সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অস্ট্রেলিয়ার হুলবিহীন মৌমাছিদের সঙ্গে পরিচিত হোন

অস্ট্রেলিয়ার হুলবিহীন মৌমাছিদের সঙ্গে পরিচিত হোন

অস্ট্রেলিয়ার হুলবিহীন মৌমাছিদের সঙ্গে পরিচিত হোন

অস্ট্রেলিয়ার সচেতন থাক! সংবাদদাতা কর্তৃক

বসন্তের শুরুতে এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে ব্যস্ত মৌমাছিরা যখন ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায় তখন তাদের গুঞ্জন শুনে কি আপনি কখনও পুলকিত হয়েছেন? সত্যিই তারা খুবই সুন্দর পোকা। যদি না তারা আপনার গায়ে হুল ফুটিয়ে থাকে!

কিন্তু আপনি হয়তো শুনে অবাক হবেন যে, এমনও মৌমাছি আছে যারা হুল ফোটায় না। এরা অস্ট্রেলিয়ার হুলবিহীন মৌমাছি নামে পরিচিত আর অস্ট্রেলিয়ার পূর্বাঞ্চলের অনেক জায়গায় এদের দেখতে পাওয়া যায়। হুলবিহীন মৌমাছি মাত্র চার মিলিমিটার লম্বা হয়। এদের গায়ের রং কালো এবং মুখ ও দুই পাশ ঘন সাদা লোমে ঢাকা। অনেকের দেহের মধ্যভাগের দুই পাশে আবার ছোট ছোট হলুদ ফোটা রয়েছে। কুইন্সল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল থেকে নিউ সাউথ ওয়েলসের দক্ষিণাঞ্চল বরাবর উপকূলবর্তী এলাকায় কমপক্ষে দশ প্রজাতির হুলবিহীন মৌমাছি দেখা যায়। এছাড়াও, এই মহাদেশের ক্রান্তীয় উত্তরাঞ্চলেও এদের দেখা যায় তবে খুব বেশি নয়।

যারা মৌচাক থেকে মধু বের করে আনেন তাদের সুবিধার কথা একটু ভেবে দেখুন। একজন মৌ-চাষী বলেন: “[অন্যান্য প্রজাতির মৌমাছিদের] বেলায় আমি জাল বা রেশম কাপড় দিয়ে তৈরি আচ্ছাদক এবং গলাবদ্ধ সোয়েটার পরি কিন্তু [হুলবিহীন মৌমাছিদের] হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমার কিছুই পরার দরকার হয় না। মৌচাকের বাক্স খুলে দেওয়ার পাঁচ মিনিট পরও মৌমাছিরা যার যার মতো কাজে ব্যস্ত থাকে, যেন তারা আমাকে দেখতেই পায়নি।”

অন্যান্য প্রজাতির মৌমাছি থেকে হুলবিহীন মৌমাছিদের চাকগুলো একেবারে আলাদা। এদের চাকগুলোকে অনেক সময় বাসা বলা হয়। হুলবিহীন মৌমাছিরা তাদের মধু ও রেণু সাধারণ মৌচাকের ষড়ভুজাকৃতির কুঠুরিগুলোতে মজুত করে না। এরা ডিম্বাকারের গুচ্ছ গুচ্ছ কুঠুরি বানায়। কুঠুরিগুলো ভরে গেলে সেগুলোর মুখ আটকে দেয় আর তারপর এগুলোর ওপরে বা চারপাশে আরও কুঠুরি তৈরি করে।

বাসার ভিতরে

চলুন আমরা হুলবিহীন মৌমাছিদের বাসার ভিতরটা একটু ঘুরে আসি। এতে প্রায় ১৫,০০০ মৌমাছি থাকে। যদিও এরা হুল ফোটায় না, তবুও একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন কারণ এরা এদের চোয়াল দিয়ে কামড়ে দিতে পারে।

