প্রচ্ছদ বিষয়
বাইবেল কি শুধুমাত্র একটা ভালো বই?
প্রায় দু-হাজার বছর আগে বাইবেল লেখা শেষ হয়েছে। সেই সময় থেকে অগণিত বই লেখা হয়েছে, যেগুলো পরে সেকেলে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাইবেলের ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। নীচের বিষয়গুলো লক্ষ করুন।
-
বাইবেলকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাইবেল এখনও আমাদের কাছে রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, মধ্যযুগের বাইবেলের ভূমিকা (ইংরেজি) নামক বইটা বলে, মধ্যযুগে তথাকথিত খ্রিস্টান দেশগুলোতে “কেউ যদি কোনো আঞ্চলিক ভাষার বাইবেল রাখত ও তা পড়ত, তা হলে তাকে প্রায়ই ধর্মভ্রষ্ট ও বিদ্রোহী হিসেবে দেখা হতো।” বিভিন্ন পণ্ডিত ব্যক্তি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেছিলেন কিংবা বাইবেল পড়তে উৎসাহিত করেছিলেন। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে হত্যাও করা হয়েছিল।
-
এত বিরোধিতা সত্ত্বেও বাইবেল এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বিতরিত বই। একটা সমীক্ষা অনুসারে, ২,৮০০-রও বেশি ভাষায় সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক বাইবেলের পাঁচ-শো কোটি কপি ছাপানো হয়েছে। এটি দর্শন, বিজ্ঞান ও অন্যান্য শাখার বইগুলোর চেয়ে কতই-না আলাদা, যেগুলো সীমিত সংখ্যায় বিতরণ করা হয় এবং কিছু দিনের মধ্যেই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
-
কিছু কিছু ভাষায় বাইবেল অনুবাদিত হওয়ার ফলে সেই ভাষাগুলো সংরক্ষিত ও উন্নত হয়েছে। মার্টিন লুথার জার্মান ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেছিলেন আর এই অনুবাদ সেই ভাষার উপর বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। কিং জেমস্ ভারশন-এর প্রথম সংস্করণের বিষয়ে বলা হয়, এটি সম্ভবত ইংরেজি ভাষায় “প্রকাশিত একমাত্র বই, যা সবচেয়ে বেশি প্রভাববিস্তার করতে পেরেছে।”
-
বাইবেল “পাশ্চাত্য সংস্কৃতির উপর গভীর ছাপ ফেলেছে; এটি ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতি ছাড়াও শিল্প, সাহিত্য, আইন, রাজনীতি ও সেইসঙ্গে অসংখ্য ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করেছে।”—দি অক্সফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অভ্ দ্যা বুকস অভ্ দ্যা বাইবেল।
এগুলো হল মাত্র কয়েকটা বিষয়, যেগুলো বাইবেলকে অন্যান্য বইয়ের চেয়ে আলাদা করে তোলে। কিন্তু, কেন বাইবেল এত জনপ্রিয়? কেন লোকেরা এই বইয়ের জন্য নিজেদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছিল? বিভিন্ন কারণের মধ্যে কয়েকটা হল: বাইবেলে এমন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা রয়েছে, যেগুলো থেকে সেই প্রজ্ঞা লাভ করা যায়, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। বাইবেল মানুষের দুঃখকষ্ট ও সংঘাতের মূল কারণ বুঝতে সাহায্য করে। আরও উত্তম বিষয় হল, বাইবেল প্রতিজ্ঞা করে, এই সমস্যাগুলো শেষ হবে আর সেইসঙ্গে এটাও জানায় যে, কীভাবে তা হবে।
বাইবেল নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান প্রদান করে
লেখাপড়া শেখা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, ‘যে-শিক্ষা আপনার নামের পাশে শুধু ডিগ্রি যোগ করে, তা এই নিশ্চয়তা দেয় না, আপনি সবসময় নৈতিক দিক দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন,’ আটাওয়া সিটিজেন নামে কানাডার একটা সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় প্রবন্ধে এই কথাগুলো বলা হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী সমীক্ষা চালানোর পর এডেলম্যান নামে এক জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান এই তথ্য প্রকাশ করে, বিভিন্ন ব্যাবসায়িক ও সরকারি কর্মকর্তা-সহ অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি প্রতারণা ও চুরি করেন আর তাদের এই ধরনের কাজ “লোকেদের আস্থা নষ্ট করে দেয়।”
বাইবেল মূলত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে শিক্ষা দেয়। এটি আমাদেরকে ‘ধার্ম্মিকতা ও বিচার, ন্যায় ও সমস্ত উত্তম পথ’ বুঝতে সাহায্য করে। (হিতোপদেশ ২:৯) যেমন ২৩ বছর বয়সি স্টিফেনের a কথাই ধরুন, যিনি পোল্যান্ডের জেলে বন্দি ছিলেন। বন্দি থাকাকালীন তিনি বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করেন এবং বুঝতে পারেন যে, এতে ব্যাবহারিক প্রজ্ঞা রয়েছে। তিনি লেখেন, “এখন আমি বুঝতে পারি ‘তোমার পিতাকে ও তোমার মাতাকে সমাদর করিও,’ আজ্ঞাটার অর্থ কী। আমি নিজের আবেগ, বিশেষ করে আমার বদমেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছি।”—ইফিষীয় ৪:৩১; ৬:২.
