সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

পরিপাক নালীতে গথিত আত্রক নায়ুতত্র (নীল রংয়ে দেখানো হয়েছ)

আন্ত্রিক স্নায়ুতন্ত্র আপনার শরীরের ‘দ্বিতীয় মস্তিষ্ক’?

আন্ত্রিক স্নায়ুতন্ত্র আপনার শরীরের ‘দ্বিতীয় মস্তিষ্ক’?

আপনার ক-টা মস্তিষ্ক রয়েছে? আপনি যদি বলেন ‘একটা,’ তা হলে আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আপনার শরীরে একাধিক স্নায়ুতন্ত্র a রয়েছে। এর মধ্যে একটা স্নায়ুতন্ত্রের গঠন এতটাই বৃহৎ যে, কোনো কোনো বৈজ্ঞানিক এটাকে ‘দ্বিতীয় মস্তিষ্ক’ বলে অভিহিত করেন। এটা হল আন্ত্রিক স্নায়ুতন্ত্র (এন্টারিক নার্ভাস সিস্টেম বা ইএনএস) আর এটা আমাদের মাথায় নয় কিন্তু প্রধানত আমাদের পেটের মধ্যে রয়েছে।

খাদ্য যাতে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, সেইজন্য আমাদের শরীরকে প্রচুর পরিমাণে সহযোগিতা ও প্রচেষ্টা করতে হয়। আর তাই, মস্তিষ্ক এমনভাবে তৈরি হয়েছে, যাতে এটা বেশিরভাগ পরিপাক নিয়ন্ত্রণের ভার ইএনএস-কে অর্পণ করে।

আন্ত্রিক স্নায়ুতন্ত্র মস্তিষ্কের চেয়ে সরল বটে কিন্তু এর গঠনও যথেষ্ট জটিল। মানুষের ক্ষেত্রে এটা ২০ থেকে ৬০ কোটি নিউরোন নিয়ে গঠিত। বৈজ্ঞানিকরা মনে করেন, ইএনএস-এর কার্যকলাপ যদি মস্তিষ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো, তা হলে প্রয়োজনীয় স্নায়ুগুলো আরও স্থূল হয়ে যেত। দ্বিতীয় মস্তিষ্ক (ইংরেজি) বই অনুযায়ী, “তাই এটা একদিকে যেমন নিরাপদ আবার অন্যদিকে খুবই সুবিধাজনক যে, [পরিপাকতন্ত্র] নিজের দেখাশোনা নিজেই করে।”

“এক রাসায়নিক কারখানা”

খাদ্য পরিপাক করার জন্য যা প্রয়োজন, তা হল সঠিক সময়ে বিভিন্ন ধরনের সুনির্দিষ্ট রাসায়নিক মিশ্র পদার্থ উৎপাদিত হওয়া আর তারপর সঠিক স্থানে পৌঁছে যাওয়া। অধ্যাপক গ্যারি মও উপযুক্তভাবেই পরিপাকতন্ত্রকে “এক রাসায়নিক কারখানা” বলে অভিহিত করেন। এই কারখানায় যে-রাসায়নিক কাজকর্ম হয়, তা এতটাই উন্নত যে, তা আমাদের বোধের অগম্য। যেমন, পাকস্থলীর ভিতরে পর পর সাজানো বিশেষ ধরনের কোষ কেমিক্যাল ডিটেক্টর অথবা টেস্ট রিসেপ্টর হিসেবে কাজ করে আর আমরা যে-খাদ্য খাই, সেটাতে কোন কোন রাসায়নিক পদার্থ থাকে, তা নির্ধারণ করে। এই তথ্য ইএনএস-কে সঠিক পরিপাক এনজাইম নিযুক্ত করতে সাহায্য করে, যাতে খাদ্যকে খাদ্যকণিকায় ভাঙা যায় আর শরীর তা শোষণ করতে পারে। এ ছাড়া, ইএনএস খাদ্যকণিকার অম্লত্ব ও অন্যান্য রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করতে আর সেইমতো পরিপাক এনজাইমগুলোতে রদবদল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

খাদ্য যেভাবে পরিপাক নালীর মধ্যে দিয়ে যায়, তা সত্যিই অসাধারণ আর সেটা প্রধানত ইএনএস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আপনার ‘দ্বিতীয় মস্তিষ্ক’ পরিপাক নালীর দেওয়ালে থাকা পেশিগুলোকে সংকুচিত হওয়ার নির্দেশনা দেয় আর এভাবে খাদ্য পরিপাকতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকে। পরিপাকতন্ত্রের কাজ চালু রাখার জন্য প্রয়োজনে ইএনএস এই পেশিগুলোর সংকোচনের মাত্রা ও হার পরিবর্তন করে।