বাসার সরু বারান্দা পেরিয়ে আমরা এমন এক দুনিয়ায় ঢুকে পড়েছি, যেখানে কেউই বসে নেই, সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। দলগতভাবে কাজ করা বলতে যা বোঝায় এই মৌমাছিরা তা করে থাকে। প্রত্যেকেই জানে যে তার কাজ কী এবং কোথায় তা করতে হবে। আমরা একটা ছোট্ট মৌমাছিকে দেখতে পাই, যে মধুর জন্য একটা নতুন কুঠুরি বানাচ্ছে ও সেটাকে পালিশ করছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন সে একটা নিখুঁত নকশা দেখে সেই কাজগুলো করছে। আমাদের পাশে আরও চারটে মৌমাছি এইমাত্র মধুতে ভরে যাওয়া একটা কুঠুরির মুখ আটকে দিচ্ছে। একটা বড় ত্রিমাত্রিক কাঠামোর ওপর মধুর কুঠুরিগুলো বানানো হয়েছে। দক্ষতার সঙ্গে বানানো এই কাঠামোটাই মধুর ওজন বইতে সাহায্য করে।

এরপর, আমরা পরের কামরায় ঢুকে দেখি যে একটা মৌমাছি অন্যান্য মৌমাছিদের চেয়ে বেশ বড়। ইনিই হচ্ছেন মহামান্য রানি! উজ্জ্বল কালোর ওপর সোনালী বলয় দেওয়া পোশাক পরা রানিকে কত সুন্দর দেখাচ্ছে, যাকে ঘিরে একদল মৌমাছি কাজে ব্যস্ত! রানি এখন তার জন্য বানানো ৬০টা কুঠুরিতে ডিম পাড়ছে। রানি কত বুদ্ধিমতি ও কত নির্ভুল তার কাজ! তাকে দেখে আমাদের চোখের সামনে একজন মা তার বাচ্চাকে বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছে সেই ছবি ভেসে ওঠে। দেখুন কর্মী মৌমাছিরা তার পিছনে পিছনে কত তাড়াতাড়ি কুঠুরির মুখ বন্ধ করে দিচ্ছে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে সব কাজ শেষ।

ডিম ফুটে যখন বাচ্চা বের হয়

ডিমগুলো যখন ফুটে তখন প্রতিটা ডিম থেকে ছোট্ট শূককীট (বা লার্ভা) বের হয় এবং তার জন্য কুঠুরিতে রাখা খাবার খায়। মোমের কুঠুরিতে শূককীট খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে এবং নিজের জন্য একটা রেশম কোকুন গঠন করে। এই কোকুনেই শূককীট (পিউপা অবস্থার পর) মৌমাছিতে পরিণত হয়। পরে, এটা কোকুন থেকে বের হয়ে আসে এবং কাজ করতে শুরু করে। কিন্তু, তার আগে কিছু সেবিকা মৌমাছি কিছু সময়ের জন্য তাদের দেখাশোনা করে। ওই মোমের কুঠুরিগুলোকে কী করা হবে? দেরি না করে ওই কুঠুরিগুলোকে জড়ো করা হয় এবং এগুলো দিয়ে আবারও কুঠুরি বানানো হয়। আর মৌমাছিগুলো যখন তাদের কোকুন থেকে বেরিয়ে আসে, তখন সেগুলো আর কোন কাজে আসে না। এগুলো যদি এখানেই পড়ে থাকে, তাহলে তাদের বাসা আবর্জনায় ভরে যাবে। তাই, একসঙ্গে অনেক কর্মী মৌমাছি বাসা পরিষ্কার করার কাজে লেগে যায়। তারা পরিত্যক্ত কোকুনগুলোকে বাসা থেকে সরিয়ে দেয়।

অনেক প্রজাতির হুলবিহীন মৌমাছি সেরুমেন নামে একরকমের পদার্থ উৎপন্ন করে, যা তাদের বাসা বানানোর কাজে লাগে। এটা মৌমাছির দেহনিঃসৃত মোম আর সেইসঙ্গে লতাপাতা ও গাছ থেকে আহরিত রজন ও মোমের মিশ্রণে উৎপন্ন হয়। সেরুমেন মৌচাকের কাঠামো নির্মাণে অর্থাৎ পিলার, বীম এবং ক্রসবারগুলোকে জুড়ে দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়। মৌমাছিরা এই কাঠামোর ওপর মধু ও রেণুর কুঠুরিগুলো বানানোর সময় এগুলোর ভিতরে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে আর এভাবেই সেরুমেনকে চাপ দিয়ে কুঠুরিকে সঠিক আকার দেয়। আর তারপর কুঠুরিগুলো মধুতে ভরে এগুলোর মুখ বন্ধ করে মজুত করে রাখা হয়। সহজাতভাবেই মৌমাছিরা জানে যে কোন্‌ ঋতুতে কোন্‌ গাছগুলোতে বেশি মধু পাওয়া যায় এবং কখন আবহাওয়া খারাপ থাকে। তারা ভালভাবেই জানে যে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য সংগ্রহ করা ও তা মজুত করে রাখা খুবই জরুরি।

