ফুড অ্যালার্জি ও ফুড ইনটলারেন্স—কোনো পার্থক্য আছে কি?
এমিলি: “সে-দিন খেতে খেতে আমার কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। আমার মুখ চুলকাতে শুরু করল। জিভটা যেন ঘুরাতেই পারছিলাম না। আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল আর নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। হাতে, গলায় লাল লাল র্যাশ বের হতে লাগল। আমি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছিলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে!”
বেশিরভাগ লোক খেতে ভালোবাসে। কিন্তু, কারো কারো কাছে কিছু কিছু খাদ্য ‘বিষের’ মতো। উপরে উল্লেখিত এমিলির মতো এই ব্যক্তিরাও ফুড অ্যালার্জিতে ভোগে। এমিলির এই তীব্র অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়াকে অ্যানাফাইলেক্সিস বা অতি সংবেদনশীল অবস্থা বলা হয়, যেটা সত্যিই খুব বিপদজনক। কিন্তু, বেশিরভাগ ফুড অ্যালার্জি এতটা বিপদজনক নয়।
বর্তমানে, লোকেদের মধ্যে ফুড অ্যালার্জি ও ফুড ইনটলারেন্সের মাত্রা অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। তবে সমীক্ষা দেখায়, যারা মনে করে তাদের ফুড অ্যালার্জি হয়েছে, তাদের মধ্যে খুব কম লোকই ডাক্তারের কাছে গিয়ে এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে।
ফুড অ্যালার্জি কী?
ডা. জেনিফার জে. স্নাইডার চেফান-এর নেতৃত্বে এক দল বিজ্ঞানী দ্যা জার্নাল অভ্ দি অ্যামেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন নামক পত্রিকায় তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করেন। তাদের মতে, “ফুড অ্যালার্জি সম্বন্ধে একেক জন একেক ধরনের সংজ্ঞা দেয়।” কিন্তু, বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের মতে অ্যালার্জি বের হওয়ার প্রাথমিক কারণ হল, রোগপ্রতিরোধ তন্ত্র।
কোনো বিশেষ খাদ্য থেকে অ্যালার্জি আসলে সেই খাদ্যে থাকা নির্দিষ্ট এক ধরনের প্রোটিনের প্রতিক্রিয়ার কারণে হয়ে থাকে। রোগপ্রতিরোধ তন্ত্র সেই প্রোটিনকে ভুলভাবে ক্ষতিকারক বলে চিহ্নিত করে। যখন এক নির্দিষ্ট ধরনের প্রোটিন দেহে প্রবেশ করে, তখন রোগপ্রতিরোধ তন্ত্র সম্ভাব্য আক্রমণকারীকে প্রতিরোধ করার জন্য আইজিই (ইমিউনোগ্লোবিউলিন-ই) নামে এক প্রকারের অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে। সেই অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী প্রোটিন শরীরে পুনরায় প্রবেশ করলে, আগে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি, হিস্টামিন-সহ অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হিস্টামিন রোগপ্রতিরোধ তন্ত্রে উপকারী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু, কোনো ব্যক্তি যদি নির্দিষ্ট কিছু খাদ্যে থাকা বিশেষ ধরনের প্রোটিনের প্রতি অতি সংবেদনশীল হয়, তা হলে কোনো অজানা কারণে আইজিই অ্যান্টিবডি ও তা থেকে নিঃসৃত হিস্টামিনের ফলে সেই ব্যক্তির শরীরে ফুড অ্যালার্জির লক্ষণ ফুটে ওঠে।
এভাবে আমরা বুঝতে পারি, কেন প্রথম বার নতুন কিছু খেলে অ্যালার্জি বের না হলেও সেই একই খাদ্য পুনরায় খেলে অ্যালার্জি বের হয়।
ফুড ইনটলারেন্স কী?
ফুড অ্যালার্জির মতো ফুড ইনটলারেন্সও কোনো বিশেষ খাদ্য খাওয়ার ফলে হয়ে থাকে। তবে এদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ফুড অ্যালার্জির কারণ হল, রোগপ্রতিরোধ তন্ত্র কিন্তু ফুড ইনটলারেন্স বা খাদ্য সহ্য না হওয়ার কারণ হল, পাচন তন্ত্রে পরিপাকের সমস্যা। ফুড ইনটলারেন্সে কোনো অ্যান্টিবডি জড়িত থাকে না। একজন ব্যক্তির কোনো খাদ্য হজম করতে না পারার পিছনে সাধারণত দুটো কারণ থাকতে পারে; হয় সেই ব্যক্তির শরীরে কোনো এনজাইমের অভাব রয়েছে, না হয় সেই খাদ্যে এমন কোনো রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যেটা হজমে অসুবিধা সৃষ্টি করছে। যেমন, কোনো কোনো ব্যক্তির দুগ্ধজাত
সামগ্রী সহ্য হয় না আর এর পিছনে কারণটা হল, তাদের পাচন তন্ত্রে দুগ্ধজাতীয় দ্রব্যে থাকা শর্করাকে হজম করার জন্য প্রয়োজনীয় এনজাইম উৎপন্ন হয় না।যেহেতু ফুড ইনটলারেন্সের পিছনে কোনো অ্যান্টিবডির হাত থাকে না, তাই প্রথম বার কোনো খাদ্য খেলেই তা হতে পারে। ফুড ইনটলারেন্স আবার খাদ্যের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। অনেক সময় কোনো খাদ্য অল্প পরিমাণে খেলে হয়তো সমস্যা হয় না কিন্তু সেই খাদ্য যদি বেশি পরিমাণে খাওয়া হয়, তা হলে সমস্যা হতে পারে। তবে, মারাত্মক ফুড অ্যালার্জির ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। এক্ষেত্রে খুব অল্প পরিমাণ খাদ্যও জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
লক্ষণ
আপনার যদি অ্যালার্জি হয়, তা হলে আপনার শরীর চুলকাবে; গায়ে লাল লাল র্যাশ বের হবে; গলা, চোখ কিংবা জিভ ফুলে যাবে; গা গুলাবে; বমি হবে; ডায়েরিয়া হবে। আরও চরম ক্ষেত্রে, আপনার রক্তচাপ নেমে যেতে পারে, মাথা ঘুরতে পারে, আপনি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন, এমনকী হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এই ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটতে পারে আর একজনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে।
যেকোনো ধরনের খাদ্য থেকেই অ্যালার্জি হতে পারে। তবে, মাত্র কয়েক প্রকারের খাদ্যই মারাত্মক ফুড অ্যালার্জির কারণ আর সেগুলো হল: দুধ, ডিম, মাছ, চিংড়ি বা কাঁকড়া জাতীয় প্রাণী, চিনাবাদাম, সয়াবিন, অন্যান্য বাদাম ও গম। একজন ব্যক্তি যেকোনো বয়সে অ্যালার্জির শিকার হতে পারে। গবেষণা দেখায়, বংশগত কারণে অ্যালার্জি হয়ে থাকে। এমনকী বাবা ও মায়ের মধ্যে যদি একজনেরও অ্যালার্জি থাকে, তা হলে সন্তানের মধ্যেও সেটা সহজেই প্রবেশ করে। অনেক সময়, সন্তানদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনা-আপনিই ফুড অ্যালার্জি সেরে যায়।
মারাত্মক অ্যালার্জির মতো ফুড ইনটলারেন্সে সে-রকম কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। ফুড ইনটলারেন্সে পেটে ব্যথা করে, পেট ফুলে যায় ও গ্যাস হয়, পেট কামড়ায়, মাথাব্যথা করে, গায়ে র্যাশ বের হয়, দুর্বল লাগে কিংবা অস্বস্তি লাগে। বিভিন্ন খাদ্য খাওয়ার ফলে ফুড ইনটলারেন্স হতে পারে, যেমন: দুগ্ধজাত সামগ্রী, গম, ময়দা, মদ্যজাতীয় পানীয় ও ইস্ট।
রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা
আপনার যদি মনে হয় আপনি ফুড অ্যালার্জি বা ফুড ইনটলারেন্সে ভুগছেন আছে, তা হলে আপনি ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করাতে পারেন। নিজে নিজে ডাক্তারি করবেন না। আপনি যদি নিজে আপনার খাদ্যতালিকা থেকে নির্দিষ্ট কিছু খাদ্য বাদ দেন, তা হলে আপনি অপুষ্টিতে ভুগতে পারেন আর এতে শরীরের ক্ষতি হতে পারে।
সাধারণত মারাত্মক ফুড অ্যালার্জি থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায় হল, অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী খাদ্যসামগ্রী সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলা। a অন্যদিকে, আপনার ফুড অ্যালার্জি যদি ততটা মারাত্মক না হয় অথবা আপনি যদি ফুড ইনটলারেন্সে ভোগেন, তা হলে আপনি সেই নির্দিষ্ট খাদ্য আগের চেয়ে কম পরিমাণে খেতে পারেন। আপনি হয়তো সেই খাদ্য ঘন ঘন খাওয়া এড়িয়ে চলতে পারেন আর এভাবে আপনি উপকৃত হতে পারেন। কখনো কখনো হজমে গুরুতর সমস্যা দেখা দিলে, অনেকে বাধ্য হয়ে সেই খাদ্য সম্পূর্ণরূপে অথবা কয়েক দিনের জন্য এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নেয়।
আপনি যদি ফুড অ্যালার্জি কিংবা ফুড ইনটলারেন্সে ভোগেন, তা হলে আপনি হয়তো এটা জেনে সান্ত্বনা পাবেন যে, অনেকে এই রোগের শিকার হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে এবং বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকর ও সুস্বাদু খাদ্য উপভোগ করছে। ◼ (g16-E No. 3)
a অনেক সময়, মারাত্মক অ্যালার্জিতে ভোগে এমন ব্যক্তিরা ডাক্তারের উপদেশ অনুযায়ী নিজেদের কাছে অ্যাড্রেনালিন (এপিনেফ্রিন) ইনজেকশন রাখে। মারাত্মক অ্যালার্জি দেখা দিলে, তারা নিজেরাই নিজেদের শরীরে এই ইনজেকশন নিতে পারে। কোনো কোনো ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী, যে-সন্তানদের অ্যালার্জি রয়েছে, তাদের হাতে এমন কোনো কিছু পরিয়ে দেওয়া উচিত বা তাদের কাছে এমন কোনো প্রমাণপত্র রাখা উচিত, যাতে শিক্ষক-শিক্ষিকা ও যারা তাদের যত্ন নেয়, তারা সহজেই তাদের অবস্থা সম্বন্ধে জানতে পারে।