সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

ভূমধ্যসাগরীয় সন্ন্যাসী সীল তারা কি টিকে থাকবে?

ভূমধ্যসাগরীয় সন্ন্যাসী সীল তারা কি টিকে থাকবে?

ভূমধ্যসাগরীয় সন্ন্যাসী সীল তারা কি টিকে থাকবে?

গ্রিসের সচেতন থাক! লেখক কর্তৃক

হোমার তার মহাকাব্য অডিসি-তে তাদের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন যে, তারা গ্রিসের রৌদ্রোজ্জ্বল সমুদ্রের তীরে রোদ পোহাচ্ছে। প্রাচীন কালের এশিয়া মাইনরের একটা শহর একসময় তাদের প্রতিকৃতি দেওয়া মুদ্রা বানিয়েছিল। ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণ সাগরে একসময় এদের প্রচুর দেখা যেত। কিন্তু, আজকে এই ভীরু প্রাণীগুলো অর্থাৎ ভূমধ্যসাগরীয় সন্ন্যাসী সীলদের একটাকেও আপনি দেখতে পাবেন কি না সন্দেহ আছে।

অন্যান্য লোমশ স্তন্যপায়ী সামুদ্রিক প্রাণীদের মতো ভূমধ্যসাগরীয় সন্ন্যাসী সীলদেরও ১৮ ও ১৯ শতকে প্রচুর পরিমাণে শিকার করা হয়েছিল। লোম, তেল ও মাংসের জন্য হাজার হাজার সীলকে হত্যা করা হয়েছে।

এখন এর ক্ষতিকর প্রভাব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হিসাব করে দেখা গেছে যে, মাত্র ৩৭৯ থেকে ৫৩০টার মতো ভূমধ্যসাগরীয় সন্ন্যাসী সীল টিকে আছে। তারা প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। কিন্তু এটা বলতেই হয় যে, মোনাকাস গার্ডিয়ান নামের একটা ছোট সংবাদপত্র অনুযায়ী সন্ন্যাসী সীলদের সংখ্যা গণনা করা ‘খুবই কঠিন বিষয়’।

এদেরকে রক্ষার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার সময় কি শেষ হয়ে গেছে? সন্ন্যাসী সীলদের রক্ষা করার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?

এক কঠিন লড়াই

সন্ন্যাসী সীলদের এইরকম নাম হওয়ার কারণ হয়তো কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের পোশাকের সঙ্গে এদের গায়ের রঙের মিল রয়েছে। এরা প্রধানত ইজিয়েন সমুদ্রের নর্দার্ন স্পোরাডিস দ্বীপগুলোর দুর্গম পাহাড়ি ঢাল এবং সমুদ্রের গুহাগুলোতে বাস করে। এছাড়াও, উত্তরপশ্চিম আফ্রিকা এবং পর্তুগালের ডেজারটাস দ্বীপগুলোর সমুদ্র উপকূলে কিছু ছোট ছোট দল দেখতে পাওয়া যায়। এরা বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রজাতির সীলদের মধ্যে একটা। এরা প্রায় ৩ মিটার লম্বা হয় এবং এদের ওজন প্রায় ২৭৫ কিলোগ্রাম হয়ে থাকে।

খুব কাছে থেকে দেখলে দেখা যায় যে এদের মাথার আকৃতি বালব্‌ বা কন্দের মতো এবং রুপালি লোমে ঢাকা। এদের গভীর কালো দুটো চোখ, বড় বড় নাসারন্ধ্র সহ লম্বা নাক, কানের জন্য ছোট্ট ছোট্ট ছিদ্র, মোটা নুইয়ে পড়া গোঁফ এবং চামড়ায় মোটা মোটা ভাঁজ রয়েছে, যা দেখে মনে হয় যে এদের অনেক থুতনি। এদের শরীর ছোট কালো বা চকলেট-বাদামি রঙের লোমে ঢাকা কিন্তু নিচের দিকের লোমগুলোর রং হালকা। তবে, নবজাত শিশু সীলগুলোর পিঠে লম্বা কালো লোম থাকে এবং পেটে জায়গায় জায়গায় সাদা ছিটা থাকে।

সন্ন্যাসী সীলদের টিকে থাকার লড়াইয়ে একটা বাধা হল যে এদের বংশবৃদ্ধির হার অনেক কম। স্ত্রী সীলরা বছরে একটার বেশি বাচ্চা দেয় না। এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক সমস্ত স্ত্রীরা প্রতি বছর বাচ্চা দেয় না।

