নার্সদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
নার্সদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
“একজন নার্স লালনপালন করে ও সুরক্ষা জোগায় —অসুস্থ, আহত ও বয়স্ক লোকেদের যত্ন নেওয়ার জন্য সবসময় তৈরি থাকে।”—আজকের বিশ্বে নার্সিং—কঠিন সমস্যাগুলো, বিবেচনার বিষয়গুলো এবং প্রবণতাগুলো। (ইংরেজি)
একজন দক্ষ নার্স হওয়ার জন্য যদিও নিঃস্বার্থ হওয়া দরকার কিন্তু শুধু তাই-ই যথেষ্ট নয়। ভাল নার্স হওয়ার জন্য অনেক প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা দরকার। নার্সিংয়ের ওপর এক থেকে চার বছর বা তারও বেশি সময় পড়াশোনা করতে এবং হাতে কলমে শিক্ষা নিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল যে, কোন্ গুণগুলো থাকলে একজন ভাল নার্স হওয়া যায়? সচেতন থাক! কিছু অভিজ্ঞ নার্সদের এই প্রশ্নটা করেছে, এখানে তাদের কয়েকজনের কথা দেওয়া হল।
“ডাক্তার রোগ সারান কিন্তু নার্স রোগীর দেখাশোনা করেন। এই জন্য নার্সদের প্রায়ই মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়া সেই সমস্ত রোগীদের গড়ে তুলতে হয়, যারা জানতে পারে যে তাদের এক দীর্ঘস্থায়ী রোগ হয়েছে বা খুব শীঘ্রিই মারা যাবে। আপনাকে একজন রোগীর মায়ের ভূমিকা নিতে হবে।”—কারমেন কিলমার্টিন, স্পেন।
“একজন রোগীর ব্যথা ও যন্ত্রণাকে অনুভব করতে হবে ও তাকে সাহায্য করার ইচ্ছা থাকতে হবে। এই জন্য দয়া ও ধৈর্য থাকা দরকার। নার্সিং ও চিকিৎসাবিদ্যা সম্বন্ধে সবসময় আরও বেশি জানতে হবে।”—তাদাশি হাতানো, জাপান।
“সম্প্রতি নার্সদের আরও বেশি করে পেশাদারি জ্ঞান নেওয়ার দরকার হয়েছে। তাই, তাদের পড়াশোনা করার ইচ্ছা ও তা বোঝার ক্ষমতা থাকা দরকার। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে নার্সদের ত্বরিত সিদ্ধান্ত ও সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে।”—কেইকো কাওয়ানে, জাপান।
“একজন নার্স হিসেবে আপনাকে আন্তরিক মনোভাব দেখাতে হবে। আপনার সহ্য শক্তি থাকতে হবে এবং সহানুভূতি দেখাতে হবে।”—আরাসেলি গারসিয়া পাডিয়া, মেক্সিকো।
“একজন ভাল নার্সের মনোযোগ দিয়ে পড়ার অভ্যাস থাকতে হবে, সবকিছু খুব ভালভাবে খেয়াল করতে এবং পেশাদারি হতে হবে। একজন নার্সের মধ্যে যদি আত্মত্যাগের মনোভাব না থাকে অর্থাৎ তার মধ্যে যদি সামান্য স্বার্থপরতা থাকে বা তার থেকে উঁচু মর্যাদার মেডিকেল কর্তৃপক্ষের কেউ পরামর্শ দিলে যদি সে বিরক্ত হয়, তাহলে ওই নার্স রোগী এবং তার সহকর্মীদের জন্য অনুপযোগী বলে বিবেচিত হবে।”—রোসাঞ্জেলা সান্তোষ, ব্রাজিল।
