গে, তিনি সেই পার্টির একটা স্থানীয় শাখার একজন নেতার গাড়ি চালাতেন। আমার মা একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক ছিলেন এবং তিনি চেয়েছিলেন যেন আমি বড়ো হয়ে একজন নান হই। আমার উপর বাবা-মায়ের এই দুই ধরনের জোরালো প্রভাব থাকা সত্ত্বেও, আমি নাতসি কিংবা নান, কোনোটাই হইনি। আসুন, আমি আপনাদের এর কারণ সম্বন্ধে বলি।

আমি অস্ট্রিয়ার গ্রাতস্‌ শহরে বড়ো হয়ে উঠেছি। সাত বছর বয়সে আমাকে ধর্মীয় প্রশিক্ষণ লাভ করার জন্য একটা স্কুলে পাঠানো হয়। কিন্তু, সেখানে আমি যাজক ও নানদের মধ্যে যৌন অনৈতিকতা লক্ষ করে একেবারে হতবাক হয়ে যাই। তাই, মা আমাকে এক বছরের মধ্যেই সেই স্কুল ছাড়ার অনুমতি দেন।

আমাদের পরিবার; বাবা সৈনিকের পোশাক পরে আছেন

পরবর্তী সময়ে, আমি একটা বোর্ডিং স্কুলে যাই। এক রাতে, বাবা আমাকে কোনো সুরক্ষিত জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আসেন কারণ গ্রাতস্‌ শহরে প্রচণ্ড বোমা বর্ষণ হচ্ছিল। সেইসময় আমরা শ্লাডমিঙ্গ শহরে আশ্রয় নিই। সেখানে এসে একটা ব্রিজ পার করার পর পরই ব্রিজটা বোমা বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায়। আরেকবার, কয়েকটা এরোপ্লেন অনেক নীচ দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের বাড়ির বাগানেই আমার ও আমার দিদিমার দিকে গুলি ছোড়ে। যত দিনে যুদ্ধ শেষ হয়েছিল, তত দিনে মনে হয়েছিল যেন গির্জা ও সরকার, উভয়ই আমাদের হতাশ করেছে।

আমি এমন এক সাহায্যের বিষয়ে শিখি, যেটা কখনো হতাশ করবে না

১৯৫০ সালে একজন যিহোবার সাক্ষি আমার মাকে বাইবেলের বার্তা জানাতে শুরু করেন। আমি তাদের আলোচনা শুনি আর এমনকী মায়ের সঙ্গে মণ্ডলীর কয়েকটা সভাতেও যোগ দিই। মা এই বিষয়ে দৃঢ়প্রত্যয়ী হন যে, যিহোবার সাক্ষিদের কাছেই সত্য রয়েছে আর তাই, তিনি ১৯৫২ সালে বাপ্তিস্ম নেন।

সেইসময়, স্থানীয় মণ্ডলীটাকে কেবল বয়স্ক মহিলাদের মিলিত হওয়ার একটা জায়গা বলে মনে হতো। কিন্তু, পরে আমরা এমন একটা মণ্ডলীতে যোগ দিই, যেখানে অনেক অল্পবয়সি ছিল—সেটা মোটেও কেবল বয়স্ক মহিলাদের মিলিত হওয়ার জায়গা ছিল না! গ্রাতস্‌ শহরে ফিরে এসে আমি প্রতিটা সভায় যোগ দিতে শুরু করি এবং শীঘ্রই, আমিও এই বিষয়ে দৃঢ়প্রত্যয়ী হই যে, আমি যা শিখছি, সেটাই সত্য। এ ছাড়া, আমি এও শিখি যে, যিহোবা ঈশ্বর তাঁর দাসদের এমন সাহায্য প্রদান করেন, যেটা কখনো তাদের হতাশ করে না। তিনি এমনকী সেইসময়ও এই সাহায্য প্রদান করেন, যখন আমরা মনে করি যে, আমরা এমন কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে একা লড়াই করছি, যেটার মোকাবিলা করা অসম্ভব।—গীত. ৩:৫, ৬.