কিন্তু, বংশবৃদ্ধির হার কম থাকাই বিলুপ্তির একমাত্র কারণ নয়। বন্যপ্রাণীদের সংরক্ষণের জন্য নিউ ইয়র্ক আ্যকোয়ারিয়ামের মহা পরিচালক ড. ডেনিস থোনি বলেন: “যদিও ভূমধ্যসাগরীয় সন্ন্যাসী সীলদের বংশবৃদ্ধির হার কম কিন্তু একইরকম বংশবৃদ্ধির হার থাকা সত্বেও হারবার সীলদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে না। সুতরাং, অন্যান্য কারণে তারা বিলুপ্ত হচ্ছে।”

আক্রমণের মুখে

আপনার বাড়িতে আগুন লাগলে যে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে, তা একবার কল্পনা করুন। আপনার সমস্ত জিনিসপত্র যেমন, আসবাবপত্র, জামাকাপড়, মূল্যবান সামগ্রী এবং স্মৃতিচিহ্নগুলো পুড়ে নষ্ট হয়ে যাবে। হঠাৎ করেই আপনার জীবনধারা বদলে যাবে। ভূমধ্যসাগরীয় সন্ন্যাসী সীলদের বাড়িতে ঠিক তাই-ই হয়েছিল। দূষণ, পর্যটকদের ভ্রমণ, শিল্পকারখানা এবং মানুষের অন্যান্য কর্মকাণ্ড এই সীলদের বেশির ভাগ প্রাকৃতিক বাসস্থানকে নষ্ট করে দিয়েছে।

শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত মাছ ধরার ফলে সন্ন্যাসী সীলদের খাবারও কমে গেছে। প্রাণিবিজ্ঞানী ড. সুজানি ক্যানিডি-স্টসকফ বলেন: “সীলদের শিকারের প্রাণী কমে যাওয়ার মানে হল, খাবার জোগাড় করার জন্য তাদের বেশি শক্তি ব্যয় করতে হয়।” তাই সন্ন্যাসী সীলরা শুধু তাদের বাসস্থান বা বাড়িই হারায়নি সেইসঙ্গে খাবারের জন্যও তাদের লড়াই করতে হয়েছিল!

অতিরিক্ত মাছ ধরার আরেকটা খারাপ পরিণতি হল যে, সীলরা মাঝে মাঝে মাছ ধরার জালে আটকা পড়ে এবং শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায়। তবে, বেশির ভাগ সময়ই জেলেরা তাদেরকে মেরে ফেলে। কেন? কারণ জাল থেকে কীভাবে খাবার চুরি করতে হয়, তা সীলরা শিখে ফেলেছে আর এর ফলে জেলেদের মাছ ধরায় ক্ষতি হয়। আর মাছের সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে মানুষ জন্তুর বিরুদ্ধে এক লড়াইয়ে নেমেছে। এই অসম লড়াইয়ের ফলে সন্ন্যাসী সীলরা বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে।

যেহেতু সন্ন্যাসী সীলরা খাদ্যশৃঙ্খলের প্রায় শীর্ষে রয়েছে, তাই কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন যে এই স্তন্যপায়ী সামুদ্রিক প্রাণীরা এক “নির্দেশক প্রজাতি।” এর মানে হল যে তারা যদি খাবার পেয়ে না থাকে, তাহলে এটা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে খাদ্যশৃঙ্খলের বাকি প্রাণীরাও খাবার পাচ্ছে না। আর এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে ভূমধ্যসাগরীয় বাস্তুতন্ত্রের সংরক্ষণ ব্যবস্থা সন্তোষজনক নয় কারণ সন্ন্যাসী সীলই ইউরোপের সবচেয়ে বেশি বিপদাপন্ন প্রজাতি।

তারা কি টিকে থাকবে?

মানুষ ভূমধ্যসাগরীয় সন্ন্যাসী সীলদের সবচেয়ে বড় শত্রু আবার তারাই তাদের সবচেয়ে বড় রক্ষক। সীলদের রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন বেসরকারী ও সরকারী সংস্থা গঠন করা হয়েছে। তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন এলাকা আলাদা করা হয়েছে। এই চমৎকার প্রাণীদের কীভাবে সাহায্য করা যায়, তা জানার জন্য তাদের বাসস্থানে গিয়ে অনেক গবেষণাও করা হয়েছে।

১৯৮৮ সালে ভূমধ্যসাগরীয় সন্ন্যাসী সীলদের ওপর গবেষণা ও তাদের সুরক্ষার জন্য হেলেনিক সোসাইটি (MOm) নামে একটা সংঘ গঠন করা হয়েছে। এই সংঘের গবেষকরা সন্ন্যাসী সীলদের সংখ্যা গণনা এবং তাদের রক্ষা করতে দরকারি অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করার জন্য নিয়মিত তাদের বাসস্থানগুলোতে যান।