“কয়েকটা গুণ থাকতেই হবে যেমন, নমনীয় মনোভাব, সহ্য শক্তি এবং ধৈর্য। শুধু তাই নয়, আপনাকে খোলা মনের
হতে হবে আর সেইসঙ্গে সহকর্মীদের ও মেডিকেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা থাকতে হবে। দক্ষভাবে কাজ করে চলার জন্য আপনাকে নতুন নতুন কৌশলগুলো তাড়াতাড়ি শিখে নিতে হবে।”—মার্ক কোলার, ফ্রান্স।“লোকেদেরকে ভালবাসতে হবে এবং অন্যদের সাহায্য করার ইচ্ছা আপনার থাকতে হবে। কঠিন মানসিক চাপ মোকাবিলা করার শক্তি থাকতে হবে কারণ এই কাজে কোনভাবেই ভুল করা চলবে না। আপনার মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও থাকতে হবে যাতে প্রয়োজনে অল্প কয়েকজন সহকর্মী নিয়েও উন্নত মানের সেবা প্রদান করতে পারেন।”—ক্লডিয়া রেকারবাকার, নেদারল্যান্ড।
রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে নার্স
আজকের বিশ্বে নার্সিং (ইংরেজি) নামের বই বলে যে “নার্সিং বলতে একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখাশোনা করা বোঝায়। তাই আমরা বলতে পারি যে, ওষুধ রোগীর রোগ সারানোর জন্য দরকার আর নার্সিং ওই রোগীর দেখাশোনা করার জন্য দরকার।”
অতএব একজন নার্সকে রক্ষণাবেক্ষণকারী বলা যায়। আর তাই একজন নার্সকে রোগীর দেখাশোনা ও যত্ন করতে হবে। কিছুদিন আগে ১,২০০ জন রেজিস্ট্রিকৃত নার্সকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: “একজন নার্স হিসেবে আপনার কাজের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি বিষয়টা কী বলে আপনি মনে করেন?” উত্তরে ৯৮ শতাংশই ভালভাবে দেখাশোনা করার কথা বলেছিলেন।
কখনও কখনও নার্সরা রোগীদের কাছে তাদের প্রয়োজনকে ছোট করে দেখেন। ওপরে বলা কারমেন কিলমার্টিন ১২ বছর ধরে একজন নার্স হিসেবে কাজ করছেন। তিনি সচেতন থাক! পত্রিকাকে বলেছিলেন: “একবার আমি আমার এক বান্ধবীর কাছে বলেছিলাম যে আমি যখন
খুবই অসুস্থ রোগীদের দেখাশোনা করি তখন আমার মনে হয় যে আমি তাদের খুব সামান্যই সাহায্য করতে পারব। সেই সময় আমার নিজেকে সামান্য একটা ‘ক্ষত বাঁধার গজ’ বলে মনে হয়। এই কথা শুনে আমার বান্ধবী আমাকে বলেছিল: ‘এক মূল্যবান “ক্ষত বাঁধার গজ” কারণ একজন লোকের যখন অসুখ হয় তখন অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে তোমার মতো একজন সহানুভূতিশীল নার্সকে তার সবচেয়ে বেশি দরকার।’”রোগীদের দেখাশোনা করার জন্য নার্সদের যে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়, তা আর কারও অজানা নয়! তারা রোজ দশ ঘন্টা কি তারও বেশি সময় কাজ করেন। কী এই আত্মত্যাগী রক্ষণাবেক্ষণকারীদের নার্স হওয়ার প্রেরণা দিয়েছিল?
কেন একজন নার্স হন?
