সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

শরীরকে সাজানোর ব্যাপারে বিচার-বুদ্ধি খাটানো দরকার

শরীরকে সাজানোর ব্যাপারে বিচার-বুদ্ধি খাটানো দরকার

বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গি

শরীরকে সাজানোর ব্যাপারে বিচার-বুদ্ধি খাটানো দরকার

একজন ফরাসি উপন্যাস লেখিকা লিখেছিলেন যে “সাজগোজ বিচার-বুদ্ধিকে নষ্ট করে দেয়।” শত শত বছর ধরে সাজগোজের জন্য মানুষ যা কিছু করেছে তার অনেক কাজেই বিচার-বুদ্ধি প্রকাশ পায়নি। উদাহরণ হিসেবে উনিশ শতকের কথা বলা যায়। সেই সময় মেয়েরা তাদের কোমরকে সরু করার জন্য একরকমের অন্তর্বাস পরত আর সেটা তারা এতটা আঁটসাঁট করে পরত যে তাদের শ্বাস নিতে কষ্ট হতো। সেই সময় কেউ কেউ দাবি করেছিল যে তাদের কোমর মাত্র ৩২৫ মিলিমিটার। কিছু মহিলা এত আঁটসাঁট অন্তর্বাস পরত যে তাদের পাঁজরের হাড়গুলো লিভারের ভেতরে ঢুকে যেত আর এর ফলে তারা মারাও গিয়েছিল।

কিন্তু, খুশির বিষয় হল যে ওই উদ্ভট ফ্যাশন এখন আর নেই, তবে সেই সময়ের মতো উদ্ভট সাজগোজ আজও করতে দেখা যায়। ছেলেমেয়েরা এখনও তাদের চেহারায় ভিন্ন রূপ আনার জন্য জটিল আর এমনকি বিপদজনক সাজগোজ করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে শরীরে উল্কি আঁকার ও ফুটো করার পার্লারগুলোর কথা বলা যায়। একসময় লোকেরা এগুলোকে খারাপ চোখে দেখত কিন্তু হঠাৎ করেই শহরের বড় বড় বিপণিকেন্দ্রে ও শহরের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় এগুলো ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে। আর সম্প্রতি এক বছর আমেরিকায় উল্কি আঁকা ছিল ষষ্ঠতম খুচরো ব্যাবসা, যা খুব দ্রুত প্রসার লাভ করেছিল।

শুধু তাই নয়, শরীরকে সাজানোর জন্য যুবক-যুবতীরা দিন দিন আরও অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করছে। শরীরের যেখানে সেখানে যেমন স্তনবৃন্ত, নাক, জিহ্বা আর এমনকি যৌনাঙ্গে ফুটো করা দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কিন্তু, কেউ কেউ এসব জায়গায় ফুটো করার মধ্যেও এখন আর ততটা উত্তেজনা খুঁজে পাচ্ছে না। এইজন্য এখন তারা আরও অদ্ভুত কিছু করার চেষ্টা করছে যেমন তারা লোহা পুড়ে শরীরে ছাপ দেয়, শরীর কাটাছেঁড়া করে * এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ভাস্কর্য করে। ভাস্কর্য করার জন্য চামড়ার নিচে বিভিন্ন বস্তু ঢোকানো হয়, যা চামড়ায় বড় বড় ছিদ্র ও উঁচুনিচু রেখা তৈরি করে।

পুরনো রীতি

শরীরকে সাজানোর চেষ্টা নতুন নয়। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে শত শত বছর ধরে নির্দিষ্ট পরিবার বা গোষ্ঠীকে শনাক্ত করার জন্য ধর্মীয় আচার অনুযায়ী শরীরে আঁচড় কাটা ও উল্কি আঁকা হতো। কিন্তু, মজার ব্যাপার হল যে এখন আফ্রিকার অনেক দেশেই এই অভ্যাসকে আর ভাল চোখে দেখা হয় না। তারা এগুলো করাও বন্ধ করে দিচ্ছে।