একটা রক্ষিবাহিনী স্পীডবোটে চড়ে সংরক্ষিত এলাকাগুলো ঘুরে দেখে। শুধু তাই নয়, এই রক্ষিবাহিনী নর্দার্ন স্পোরাডিস দ্বীপগুলোর আ্যলোনিসসে অবস্থিত গ্রিসের ন্যাশনাল ম্যারিন পার্কে যারা বেড়াতে আসেন ও যে জেলেরা ঘুরে বেড়ান তাদের তথ্য ও নির্দেশনা দিয়ে থাকে। যখন অসুস্থ ও আহত সীলদের দেখা যায়, এই রক্ষিবাহিনী প্রয়োজনীয় সমস্ত চিকিৎসা করে থাকে ও সেইসঙ্গে MOm পুনর্বাসন কেন্দ্রে আনার ব্যবস্থা করে।

সীলদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে অনাথ, অসুস্থ বা আহত বাচ্চাদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তাদেরকে সেই পর্যন্ত চিকিৎসা করা ও যত্ন নেওয়া হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেকে নিজে রক্ষা করতে শেখে। এর ফলাফল সম্ভাবনাময়। বেশ কিছু বছর ধরে দ্রুত হ্রাস পাওয়ার পর, এই প্রথমবারের মতো নর্দার্ন স্পোরাডিসে সন্ন্যাসী সীলদের সংখ্যা বাড়তে দেখা যাচ্ছে।

এই চেষ্টা কি সবসময় এভাবে সফল হবে? সময়ই তা বলে দেবে। কিন্তু, এটা স্পষ্ট যে এই বিপন্ন প্রজাতিকে যদি টিকিয়ে রাখতে হয়, তাহলে আরও অনেক কাজ করা দরকার। স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের ড. ডেভিড ওয়াইল্ড সচেতন থাক! পত্রিকাকে বলেছিলেন: “সামুদ্রিক জীব জগতের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। সমস্যা হল যে, সমুদ্রে কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা আমরা খুব ভালভাবে জানি না আর তাই এটাকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, তা এখনও আমাদের অজানা।”(g০১ ৩/৮)

[১৭ পৃষ্ঠার বাক্স]

অন্য সন্ন্যাসী সীলদের জীবনও বিপন্ন

সন্ন্যাসী সীলদের পৃথিবীর অন্যান্য সমুদ্রেও দেখা যায় আর এই সীলদের জীবনও বিপন্ন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকা বলে যে ক্যারিবিয় বা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান সন্ন্যাসী সীলরাই ছিল “প্রথম সীল যাদেরকে আমেরিকার কলম্বাস দেখেছিলেন। সমুদ্র তীরে থাকতে পছন্দ করে এই অপূর্ব সন্ন্যাসী সীলদের শীঘ্রিই ঝাঁকে ঝাঁকে হত্যা করা হয়। . . . সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ক্যারিবিয়ান সন্ন্যাসী সীলকে শেষবারের মতো ১৯৫২ সালে দেখা গিয়েছিল।”

হাওয়াইয়ান আইল্যান্ডস ন্যাশনাল ওয়াইল্ডলাইফ রেফিউজ হয়তো দ্যা ফ্রেঞ্চ ফ্রিগেটই হাওয়াইয়ান বা লেসান সন্ন্যাসী সীলদের শেষ আশ্রয়। তাদেরকে রক্ষা করার আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও প্রায় ১,৩০০ জীবিত সীল “বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত।”

১৯৯৭ সালের বসন্তকাল থেকে, ওয়েস্ট আফ্রিকার মৌরিতানিয়া উপকূলে বসবাসকারী ২৭০টা ভূমধ্যসাগরীয় সন্ন্যাসী সীলদের মধ্যে প্রায় তিন চতুর্থাংশ সীল এক মহামারীতে মারা গেছে। সায়েন্স নিউজ পত্রিকার একটা রিপোর্ট অনুযায়ী বেশির ভাগ সীলদের পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল যে তাদের শরীরে “ডলফিন মরবিলিভাইরাস নামের একধরনের ভাইরাস ছিল, যা কুকুরের রোগ ঘটায় এমন ভাইরাসের অনুরূপ।”

[১৬ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

সন্ন্যাসী সীলদের অনেক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেমন, বালব্‌ বা কন্দ আকৃতির মাথা এবং বড় বড় নাসারন্ধ্র

সীলদের রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন সংস্থা গঠন করা হয়েছে

[সৌজন্যে]

Panos Dendrinos/HSSPMS

[১৭ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

বেশ কিছু বছর ধরে হ্রাস পাওয়ার পর, এই প্রথমবারের মতো নর্দার্ন স্পোরাডিসে সন্ন্যাসী সীলদের সংখ্যা বাড়তে দেখা যাচ্ছে

[সৌজন্যে]

P. Dendrinos/MOm

D. Kanellos/MOm

[১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

হাওয়াইয়ের সন্ন্যাসী সীল

[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

Panos Dendrinos/HSSPMS