আমি অন্যদেরও সত্য জানানোর বিষয়ে আকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠি। প্রথমে, আমি আমার ভাই-বোনদের সত্য জানাই। আমার চার দিদি ইতিমধ্যেই স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করার জন্য বাড়ি ছেড়ে অন্যান্য গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। তাই, আমি সেই গ্রামগুলোতে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করি এবং তাদের বাইবেল অধ্যয়ন করার জন্য উৎসাহিত করি। পরবর্তী সময়ে, আমার সমস্ত ভাই-বোনই বাইবেল অধ্যয়ন করে এবং যিহোবার সাক্ষি হয়।

ঘরে ঘরে সাক্ষ্যদান করার দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার এমন একজন মহিলার সঙ্গে দেখা হয়, যার বয়স ৩০-এর কোঠায়। আমি তার সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করি। তিনি উন্নতি করে বাপ্তিস্ম নেন এবং পরবর্তী সময়ে, তার স্বামী ও দুই ছেলেও একই পথ অনুসরণ করেন। সেই অধ্যয়ন আমার নিজের বিশ্বাসকে আরও শক্তিশালী করে। কেন জানেন? আসলে, কেউ কখনো আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বাইবেল অধ্যয়ন করাননি। প্রতিটা অধ্যয়নের আগে আমাকে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হতো। এক অর্থে, এভাবে আমি প্রথমে নিজে শিখতাম আর তারপর, আমার ছাত্রীকে শেখাতাম! এমনটা করার ফলে, সত্যের বিষয়ে আমার বোধগম্যতা সত্যিই বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে আমি যিহোবার কাছে আমার উৎসর্গীকরণের প্রতীক হিসেবে জলে বাপ্তিস্ম নিই।

“তাড়িত হইতেছি, কিন্তু পরিত্যক্ত হই না”

১৯৫৫ সালে আমি জার্মানি, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিই। লন্ডনে থাকার সময় ভাই আ্যলবার্ট শ্রোডারের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি বাইবেল স্কুল অভ্‌ গিলিয়েড-এর একজন শিক্ষক ছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে, তিনি পরিচালকগোষ্ঠীর একজন সদস্য হিসেবেও সেবা করেছিলেন। ব্রিটিশ মিউজিয়াম পরিদর্শন করার সময় ভাই শ্রোডার আমাদের বাইবেলের কয়েকটা পাণ্ডুলিপি দেখান। সেই পাণ্ডুলিপিগুলোতে হিব্রু ভাষায় ঈশ্বরের নাম লেখা ছিল এবং তিনি সেই পাণ্ডুলিপিগুলোর গুরুত্ব সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করেন। এটা আমাকে যিহোবা ও বাইবেলের সত্যকে আরও বেশি করে ভালোবাসতে অনুপ্রাণিত করে আর এর ফলে, আমি ঈশ্বরের বাক্যের সত্য ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে আরও বেশি দৃঢ়প্রত্যয়ী হই।

অস্ট্রিয়ায় মিসটালভাখ শহরে সেবা করার সময় আমি ও আমার অগ্রগামী সঙ্গী

১৯৫৬ সালের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে আমি পূর্ণসময়ের অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করি। চার মাস পর, আমাকে অস্ট্রিয়ায় বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমাকে মিসটালভাখ শহরে সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়। সেইসময়, সেখানে কোনো সাক্ষি ছিল না। কিন্তু, আমি একটা বিশেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হই। আমার অগ্রগামী সঙ্গী ও আমি খুবই ভিন্ন প্রকৃতির ছিলাম। আমার বয়স ছিল প্রায় ১৯ বছর আর আমি শহর থেকে এসেছিলাম; আমার সঙ্গীর বয়স ছিল ২৫ বছর আর তিনি গ্রাম থেকে এসেছিলেন। আমি প্রতিদিন সকালে দেরি করে উঠতে পছন্দ করতাম; সেই বোন সকাল সকাল উঠতে পছন্দ করতেন। যখন সন্ধ্যা হতো, আমি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে পছন্দ করতাম; সেই বোন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে পছন্দ করতেন। তা সত্ত্বেও, আমরা বাইবেলের পরামর্শ কাজে লাগিয়ে আমাদের মধ্যে থাকা পার্থক্যগুলোর সমাধান বের করি এবং অগ্রগামী সঙ্গী হিসেবে সাফল্য লাভ করে আনন্দিত হই।

