সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

খালি চোখে যা দেখা যায় না

খালি চোখে যা দেখা যায় না

খালি চোখে যা দেখা যায় না

সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ধূলিকণা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এগুলোকে আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। কিন্তু, জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে যখন সূর্যের আলো ঘরে আসে তখন আলোর স্তম্ভ তৈরি হয় আর সেই আলোয় আচমকাই অদৃশ্য বস্তুগুলো আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। জানালা গলে আসা আলোকরশ্মিতে বাতাসে ভেসে বেড়ানো ধূলিকণাগুলো দেখতে পাওয়া যায়।

এছাড়াও আমাদের চারিদিকে যে আলো আমরা দেখতে পাই তার কথাও একটু ভেবে দেখুন। খালি চোখে এই আলোকে সাদা বা বর্ণহীন বলে মনে হয়। কিন্তু সূর্যের আলো যদি সঠিক কোণ থেকে এক বিন্দু জলের ভেতর দিয়ে চলে যায়, তাহলে কী দেখা যাবে? ওই জলের বিন্দু প্রিজমের মতো কাজ করে আর আমরা এক অপূর্ব রংধনু দেখতে পাই!

আসলে আমাদের চারপাশে যে সমস্ত বস্তু রয়েছে সেগুলো আলোকরশ্মির বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে প্রতিফলিত করে আর এর ফলেই আমরা বিভিন্ন রং দেখতে পাই। উদাহরণ হিসেবে সবুজ ঘাসের কথাই বলা যায়। সবুজ ঘাস নিজে নিজে সবুজ আলো উৎপন্ন করতে পারে না কিন্তু তা আলোকরশ্মির সবুজ ছাড়া বাকি সমস্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলোকে শুষে নেয়। শুধু সবুজ তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে ফিরিয়ে দেয়, যা আমাদের চোখে প্রতিফলিত হয় আর এর ফলে আমরা ঘাসকে সবুজ দেখি।

মানুষের তৈরি যন্ত্রগুলোর সাহায্য নেওয়া

সম্প্রতি অনেক নতুন নতুন যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে আর এর ফলে আগে আমরা যে জিনিসগুলো খালি চোখে দেখতে পারতাম না, তা এখন এই যন্ত্রগুলোর সাহায্যে দেখতে পাই। আগে এক বিন্দু জলকে নির্জীব বলেই মনে হতো কিন্তু এখন একটা সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে আমরা যদি ওই এক বিন্দু জলকে দেখি, তাহলে দেখব যে এতে বিভিন্নরকমের জীব ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা চুল দেখতে মসৃণ মনে হয় কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রাখলে এটাকে খাঁজ-কাটা ও অমসৃণ দেখায়। খুবই শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রগুলো একটা জিনিসকে দশ লক্ষ গুণ বড় করতে পারে। এইরকম অণুবীক্ষণ যন্ত্র একটা ডাকটিকিটকে ছোটখাটো একটা দেশের আকার দিতে পারে!

এখন আরও শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা কোন বস্তুর পৃষ্ঠ বা তলে পরমাণুগুলো কীভাবে সাজানো থাকে তা দেখতে পারেন। আর এর ফলে কিছু বছর আগেও মানুষ যা দেখতে পারত না, তা এখন দেখতে পারছে।

অন্য দিকে, রাতের আকাশে তাকিয়ে আমরা অনেক অনেক তারা দেখি। কিন্তু কটা? খালি চোখে আমরা বড় জোর কয়েক হাজার তারা দেখি। কিন্তু, প্রায় ৪০০ বছর আগে দূরবিন উদ্ভাবনের পর লোকেরা আরও অনেক অনেক তারা দেখতে পায়। পরে ১৯২০ এর দশকে মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরিতে একটা শক্তিশালী দূরবিনের সাহায্য দেখা গিয়েছিল, আমরা যে ছায়াপথে আছি সেটা ছাড়াও আরও অনেক অনেক ছায়াপথ আছে আর সেগুলোতে অসংখ্য তারা রয়েছে। আজকে মানুষের তৈরি জটিল যন্ত্র দিয়ে মহাবিশ্বকে নিরীক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা বলেন যে, এই মহাবিশ্বে কোটি কোটি ছায়াপথ রয়েছে আর এই ছায়াপথগুলোর অনেকগুলোতে আবার কয়েক শত কোটি তারা রয়েছে!

