আধুনিক চিকিৎসা—কতদূর পর্যন্ত নাগাল পেতে পারে?
আধুনিক চিকিৎসা—কতদূর পর্যন্ত নাগাল পেতে পারে?
আপেল গাছ জন্মে এমন দেশগুলোতে, অনেক ছেলেমেয়েরা একেবারে ছেলেবেলাতেই একটা বিষয় শিখে নেয়: তাদের নাগালের বাইরে থেকে আপেল পেড়ে আনতে হলে তাদেরকে অন্য আরেকজন খেলার সাথির কাঁধে চড়ে তা পাড়তে হবে। আধুনিক চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এইরকম কিছু ঘটেছে। চিকিৎসাবিদ্যার গবেষকরা, অতীতের বিখ্যাত চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের কাঁধে ভর করে প্রাপ্তির শিখরে পৌঁছেছেন।
অতীতের আরোগ্যকারীদের মধ্যে সুপরিচিত ব্যক্তিরা হলেন হিপোক্রেটিস ও পাস্তুর এবং সেইসঙ্গে ভেসেলিয়াস ও উইলিয়াম মরটন। তবে এই ব্যক্তিদের নাম হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা তাদের কাছে কীভাবে ঋণী?
প্রাচীন কালে, আরোগ্য বিদ্যায় বৈজ্ঞানিক কোন পদ্ধতি প্রচলিত ছিল না বরং কুসংস্কার ও ধর্মীয় রীতিনীতির মিশ্রণ ছিল। ডা. ফিলিক্স মার্টি-ইব্যানেজ সম্পাদিত চিকিৎসাবিদ্যার মহাকাব্য (ইংরেজি) বই বলে: “রোগব্যাধিকে দমন করার জন্য . . . মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীরা চিকিৎসাবিদ্যা ও ধর্ম মিলিয়ে ওষুধ তৈরি করেছিলেন, কারণ রোগব্যাধিকে তারা দেবতাদের কাছ থেকে অভিশাপ বলে মনে করতেন।” কিছুদিন পর মিশরীয় চিকিৎসাবিদ্যার উদ্ভব হয় কিন্তু এটার উৎসও ছিল ধর্ম। তাই, একেবারে শুরু থেকেই আরোগ্যকারীদেরকে ধর্মের মতো শ্রদ্ধার চোখে দেখা হতো।
কাদামাটির স্তম্ভ (ইংরেজি) বইয়ে ডা. টমাস এ. প্রেসটন বলেন: “প্রাচীন কালের অনেক বিশ্বাস আজকের দিনে প্রচলিত চিকিৎসাবিদ্যায় বিরাট ছাপ ফেলেছে। এইরকম একটা বিশ্বাস হল, রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা রোগীর পক্ষে অসাধ্য তবে একমাত্র চিকিৎসকের অলৌকিক শক্তিতেই সুস্থ হওয়ার আশা আছে।”
ভিত্তি স্থাপন করা
কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসাবিদ্যা বিজ্ঞানভিত্তিক হয়ে উঠেছিল। প্রাচীন কালের সবচেয়ে প্রথম বিজ্ঞানসম্মত আরোগ্যকারী ছিলেন হিপোক্রেটিস। সা.কা.পূ. প্রায় ৪৬০ সালে গ্রিসের কস দ্বীপে তার জন্ম হয় এবং অনেকে তাকে পশ্চিমা চিকিৎসাবিদ্যার জনক বলে মনে করেন। হিপোক্রেটিস চিকিৎসাবিদ্যায় যুক্তিসংগত পদক্ষেপ নেওয়ার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। রোগব্যাধি দেবতার কাছ থেকে অভিশাপ, এই ধারণাকে বাতিল করে দিয়ে তিনি যুক্তি দেখিয়ে বলেছিলেন যে, রোগব্যাধির পিছনে প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেক দিন ধরে মৃগীরোগকে পবিত্র রোগ বলা হতো কারণ মনে করা হতো যে, একমাত্র দেবতাদের সাহায্যেই এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু হিপোক্রেটিস লিখেছিলেন: “যেটাকে পবিত্র রোগ বলে মনে করা হয় সেটা ঐশিকও নয় বা অন্যান্য রোগগুলোর চেয়ে আলাদাও নয় বরং এই রোগেরও প্রাকৃতিক কারণ আছে।” এছাড়াও হিপোক্রেটিসই ছিলেন প্রথম আরোগ্যকারী, যিনি বিভিন্ন রোগের লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন ও ভবিষ্যতের জন্য সেগুলোকে রেকর্ড করে রেখেছিলেন।