আসলে, আমরা অন্যান্য কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হই। আমরা এমনকী কয়েক বার তাড়নার সম্মুখীন হই কিন্তু আমরা ‘পরিত্যক্ত হইনি।’ (২ করি. ৪:৭-৯) একবার, অনেক দূরে একটা গ্রামে প্রচার করার সময়ে লোকেরা তাদের কুকুরগুলো ছেড়ে দেয়। শীঘ্রই, বড়ো বড়ো কয়েকটা কুকুর আমাকে ও আমার সঙ্গীকে ঘিরে ধরে দাঁত বের করে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। আমি ও আমার সঙ্গী একে অপরের হাত ধরি আর আমি এমনকী প্রার্থনা করি, “যিহোবা, কুকুরগুলো যখন আমাদের আক্রমণ করবে, তখন আমরা যেন তাড়াতাড়ি মরে যাই!” কিন্তু, কুকুরগুলো যখন আমাদের থেকে এক হাত দূরে এসে পৌঁছায়, তখন তারা থেমে গিয়ে লেজ নাড়ায় আর চুপচাপ চলে যায়। আমরা অনুভব করি, যিহোবাই আমাদের সুরক্ষা জুগিয়েছেন। এই ঘটনার পর, আমরা সেই গ্রামের সমস্ত এলাকায় প্রচার করি এবং আনন্দের বিষয় হল, লোকেরা মন দিয়ে আমাদের কথা শোনে। হতে পারে, তারা এই কারণে অবাক হয়ে গিয়েছিল যে, সেই কুকুরগুলো আমাদের আক্রমণ করেনি অথবা আমরা সেই আতঙ্কজনক ঘটনা সত্ত্বেও হাল ছেড়ে দিইনি। পরিশেষে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাক্ষি হয়েছিল।

আমরা আরও একটা আতঙ্কজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হই। একদিন, আমাদের বাড়িওয়ালা মত্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসেন এবং আমাদের মেরে ফেলার হুমকি দিতে থাকেন। তিনি আমাদের বিরুদ্ধে দোষারোপ করেন যে, আমরা সেই এলাকার লোকেদের বিরক্ত করছি। তার স্ত্রী তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন কিন্তু কোনো লাভ হয় না। আমরা উপরে আমাদের ঘর থেকে এই সমস্ত কিছু শুনতে পাই। আমরা তাড়াতাড়ি আমাদের দরজার সামনে কয়েকটা চেয়ার রাখি আর সুটকেস গোছাতে শুরু করি। আমরা যখন দরজা খুলি, তখন দেখি, আমাদের বাড়িওয়ালা একটা বড়ো ছুরি নিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন। তাই, আমরা আমাদের সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে দ্রুত পিছনের দরজা দিয়ে বের হই আর বাগানের মধ্যে দিয়ে একটা লম্বা রাস্তা ধরে পালিয়ে যাই। আমরা সেখানে আর কোনো দিন ফিরে যাইনি।

এরপর, আমরা একটা হোটেলে গিয়ে রুম ভাড়া করি। পরিস্থিতির কারণে আমরা সেখানে প্রায় এক বছর থাকি আর এর ফলে, আমরা পরিচর্যায় অনেক উপকার লাভ করি। কীভাবে? হোটেলটা শহরের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত ছিল এবং আমরা যাদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতাম, তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেখানে এসে অধ্যয়ন করতে চাইত। শীঘ্রই, আমরা আমাদের হোটেলের রুমে বই অধ্যয়ন ও সাপ্তাহিক প্রহরীদুর্গ অধ্যয়ন অনুষ্ঠিত করতে শুরু করেছিলাম এবং প্রায় ১৫ জন সেখানে উপস্থিত হতো।

আমরা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মিসটালভাখ শহরে থাকি। তারপর, আমাকে গ্রাতস্‌ শহরের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ফেট্‌ভাখ শহরে সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়। আমি একজন বোনকে আমার নতুন অগ্রগামীর সঙ্গী হিসেবে পাই কিন্তু আবারও, সেই এলাকায় কোনো মণ্ডলী ছিল না। আমরা একটা কাঠের বাড়ির তৃতীয় তলায় একটা ছোট্ট ঘরে বাস করতে শুরু করি। কাঠের ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকত আর তাই, আমরা খবরের কাগজ দিয়ে সেই ফাঁকগুলো বন্ধ করার চেষ্টা করতাম। এর পাশাপাশি, আমাদের একটা কুয়ো থেকে জল তুলতে হতো। কিন্তু, এই সমস্ত প্রচেষ্টা সার্থক হয়। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সেখানে একটা দল গঠিত হয়। আমরা একটা যে-পরিবারের সঙ্গে অধ্যয়ন করতাম, সেই পরিবারের প্রায় ৩০ জন সদস্য পরিশেষে সত্য গ্রহণ করেছিল!

এইরকম অভিজ্ঞতাগুলো এই বিষয়টার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতাকে বৃদ্ধি করেছিল যে, যারা রাজ্যের বিষয়ে চেষ্টা করে, তাদের যিহোবা এমন সাহায্য প্রদান করেন, যেটা কখনো তাদের হতাশ করে না। এমনকী কোনো মানুষ যদি আমাদের সাহায্য করতে না-ও পারে, তা সত্ত্বেও যিহোবা সবসময় আমাদের সাহায্য করতে পারেন।—গীত. ১২১:১-৩.