সচেতন থাক! বিভিন্ন দেশের নার্সদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল এবং তাদের জিজ্ঞেস করেছিল, “কী আপনাকে নার্স হওয়ার প্রেরণা দিয়েছিল?” এখানে কিছু নার্সদের উত্তর দেওয়া হল।
টেরি ওয়েদারসান ৪৭ বছর ধরে নার্সিং করেছেন। তিনি এখন ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরে একটা হাসপাতালের ইয়োরোলজি ডিপার্টমেন্টে একজন ক্লিনিক্যাল নার্স বিশেষজ্ঞা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন: “আমি একজন ক্যাথলিক হিসেবে বড় হয়েছি এবং ক্যাথলিক বোর্ডিং স্কুলে লেখাপড়া করেছি। তাই ছোট্ট বেলাতেই আমি ঠিক করেছিলাম যে বড় হয়ে আমি হয় একজন নান হব নতুবা একজন নার্স হব। আমি অন্যদের সেবা করতে চাইতাম। এটাকে দায়িত্ববোধ বলা যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত আমি নার্সিং করাই বেছে নিয়েছি।”
জাপানের সাইতামা শহরের চিওয়া মাৎসুনাগা আট বছর ধরে তার নিজের ক্লিনিক চালাচ্ছেন। তিনি বলেন: “আমার বাবা বলতেন, ‘এমন একটা কাজ শেখা ভাল যা তুমি সারা জীবন করতে পারবে।’ আর বাবার সেই উপদেশ মেনেই আমি একজন নার্স হয়েছি।”
জাপানের টোকিওর এতস্কো কোতানি একজন বড় নার্স। তিনি ৩৮ বছর ধরে নার্সিং করছেন। তিনি বলেছিলেন: “আমি তখনও স্কুলে পড়তাম। একদিন হঠাৎ আমার বাবা অজ্ঞান হয়ে যান এবং তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। বাবাকে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে আমি ঠিক করেছিলাম যে আমি একজন নার্স হব যাতে ভবিষ্যতে আমি অসুস্থ লোকেদের সেবা করতে পারি।”
আবার কেউ কেউ নিজেদের অসুখ থেকে নার্স হওয়ার প্রেরণা পেয়েছিলেন। মেক্সিকোর নার্স এনেডা বিয়েরা বলেন: “ছয় বছর বয়সে একবার আমার ব্রংকাইটিস হয়েছিল এবং তার জন্য আমাকে দুসপ্তা হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। আর তখনই আমি ঠিক করেছিলাম যে আমি একজন নার্স হব।”
অতএব, এটা স্পষ্ট যে নার্স হতে গেলে প্রচুর আত্মত্যাগ করতে হয়। এই মহৎ পেশায় যে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় ও সেইসঙ্গে যে আনন্দ পাওয়া যায় আসুন আমরা এখন তা দেখি।
নার্স হওয়ার আনন্দ
নার্সিংয়ে কীরকম আনন্দ পাওয়া যায়? এই প্রশ্নের উত্তর একজন ব্যক্তি নার্সিংয়ের কোন্ শাখায় কাজ করেন তার ওপর নির্ভর করে। যেমন ধাত্রীরা যখন কোন শিশুকে সুস্থভাবে জন্ম নিতে দেখেন তখন তারা খুবই আনন্দিত হন। নেদারল্যান্ডের একজন ধাত্রী বলেন, “একটা সুস্থসবল শিশুকে জন্ম নিতে সাহায্য করা ও দেখা সত্যিই আনন্দের।” ইয়োলান্ডা কিলেন-ফান হুফ্ট নামে নেদারল্যান্ডেরই আর একজন ধাত্রী বলেন: “শিশুর জন্ম হল
বড় বড় আনন্দগুলোর মধ্যে একটা, যা এক দম্পতি ও একজন স্বাস্থ্য কর্মী উপভোগ করতে পারেন। এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার!”ফ্রান্সের দ্রুয়ের রাশিট আ্যসাম একজন সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত নার্স আ্যনেসথেটিস্ট। তার বয়স ৪২ কি ৪৩ বছর। কেন তার নার্সিং করতে ভাল লাগে? তিনি বলেন, এর কারণ হল ‘একটা সফল অপারেশনে অবদান রাখতে পারার এবং আগ্রহজনক ও দিন দিন উন্নত হচ্ছে এমন এক পেশার কর্মী হতে পারার সন্তুষ্টি।’ ফ্রান্সের আইজ্যাক বেংগিলি বলেছিলেন, “একজন মূমুর্ষু রোগী যার বাঁচার কোন আশা নেই বলে মনে করা হয়, তাকে যখন আমরা সুস্থ করে তুলি তখন রোগী ও তার পরিবারের লোকেরা যখন আমাদের ধন্যবাদ জানায় সেটাই আমার মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেয়।”
