গুটেনবার্গ—যেভাবে তিনি পৃথিবীকে ধনবান করেছিলেন!
গুটেনবার্গ—যেভাবে তিনি পৃথিবীকে ধনবান করেছিলেন!
জার্মানির সচেতন থাক! সংবাদদাতা কর্তৃক
গত হাজার বছরে উদ্ভাবিত কোন্ জিনিসটা আপনার জীবনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে? টেলিফোন, টেলিভিশন বা মোটর গাড়ি? হয়তো এগুলোর কোনটাই নয়। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, যেটা প্রভাবিত করেছিল তা হল যন্ত্রচালিত ছাপা কাজের উদ্ভাবন। এই কাজে প্রথম ব্যবহারিক পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য যে ব্যক্তি কৃতিত্ব পান তিনি হলেন জোহান্স জেন্সফ্লিশ্ জুর ল্যাডেন, যিনি জোহান্স গুটেনবার্গ নামে বেশি পরিচিত। তিনি খুব অভিজাত পরিবার থেকে এসেছিলেন আর তাই শিক্ষা গ্রহণের জন্য তাকে একনাগাড়ে কোন শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি হতে হয়নি।
গুটেনবার্গের উদ্ভাবনকে “সভ্যতার প্রতি জার্মানির এক বড় অবদান” বলে বর্ণনা করা হয়। তার সেরা শিল্পকর্ম ৪২ লাইনের গুটেনবার্গ বাইবেল যে আজও আছে, তা সত্যিই এক বিরাট ব্যাপার।
গোল্ডেন মাইন্জ
মাইন্জ শহরে ১৩৯৭ সালে অথবা প্রায় সেই বছরে গুটেনবার্গের জন্ম হয়েছিল। মাইন্জ শহরটা রাইন নদীর ধারে অবস্থিত ও সেই সময় সেখানে প্রায় ৬,০০০ লোক বাস করত। এই শহরকে গোল্ডেন মাইন্জ বলা হতো তার কারণ শহরগুলোর এক শক্তিশালী সংঘ এখানে ছিল। মাইন্জ শহরের আর্চবিশপরা পবিত্র রোম সাম্রাজ্যের নির্বাচক মণ্ডলীর মধ্যে ছিলেন। মাইন্জ শহর স্বর্ণকারদের জন্য সুপরিচিত ছিল। যুবক জোহান্স ধাতুর শিল্পকর্মের কাজে পারদর্শী ছিলেন, যার মধ্যে ধাতুর ওপর অক্ষরগুলোর উলটো ছবি কীভাবে তৈরি করা যায়, তা-ও ছিল। রাজনৈতিক ঝুটঝামেলাতে জড়িয়ে পড়ায় তিনি স্ট্র্যাসবার্গে কয়েক বছর জেল খেটেছিলেন, যেখানে তিনি রত্ন কাটার কাজ করতেন এবং শেখাতেন। কিন্তু যে কাজে তিনি সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন তা হল, একটা নতুন উদ্ভাবনের জন্য গোপনে করা তার কাজ। গুটেনবার্গ যন্ত্রচালিত ছাপানোর কৌশলকে আরও কার্যকর করার চেষ্টা করেছিলেন।
গুটেনবার্গের প্রতিভা ও ফাস্টের জোগানো পয়সা
গুটেনবার্গ মাইন্জে ফিরে এসেছিলেন ও তার গবেষণাকে চালিয়ে গিয়েছিলেন। টাকাপয়সার জন্য তিনি জোহান ফাস্টের সাহায্য নেন, যিনি তাকে ১,৬০০ গুলডেন ধার দিয়েছিলেন। সেই সময়ে এই পরিমাণটা খুবই রাজকীয় ব্যাপার ছিল কারণ একজন দক্ষ কারিগর এক বছরে মাত্র ৩০ গুলডেন আয় করত। ফাস্ট একজন চতুর ব্যবসায়ী ছিলেন, যিনি এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাভ দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু, গুটেনবার্গ কোন্ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার চিন্তা করছিলেন?