কয়েকশ বছর পর, সা.কা. ১২৯ সালে গ্রিক চিকিৎসক গ্যালেনের জন্ম হয় আর হিপোক্রেটিসের মতো তিনিও নতুন ধারায় বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছিলেন। মানুষ ও পশুর দেহের ব্যবচ্ছেদের ওপর ভিত্তি করে গ্যালেন দৈহিক গঠনতন্ত্রের বিষয়ে একটা বই লিখেছিলেন, যেটা কয়েকশ বছর ধরে ডাক্তাররা ব্যবহার করেছেন! ১৫১৪ সালে ব্রাসেলসে আ্যন্ড্রিয়াস ভেসেলিয়াসের জন্ম হয় আর তিনি মানব দেহের গঠন (ইংরেজি) নামক বই লিখেছিলেন। এটা অনেক বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিল কারণ এই বইয়ে গ্যালেনের অনেক ধারণাকে অস্বীকার করা হয়েছে কিন্তু এটাই আধুনিক দৈহিক গঠনতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। ডি গ্রোজেন (মহান ব্যক্তিরা) বই অনুসারে, এভাবেই ভেসেলিয়াস “সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন চিকিৎসা গবেষকে পরিণত হয়েছিলেন।”
* ইংরেজ চিকিৎসক উইলিয়াম হারভে, পশুপাখির ব্যবচ্ছেদের পিছনে অনেক বছর ব্যয় করেছিলেন। তিনি হৃৎপিণ্ডের ভাল্বগুলোর কাজ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, হৃৎপিণ্ডের প্রতিটা প্রকোষ্ঠে কতখানি রক্ত থাকে ও পুরো শরীরে কী পরিমাণ রক্ত থাকে, তা হিসাব করেছিলেন। গবেষণা করে পাওয়া এই বিষয়গুলোকে হারভে ১৬২৮ সালে পশুপাখিদের হৃৎপিণ্ড ও রক্ত সচল (ইংরেজি) নামক বইয়ে ছাপিয়েছিলেন। এর জন্য তিনি অনেক সমালোচনা, বিরোধিতা, আক্রমণ ও এমনকি অপমানেরও শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু তার কাজ চিকিৎসাবিদ্যায় যুগান্তের সূচনা করেছিল—দেহের রক্তসংবহন তন্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছিল!
একইভাবে, হৃৎপিণ্ড ও রক্তসংবহন সম্বন্ধে গ্যালেনের তত্ত্বগুলোও পরে বাতিল হয়ে গিয়েছিল।ক্ষৌরি থেকে অপারেশন
অপারেশনের কৌশলেও বিপুল উন্নতি হচ্ছিল। মধ্যযুগে সাধারণত ক্ষৌরকাররাই অপারেশন করত। এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে, কেউ কেউ বলেন, আধুনিক অপারেশনের জনক ছিলেন ১৬শ শতাব্দীর ফরাসি পুরুষ আ্যমব্রোয়েস প্যারি। তিনি ছিলেন সবচেয়ে প্রথম সার্জন, যিনি ফ্রান্সের চারজন রাজার ক্ষৌরকার হিসেবে কাজ করেছিলেন। সেইসঙ্গে প্যারি অপারেশন করার জন্য অনেক অনেক যন্ত্রপাতিও উদ্ভাবন করেছিলেন।
উনিশ শতকে এসেও সার্জনরা যে বিরাট সমস্যার মুখোমুখি হতেন তা ছিল অপারেশনের ব্যথা, যা তারা উপশম করতে পারতেন না। কিন্তু, ১৮৪৬ সালে উইলিয়াম মরটন নামে একজন ডেন্টাল সার্জন অপারেশনের সময় চেতনানাশক পদার্থ ব্যবহার করার পথ খুলে দিয়েছিলেন। *
১৮৯৫ সালে, জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী উইলহেলম্ রন্ট্জেন তড়িৎ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার সময় দেখতে পেয়েছিলেন যে, এর রশ্মিগুলো মাংস ভেদ করে ঠিকই কিন্তু হাড়কে ভেদ করে না। রশ্মির উৎস কী তা তিনি জানতেন না আর তাই তিনি এর নাম দিয়েছিলেন এক্স-রে, যে নাম ইংরেজি-ভাষী দেশগুলোতে এখনও ব্যবহার হয়। (জার্মানির লোকেরা এটাকে রন্ট্জেনস্ট্রেহ্লেন হিসেবে জানে।) ডি গ্রোবেন ডয়েসচেন (জার্মানির মহান ব্যক্তিরা) বই অনুসারে, রন্ট্জেন তার স্ত্রীকে বলেছিলেন: “লোকেরা বলবে: ‘রন্ট্জেন পাগল হয়ে গেছে।’” অবশ্য কেউ কেউ তা-ই বলেছিল। কিন্তু তার এই আবিষ্কার অপারেশনে বিপ্লব এনে দিয়েছিল। এর পর থেকে সার্জনরা শরীর না কেটেই ভিতরের অবস্থা দেখতে পারতেন।
