সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

মরণ “চুম্বনের” সঙ্গে লড়াই করা

মরণ “চুম্বনের” সঙ্গে লড়াই করা

মরণ “চুম্বনের” সঙ্গে লড়াই করা

ব্রাজিলের সচেতন থাক! সংবাদদাতা কর্তৃ ক

নিঝুম রাতে আপনি যখন গভীর ঘুমে মগ্ন তখন এটা আপনার কাছে আসে। তবে এটা আপনার ঘুম ভাঙায় না। আর এমনকি সর্বনাশা ‘চুমু’ দেওয়ার সময়ও আপনি একটুও টের পান না।

নিশাচর এই অবাঞ্চিত চুম্বনকারীকে গুবরেপোকা বা কাঁচপোকা বলে। এছাড়া এটাকে চুম্বন পোকাও বলে আর দক্ষিণ আমেরিকায় এই পোকা প্রচুর পরিমাণে জন্মে। এই পোকা ১৫ মিনিট ধরে ‘চুমু’ দিতে পারে আর সেই সময় এটা ধীরে ধীরে আপনার রক্ত শুষে নেয়। কিন্তু এই ‘চুমু’ আপনার কোন ক্ষতি করবে না, যদি না এটা আপনার ত্বকের ওপর মলত্যাগ করে। এই পোকার মলের মধ্যে ট্রাইপ্যানোসোমা ক্রুজি অথবা সংক্ষেপে টি. ক্রুজি নামে এক অতি ক্ষুদ্র জীবাণু থাকে। চোখ, মুখ অথবা শরীরে কোন কাটা জায়গা দিয়ে এই জীবাণু যদি আপনার শরীরে ঢোকে, তাহলে এর জন্য আ্যমেরিকান ট্রাইপ্যানোসোমায়াসিস হতে পারে, যা স্যাগাস রোগ নামেই বেশি পরিচিত।

প্রাথমিক পর্যায়ে স্যাগাস রোগের প্রধান উপসর্গ হল রোগীর চোখ ফুলে যাওয়া। এছাড়া ক্লান্তি, জ্বর, ক্ষুধামান্দ্য অথবা ডায়রিয়াও হতে পারে। তারপর সাধারণত এক বা দুমাস পর কোনরকম চিকিৎসা ছাড়াই এগুলো ভাল হয়ে যায়। তবে পরে এই রোগ ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। এই পোকা যাকে কামড়েছে তার শরীরে এই জীবাণু সংক্রমণের প্রায় ১০ থেকে ২০ বছর পর হার্টের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন তার হৃদস্পন্দন কমবেশী হতে পারে বা এমনকি হৃদক্রিয়া বন্ধও হয়ে যেতে পারে। *

হিসেব করে দেখা গেছে যে প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ লোক স্যাগাস রোগে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ৫০,০০০ জন এই রোগে ভুগে মারা যায়। তবে এদের সবাইকেই যে এই পোকা কামড়ায় তা কিন্তু নয়। যেমন মায়েরা যদি এই রোগে আক্রান্ত থাকে, তাহলে বাচ্চারা মায়ের দুধের মাধ্যমে এই রোগে আক্রান্ত হয়। একজন গর্ভবতী মহিলা তার গর্ভের শিশুর মধ্যেও এই রোগ দিয়ে দিতে পারে বা জন্মের সময়েও শিশু এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া রক্ত নিলে এবং টি. ক্রুজি জীবাণুযুক্ত খাবার যদি কাঁচা খাওয়া হয়, তাহলেও লোকেরা এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। *

স্যাগাস রোগ দমন করার জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? কীটনাশক ওষুধ দিয়ে গুবরেপোকার বংশ নিধন করা যায়। কিন্তু, ঘরে স্প্রে করা ঝামেলার ব্যাপার কারণ প্রতি ছয় মাস পর পর তা করতে হবে। রিও ডি জেনেরিওর ফেডারেল ইউনিভারসিটি আরেকটা বিকল্প পদ্ধতি বের করেছে। তারা এমন একটা রং তৈরি করেছে যেটার মধ্যে কীটনাশক মেশানো থাকে। পরীক্ষা করার জন্য প্রায় ৪,৮০০টা ঘরে এই রং দেওয়া হয়েছে। এর ফল কী হয়েছে? দুবছর পর ৮০ শতাংশ ঘরেই কোন পোকা ছিল না। এছাড়াও গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন, নিম পাতা বা ব্রাজিলের সিনামোমো গাছের মধ্যে জীবাণু দ্বারা বিভাজিত হয় এমন এক ধরনের নির্বিষ উপাদান (আ্যজাডাইরেকটিন) আছে, যা শুধু সংক্রমিত গুবরেপোকাকেই আরোগ্য করে না সেইসঙ্গে কোন পোকা যাতে সংক্রমিত না হয় তাতেও সাহায্য করে।

আক্রান্তদের জন্য সাহায্য

প্রতি বছর যে লাখ লাখ লোকেরা স্যাগাস রোগে আক্রান্ত হয় তাদের কি সুস্থ হওয়ার কোন আশা আছে? হ্যাঁ আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার কিছু বিজ্ঞানী টি. ক্রুজি জীবাণুর ১০,০০০টা জিনের রহস্য জানার চেষ্টা করছেন। এর ফলে হয়তো রোগ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা, প্রতিষেধক টীকা ও আরও অন্যান্য ওষুধ বের করা সম্ভব হবে।