টেরি ওয়েদারসান, যার কথা আগে বলা হয়েছে তাকে একবার এভাবে ধন্যবাদ জানানো হয়েছিল। একজন বিধবা তাকে লিখেছিলেন: “শার্লির অসুখের সময় আপনি যেভাবে শান্ত মনোভাব ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে সেবা করেছিলেন তা আমাদের মন থেকে সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর করে দিয়েছিল, যা আরেকবার না বলে আমি থাকতে পারছি না। আপনার আন্তরিকতা আমাদের দুঃখ দূর করে দিয়েছিল ও তা আমাদের জন্য এক আশ্রয় হয়েছিল, যেখান থেকে আমরা শক্তি পেয়েছিলাম।”
কঠিন সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হওয়া
নার্সিংয়ে যেমন আনন্দ আছে তেমনই অনেক কঠিন সমস্যাও রয়েছে। এই কাজে কখনও কোন ভুল করা চলবে না! ওষুধ খাওয়ানোর সময়, রোগীর শরীর থেকে রক্ত নেওয়ার বা তার শরীরে কোন কিছু ঢোকানোর সময়, এমনকি রোগীকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেওয়ার সময়ও নার্সকে চোখকান খোলা রাখতে হবে। তার কোন ভুল করা চলবে না, বিশেষ করে সেই সমস্ত দেশে যেখানে সামান্য ভুলের জন্য মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। এছাড়াও, কখনও কখনও নার্সরা এক কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হন। যেমন, একজন নার্স হয়তো মনে করতে পারেন যে ডাক্তার রোগীকে ভুল ওষুধ দিয়েছেন বা তিনি এমন কোন কিছু করতে বলেছেন, যা রোগীর জন্য ভাল হবে না। সেই সময় একজন নার্স কী করবেন? তিনি কি ডাক্তারের কথায় আপত্তি জানাবেন? এর জন্য সাহস, বিচার-বুদ্ধি ও দক্ষতা দরকার কারণ এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, কিছু ডাক্তাররা তাদের অধীনের কোন কর্মচারীর দেওয়া পরামর্শ মেনে নিতে চান না।
এই বিষয়ে কিছু নার্স কী বলেছেন? আমেরিকার উইসকনসিনের বারবারা রেইনকি ৩৪ বছর ধরে একজন রেজিস্ট্রিকৃত নার্স। সচেতন থাক! পত্রিকাকে তিনি বলেছিলেন: “একজন নার্সকে সাহসী হতে হবে। প্রথমত, সে রোগীকে যে সমস্ত ওষুধ খাওয়ায় বা চিকিৎসা করে তার জন্য রোগীর কোনরকম ক্ষতি হলে সে আইনগতভাবে দায়ী। একজন ডাক্তার
যদি তাকে এমন কিছু করতে বলেন যা সে আগে কখনও করেনি বা যদি সেটাকে সে ভুল বলে মনে করে, তাহলে সে সেই কাজ করতে পারবে না, তা বলার মতো সাহস তার থাকতে হবে। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের আমলের বা মাত্র ৫০ বছর আগের নার্সিং আর আজকের নার্সিংয়ের মধ্যে আকাশপাতাল তফাত রয়েছে। কখন ডাক্তারকে না বলতে হবে এবং কখন রোগী দেখার জন্য ডাক্তারকে আসতে বলতে হবে এমনকি তা যদি মাঝরাতেও হয়, তা এখন নার্সকে বুঝতে হয়। আর আপনি যদি কোন ভুল করেই ফেলেন, তাহলে ডাক্তারের কাছ থেকে বকা শোনার মতো ধৈর্য আপনার থাকতে হবে।”কাজ করার সময় নার্সদের আরেকটা কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় আর তা হল তাদের শারীরিক আক্রমণের শিকার হতে হয়। সাউথ আফ্রিকার একটা রিপোর্ট বলে যে, নার্সরাই “কাজের জায়গায় সবচেয়ে বেশি খারাপ ব্যবহার ও শারীরিক আক্রমণের শিকার হন। সত্যি বলতে কী কারারক্ষক বা পুলিশ অফিসারদের চেয়ে কাজের সময় নার্সদের ওপরই আক্রমণ আসার ভয় বেশি আর শতকরা ৭২ জন নার্স নিজেদের নিরাপদ মনে করেন না।” যুক্তরাজ্যেও একই বিষয় বলা হয়েছিল। সেখানে কিছু দিন আগে করা এক সমীক্ষায় ৯৭ শতাংশ নার্স বলেছিলেন যে তারা প্রত্যেকেই এমন একজন নার্সকে চেনেন, যিনি গত বছর শারীরিক আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। কারা আক্রমণ করে? সাধারণত যে রোগীরা মাদকাসক্ত বা মাতাল, মানসিক চাপ বা যন্ত্রণার মধ্যে থাকে, তারাই তা করে থাকে।