ঈশ্বরের “ধর্ম্মশীলতার দক্ষিণ হস্ত” আমাকে সাহায্য করে

১৯৫৮ সালে নিউ ইয়র্ক সিটির ইয়াংকি স্টেডিয়াম ও পোলো গ্রাউন্ডে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল। আমি যখন সেখানে উপস্থিত হওয়ার জন্য আবেদন করি, তখন অস্ট্রিয়ার শাখা অফিস আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, আমি গিলিয়েড স্কুল-এর ৩২তম ক্লাসে যোগ দিতে চাই কি না। কীভাবেই-বা আমি এইরকম একটা বিশেষ সুযোগ হাতছাড়া করতে পারি? আমি সঙ্গেসঙ্গে উত্তর দিই, “হ্যাঁ, আমি যোগ দিতে চাই!”

গিলিয়েডের ক্লাসে আমি ভাই মার্টিন পোয়েটজিঙ্গারের পাশে বসি। তিনি নাতসিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ভয়াবহ পরিস্থিতির সঙ্গে ধৈর্য ধরে মোকাবিলা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে, তিনিও পরিচালকগোষ্ঠীর একজন সদস্য হিসেবে সেবা করেছিলেন। ক্লাস চলাকালীন, তিনি মাঝে মাঝে ফিসফিস করে আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, “এরিকা, জার্মান ভাষায় এটার অর্থ কী?”

সেই স্কুলের মাঝামাঝি সময়ে ভাই নেথেন নর আমাদের কার্যভারের বিষয়ে ঘোষণা করেন। আমাকে প্যারাগুয়েতে সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়। যেহেতু আমার বয়স তখন খুব অল্প ছিল, তাই সেই দেশে প্রবেশ করার জন্য বাবার কাছ থেকে আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয়। অনুমতি নেওয়ার পর, ১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে আমি প্যারাগুয়েতে যাই। আমাকে আসুনসিয়নে একটা মিশনারি হোমে একজন অগ্রগামী সঙ্গীর সঙ্গে থাকতে বলা হয়।

কিছুসময় পরই, আমার ওয়াল্টার ব্রাইট নামে একজন মিশনারি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়, যিনি গিলিয়েড স্কুল-এর ৩০তম ক্লাস থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে আমরা বিয়ে করি আর একসঙ্গে জীবনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোর মোকাবিলা করি। আমরা যখনই কোনো কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতাম, তখন আমরা যিশাইয় ৪১:১০ পদে বলা যিহোবার প্রতিজ্ঞাটা পড়তাম: “ভয় করিও না, কারণ আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে আছি; ব্যাকুল হইও না, কারণ আমি তোমার ঈশ্বর; আমি তোমাকে পরাক্রম দিব।” এটা আমাদের এই আশ্বাস প্রদান করেছিল যে, যতদিন পর্যন্ত আমরা ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ততা বজায় রাখার এবং তাঁর রাজ্যকে প্রথমে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করব, ততদিন পর্যন্ত তিনি কখনো আমাদের হতাশ করবেন না।

একসময়, আমাদের ব্রাজিলের বর্ডারের কাছে অবস্থিত একটা এলাকায় সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়। সেখানে, পাদরিরা অল্পবয়সিদের উসকে দেয়, যাতে তারা আমাদের মিশনারি হোমে পাথর ছোড়ে, যেটা এমনিতেই খুব-একটা ভালো অবস্থায় ছিল না। তারপর, আমার স্বামী পুলিশের একজন প্রধান কর্মকর্তার সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করে। সেই কর্মকর্তা এই বিষয়ে খেয়াল রেখেছিলেন যেন কয়েক জন পুলিশ অফিসার এক সপ্তাহ ধরে আমাদের বাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকে আর তারপর থেকে তাড়নাকারীরা আমাদের জন্য আর কোনো সমস্যা তৈরি করেনি। এর কিছুসময় পরই, আমাদের ব্রাজিলের বর্ডারের অপর প্রান্তে আরও ভালো একটা থাকার জায়গায় যেতে বলা হয়। সেটা আমাদের জন্য বেশ সুবিধাজনক হয় কারণ আমরা প্যারাগুয়ে ও ব্রাজিল, উভয় জায়গাতেই সভা অনুষ্ঠিত করতে সক্ষম হই। আমরা সেখানকার কার্যভার ছাড়ার আগে সেখানে দুটো ছোটো মণ্ডলী গঠিত হয়।

