সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

লুইস ব্রেইল অন্ধকারে বন্দি লোকেদের কাছে আলো পৌঁছে দেন

লুইস ব্রেইল অন্ধকারে বন্দি লোকেদের কাছে আলো পৌঁছে দেন

লুইস ব্রেইল অন্ধকারে বন্দি লোকেদের কাছে আলো পৌঁছে দেন

আপনার কাছে পড়ালেখার মূল্য কতখানি? কেউ কেউ হয়তো পড়ালেখাকে ততটা গুরুত্ব দেন না কিন্তু পড়ালেখাই হল জ্ঞানলাভের মূল ভিত্তি। পড়তে না জানলে মানুষ কখনোই বিশাল জ্ঞানভাণ্ডারের নাগাল পেতে পারে না।

শত শত বছর ধরে অন্ধ লোকেরা পড়তে পারত না। কিন্তু উনিশ শতকে একজন আন্তরিক যুবক, অন্ধদের কথা চিন্তা করে একটা পদ্ধতি বের করেন, যেটা স্বয়ং তাকে ও হাজার হাজার অন্ধ ব্যক্তিদেরকে আশার আলো দেখিয়েছে।

দুঃখের মাঝে আশার আলো

লুইস ব্রেইল ১৮০৯ সালে ফ্রান্সের প্যারিস শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে কুভ্রে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সাইমন রেনে ব্রেইল বর্ম তৈরি করে সংসার চালাতেন। ছোটবেলায় লুইস সম্ভবত প্রায়ই তার বাবার কারখানায় গিয়ে খেলা করত। আর এখানেই একদিন এক ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে। একদিন খেলতে খেলতে লুইস একটা সূচালো হাতিয়ার নিজের চোখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। সেই চোখ চিরদিনের জন্য নষ্ট হয়ে যায়। এর চেয়েও দুঃখজনক হল, খুব তাড়াতাড়ি তার অন্য চোখও সংক্রামিত হয়। মাত্র তিন বছর বয়সে লুইসের দুচোখই অন্ধ হয়ে যায়।

লুইসের জীবনটা যেন নষ্ট না হয় সেইজন্য লুইসের বাবামা ও সেখানকার গির্জার যাজক জ্যাকুস পলি সেখানকার স্কুলে লুইসকে ভর্তি করে দেন। লুইস শুনে শুনেই অনেক কিছু শিখে ফেলত। কয়েক বছর ধরে লুইস ক্লাসের সবচেয়ে ভাল ছাত্র ছিল! কিন্তু ভাল ছাত্র হলে হবে কী, এভাবে পড়ালেখা করতে গিয়ে অন্ধত্ব তার জন্য একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় কারণ পড়ালেখা করার ওই পদ্ধতিটা ছিল যাদের চোখ আছে শুধু তাদের জন্য। তাই, ১৮১৯ সালে লুইসকে রয়্যাল ইনস্টিটিউট ফর ব্লাইন্ড ইয়ুথ-এ ভর্তি করে দেওয়া হয়।

ওই ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেনটিন হোয়ই প্রথম অন্ধদের পড়তে সাহায্য করার জন্য একটা পদ্ধতি বের করেন। অন্ধরা পড়ালেখা করতে পারবে না, সেই সময়ের লোকেদের এই ধারণাকে তিনি ভুল প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। হোয় প্রথমে মোটা কাগজের ওপর বর্ণমালার অক্ষরগুলো বড় আকারে উঁচু করে সাজিয়েছিলেন। এই পদ্ধতিটা যদিও খুব একটা ভাল ছিল না কিন্তু এর ওপর ভিত্তি করেই পরে উন্নত পদ্ধতি বের করা হয়েছিল।

হোয়ের ছোট লাইব্রেরিতে উঁচু করে তৈরি বড় অক্ষরের কিছু বই ছিল। আর সেখান থেকেই ব্রেইল এই বড় অক্ষরগুলো কীভাবে পড়তে হয় তা শিখেছিলেন। কিন্তু শীঘ্রিই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এভাবে শিখতে অনেক সময় লাগবে এবং এই পদ্ধতি খুব একটা ব্যবহারিকও নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা হল অক্ষরগুলো আঙুলের জন্য নয় কিন্তু চোখের জন্য করা তৈরি হয়েছিল। তবে খুশির বিষয় হল যে একজন ব্যক্তি এই অসুবিধাগুলো বুঝতে পেরেছিলেন আর সাহায্য করার জন্য তিনি এগিয়ে আসেন।

অপ্রত্যাশিত সাহায্য

১৮২১ সালে লুইস ব্রেইলের বয়স যখন মাত্র ১২ বছর তখন চার্লস বার্বিয়া নামে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা ক্যাপ্টেন ওই প্রতিষ্ঠানে আসেন। সেখানে তিনি পড়ার একটা পদ্ধতি সম্বন্ধে বলেন, যেটাকে রাতে পড়ার পদ্ধতি বলা হতো। পরে এটাকে সনোগ্রাফি নাম দেওয়া হয়। এই পদ্ধতি যুদ্ধের সময় ব্যবহার করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এই পদ্ধতিতে ওপর থেকে নিচের দিকে উঁচু করা ছটা বিন্দু ও পাশে সর্বোচ্চ দুটো বিন্দু দিয়ে সাজিয়ে অক্ষর বানানো হতো আর এই অক্ষরগুলোকে স্পর্শ করে বোঝা যেত। পড়ার জন্য সংকেতলিপি ব্যবহার করার এই পদ্ধতির ব্যাপারে ওই স্কুলের সবাই-ই বেশ আগ্রহ দেখিয়েছিল। ব্রেইল খুব উৎসাহ নিয়ে এই পদ্ধতিটা শিখেছিলেন এবং পরে এটাকে আরও উন্নত করেছিলেন। কিন্তু, এই পদ্ধতিকে ব্যবহারিক করার জন্য তাকে এর পেছনে লেগে থাকতে হয়েছিল। তিনি তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন: “বিভিন্ন মানুষ, তাদের ধ্যানধারণা, মতবাদ ও ঘটনা সম্বন্ধে জানার ক্ষেত্রে অন্ধত্ব যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আমাকে অন্য পথ বের করতে হবে।”