শুধু তাই নয়, সবসময় চাপের মধ্যে থাকার ফলে নার্সরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আর তার একটা কারণ হল পর্যাপ্ত কর্মচারী না থাকা। অতিরিক্ত কাজের চাপে যখন একজন সচেতন নার্স রোগীকে ঠিকমতো দেখাশোনা করতে পারেন না, তখন তিনি মনের মধ্যে একটা চাপ অনুভব করেন। এই অবস্থাকে কাটানোর জন্য তিনি বিরতির সময় এবং নির্ধারিত কাজের সময়ের পরে অতিরিক্ত সময় কাজ করেন কিন্তু তা কেবল আরও বেশি চাপই নিয়ে আসে।
সারা পৃথিবীতে এমন অনেক হাসপাতাল রয়েছে, যেখানে পর্যাপ্ত কর্মচারী নেই। মাদ্রিদের মানডু সানিটারিও একটা রিপোর্টে বলে, “আমাদের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত নার্স নেই। যাদের চিকিৎসার দরকার হয়েছে তারাই নার্সদের মর্ম বুঝেছেন।” এই ঘাটতির কারণ কী ছিল? টাকা বাঁচানো! ওই একই রিপোর্ট আরও বলেছিল যে মাদ্রিদের হাসপাতালগুলোতে ১৩,০০০ নার্সের ঘাটতি ছিল!
নার্সদের ওপর চাপের আরেকটা কারণ হল, তাদের অনেক বেশি সময় কাজ করতে হয় অথচ সেই তুলনায় বেতন খুবই কম। দ্যা স্কটস্ম্যান বলেছিল: “জনসেবা সংঘ, ইউনিসন
অনুযায়ী ব্রিটেনে প্রতি পাঁচ জন নার্সের মধ্যে একজনেরও বেশি নার্স এবং নার্সিংয়ের এক চতুর্থাংশ সহকারী কর্মচারীদের তাদের রোজকার জীবনের চাহিদা মেটানোর জন্য আরেকটা চাকরি করতে হয়।” প্রতি চার জনের মধ্যে তিন জন নার্সই মনে করেন যে তাদের কম বেতন দেওয়া হয়। আর এর ফলে অনেকেই নার্সিং ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছেন।নার্সদের চাপ অনুভব করার আরও অনেক কারণ রয়েছে। সচেতন থাক! বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নার্সদের কাছ থেকে যে মন্তব্যগুলো জেনেছেন, তার থেকে বোঝা যায় যে রোগীর মৃত্যুও নার্সদের মন ভেঙে দিতে পারে। মিশরীয় বংশোদ্ভদ মাগ্দা সোয়াং নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে কাজ করেন। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে কী তার কাজকে কঠিন করে তোলে, উত্তরে তিনি বলেছিলেন: “গত দশ বছরে আমি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত ৩০ জন রোগীকে মারা যেতে দেখেছি, যাদের আমি দেখাশোনা করতাম। এটা একজনকে মানসিক ও শারীরিক দিক দিয়ে দুর্বল করে দেয়।” তাই এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে, একটা বই বলে: “মনপ্রাণ দিয়ে কোন রোগীর দেখাশোনা করার পর যদি সেই রোগী মারা যায়, তাহলে তা একজনের শরীর ও মনের ওপর প্রচণ্ড আঘাত আনতে পারে।”
নার্সদের ভবিষ্যৎ
প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি এবং প্রভাব নার্সিংয়ের ওপর চাপ বাড়ায়। কারণ প্রযুক্তি এবং মানবিকতা অর্থাৎ মানুষ যেভাবে রোগীদের দেখাশোনা করে, এই দুইয়ের মধ্যে সমতা রাখা খুবই মুশকিল। কোন যন্ত্র কখনোই একজন নার্সের মতো যত্ন ও সহানুভূতি দেখাতে পারবে না।
একটা পত্রিকা বলে: “নার্সিং চিরস্থায়ী এক পেশা। . . . যতদিন মানুষ থাকবে, ততদিন যত্ন, মমতা ও সহানুভূতির দরকার হবে।” নার্সিং এই প্রয়োজনগুলো মেটায়। তবে মানুষের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে আরও সুন্দর এক আশা রয়েছে। বাইবেল জানায় যে এমন এক সময় আসবে যখন কেউ বলবে না, “আমি পীড়িত।” (যিশাইয় ৩৩:২৪) আর তাই, ঈশ্বর যে নতুন জগতের প্রতিজ্ঞা করেছেন সেখানে ডাক্তার, নার্স ও হাসপাতালের দরকার হবে না।—যিশাইয় ৬৫:১৭; ২ পিতর ৩:১৩.