রোগব্যাধিকে জয় করা
যুগ যুগ ধরে গুটি বসন্তের মতো সংক্রামক রোগগুলো মহামারী, আতঙ্ক ও মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর-রাজি
নামে নবম শতাব্দীর একজন পারস্য চিকিৎসক সবচেয়ে প্রথমে গুটি বসন্তের বিষয়ে চিকিৎসাবিদ্যার ভাষায় সঠিক বর্ণনা করেছিলেন, যাকে কেউ কেউ সেই সময়কার ইসলামিক বিশ্বের সর্বমহান চিকিৎসক বলে মনে করতেন। কিন্তু, কয়েকশ বছর পরই ব্রিটিশ চিকিৎসক এডোয়ার্ড জিনার এই রোগ আরোগ্যের উপায় বের করেছিলেন। জিনার লক্ষ্য করেছিলেন যে, কোন ব্যক্তির যদি গোবসন্ত হয়—যা সাধারণত কোন ক্ষতি করে না—তাহলে তার গুটি বসন্ত ভাল হয়ে যেত। এই পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে জিনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য গোবসন্তে আক্রান্ত অঙ্গ থেকে পদার্থ ব্যবহার করেছিলেন। সেটা ছিল ১৭৯৬ সালের কথা। তার আগের প্রবর্তনকারীদের মতো জিনারকেও অনেক সমালোচনা ও বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কিন্তু, ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যাপারে এই পদ্ধতি আবিষ্কারই শেষ পর্যন্ত এই রোগকে একেবারে নির্মূল করে দিয়েছিল এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানকে এক শক্তিশালী নতুন হাতিয়ার জুগিয়েছিল।ফ্রান্সের লুই পাস্তুর, র্যাবিস ও পশুরোগকে প্রতিরোধ করার জন্য ভ্যাকসিন ব্যবহার করেছিলেন। তিনিও প্রমাণ করেছিলেন যে, অসুখবিসুখ হওয়ার প্রধান কারণ হল রোগজীবাণু। ১৮৮২ সালে রবার্ট কক যক্ষ্মার জীবাণুকে চিহ্নিত করেছিলেন, যেটাকে একজন ইতিহাসবেত্তা “উনিশ শতকের সবচেয়ে বড় ঘাতক রোগ” বলে অভিহিত করেছিলেন। এক বছর পর, কলেরা রোগের জীবাণুকে কক চিহ্নিত করেছিলেন। জীবন (ইংরেজি) পত্রিকা বলে: “পাস্তুর ও ককের আবিষ্কার জীবাণুবিজ্ঞানের বিকাশ ঘটিয়েছে এবং তা অনাক্রম্যতাবিদ্যায় উন্নতি ঘটিয়েছে, স্বাস্থ্যবিধান মানুষের আয়ু বাড়িয়েছে, যা কিনা বিগত ১,০০০ বছরের কোন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই করতে পারেনি।”
বিংশ শতাব্দীর চিকিৎসাবিজ্ঞান
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, চিকিৎসাবিজ্ঞান অতীতের এই মেধাবী ব্যক্তি ও অন্যান্য চিকিৎসাবিদদের কাঁধে ভর করেই এগিয়ে চলেছে। তখন থেকেই চিকিৎসাবিজ্ঞান খুব দ্রুত উন্নতি করে চলেছে—ডায়াবিটিসের জন্য ইনসুলিন, ক্যানসারের জন্য কেমোথেরাপি, গ্রন্থির ব্যাধির জন্য হরমোন চিকিৎসা, যক্ষ্মার জন্য আ্যন্টিবায়োটিক, কয়েক ধরনের ম্যালেরিয়ার জন্য ক্লোরোকুইন এবং কিডনির অসুখের জন্য ডায়ালাইসিস ও সেইসঙ্গে ওপেন হার্ট সার্জারি এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপন হল মাত্র কয়েকটা চিকিৎসা।
কিন্তু, এখন এই একুশ শতকের শুরুতে দাঁড়িয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান “বিশ্বের সকলের জন্য মোটামুটি ভাল স্বাস্থ্য” নিশ্চিত করার লক্ষ্যের কতটা কাছে পৌঁছাতে পেরেছে?