হিতোপদেশ ১৯:১১ পদের নীতিটা স্টিফেনের হৃদয় স্পর্শ করেছিল, যেটা বলে, “মানুষের বুদ্ধি তাহাকে ক্রোধে ধীর করে, আর দোষ ছাড়িয়া দেওয়া তাহার শোভা।” বর্তমানে স্টিফেন কোনো সমস্যায় পড়লে মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরিস্থিতি বিবেচনা করার ও বাইবেলের নীতি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, “আমি দেখেছি, বাইবেলে সবচেয়ে ভালো পরামর্শ পাওয়া যায়।”
মারিয়া নামে একজন যিহোবার সাক্ষিকে একজন মহিলা জনসমক্ষে অপমান করেন। এই মহিলা ছিলেন বিদ্বেষ মনোভাবাপন্ন আর মারিয়াকে দেখে তিনি চিৎকার করে লোক জড়ো করেন। কিন্তু মারিয়া কোনো কথা না বলে শান্তভাবে সেখান থেকে চলে যান। পরে সেই মহিলা নিজের আচরণের জন্য লজ্জিত হন এবং যিহোবার সাক্ষিদের খোঁজ করেন। প্রায় এক মাস পর তিনি মারিয়াকে খুঁজে পান এবং তাকে জড়িয়ে ধরে যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে রাজি হন।
ক্ষমা চান। শুধু তা-ই নয়, তিনি বুঝতে পারেন, মারিয়া তার ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই মৃদুতা ও আত্মসংযম দেখিয়েছিলেন। এর ফল কী হয়? একসময়কার সেই বিদ্বেষ মনোভাবাপন্ন মহিলা ও তার পরিবারের পাঁচ জন সদস্যযিশু বলেছিলেন, প্রজ্ঞা যে সঠিক, তা ফলাফল থেকেই প্রমাণিত হয়। (মথি ১১:১৯) বাইবেলের নীতিগুলো যে কাজ করে, সেটার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে! এগুলো আমাদের মধ্যে ভালো গুণাবলি গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এই নীতিগুলো “অল্পবুদ্ধির জ্ঞানদায়ক,” “চিত্তের আনন্দবর্দ্ধক” এবং “চক্ষুর দীপ্তিজনক” কারণ এটা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।—গীতসংহিতা ১৯:৭, ৮.
বাইবেল মানুষের দুঃখকষ্ট ও সংঘর্ষের কারণ ব্যাখ্যা করে
কোনো রোগ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে অনুসন্ধানকারীরা এটার কারণ অর্থাৎ এটা কীভাবে শুরু হয়েছিল, সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। মানুষের দুঃখকষ্ট ও সংঘর্ষের কারণ বোঝার ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য। এই ব্যাপারেও বাইবেল আমাদের সাহায্য করে কারণ এতে সেই সময়ের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা রয়েছে, যখন সমস্যাগুলো শুরু হয়েছিল।
আদিপুস্তক বইটা জানায়, প্রথম মানবদম্পতি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পর মানবজাতির দুর্দশা শুরু হয়েছিল। তাদের জন্য কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, সেই সিদ্ধান্ত তারা নিজেরাই নিতে চেয়েছিল, যে-সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একমাত্র আমাদের সৃষ্টিকর্তার ছিল। (আদিপুস্তক ৩:১-৭) দুঃখের বিষয় হল, সেই সময় থেকে বেশিরভাগ মানুষ একই ধরনের স্বাধীনচেতা মনোভাব গ্রহণ করেছে। এর পরিণতি কী হয়েছে? মানব ইতিহাস স্বাধীনতা কিংবা আনন্দের বিবরণ নয় বরং সংঘর্ষ, অত্যাচার এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মতভেদের বিবরণে পূর্ণ হয়েছে। (উপদেশক ৮:৯) বাইবেল ঠিকই বলে: “মনুষ্য . . . আপন পাদবিক্ষেপ স্থির করিতে পারে না।” (যিরমিয় ১০:২৩) কিন্তু আশার কথা হল, মানবজাতির বিদ্রোহ প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
বাইবেল আশার আলো দেখায়
যারা ঈশ্বরের কর্তৃত্ব ও মানদণ্ডের প্রতি সম্মান দেখায়, তাদেরকে তিনি প্রেম করেন। বাইবেল আমাদের আশ্বাস দেয়, এই ব্যক্তিদের জন্য তিনি মন্দতা ও এর ফলে যে-দুঃখকষ্ট আসে, সেগুলো চিরকাল সহ্য করবেন না। দুষ্ট ব্যক্তিরা “স্ব স্ব আচরণের ফল ভোগ করিবে।” (হিতোপদেশ ১:৩০, ৩১) অপরদিকে, “মৃদুশীলেরা দেশের অধিকারী হইবে, এবং শান্তির বাহুল্যে আমোদ করিবে।”—গীতসংহিতা ৩৭:১১.