বাইবেলের সময়েও উল্কি আঁকা হতো, শরীরের যেখানে-সেখানে ফুটো ও শরীরে কাটাছেঁড়া করা হতো। এগুলো সাধারণত পৌত্তলিক জাতির লোকেরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য করত। আর এই কারণেই যিহোবা তাঁর লোকেদের অর্থাৎ যিহুদিদের ওই পৌত্তলিক জাতির লোকেদের মতো কাজ করতে না করেছিলেন। (লেবীয় পুস্তক ১৯:২৮) আর এভাবে ঈশ্বরের “নিজস্ব প্রজা” যিহুদিরা মিথ্যা ধর্মের জঘন্য রীতিগুলো থেকে নিজেদের আলাদা রাখত।—দ্বিতীয় বিবরণ ১৪:২.

খ্রীষ্টীয় স্বাধীনতা

খ্রীষ্টানরা মোশির ব্যবস্থার অধীনে নন কিন্তু এর কিছু নীতি খ্রীষ্টীয় মণ্ডলী শুরু থেকে আজও মেনে চলেছে। (কলসীয় ২:১৪) তাই, খ্রীষ্টানরা শালীনতা বজায় রেখে সাজগোজ করতে পারেন। (গালাতীয় ৫:১; ১ তীমথিয় ২:৯, ১০) কিন্তু তাদের এই স্বাধীনতার একটা সীমা আছে।—১ পিতর ২:১৬.

১ করিন্থীয় ৬:১২ পদে পৌল লিখেছিলেন: “সকলই আমার পক্ষে বিধেয়, কিন্তু সকলই যে হিতজনক, তাহা নয়।” পৌল বুঝতে পেরেছিলেন যে একজন খ্রীষ্টান হিসেবে তার যে স্বাধীনতা ছিল, তা তাকে অন্যের কথা না ভেবে যা খুশি তাই-ই করার অনুমতি দেয় না। অন্যের জন্য ভালবাসা তার ব্যবহারের ওপর ছাপ ফেলেছিল। (গালাতীয় ৫:১৩) তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন: “প্রত্যেক জন আপনার বিষয়ে নয়, কিন্তু পরের বিষয়েও লক্ষ্য রাখ।” (ফিলিপীয় ২:৪) পৌলের এই নিঃস্বার্থ মনোভাব সেই খ্রীষ্টানদের জন্য এক চমৎকার উদাহরণ, যারা নিজেদের শরীরকে সাজানোর কথা ভাবছেন।

বাইবেলের যে নীতিগুলো ভেবে দেখা দরকার

খ্রীষ্টানদের সুসমাচার প্রচার করার ও শিক্ষা দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। (মথি ২৮:১৯, ২০; ফিলিপীয় ২:১৫) একজন খ্রীষ্টান এমন কিছু করবেন না বা এমন কোন সাজগোজ করতে চাইবেন না, যার ফলে লোকেরা সুসমাচার না শুনে তার দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়।—২ করিন্থীয় ৪:২.

শরীরের যেখানে সেখানে ফুটো করা বা উল্কি আঁকা কিছু লোকেদের কাছে জনপ্রিয় হলেও একজন খ্রীষ্টানের নিজেকে জিজ্ঞেস করা দরকার, ‘আমি যে এলাকায় থাকি, সেখানে এইরকম সাজগোজকে লোকেরা কোন্‌ চোখে দেখে? আমাকে দেখে কি তারা ভাববে যে, আমি কোন উদ্ভট দলের লোক? যদি আমার বিবেক আমাকে শরীরের যেখানে-সেখানে ফুটো করতে বা উল্কি আঁকতে বাধা না-ও দেয়, তবুও মণ্ডলীর ভাইবোনদের ওপর তা কীরকম ছাপ ফেলবে? তারা কি এটাকে ‘জগতের আত্মার’ একটা চিহ্ন বলে মনে করবেন? সত্যিই আমার “সংযত” মন আছে কি না, তা নিয়ে কি তারা কোনরকম সন্দেহ করবেন?’—১ করিন্থীয় ২:১২; ১০:২৯-৩২; তীত ২:১২.