এই লক্ষ্য কি নাগালের বাইরে?
ছেলেমেয়েরা জানে যে, বন্ধুর কাঁধে চড়লেই সব আপেল তার নাগালের মধ্যে চলে আসে না। কিছু কিছু রসালো আপেল একেবারে গাছের আগায় থাকে, যা নাগালের অনেক বাইরে। একইভাবে, চিকিৎসাবিজ্ঞান একটার পর একটা বড় বড় সাফল্যের নাগাল পেয়েছে, দিনের পর দিন উন্নতি করে চলেছে। কিন্তু, সকলের জন্য ভাল স্বাস্থ্য এনে দেওয়ার সবচেয়ে মূল্যবান লক্ষ্যটা নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে।
তাই, ১৯৯৮ সালে ইউরোপিয়ান কমিশন যখন রিপোর্ট করেছিল যে, “ইউরোপীয়রা কখনও এত দীর্ঘ ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবন উপভোগ করেনি,” তখন ওই রিপোর্ট এও বলেছিল: “প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন ব্যক্তি ৬৫ বছর হওয়ার আগেই মারা যাবে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ লোক ক্যানসারে, আরও ৩০ শতাংশ লোক কার্ডিভাসকুলার রোগে মারা যাবে . . .। স্বাস্থ্যের নতুন নতুন সমস্যার জন্য আরও ভাল প্রতিষেধক অবশ্যই তৈরি করতে হবে।”
স্বাস্থ্য বিষয়ক জার্মান পত্রিকা, জেসান্ডহিট ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে রিপোর্ট করেছিল যে, কলেরা ও যক্ষ্মার মতো সংক্রামক রোগগুলো দিন-দিন হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কেন? কারণ আ্যন্টিবায়োটিকগুলো “কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলছে। দিন-দিন অনেক সংখ্যক ব্যাকটেরিয়া বহুল প্রচলিত অন্তত একটা ওষুধের কার্যকারিতাকে প্রতিরোধ করছে; আর সত্যি বলতে কী, অনেক ব্যাকটেরিয়া আবার বেশ কয়েকটা ওষুধের কার্যকারিতাকে প্রতিরোধ করছে।” শুধু পুরনো রোগগুলোই আবার নতুন করে দেখা দিচ্ছে না কিন্তু এইডসের
মতো নতুন নতুন রোগগুলোর আবির্ভাব হচ্ছে। জার্মানির ওষুধ প্রস্তুত সম্বন্ধীয় প্রকাশনা পরিসংখ্যান ৯৭ (ইংরেজি) আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়: “এই পর্যন্ত, জানা রোগগুলোর দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় ২০,০০০ রোগের কারণ সম্বন্ধে কিছু জানা যায়নি।”জিন থেরাপি কি উত্তর দিতে পারে?