এ ছাড়া, ইএনএস সুরক্ষার দিকটা দেখাশোনা করে। আপনি যে-খাদ্য খান, তাতে হয়তো কোনো ক্ষতিকর ব্যাকটিরিয়া রয়েছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, আপনার শরীরের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ লিম্ফোসাইট কোষ আপনার পেটের মধ্যে রয়েছে। লিম্ফোসাইট কোষ হল, আপনার রোগপ্রতিরোধ তন্ত্রের এক মুখ্য উপাদান। আপনার শরীরে যদি খাদ্যের মাধ্যমে অতিরিক্ত পরিমাণে ক্ষতিকর পদার্থ প্রবেশ করে, তা হলে ইএনএস শরীরকে সুরক্ষা প্রদান করার জন্য জোরালো সংকোচনের নির্দেশনা দেয় আর এর ফলে বমি কিংবা ডায়েরিয়ার মাধ্যমে বেশিরভাগ বিষাক্ত পদার্থ শরীর থেকে বের হয়ে যায়।

উত্তম যোগাযোগ

যদিও এমনটা মনে হয়, ইএনএস মস্তিষ্ক থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করে কিন্তু এই দুটো স্নায়ুকেন্দ্র নিজেদের মধ্যে অনবরত যোগাযোগ রাখে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইএনএস সেইসমস্ত হরমোনগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, যেগুলো মস্তিষ্ককে নির্দেশনা দেয় যে, কখন আপনাকে খেতে হবে আর কতটা পরিমাণে খেতে হবে। যখন আপনার পেট ভরে যায়, তখন ইএনএস স্নায়ুকোষগুলো মস্তিষ্ককে সংকেত দেয়, এর পরেও আপনি যদি বেশি খান, তা হলে আপনার বমি বমি লাগতে পারে।

এই প্রবন্ধ পড়ার আগে আপনার হয়তো মনে হতো, পরিপাক নালী আর আপনার মস্তিষ্কের মধ্যে কোনো যোগাযোগ আছে। উদাহরণ স্বরূপ, আপনি কী লক্ষ করেছেন, কোনো নির্দিষ্ট ধরনের খাদ্য খেলে আপনার মেজাজটা কেমন ভালো হয়ে যায়? গবেষণা দেখায়, এটা তখনই ঘটে, যখন ইএনএস আপনার মস্তিষ্কে ‘খুশির সংকেত’ পাঠায় আর এক ধারাবাহিক বিক্রিয়া শুরু হয়, ফলে আপনার ভালো লাগে। এটা হয়তো আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, কেন লোকেরা চাপের মধ্যে থাকলে সেইসমস্ত খাবার খেতে চায়, যেগুলোকে লোকেরা কমফর্ট ফুড বা তৃপ্তিকর খাবার বলে থাকে। ডিপ্রেশন বা অবসাদ রোগের চিকিৎসার জন্য বৈজ্ঞানিকরা আবিষ্কার করার চেষ্টা করছেন যে, কৃত্রিমভাবে ইএনএস-কে উত্তেজিত করা যায় কি না।

মস্তিষ্ক ও পরিপাক তন্ত্রের মধ্যে যোগাযোগের আরেকটা উদাহরণ রয়েছে। একেক সময় আমাদের পেটের মধ্যে উত্তেজনার অনুভূতি হয়। এই অনুভূতির কারণ হতে পারে, যখন মস্তিষ্ক উদ্‌বেগ বা চাপ অনুভব করে, তখন ইএনএস রক্তকে পাকস্থলী থেকে বিপরীত দিকে প্রবাহিত হওয়ার নির্দেশনা দেয়। আবার চাপের সময় মস্তিষ্ক ইএনএস-কে পরিপাক নালীর স্বাভাবিক সংকোচন পরিবর্তন করার নির্দেশনা দেয় আর এর ফলে বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে।

যদিও ইএনএস-কে শরীরের ‘দ্বিতীয় মস্তিষ্ক’ বলা হয়, তবে এটা আপনাকে চিন্তা করতে সাহায্য করে না কিংবা আপনি কী সিদ্ধান্ত নেবেন, তা বলে দিতে পারে না। আরেক কথায় বললে, ইএনএস আসলে আপনার মস্তিষ্ক নয়। এটা আপনাকে গান রচনা করতে, ব্যাঙ্কের হিসাব-নিকাশ করতে কিংবা হোমওয়ার্ক করতে সাহায্য করে না। তা সত্ত্বেও, এই চমৎকার তন্ত্রের জটিলতা বৈজ্ঞানিকদের ক্রমাগত অবাক করেছে, যদিও তারা এর বেশিরভাগটাই এখনও পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারেননি। তাই, এবার যখন আপনি খেতে বসবেন, তখন আপনার পরিপাকতন্ত্রে যে-সমস্ত পর্যবেক্ষণ, ধারাবাহিক তথ্যগ্রহণ, সমন্বয় ও যোগাযোগের কাজ হতে চলেছে, তা একটু থেমে চিন্তা করুন! ◼

[পাদটীকা]

a স্নায়ু ও স্নায়ুকোষ বা নিউরোনের দ্বারা গঠিত জটিল তন্ত্র, যেটা দেহের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংকেত আদান-প্রদান করে।