শুধু তাই নয়, বাইবেল এও প্রতিজ্ঞা করে যে “ঈশ্বর . . . তাহাদের সমস্ত নেত্রজল মুছাইয়া দিবেন; এবং মৃত্যু আর হইবে না; শোক বা আর্ত্তনাদ বা ব্যথাও আর হইবে না; কারণ প্রথম বিষয় সকল লুপ্ত হইল।” (প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪) তবে এখন সারা পৃথিবীতে যে লক্ষ লক্ষ নার্সরা আত্মত্যাগ করে সেবা করছেন, তার জন্য তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। তারা না থাকলে হাসপাতালের জীবন চলবে ঠিকই কিন্তু তাতে কোন আনন্দের ছোঁয়া থাকবে না। তাই এই প্রশ্নটা কত উপযুক্ত, “নার্সরা না থাকলে আমাদের কী হতো?”
(g০০ ১১/৮)
[৬ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]
ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল—আধুনিক নার্সিংয়ের প্রবর্তক
১৮২০ সালে ইতালিতে এক ইংরেজ পরিবারে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জন্ম হয়। তার বাবামা খুবই ধনী ছিলেন আর তাই তিনি অনেক আদরযত্নে ও বিত্তবৈভবের মধ্যে মানুষ হন। যুবতী ফ্লোরেন্স অনেক বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন আর স্বাস্থ্য নিয়ে পড়াশোনা এবং দুঃস্থদের সেবা করতে শুরু করেন। বাবামার শত নিষেধ সত্ত্বেও, ফ্লোরেন্স জার্মানির কাইজারওয়ার্থে একটা স্কুলে নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ নেন। পরে তিনি প্যারিসে পড়াশোনা করেন এবং ৩৩ বছর বয়সে লন্ডনে মহিলাদের একটা হাসপাতালের পরিচালিকা হন।
কিন্তু ফ্লোরেন্স যখন স্বেচ্ছায় ক্রিমিয়ার আহত সৈনিকদের সেবা করার জন্য যান, তখনই তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হন। সেখানে তাকে এবং তার দলের ৩৮ জন নার্সকে মিলে ইঁদুরে ভরা হাসপাতাল পরিষ্কার করতে হয়। প্রথমে সেখানে কাজ করাকে অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল কারণ ওখানে কোন সাবান ছিল না, হাত-মুখ ধোয়ামোছার জন্য কোন বেসিন বা তোয়ালে ছিল না আর রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত খাট, তোশক ও ব্যান্ডেজও ছিল না। কিন্তু ফ্লোরেন্স ও তার দলের নার্সরা সেই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রাণপণ করেছিলেন আর যুদ্ধ শেষে তিনি সারা বিশ্বের নার্সিং পদ্ধতি এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার সংস্কার করেছিলেন। ১৮৬০ সালে তিনি লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে নার্সদের জন্য নাইটিংগেল প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। লন্ডনে এটাই ছিল প্রথম নার্সিং স্কুল যেটাতে কোন ধর্মীয় প্রভাব ছিল না। ১৯১০ সালে মারা যাওয়ার আগে তিনি দীর্ঘ সময় অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় ছিলেন। তারপরও তিনি স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নের জন্য অনেক বই ও প্যাম্ফ্যাল্ট লিখে গিয়েছিলেন।