এটা স্বীকার করতেই হবে যে, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়ে চলেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেকে মনে করেন যে জিনতত্ত্বীয় প্রকৌশলই হয়তো ভাল স্বাস্থ্য এনে দিতে পারবে। ১৯৯০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ড. উইলিয়াম ফ্রেঞ্চ এন্ডারসনের মতো ডাক্তাররা জিনতত্ত্বের ওপর গবেষণা করার পর, জিন থেরাপিকে “চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণায় সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ও জনপ্রিয় নতুন ক্ষেত্র” হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। সত্যিই, হেইলিন মিট জেনেন (জিন দিয়ে সুস্থ করা) বইটা বলে যে, জিন থেরাপির মাধ্যমে “চিকিৎসাবিজ্ঞান আরও বেশি উন্নতির দোরগোড়ায় চলে যেতে পারে। এটা বিশেষ করে সেই রোগগুলোর চিকিৎসার জন্য খাটে, যেগুলোকে এখনও প্রতিরোধ করা যায়নি।”
বিজ্ঞানীরা আশা করেন যে, জিনসংক্রান্ত রোগ নিয়ে জন্মানো রোগীদের দেহে ইনজেকশনের মাধ্যমে ভাল জিন ঢুকিয়ে সুস্থ করে তুলতে পারবেন। এমনকি ক্ষতিকর কোষগুলো যেমন ক্যানসার কোষগুলো যাতে নিজে নিজে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা হবে। একজন ব্যক্তি কোন নির্দিষ্ট রোগে আক্রান্ত হবে কি না, তা এখন জিনের সাহায্যে আগে থেকেই অনুসন্ধান করা যায়। কেউ কেউ বলেন যে, রোগীর জিনের গঠনের উপযোগী করে ওষুধ তৈরি করাই হবে এর পরের অগ্রগতি। একজন বিখ্যাত গবেষক বলেন, ডাক্তাররা এক সময় “তাদের রোগীদের রোগনির্ণয় করতে পারবেন ও তাদেরকে সুস্থ করে তোলার জন্য আণবিক সূত্রের উপযুক্ত অংশ দেবেন।”
কিন্তু জিন থেরাপির মাধ্যমে ভবিষ্যতে ‘অলৌকিকভাবে আরোগ্য’ হওয়া যাবে, এই ধারণাটা সবাই বিশ্বাস করে না। সত্যি বলতে কী, বিভিন্ন সমীক্ষা জানায় যে লোকেরা এমনকি তাদের জিনগুলোর গঠনও পরীক্ষা করে দেখতে চায় না। এছাড়া অনেকে আবার এই ভেবে ভয় পান যে, জিন থেরাপি হয়তো স্বাভবিক বৈশিষ্ট্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
জিনতত্ত্বীয় প্রকৌশল বা চিকিৎসাবিজ্ঞানের অত্যাধুনিক পদ্ধতিগুলো তাদের বড় বড় প্রতিজ্ঞাগুলোকে শেষ পর্যন্ত রাখতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে, খুব বেশি আশা না করার পিছনে যথেষ্ট কারণ আছে। কাদামাটির স্তম্ভ বইটা অত্যন্ত পরিচিত একটা চক্রের বিষয় বর্ণনা করে: “চিকিৎসা বিষয়ক সভাগুলোতে এবং পত্রপত্রিকায় এক নতুন থেরাপির ব্যাপারে ঘোষণা করা হয়েছে ও স্বাগত জানানো হয়েছে। যারা এটা উদ্ভাবন করেছেন তারা এই পেশায় বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন এবং প্রচার মাধ্যমগুলো এই উন্নতিকে প্রশংসা করেছে। বিস্ময়কর চিকিৎসার পক্ষে এক আশাবাদী মনোভাবের সময় ও সুপ্রতিষ্ঠিত সাক্ষ্যের পর, ধীরে ধীরে বিভ্রান্তির শুরু হয় আর তা কয়েক মাস থেকে কয়েক দশক পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এরপর এক নতুন ধরনের চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয় এবং বলতে গেলে রাতারাতি তা পুরনোটার জায়গা নিয়ে নেয় এবং অকেজো বলে সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে বাতিল করে দেয়।” যে চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোকে অনেক ডাক্তাররা অকেজো বলে বাতিল করে দিয়েছেন, কিছুদিন আগেও সেগুলো সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুপরিচিত ছিল।
যদিও ডাক্তারদেরকে এখন আর প্রাচীন কালের আরোগ্যকারীদের