তাই সংকেতলিপিকে আরও সহজ করার জন্য পরের দুবছর ব্রেইল অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ওই সংকেতলিপিকে সংশোধন করে একটা সহজ ও সুন্দর পদ্ধতি বের করেন, যেটাতে একটা কুঠরিতে ওপর থেকে নিচে সর্বোচ্চ তিনটে বিন্দু ও পাশে সর্বোচ্চ দুটো বিন্দু দিয়ে সাজিয়ে অক্ষর তৈরি করতে হতো। ১৮২৪ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে লুইস ব্রেইল ছয় বিন্দু সম্বলিত একটা পদ্ধতি বানানো শেষ করেন। তার অল্প কিছুদিন পরই অন্ধদের ওই ইনস্টিটিউটে ব্রেইল এই পদ্ধতি শেখাতে শুরু করেন এবং ১৮২৯ সালে তিনি এই পদ্ধতি নিয়ে একটা বই ছাপান। এই পদ্ধতিটা আজকে তার নামে পরিচিত। ছোটখাটো কিছু সংশোধন ছাড়া তার এই পদ্ধতি আজও আগের মতোই আছে।

সারা পৃথিবীতে ব্রেইল পদ্ধতিকে ছড়িয়ে দেওয়া

১৮২০ দশকের শেষ দিকে বিন্দু দিয়ে কীভাবে ব্রেইল অক্ষর লেখা হয়, তা বুঝিয়ে প্রথমে একটা বই ছাপানো হয়; কিন্তু সেটা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে কিছুটা সময় লেগেছিল। এমনকি ওই ইনস্টিটিউটেও ব্রেইল মারা যাওয়ার দুবছর পর অর্থাৎ ১৮৫৪ সালে এই নতুন সংকেতলিপিকে সরকারিভাবে গ্রহণ করা হয়। আর শেষ পর্যন্ত এই পদ্ধতিই সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি বলে সবাই মেনে নেয়।

কয়েকটা সংগঠন ব্রেইল অক্ষরে বইপত্র ছাপিয়েছে। ওয়াচটাওয়ার সোসাইটি ১৯১২ সাল থেকে ব্রেইল অক্ষরে বইপত্র ছাপাতে শুরু করেছে আর সেই সময়ে ইংরেজি ভাষায় ব্রেইল অক্ষর বানানোর কাজ চলছিল। আজকে, উন্নত ব্রেইল ছাপার পদ্ধতি ব্যবহার করে সোসাইটি প্রতি বছর আটটা ভাষায় লাখ লাখ পৃষ্ঠায় ব্রেইল অক্ষর ছাপায় এবং ৭০টারও বেশি দেশে এই বইপত্র বিতরণ করে। ব্রেইল অক্ষরে তৈরি বাইবেল ভিত্তিক বইপত্রের চাহিদা বাড়ার কারণে সোসাইটি এখন দ্বিগুণ পরিমাণে বইপত্র ছাপাতে শুরু করেছে।

প্রায় দুশ বছর আগে একটা ছোট ছেলের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য আজকে প্রায় লাখ লাখ অন্ধ লোকেরা সহজ, সুন্দর ব্রেইল অক্ষরে লেখা বইপত্র পড়তে পারছেন।

[১৫ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্রগুলো]

ব্রেইল সংকেতলিপিকে যেভাবে পড়া হয়

ব্রেইল অক্ষর বাঁ দিক থেকে ডান দিকে এক হাত বা দুহাত বুলিয়েই পড়া যায়। প্রত্যেকটা ব্রেইল কুঠরির বিন্দুগুলোকে ৬৩ রকমভাবে সাজানো যায়। অতএব, ওই বিন্দুগুলোকে নির্দিষ্টভাবে সাজিয়ে বেশির ভাগ ভাষার বর্ণমালার প্রত্যেকটা অক্ষর ও বিরাম চিহ্নগুলোকে লেখা যায়। ব্রেইল অক্ষরে নির্দিষ্ট কিছু কুঠরি আছে যেগুলো শুধু যে শব্দগুলো বার বার লেখা হয় সেগুলোর জন্য ব্যবহার করা হয় আর কিছু ভাষায় ব্রেইল অক্ষরের সংক্ষিপ্ত রূপ আছে। কিছু লোকেরা ব্রেইল বর্ণ পদ্ধতিতে এতটাই দক্ষ যে তারা প্রতি মিনিটে প্রায় দুশটা শব্দ পড়তে পারে!

[চিত্রগুলো]

প্রথম দশটা বর্ণে শুধু ওপরের দুসারিতে বিন্দু সাজানো হয়

দ্বিতীয় দশটা বর্ণে প্রথম দশটা বর্ণের নিচে শুধু বাঁ দিকে একটা করে বিন্দু যোগ করা হয়

শেষের পাঁচটা বর্ণে প্রথম পাঁচটা বর্ণের সঙ্গে নিচে দুদিকেই দুটো করে বিন্দু যোগ করা হয়; “w” হল ব্যতিক্রম কারণ এই অক্ষরটাকে পরে ফ্রেঞ্চ বর্ণমালায় যোগ করা হয়েছিল

[১৪ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

ফটো: © Maison Natale de Louis Braille - Coupvray, France/Photo Jean-Claude Yon