কেউ কেউ ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের পরহিতব্রতী ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে আপত্তি জানান। তারা বলেন যে, নার্সিং পদ্ধতি প্রবর্তনে অবদান রাখার জন্য অন্যরাও কিছুটা কৃতিত্বের ভাগীদার। এছাড়াও তার চরিত্র নিয়েও অনেক বিতর্ক রয়েছে। নার্সিংয়ের ইতিহাস (ইংরেজি) নামে একটা বই বলে যে, কিছু জন দাবি করেন তিনি “বদমেজাজি, স্বেচ্ছাচারী, একগুঁয়ে, বদরাগী ও উদ্ধত” ছিলেন কিন্তু অন্যরা আবার তার “মেধা ও গুণ, অসাধারণ সহ্য শক্তি আর তার পরস্পরবিরোধী ব্যক্তিত্বের” কারণে তার ভক্ত ছিলেন। তার সত্যিকারের চরিত্র যাই হোক না কেন, একটা বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে তার নার্সিং কৌশল এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। তিনিই নার্সিংকে পেশা হিসেবে প্রবর্তন করেছেন বলে মনে করা হয় আর আজকে আমরা তাই-ই জানি।
[চিত্র]
নার্সদের জন্য নাইটিংগেল প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেন্ট থমাস হাসপাতাল
[সৌজন্যে]
Courtesy National Library of Medicine
[৮ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]
একজন নার্সের যে সমস্ত যোগ্যতা থাকতে হয়
নার্স: “যিনি নার্সিংয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং সেই বিষয়ে নির্ধারিত মান পর্যন্ত পড়াশোনা করেন ও চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে পারদর্শী।”
রেজিস্ট্রিকৃত নার্স: “স্নাতক উপাধি প্রাপ্ত একজন নার্স, যার যোগ্যতা রাষ্ট্রীয় নার্স পরীক্ষক পরিষদ ভালভাবে যাচাই করে তাকে নার্সিং করার জন্য আইনগত অনুমতি প্রদান করে (রেজিস্ট্রিভুক্ত করে) . . . আর তখন তিনি রেজিস্ট্রিকৃত নার্স এই উপাধি ব্যবহার করার আইনগত অধিকার পান।”
ক্লিনিক্যাল নার্স বিশেষজ্ঞা: “নার্সিংয়ের বিশেষ ক্ষেত্র সম্বন্ধে ভাল জ্ঞান, দক্ষতা এবং যোগ্যতা আছে এমন একজন সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত নার্স।”
ধাত্রী নার্স: “যিনি নার্সিং ও ধাত্রীবিদ্যা দুটো বিষয় নিয়েই পড়াশোনা করেছেন।”
প্র্যাকটিকাল নার্স: “যার নার্সিং সম্বন্ধে ব্যবহারিক জ্ঞান আছে কিন্তু কোন নার্সিং স্কুল থেকে স্নাতক উপাধি পাননি।”
অনুমোদনপ্রাপ্ত প্র্যাকটিকাল নার্স: “যিনি প্র্যাকটিকাল নার্সিং স্কুল থেকে স্নাতক উপাধি পেয়েছেন . . . যাকে অনুমোদনপ্রাপ্ত বা পেশাদার নার্স হিসেবে কাজ করার আইনগত অনুমতি দেওয়া হয়েছে।”
[সৌজন্যে]
আমেরিকার ডরল্যান্ডস ইলাসট্রেটেড মেডিকেল ডিকশনারি প্রকাশনা থেকে
UN/J. Isaac
[৯ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্রগুলো]
‘স্বাস্থ্য সেবার মেরুদণ্ড’
১৯৯৯ সালের জুন মাসে আন্তর্জাতিক নার্স পরিষদের শততম অধিবেশনে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. গ্রু হারলেম ব্রান্টল্যান্ড বলেছিলেন:
“সবচেয়ে জরুরি স্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে নার্সরা একটা সুস্থ পৃথিবীর জন্য যেভাবে মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করছেন, তার সঙ্গে আর কোন কিছুর তুলনা হয় না। . . . বেশির ভাগ দেশের স্বাস্থ্য সংগঠনগুলোতে যোগ্য স্বাস্থ্য কর্মীদের ৮০ শতাংশ জায়গাই নার্স ও ধাত্রীরা দখল করে নিয়েছেন। তারা ২১ শতকে সবার স্বাস্থ্য চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো আনার মূল শক্তি হিসেবে কাজ করার উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে তুলে ধরেন। সত্যি বলতে কী, স্বাস্থ্য সেবার সমস্ত শাখায় তাদের অবদানই সবচেয়ে বেশি . . . তাই এটা একেবারে পরিষ্কার যে, নার্সরাই বেশির ভাগ স্বাস্থ্য সেবা দলগুলোর মেরুদণ্ড।”
মেক্সিকোর রাষ্ট্রপতি, আরনেস্তো সিদিয়ো ডি লিয়ন এক বাণীতে মেক্সিকোর নার্সদের প্রশংসা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “আপনারা সবাই . . . মেক্সিকানদের সুস্থ রাখার ও তাদের রোগ ভাল করে তোলার জন্য দিনের পর দিন আপনাদের জ্ঞান, সংহতি ও শ্রমকে সবচেয়ে ভালভাবে কাজে লাগাচ্ছেন। দিনের পর দিন আপনারা তাদের সেবা করে চলেছেন যাদের শুধু আপনাদের পেশাদার সাহায্যই নয় সেইসঙ্গে সান্ত্বনার দরকার যা আপনারা সহানুভূতি, নৈতিক দায়িত্ব বোধ ও মানবিকতার খাতিরে দিয়ে থাকেন। . . . আমাদের স্বাস্থ্য সংগঠনগুলোর মধ্যে আপনারাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। . . . প্রতিটা জীবন বাঁচাতে, প্রতিটা শিশুকে টীকা দেওয়ায়, প্রতিটা শিশুর জন্মে, স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিটা আলোচনায়, প্রতিটা রোগীর রোগ ভাল হওয়ায় এবং প্রতিটা রোগী যারা সেবা ও সাহায্য পায় তাতে আমাদের নার্সদের শ্রম রয়েছে।”
[সৌজন্যে]
UN/DPI Photo by Greg Kinch
UN/DPI Photo by Evan Schneider
[১১ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]
একজন কৃতজ্ঞ ডাক্তার
নিউ ইয়র্ক প্রেসবিটেরিয়ান হাসাপাতালের ডাক্তার সন্দীপ জহুর বলেন যে তিনি দক্ষ নার্সদের কাছে ঋণী। একবার একজন নার্স সুকৌশলে তাকে বলেছিলেন যে একজন মুমূর্ষু রোগীর আরও মরফিন দরকার। তিনি লিখেছিলেন: “দক্ষ নার্সরা ডাক্তারদেরও শেখাতে পারেন। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের মতো বিশেষ বিভাগগুলোতে যে নার্সরা কাজ করেন তারা হাসপাতালের সবচেয়ে ভাল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের কয়েকজন। আমি যখন একজন তরুণ চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম তখন তারা আমাকে শিখিয়েছিলেন যে কীভাবে ক্যাথিটার ব্যবহার করতে হয় ও ভেন্টিলেটার ঠিক করতে হয়। কোন্ কোন্ ওষুধের ব্যবহার এড়িয়ে চলতে হবে তা-ও তারা আমাকে বলেছিলেন।”
তিনি আরও বলেছিলেন: “নার্সরা রোগীদের প্রয়োজনীয় মানসিক এবং আবেগগত সাহায্য করে থাকেন কারণ তারাই রোগীদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সময় কাটান। . . . একজন নার্স যার ওপর আমার পুরো ভরসা আছে তিনি যখন বলেন যে আমাকে এখনই একটা রোগী দেখতে হবে আমি সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছুটে যাই।”
[৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
“আমি অন্যদের সেবা করতে চেয়েছিলাম।”—টেরি ওয়েদারসান, ইংল্যান্ড।
[৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
“বাবাকে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে, আমি ঠিক করেছিলাম যে আমি একজন নার্স হব।”—এতস্কো কোতানি, জাপান।
[৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
‘শিশুর জন্ম হল সবচেয়ে বড় আনন্দ, যা একজন ধাত্রী উপভোগ করতে পারেন।’—ইয়োলান্ডা কিলেন-ফান হুফ্ট, নেদারল্যান্ডস।
[৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
শিশুর জন্মের সময় সাহায্য করে ধাত্রীরা আনন্দ ও পরিতৃপ্তি লাভ করেন