ঈশ্বর ‘তাঁর রাজ্যের’ মাধ্যমে এক শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর বিষয়ে নিজের উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেন। (লূক ৪:৪৩) সেই রাজ্য হল এক বিশ্বব্যাপী সরকার আর এটার মাধ্যমে ঈশ্বর মানবজাতির উপর তাঁর শাসন করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করবেন। সেই রাজ্য ও পৃথিবীর মধ্যে যে একটা সম্পর্ক রয়েছে, এই বিষয়টা যিশু তাঁর আদর্শ প্রার্থনায় উল্লেখ করে বলেছিলেন: ‘তোমার রাজ্য আইসুক, তোমার ইচ্ছা পৃথিবীতে সিদ্ধ হউক।’—মথি ৬:১০.
ঈশ্বরের রাজ্যের প্রজারা ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করবে। কারণ তারা উপলব্ধি করতে পারবে যে, কোনো মানুষ নয় বরং সৃষ্টিকর্তাই হলেন যোগ্য শাসক। দুর্নীতি, লোভ, অর্থনৈতিক ও জাতিগত বৈষম্য এবং যুদ্ধ আর থাকবে না। সত্যি সত্যিই তখন এক পৃথিবী, এক সরকার ও একই প্রকারের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মান থাকবে।—প্রকাশিত বাক্য ১১:১৫.
সেই নতুন জগৎ দেখার একমাত্র উপায় হল, শিক্ষা নেওয়া। ১ তীমথিয় ২:৩, ৪ পদ বলে, “[ঈশ্বরের] ইচ্ছা এই, যেন সমুদয় মনুষ্য পরিত্রাণ পায়, ও সত্যের তত্ত্বজ্ঞান পর্য্যন্ত পঁহুছিতে পারে।” এই সত্যের অন্তর্ভুক্ত হল বাইবেলের বিভিন্ন শিক্ষা, যেগুলোকে আমরা রাজ্যের সংবিধান বলতে পারি। এগুলো হল রাজ্য পরিচালনা করার বিভিন্ন আইন ও নীতি। যিশু খ্রিস্টের পর্বতেদত্ত উপদেশে এইরকম কিছু আইন ও নীতির উদাহরণ পাওয়া যায়। (মথি ৫-৭ অধ্যায়) সেই তিনটে অধ্যায় পড়ার সময় চিন্তা করুন, প্রত্যেকে যখন যিশুর এই প্রজ্ঞা কাজে লাগাবে, তখন জীবন কেমন হবে।
তাই, আমাদের কি এতে আশ্চর্য হওয়া উচিত যে, বাইবেল হল বিশ্বের সবচেয়ে বিতরিত বই? কখনোই না! বাইবেলের শিক্ষাগুলো প্রমাণ দেয়, এটি ঈশ্বরের অনুপ্রেরণায় লেখা হয়েছে। আর বাইবেলের এই ব্যাপক মাত্রায় বিতরণ দেখায়, ঈশ্বর চান যেন সমস্ত ভাষাভাষী ও জাতির লোক তাঁর সম্বন্ধে শিখতে পারে এবং তাঁর রাজ্য যে-আশীর্বাদগুলো নিয়ে আসবে, সেগুলো উপভোগ করতে পারে।—প্রেরিত ১০:৩৪, ৩৫. ◼ (g16-E No. 2)
a নামগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে।