সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

‘বড় বড় পরিবর্তন’

‘বড় বড় পরিবর্তন’

‘বড় বড় পরিবর্তন’

“মানুষের ইতিহাসে একমাত্র বিংশ শতাব্দীই সবচেয়ে বড় বড় এবং সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনগুলো হতে দেখেছে।”—দ্যা টাইমস আ্যটলাস অফ দ্যা টোয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরি।

কোন সন্দেহ নেই যে বিংশ শতাব্দীর দিকে তাকিয়ে অনেকেই টাইম পত্রিকার সম্পাদক, ওয়ালটার আইজ্যাকসনের সুরে সুর মেলাবেন, যিনি বলেছিলেন: “শতাব্দী এসেছে, শতাব্দী চলে গেছে কিন্তু এই শতাব্দীর মতো এমন একেবারে সতন্ত্র, প্রেরণাদায়ক, কখনও কখনও ভয়ংকর আবার সবসময়ই কৌতূহলজনক শতাব্দী আর কখনও আসেনি।”

নরওয়ের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, গ্রু হারলেম ব্রুন্টল্যান্ডও একই কথা বলেন, তিনি বলেন যে এই শতাব্দী “সমস্ত সীমাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে, . . . মানুষের অসততা চরম অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে।” তিনি বলেন, এই শতাব্দীতে মানুষ “সাফল্যের চূঁড়ায় পৌঁছেছে [এবং কিছু কিছু দেশে] নজিরবিহীন আর্থিক উন্নতি হয়েছে।” কিন্তু একই সময়ে “ঘনবসতি ও দারিদ্রের ফলে আসা রোগ এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের” জন্য দরিদ্র এলাকাগুলোর ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকারে ডুবে গেছে।

রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন

বিংশ শতাব্দী যখন শুরু হয়, তখন চিনের মাঞ্চু রাজবংশ, অটোমেন সাম্রাজ্য এবং ইউরোপের কয়েকটা সাম্রাজ্য পৃথিবীর বেশির ভাগ অঞ্চলকে শাসন করত। কেবল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরই পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ এলাকার ওপর কর্তৃত্ব ছিল আর এটা পৃথিবীর প্রতি ৪ জন মানুষের মধ্যে ১ জনের ওপর শাসন করত। কিন্তু বিংশ শতাব্দী শেষ হওয়ার বহু আগেই এই সাম্রাজ্যগুলো ইতিহাসের পাতায় জায়গা নিয়েছে। দ্যা টাইমস আ্যটলাস অফ দ্যা টোয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরি বলে: ‘১৯৪৫ সালে, সাম্রাজ্যবাদের যুগ শেষ হয়ে গেছে।’

ঔপনিবেশিকতাবাদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সপ্তদশ থেকে উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে জাতীয়তাবাদের ঢেউ বয়ে গিয়েছিল এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তা ছড়িয়ে পড়েছিল। দ্যা নিউ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলে: “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের অনেক দেশেই জাতীয়তাবাদী উৎসাহে ভাটা পড়ে . . . কিন্তু এশিয়া ও আফ্রিকায় মূলত ঔপনিবেশিকতাবাদকে শেষ করার জন্যই জাতীয়তাবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।” দ্যা কলিন্স আ্যটলাস অফ ওয়ার্ল্ড হিস্টোরি অনুসারে, শেষ পর্যন্ত “ইতিহাসে তৃতীয় বিশ্বের আবির্ভাব ঘটেছিল আর পাঁচশ বছর আগে ইউরোপীয়দের দিয়ে যে যুগের সূচনা হয়েছিল তা তখন শেষ হয়ে গিয়েছিল।”

সাম্রাজ্যবাদ ধ্বসে পড়ায় স্বাধীন জাতিগুলোর জন্ম হয়েছিল আর এদের মধ্যে অনেক দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বার বার কঠিন বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিল, যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইউরোপ ও এশিয়ার শক্তিশালী স্বৈরাচারী সরকারগুলো এর বিরোধিতা করেছিল। এই সরকারগুলো ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সীমিত করেছিল এবং অর্থনীতি, প্রচার মাধ্যম ও সামরিক বাহিনীগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, প্রচুর টাকাপয়সা ও মানুষের জীবনের বিনিময়ে, সারা দুনিয়াকে তাদের হাতের মুঠোয় ভরার এই চেষ্টাকে থামানো গিয়েছিল।

যুদ্ধোন্মাদ এক শতাব্দী

যুদ্ধই বিংশ শতাব্দীকে আগের সমস্ত শতাব্দী থেকে আলাদা করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সম্বন্ধে জার্মান ইতিহাসবেত্তা গিডো নপ লেখেন: “১৯১৪ সালের ১লা আগস্ট: কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে উনবিংশ শতাব্দী, যে সময় ইউরোপীয়রা দীর্ঘ দিন শান্তিতে ছিল, তা ওই দিনই শেষ হয়ে যাবে; আর কেউ খেয়ালই করেনি যে বিংশ শতাব্দী আসলে তখনই শুরু হয়ে গিয়েছিল—এক যুদ্ধ দিয়ে, যা ত্রিশ বছর ধরে চলেছিল আর যা দেখিয়েছিল যে মানুষ মানুষের প্রতি কী করতে পারে।”

ইতিহাসের অধ্যাপক, হিউ ব্রোগান আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে “ওই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এক বিরাট ও বিভীষিকাময় ছাপ ফেলেছিল, যা আজও [এই ১৯৯৮ সালেও] মুছে ফেলা যায়নি।” হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক, আকিরা ইরিয়ে লিখেছিলেন: “প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অনেক দিক দিয়েই পূর্ব এশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসকে একেবারে বদলে দিয়েছিল।”

দ্যা নিউ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলে যে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ “বিংশ শতাব্দীর পুরো রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বিপদজনক মোড়” ছিল। এটা আরও বলে, “প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চারটে বড় বড় সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়েছিল . . . , রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল এবং . . . দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভিত তৈরি করেছিল।” এটা একথাও জানায় যে বিশ্বযুদ্ধগুলো “হত্যা, রক্তপাত ও ধ্বংসের দিক দিয়ে আগের যুদ্ধগুলোকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।” গিডো নপও একই কথা বলেন: “নৃশংসতা ও মানুষের পাশবিকতা যতটা কল্পনা করা যায় তার চেয়েও অনেক অনেক গুণ বেশি ছিল। তখন . . . এমন এক যুগের বীজ বোনা হয়েছিল যে যুগে মানুষকে আর মানুষ বলে নয় কিন্তু বস্তু হিসেবে দেখা হবে।”

এইরকম সর্বনাশা যুদ্ধ যাতে আর না হয় সেইজন্য ১৯১৯ সালে জাতিপুঞ্জ গঠন করা হয়। কিন্তু জাতিপুঞ্জ বিশ্বে শান্তি বজায় রাখতে না পারায়, এর জায়গায় ১৯৪৬ সালে রাষ্ট্রসংঘ আসে। রাষ্ট্রসংঘ যদিও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ঠেকাতে পেরেছে কিন্তু ঠাণ্ডা লড়াইকে শেষ করতে পারেনি, যা বহু বছর ধরে পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দিয়ে আসছে। তাছাড়া এটা বলকানের যুদ্ধের মতো বিশ্ব জুড়ে চলতে থাকা ছোটখাটো যুদ্ধগুলোকেও থামাতে পারেনি।

বিশ্বে স্বাধীন জাতির সংখ্যা যতই বেড়েছে, তাদের মধ্যে শান্তি বজায় রাখা ততই কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের মানচিত্রের সঙ্গে আজকের মানচিত্রের তুলনা করলে দেখা যায় যে আফ্রিকায় অন্তত ৫১টা এবং এশিয়ায় ৪৪টা স্বাধীন জাতি রয়েছে যা আগে ছিল না। বর্তমানে রাষ্ট্রসংঘের ১৮৫টা সদস্য দেশের মধ্যে ১১৬টাই, ১৯৪৫ সালে এটা গড়ে ওঠার সময়ে ছিল না!

“অত্যন্ত অদ্ভুত এক ঘটনা”

উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, রাশিয়া ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও ক্ষমতাশালী সাম্রাজ্য। কিন্তু এটা দ্রুত সমর্থন হারাতে থাকে। লেখক জেফ্রি পনটনের মতে, অনেক লোকই মনে করেছিলেন যে “সংস্কারের চেয়ে বিপ্লবই বেশি জরুরি ছিল।” তিনি আরও বলেন: “কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো মহাযুদ্ধ আর এর ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা থেকেই এই বিপ্লব শুরু হয়েছিল।”

রাশিয়ায় বলশেভিকরা ক্ষমতা গ্রহণ করায় তখন এক নতুন সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল আর তা ছিল বিশ্ব সাম্যবাদ, যার সমস্ত দায়দায়িত্ব নিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। যদিও বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের জন্ম হয়েছিল কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এর অস্তিত্ব থেকে যায়। কিন্তু মাইকেল ডবসের ডাউন উইথ বিগ ব্রাদারস বই দাবি করে যে ১৯৭০ দশকের শেষের দিকে “অনেক জাতি নিয়ে গঠিত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এমনভাবে হতে শুরু হয়েছিল যেখান থেকে উঠে আসা এর জন্য আর সম্ভব ছিল না।”

কিন্তু তবুও এর পতন আচমকাই হয়েছিল। নরম্যান ডেভিসের ইউরোপ—এক ইতিহাস (ইংরেজি) বইটা বলে: “এর পতন যত তাড়াতাড়ি হয়েছিল তা ইউরোপের ইতিহাসের অন্যান্য বড় বড় পতনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল” আর “এর পতনের কারণগুলো ছিল খুবই সাধারণ।” পনটন বলেন, সত্যিই “সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান, উন্নয়ন ও পতন” ছিল “বিংশ শতাব্দীর অত্যন্ত অদ্ভুত এক ঘটনা।”

আসলে বিংশ শতাব্দীতে একের পর এক বড় বড় পরিবর্তন হয়েছে, যেগুলোর প্রভাব অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল আর তার মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ছিল মাত্র একটা। অবশ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন নতুন কিছু নয়। হাজার হাজার বছর ধরে এগুলো ঘটে চলছে।

কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে সরকার ব্যবস্থায় আরেকটা পরিবর্তনও হয়েছে আর যা ছিল বিশেষ কিছু। এই পরিবর্তনটা কী এবং এটা আপনাকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা আমরা পরে দেখব।

তার আগে আসুন আমরা বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান কী কী আশ্চর্য কাজ করেছে তা একটু দেখি। এই সম্বন্ধে অধ্যাপক মাইকেল হাওয়ার্ড বলেন: “পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার লোকেদের বিংশ শতাব্দীকে মানুষের ইতিহাসের এক নতুন ও সৌভাগ্যের যুগ হিসেবে স্বাগত জানানোর কারণ ছিল।” কিন্তু বিজ্ঞানের এই অগ্রগতি কি লোকেদেরকে আরও উন্নত জীবনে পৌঁছে দিয়েছে?

[২-৭ পৃষ্ঠার তালিকা/চিত্রগুলো]

(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)

১৯০১

৬৪ বছর রাজত্বের পর রানি ভিক্টোরিয়া মারা যান

পৃথিবীর জনসংখ্যা ১৬০ কোটি

১৯১৪

আর্চডিউক ফার্দিনান্দ আততায়ীদের হাতে নিহত হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়

রাশিয়ার শেষ সম্রাট, নিকোলাস দ্বিতীয় ও তার পরিবার

১৯১৭

লেনিন রাশিয়ায় বিপ্লব ঘটান

১৯১৯

জাতিপুঞ্জ গঠিত হয়

১৯২৯

যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজার পড়ে যাওয়ায় মহামন্দা দেখা দেয়

গান্ধী ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান

১৯৩৯

এডল্ফ হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়

উইনস্টন চার্চিল ১৯৪০ সালে গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন

ব্যাপক হত্যাকাণ্ড

১৯৪১

পার্ল হারবারে জাপানের বোমা নিক্ষেপ

১৯৪৫

হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকার পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ

১৯৪৬

রাষ্ট্রসংঘ গণপরিষদের প্রথম সভা হয়

১৯৪৯

মাও সে-তুং গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের ঘোষণা করেন

১৯৬০

আফ্রিকায় সতেরটা নতুন জাতির জন্ম হয়

১৯৭৫

ভিয়েতনামের যুদ্ধ শেষ হয়

১৯৮৯

সাম্যবাদ ক্ষমতা হারালে বার্লিনের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়

১৯৯১

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়