গুটেনবার্গ তার তীক্ষ্ণ বোধশক্তির দ্বারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, কিছু কিছু জিনিস প্রচুর সংখ্যায় উৎপাদন করা হতো আর সেগুলো প্রতিটা একইরকম। উদাহরণ হিসেবে ধাতু দিয়ে প্রচুর পরিমাণে মুদ্রা ও ধাতুতে ঢালাই করা বুলেটগুলো তৈরি করা হতো। তাহলে কেন একইরকম হাজার হাজার পৃষ্ঠা ছাপানো ও পরে সেগুলোকে নম্বর অনুসারে সাজিয়ে একইরকম বই বানানো যেতে পারে না? কোন্ বইগুলো? তিনি বাইবেলের কথা ভেবেছিলেন যে বইটা এত দামি যে মাত্র বিশেষ কিছু ব্যক্তিদের কাছে ব্যক্তিগত কপি ছিল। গুটেনবার্গ একইরকমের বাইবেল প্রচুর সংখ্যায় ছাপাতে চেয়েছিলেন এবং এগুলো যাতে হাতে লেখা কপিগুলোর চেয়ে সস্তায় পাওয়া যায় ও সেইসঙ্গে এর সৌন্দর্য বজায় থাকে, সেই দিকে লক্ষ্য রেখেছিলেন। কীভাবে এটা করা যায়?
বেশির ভাগ বই-ই হাতে লিখে কপি করা হতো এবং এর জন্য পরিশ্রম ও সময়ের দরকার ছিল। হাতে খোদাই করা কাঠের ছাঁচের মাধ্যমে ছাপানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, যেগুলোর প্রত্যেকটার মধ্যে একটা করে লিখিত পৃষ্ঠা ছিল। বি শিন নামে একজন চাইনিজ ব্যক্তি ছাপানোর কাজে ব্যবহার করার জন্য এমনকি মাটি দিয়ে অক্ষর তৈরি করেছিলেন। কোরিয়াতে তামার তৈরি অক্ষরগুলো এক সরকারি ছাপাখানায় ব্যবহার করা হতো। কিন্তু চলমান মুদ্রাক্ষরের সাহায্যে ছাপাতে প্রচুর সংখ্যক অক্ষরের প্রয়োজন কারণ প্রত্যেকটা অক্ষর তৈরি করতে হয়, যেগুলোকে প্রত্যেকটা নতুন পৃষ্ঠায় পুনরায় গুছানো যেতে পারে আর কেউই এগুলো তৈরি করার পন্থা আবিষ্কার করেননি। এই কাজটা কেবল গুটেনবার্গের জন্যই ছিল।
একজন দক্ষ ধাতুকর্মকার হিসেবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মাটি বা কাঠ দিয়ে নয় কিন্তু ধাতু দিয়ে তৈরি চলমান অক্ষরগুলোর সাহায্যেই ভাল ছাপানো বিষয়বস্তু পাওয়া যেতে পারে। সেগুলো উনুনে রেখে খোদাই করা বা সেঁকা হয় না কিন্তু ছাঁচে ঢালাই করা হয়। তার বর্ণমালার সমস্ত ২৬টা অক্ষর, যার মধ্যে রয়েছে ছোট ও বড় অক্ষর, সেইসঙ্গে যুক্ত অক্ষর, বিরাম চিহ্ন, অন্যান্য চিহ্ন ও বিভিন্ন সংখ্যা ঢালাই করার জন্য গুটেনবার্গের ছাঁচের দরকার ছিল। সব মিলিয়ে তিনি গুণে দেখেছিলেন যে ২৯০টা বিভিন্ন অক্ষরের প্রয়োজন আছে, একেকটা অক্ষরের জন্য বেশ কয়েকটা করে একইরকম অক্ষরের দরকার রয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ কাজ শুরু