শরীরকে সাজানোর কিছু পদ্ধতি অত্যন্ত বিপদজনক। উল্কি আঁকার সময় সুইকে জীবাণুমুক্ত না করায় হেপাটাইটিস ও এইচআইভি ছড়িয়েছে। বিভিন্ন ধরনের রং ব্যবহার করায় কখনও কখনও চর্মরোগ দেখা দেয়। শরীরের ফুটো অংশ শুকোতে কয়েক মাস লাগতে পারে আর ফুটো করার সময় প্রচণ্ড ব্যথা লাগতে পারে। শুধু তাই নয়, এগুলো করার ফলে রক্তে বিষ ছড়িয়ে পড়তে পারে, রক্তক্ষরণ হতে পারে, রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে, স্নায়ুতে আঘাত লাগতে পারে এবং গুরুতর সংক্রামক রোগও হতে পারে। এছাড়াও, কিছু পদ্ধতি আছে যা করলে শরীরকে আর কখনও আগের মতো করা যাবে না। যেমন আকার ও রঙের ওপর ভিত্তি করে একটা উল্কি মুছে ফেলার জন্য কয়েকবার ব্যয়বহুল ও যন্ত্রণাদায়ক লেজার চিকিৎসা করার দরকার হতে পারে। আর ফুটো অংশ হয়তো আর কখনোই বন্ধ করা যাবে না।

শরীরকে সাজানোর জন্য এইরকম ঝুঁকি নেবেন কী নেবেন না, তা একজনের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু, যারা ঈশ্বরকে খুশি করতে চান তারা জানেন যে খ্রীষ্টান হওয়া মানে নিজেকে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করা। আমাদের শরীর ঈশ্বরের উদ্দেশে জীবিত বলিরূপে উৎসর্গ করা হয়েছে যেন ঈশ্বর আমাদেরকে তাঁর ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারেন। (রোমীয় ১২:১) আর তাই পরিপক্ব খ্রীষ্টানরা নিজেদের শরীরকে একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে মনে করেন না ও ভাবেন না যে, যা খুশি তাই করে তিনি তার শরীরের ক্ষতি করতে বা সেটাকে নষ্ট করতে পারেন। বিশেষ করে যারা মণ্ডলীতে নেতৃত্ব নেওয়ার জন্য যোগ্য হতে চান তাদের মিতাচারী, আত্মসংযমী ও যুক্তিবাদী হতে হবে।—১ তীমথিয় ৩:২, ৩.

বাইবেল-শিক্ষিত যুক্তি করার ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে এবং তা ব্যবহার করে খ্রীষ্টানরা এই জগতের চরম ও বিকৃত অভ্যাসগুলো এড়িয়ে চলবেন কারণ এই অভ্যাসগুলো একেবারেই “ঈশ্বরের জীবনের বহির্ভূত।” (ইফিষীয় ৪:১৮) আর এভাবেই তাদের বিচার-বুদ্ধি সমস্ত মানুষের সামনে প্রকাশ পাবে।—ফিলিপীয় ৪:৫.

[পাদটীকা]

^ চিকিৎসা বা সৌন্দর্যের জন্য শরীর কাটা আর যুবক-যুবতীরা বিশেষ করে কিশোরী মেয়েরা যে ইচ্ছের বিরুদ্ধে শরীরের বিভিন্ন অংশ কাটে তা এক কথা নয়। এইরকম কাটাছেঁড়া গুরুতর মানসিক সমস্যা বা অপব্যবহারের লক্ষণ, যার জন্য ডাক্তারের সাহায্য নিতে হতে পারে।