খালি চোখে কোটি কোটি তারাকে খুব কাছাকাছি বলে মনে হয় আর এভাবেই মিল্কি ওয়ে ছায়াপথ তৈরি হয় কিন্তু দূরবিনের সাহায্যে দেখা গেছে যে কোটি কোটি তারা একটা থেকে আরেকটা এত দূরে রয়েছে যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। এটা সত্যিই আমাদের অবাক করে। একইভাবে শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র আমাদেরকে সেই সমস্ত জিনিসগুলোকে দেখতে সাহায্য করেছে যেগুলোকে দেখতে কঠিন মনে হলেও আসলে সেগুলো বিভিন্নরকমের পরমাণু দিয়ে তৈরি আর এই পরমাণুগুলোর ভেতরটা ফাঁপা।

ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র

সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে যে বস্তুকে একটা বিন্দুর মতো মনে হয়, সেটাই এক হাজার কোটি পরমাণু দিয়ে গঠিত! এছাড়াও, ১৮৯৭ সালে আবিষ্কার করা হয়েছে যে পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রন নামে সূক্ষ্ম কণিকা রয়েছে যা কক্ষপথে ঘুরছে। এই ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর কেন্দ্রের চারিদিকে ঘুরছে আর পরে জানা গেছে যে এই কেন্দ্র নিউট্রন ও প্রোটন নামে কিছুটা বড় কণিকা দ্বারা গঠিত। এই পৃথিবীতে মোট ৮৮টা প্রাকৃতিক মৌল বা পরমাণু রয়েছে, যেগুলোর আকার মূলত একই কিন্তু ওজন বিভিন্ন কারণ এগুলোতে ওই তিনটে কণিকা ক্রমান্বয়ে আরও বেশি সংখ্যায় থাকে।

ইলেকট্রনগুলো যেমন হাইড্রোজেন পরমাণুর ক্ষেত্রে একটা ইলেকট্রন, এক সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময়ে পরমাণু কেন্দ্রের চারিদিকে কোটি কোটি বার ঘুরছে আর এভাবে তা পরমাণুকে আকার দেয় ও এটাকে কঠিন পদার্থের মতো করে তোলে। প্রায় ১,৮৪০টা ইলেকট্রনের ভর একটা প্রোটন বা নিউট্রনের ভরের সমান। আর প্রোটন ও নিউট্রন দুটোই একটা সম্পূর্ণ পরমাণুর চেয়ে ১,০০,০০০ গুণ ছোট!

একটা পরমাণু কতটা ফাঁপা সেই সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা পাওয়ার জন্য একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর কেন্দ্রকে কল্পনা করুন যেটাকে ঘিরে ইলেকট্রন ঘুরছে। পরমাণুর ওই কেন্দ্র যদি মাত্র একটা প্রোটন নিয়ে গঠিত হয় ও এর আকার যদি একটা টেনিস বলের মতো ধরা হয়, তাহলে এটাকে ঘিরে ইলেকট্রন প্রায় তিন কিলোমিটার দূর দিয়ে ঘুরবে!

ইলেকট্রন আবিষ্কৃত হওয়ার একশ বছরের পূর্তিতে একটা রিপোর্ট জানায়: “যেটা কেউই দেখেনি, যেটার আকার চোখে দেখা যায় না কিন্তু ওজন ও বৈদ্যুতিক আধান রয়েছে এবং লাটিমের মতো ঘোরে, সেটার শততম বার্ষিকী পালন করতে খুব কম লোকই দ্বিধা করে। . . . আমরা দেখতে পাই না এমন কিছুর অস্তিত্ব সম্বন্ধে কেউই আজকে প্রশ্ন তোলে না।”

আরও ক্ষুদ্র কণিকা

পরমাণু চূর্ণকারী যন্ত্র পরমাণুর কণিকাগুলোকে একটার দিকে আরেকটাকে এত জোরে নিক্ষেপ করতে পারে যে এর ফলে আজকে বিজ্ঞানীরা পরমাণুর কেন্দ্রের ভেতরটা দেখতে পারেন। আর তাই আরও অনেক কণিকা সম্বন্ধে জানা যায় যেগুলোর নাম হয়তো আমাদের কাছে নতুন যেমন পজিট্রন, ফোটন, মেসন, কোয়ার্ক, গ্লুয়ন ইত্যাদি। এগুলোর একটাকেও চোখে দেখা যায় না এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও নয়। কিন্তু, মেঘ ও বুদবুদ প্রকোষ্ঠ এবং সিনটিলেশন কাউন্টারের মতো যন্ত্রের সাহায্যে এগুলো যে সত্যিই আছে তা বোঝা যায়।

একসময় যে বস্তুগুলো দেখা যেত না এখন গবেষকেরা তা দেখতে পারছেন। আর এই কারণে তারা যে চারটে মৌলিক বল আছে বলে মনে করেন সেগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পারছেন। এই বলগুলো হল অভিকর্ষ বল, তড়িৎ-চুম্বকীয় বল এবং দুটো উপনিউক্লীয় বল যার একটা “ক্ষীণ বল” ও অন্যটা “শক্তিশালী বল।” কিছু বিজ্ঞানীরা “থিওরি অফ এভরিথিং” বের করার চেষ্টা করে চলেছেন কারণ তারা আশা করেন যে এই থিওরি তাদেরকে মহাবিশ্বের বড় থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়গুলো বুঝতে সাহায্য করবে।

খালি চোখে যা দেখা যায় না, তা দেখে আমরা কী শিখতে পারি? আর অনেকে যা দেখেছেন তার ওপর ভিত্তি করে কোন্‌ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন? পরের প্রবন্ধে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া হবে।

[৩ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

নিকেল (ওপরে) ও প্লাটিনাম পরমাণুর বিন্যাস

[সৌজন্যে]

Courtesy IBM Corporation, Research Division, Almaden Research Center