১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে বিজ্ঞানীরা টি. ক্রুজির জরুরি প্রোটিনগুলোর গঠন পরীক্ষা করার জন্য মহাকাশযান কলাম্বিয়ায় করে মহাশূন্যে পাঠিয়েছিলেন যেখানে অভিকর্ষীয় বল একেবারে নেই বললেই চলে। টি. ক্রুজি জীবাণুর গঠনের উপযোগী ওষুধ তৈরি করার জন্য এটা হল প্রাথমিক ধাপ। এখন পর্যন্ত এই রোগের কোন ওষুধ তৈরি করা হয়নি, তাই নতুন ওষুধ আবিষ্কার করা জরুরি কারণ এই রোগ চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলে খুবই মারাত্মক আকার ধারণ করে। *

রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করলে উপকার পাওয়া যায় তা জানতে পেরে কন্সটানসা ব্রিটো নামে ব্রাজিলের একজন জীববিজ্ঞানী পলিমেরাস চেইন রিয়েকশন পরীক্ষা উদ্ভাবন করেন, যে পরীক্ষার মাধ্যমে দুদিনের মধ্যেই রোগ নির্ণয় করা যায়। কিন্তু, দুঃখের বিষয় হল যে অনেকে প্রাথমিক পর্যায়ে বুঝতেই পারে না যে তাদের এই রোগ হয়েছে।

প্রতিরোধই আসল

আপনি যদি এমন কোন জায়গায় থাকেন যেখানে গুবরেপোকা খুব বেশি, তাহলে আপনি আগে থেকে কীভাবে সাবধান হতে পারেন?

আপনি যদি মাটি বা খড়পাতা দিয়ে তৈরি ঘরে থাকেন, তাহলে সবসময় মশারি ব্যবহার করুন।

কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করুন। তাহলে এই পোকার দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকবে।

দেয়ালে বা ছাদে কোন ফাটল বা ছিদ্র থাকলে সেগুলো শীঘ্রিই মেরামত করুন কারণ এই সমস্ত জায়গাতেই গুবরেপোকা বংশ বৃদ্ধি করে।

আপনার ঘরদোর এবং ছবি বা আসবাবপত্রের পেছনের দিকটা সবসময় পরিষ্কার রাখুন।

ম্যাট্রেস ও কম্বল মাঝে মাঝে রোদে দিন।

মনে রাখবেন, গৃহপালিত ও বন্য পশুপাখিরা এদের শরীরে এই জীবাণু বহন করতে পারে।

কোন পোকাকে যদি গুবরেপোকা বলে সন্দেহ লাগে, তাহলে এটাকে পরীক্ষা করার জন্য কাছের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পাঠান।

[পাদটীকাগুলো]

^ বিভিন্ন রকমের উপসর্গ দেখা দিতে পারে তবে সবগুলোই স্যাগাস রোগের উপসর্গ নয়। এখানে শুধু সাধারণ কয়েকটা উপসর্গ দেওয়া হয়েছে কিন্তু এগুলো দেখে যেন কেউ রোগ নির্ণয় করার চেষ্টা না করেন। অনেকের বেলায় রোগ একেবারে চূড়ান্ত অবস্থায় না পৌঁছানো পর্যন্ত এই রোগের কোন উপসর্গ দেখা যায় না।

^ দ্যা ইউ.এস. সেন্টারস্‌ ফর ডিজিস কন্ট্রোল আ্যন্ড প্রিভেনশন বলে যে, রক্তে স্যাগাস রোগের জীবাণু আছে কি না, তা কিছু দেশে সবসময় পরীক্ষা করা হয় না।

^ ডাক্তাররা টি. ক্রুজির চিকিৎসা করার জন্য নিফার্টিমক্স ব্যবহার করেন কিন্তু প্রায়ই এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো খুবই ভয়াবহ হয়।

[১৩ পৃষ্ঠার বাক্স]

স্যাগাস রোগ আবিষ্কার

কার্লোস স্যাগাস নামে ব্রাজিলের একজন ডাক্তার ১৯০৯ সালে ব্রাজিলের মাইনাস জেরেইস রাজ্যে ডাক্তারি করতেন। তখন ওই জায়গায় ম্যালেরিয়া রোগ দেখা দেয় আর এইজন্য ট্রেনের লাইন বানানোর কাজ পিছিয়ে পড়ে। তার কাছে এমন অনেক রোগীরা আসেন যাদের লক্ষণগুলো, জানা কোন রোগের সঙ্গে মিলত না। এছাড়াও, তিনি দেখেছিলেন যে ওই এলাকার ঘরবাড়িগুলো গুবরেপোকায় ভরা ছিল যেগুলো রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে। এই পোকার অন্ত্র পরীক্ষা করে কার্লোস স্যাগাস একটা নতুন প্রোটোজোয়া আবিষ্কার করেন। তার বিজ্ঞানী বন্ধু অসওয়ালডো ক্রুজকে সম্মান দেখিয়ে এটার নাম দেন ট্রাইপ্যানোসোমা ক্রুজি। এই নতুন রোগের নাম কার্লোস স্যাগাসের নামে রাখা একেবারে উপযুক্ত কারণ তার অক্লান্ত গবেষণার জন্যই এই রোগ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে।

[১২, ১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

গ্রামাঞ্চলের বাড়িঘরগুলোতে প্রায়ই গুবরেপোকার উপদ্রব দেখা যায়

[সৌজন্যে]

ফটো: PAHO/WHO/P. ALMASY