প্যারাগুয়ের আসুনসিয়নে মিশনারি হিসেবে সেবা করার সময় আমি ও আমার স্বামী ওয়াল্টার

যিহোবা আমাকে ক্রমাগত সাহায্য করছেন

আমার ডাক্তাররা আমাকে জানিয়েছিলেন যে, আমি কখনো সন্তানের জন্ম দিতে পারব না আর তাই, ১৯৬২ সালে আমরা যখন জানতে পাই যে, আমি মা হতে চলেছি, তখন আমরা খুব অবাক হয়ে যাই! আমরা অবশেষে ফ্লোরিডার হলিউডে আমার স্বামীর পরিবারের কাছাকাছি এলাকায় থাকতে শুরু করি। বেশ কিছু বছর ধরে আমি ও আমার স্বামী অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। আমাদের নিজেদের পরিবারের যত্ন নিতে হয়। তা সত্ত্বেও, আমরা সবসময় রাজ্যের বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে চলি।—মথি ৬:৩৩.

আমরা যখন ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ফ্লোরিডায় আসি, তখন আমরা এটা দেখে অবাক হয়ে যাই যে, স্থানীয় লোকেদের মনোভাবের কারণে কৃষ্ণাঙ্গ ভাইয়েরা শ্বেতাঙ্গ ভাইদের চেয়ে ভিন্ন জায়গায় সভা করত এবং ভিন্ন এলাকায় প্রচার করত। কিন্তু, যিহোবা জাতিগত বৈষম্যকে পছন্দ করেন না আর তাই, শীঘ্রই ভিন্ন জাতির লোকেদের একসঙ্গে একই মণ্ডলীতগুলোতে থাকার জন্য ব্যবস্থা করা হয়। এই বিষয়টা স্পষ্ট যে, সেই ব্যবস্থায় যিহোবার হাত ছিল কারণ বর্তমানে সেই এলাকায় প্রচুর মণ্ডলী গঠিত হয়েছে।

দুঃখের বিষয় হল ২০১৫ সালে আমার স্বামী ব্রেন ক্যান্সারের কারণে মারা যায়। আমরা ৫৫ বছর ধরে বিবাহিত জীবন কাটিয়েছি। ও একজন চমৎকার স্বামী ছিল আর ও যিহোবাকে খুব ভালোবাসত এবং অনেক ভাইকে সাহায্য করেছিল। আমি সেই সময়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি, যখন আমি পুনরুত্থানে আবার ওকে সুস্থ শরীরে দেখতে পাব।—প্রেরিত ২৪:১৫.

আমি এই বিষয়ে খুবই কৃতজ্ঞ যে, আমি ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পূর্ণসময়ের পরিচর্যায় রত থাকতে পেরেছি এবং অনেক আনন্দ ও পুরস্কার লাভ করতে পেরেছি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমার স্বামী ও আমি আমাদের বাইবেল ছাত্রদের মধ্যে ১৩৬ জনের বাপ্তিস্মের সময়ে উপস্থিত থাকতে পেরেছি। এটা ঠিক যে, আমাদের কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু, আমরা কখনো সেগুলোকে আমাদের বিশ্বস্ত ঈশ্বরের সেবা করা বন্ধ করার কারণ হিসেবে দেখিনি। এর পরিবর্তে, আমরা তাঁর আরও নিকটবর্তী হয়েছি এবং তাঁর উপর এই আস্থা রেখেছি যে, তিনি নিজের সময়ে ও নিজের উপায়ে বিভিন্ন বিষয়ের সমাধান করবেন। আর এই ক্ষেত্রে, তিনি আমাদের কখনো হতাশ করেননি!—২ তীম. ৪:১৬, ১৭.

আমার স্বামীর কথা আমার খুব মনে পড়ে কিন্তু অগ্রগামীর কাজ আমাকে আমার শোকের সঙ্গে মোকাবিলা করতে সাহায্য করে। আমি অন্যদের শিক্ষা দিয়ে ও বিশেষ করে তাদের পুনরুত্থানের আশা সম্বন্ধে জানিয়ে অনেক উপকার লাভ করেছি। সত্যি বলতে কী, যিহোবা যে আমাকে কখনো হতাশ করবেন না, সেই বিষয়টা তিনি এত উপায়ে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, আমি তা বলে শেষ করতে পারব না। যিহোবা ঠিক তাঁর প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী আমাকে সাহায্য করেছেন, শক্তি জুগিয়েছেন এবং তাঁর “ধর্ম্মশীলতার দক্ষিণ হস্ত” দিয়ে আমাকে ধরে রেখেছেন।—যিশা. ৪১:১০.