মৌমাছিরা তাদের বাসা বানানোর জন্য সেরুমেন ও সেইসঙ্গে মৌ এবং রেণুর খোঁজে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। বাসা ছেড়ে বেরনোর সঙ্গে সঙ্গে তারা দক্ষ পাইলট ও নাবিক হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, মৌমাছিরা জানে যে কী সংগ্রহ করতে হবে এবং তা কোথায় পাওয়া যাবে।

নতুন বাসা বানানো

পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকায়, বাসায় থাকার বা খাবার মজুত করার জায়গা কমে যায়। তাহলে, এখন কী হবে? “আমাদের এখন আরেকটা বাসা বানাতে হবে,” পরিবারের সবার কাছে মনে হয় এই খবর পৌঁছে যায়। প্রথমে একজন স্কাউট একটা গর্ত খুঁজে বের করে, যা হয়তো বাসা বানানোর জন্য উপযুক্ত জায়গা হতে পারে। এরপর “প্রকৌশলীরা” সেই জায়গা দেখতে আসে। সাধারণত ৩০ থেকে ৫০টা দক্ষ মৌমাছি ওই গর্তের ভিতরটা কয়েক ঘন্টা ধরে খুব ভালভাবে দেখে যেন তারা প্রয়োজনীয় মাপঝোক করে। যদি তারা দেখে যে এর ভিতরটা বাসা বানানোর উপযুক্ত, তাহলে তারা রিপোর্ট করার জন্য তাদের পুরনো বাসায় ফিরে যায়। এরপর, সাধারণত ৪৮ ঘন্টার মধ্যে আসল “নির্মাণকারীরা” সেখানে এসে পৌঁছায়। এই নির্মাণকারী দলের মধ্যে এক হাজারেরও বেশি মৌমাছি থাকে কিন্তু কোন রানি সেখানে থাকে না। সময় নষ্ট না করে তারা কাজে লেগে যায়। তারা পুরনো বাসা থেকে নির্মাণ সামগ্রী ও খাবার নিয়ে আসে।

এই নতুন বাসায় রানি আসার আগে, বাসাকে এমনভাবে বানাতে হবে যাতে সেখানে সঠিক তাপমাত্রা বজায় থাকে—প্রায় ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। বাসার মধ্যে এই তাপমাত্রা বজায় রাখার জন্য কর্মী মৌমাছিরা বাসার চারিদিকে সেরুমেনের দেয়াল তৈরি করে, যেন বাসাটাকে একটা কম্বলে ঢেকে দিচ্ছে। আর তা দেখে মনে হয় যেন এই বুদ্ধিমান মৌমাছিরা জানে যে ডিমগুলোকে উষ্ণ রাখতে হবে। এখন, সমস্ত কিছু তৈরি। নবম দিনে নতুন রানিকে এই বাসায় নিয়ে আসা হয়, যে রানি পুরনো বাসায় বড় হয়েছে। রানি এই বাসায় আসার সঙ্গে সঙ্গে ডিম পাড়তে শুরু করে, যা থেকে তার প্রাসাদে আরও মৌমাছি জন্মাবে।

একসময়, পুরনো বাসা থেকে আসা মৌমাছিরা মারা যাবে এবং এই নতুন বাসার তরুণ মৌমাছিরা তাদের জায়গা নেবে। পরে আবার এই বাসার মৌমাছিরা আরেকটা বাসা বানানোর দরকার বলে মনে করবে। আর এর ফলে আরেকবার সেই বিস্ময়কর কাজ চলবে, যা একজন অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন!

(g০০ ১১/৮)

[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

ষড়ভুজাকৃতির মৌচাক না বানিয়ে, হুলবিহীন মৌমাছিরা গুচ্ছ গুচ্ছ ডিম্বাকার কুঠুরি বানায়

[১৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

অস্ট্রেলিয়ায় কমপক্ষে দশ প্রজাতির হুলবিহীন মৌমাছি দেখা যায়