মতো ধর্মীয় মর্যাদা দেওয়া হয় না কিন্তু এখনও কিছু লোকেদের মধ্যে এমন প্রবণতা রয়েছে যারা মনে করেন যে, চিকিৎসকদের ঈশ্বরের মতো শক্তি আছে ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মানবজাতির সমস্ত অসুখ দূর হয়ে যাবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বাস্তবে আসলে এর উলটোটা হয়। ড. লিওনার্ড হেফ্লিক তার লেখা কীভাবে ও কেন আমরা বুড়ো হই (ইংরেজি) বইয়ে বলেন: “১৯০০ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা প্রায় ৭৫ জন লোক পয়ষট্টি বছর হওয়ার আগেই মারা যেতেন। আজকে, এই পরিসংখ্যান একেবারে বদলে গেছে: এখন প্রায় ৭০ শতাংশ লোক পয়ষট্টি বছর হওয়ার পরে মারা যান।” লক্ষণীয়ভাবে আয়ু বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন্ বিষয়টা অবদান রেখেছে? হেফ্লিক বলেন যে, এর “মূল কারণ হল নবজাত শিশুদের মৃত্যুর হার কমে গিয়েছিল।” মনে করুন চিকিৎসাবিজ্ঞান বয়স্কদের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলো যেমন হার্টের রোগ, ক্যানসার ও স্ট্রোক নির্মূল করে ফেলেছে। তাহলে কি তা অমরত্ব এনে দেবে? কখনোই না। হেফ্লিক বলেন যে, এমনকি তারপরেও “বেশির ভাগ লোকেরা মাত্র একশ বছর বেঁচে থাকতে পারবে।” তিনি আরও বলেন: “তবুও এই একশ বছর বয়সী ব্যক্তিরা অমর হতে পারবে না। কিন্তু কোন্ কারণগুলোর জন্য তারা মারা যাবে? মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তারা দিন-দিন কেবল দুর্বল হবে।”চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, মৃত্যুকে নির্মূল করার বিষয়টা এখনও চিকিৎসাবিদ্যার নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে। কিন্তু কেন এরকম হয়? আর সবার জন্য ভাল স্বাস্থ্য আনা কি এক অবাস্তব স্বপ্ন?(g০১ ৬/৮)
[পাদটীকাগুলো]
^ দ্যা ওয়ার্ল্ড বুক এনসাইক্লোপিডিয়া অনুসারে, গ্যালেন ভেবেছিলেন যে যকৃৎ পরিপাককৃত খাদ্যকে রক্তে পরিণত করত এবং ওই রক্ত পরে দেহের অন্যান্য অংশে প্রবাহিত হতো এবং অন্যান্য অঙ্গগুলো তা শুষে নিত।
^ ২০০১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ সচেতন থাক! এর “ব্যথা থেকে আ্যনেসথেসিয়া” প্রবন্ধটা দেখুন।
[৪ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]
“প্রাচীন কালের অনেক বিশ্বাস আজকের দিনে প্রচলিত চিকিৎসাবিদ্যায় বিরাট ছাপ ফেলেছে।”—কাদামাটির স্তম্ভ
[৪, ৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
হিপোক্রেটিস, গ্যালেন এবং ভেসেলিয়াস আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন
[সৌজন্যে]
Kos Island, Greece
Courtesy National Library of Medicine
Woodcut by Jan Steven von Kalkar of A. Vesalius, taken from Meyer’s Encyclopedic Lexicon
[৬ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
আ্যমব্রোয়েস প্যারি প্রথম সার্জন ছিলেন, যিনি ফ্রান্সের চারজন রাজার ক্ষৌরকার হিসেবে কাজ করেছিলেন
পারস্য চিকিৎসক আর-রাজি (বাঁয়ে) এবং ব্রিটিশ চিকিৎসক এডোয়ার্ড জিনার (ডান দিকে)
[সৌজন্যে]
প্যারি এবং আর-রাজি: Courtesy National Library of Medicine
From the book Great Men and Famous Women
[৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
ফ্রান্সের লুই পাস্তুর প্রমাণ করেছিলেন যে রোগজীবাণুর কারণেই অসুখ হয়
[সৌজন্যে]
© Institut Pasteur
[৮ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোকে নির্মূল করা গেলেও মানুষ বুড়ো হয়ে মারা যাবে