গুটেনবার্গ তার বইয়ের জন্য ল্যাটিন ভাষার গোথিক লিপির স্টাইলটা বেছে নিয়েছিলেন, যেটাকে সন্ন্যাসীরা বাইবেলকে কপি করার সময় ব্যবহার করতেন। ধাতুকর্মকার হিসেবে তার দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি এক ছোট্ট স্টিলের স্ট্যাম্পে প্রত্যেকটা অক্ষর ও চিহ্নগুলোর উলটো ছবি খোদাই করেছিলেন, সেটা হল স্টিলের উপর ছবিটা উঁচু-উঁচু হয়ে থাকা। (১ম ছবি) এরপর এই স্টিলের স্ট্যাম্পটাকে একটা ছোট্ট নরম ধাতু তামা অথবা পিতলের টুকরোর ওপর ছবিটার ছাপ বসানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। এর ফলে, সেই নরম ধাতু যেটাকে ম্যাট্রিক্স বলা হয় সেটার ওপর এই অক্ষরটার সোজা ছবি বসে যায়।
পরের ধাপটা হল ছাঁচ তৈরি করা, যেটা গুটেনবার্গের প্রতিভার ফলাফল ছিল। সেই ছাঁচটা ছিল একটা মানুষের হাতের মুঠির সমান এবং ওপর ও তলার দিকে খোলা। একটা অক্ষরের ম্যাট্রিক্সকে এই ছাঁচের তলায় বসানো হয় এবং ওপর থেকে গলানো ধাতু ঢেলে দেওয়া হয়। (২য় ছবি) টিন, লোহা, আ্যন্টিমনি ও বিসমাত ধাতু সংকর খুব তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হয় ও শক্ত হয়ে যায়।
ছাঁচের মধ্যে থেকে বের করা সংকর ধাতুর এক দিকে অক্ষরের উলটো ছবি বসে যেত ও এটাকে টাইপ বলা হয়। সেই অক্ষরের যতগুলো টাইপ দরকার সেগুলো পাওয়া না পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াকে বারবার করা হয়। এরপর সেই ম্যাট্রিক্সকে ছাঁচ থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং পরের অক্ষরের ম্যাট্রিক্সকে সেই জায়গায় বসানো হয়। এভাবে প্রত্যেকটা অক্ষর ও চিহ্নগুলোর অনেককটা টাইপ খুব কম সময়ে তৈরি করা যেতে পারে। প্রত্যেকটা টাইপের একই উচ্চতা ছিল, ঠিক গুটেনবার্গ যেমনটা চেয়েছিলেন।
এবার ছাপা কাজ শুরু হতে পারে। গুটেনবার্গের বাইবেলের যে অংশটা কপি করার ইচ্ছা ছিল সেটাকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন। সেটিং স্টিক হাতে নিয়ে শব্দের বানান করার জন্য তিনি টাইপ ব্যবহার করেন এবং এভাবে শব্দগুলো দিয়ে অনেকগুলো লাইন বানান। (৩য় ছবি) প্রত্যেকটা লাইনকে ঠিকঠিক সাজানো হয়, যার মানে সবকটা যেন একই দৈর্ঘ্যের থাকে। একটা গ্যালি ব্যবহার করে তিনি লাইনগুলোকে পাঠ্যাংশের একটা কলামে সাজান, একটা পৃষ্ঠায় দুটো কলাম। (৪র্থ ছবি)
পাঠ্যাংশের এই পৃষ্ঠাকে একটা ছাপানোর যন্ত্রের সমতল জায়গায় আটকানো হয় এবং এরপর কালো কালি দিয়ে ভেজানো হয়। (৫ম ছবি) মদ তৈরি করার জন্য যেমন যন্ত্র ব্যবহার করা হয় একইভাবে ছাপানোর যন্ত্র টাইপ থেকে কাগজের ওপর কালি ঢেলে দেয়। এর ফলে ছাপানো পৃষ্ঠা বের হয়ে আসে। অনেক কালি ও কাগজ ব্যবহার করা হয় এবং প্রয়োজন মতো কপিগুলো না পাওয়া পর্যন্ত এই প্রণালীটা বারবার করা হয়। যেহেতু এটা ছিল চলমান টাইপ, তাই আরেকটা পৃষ্ঠা এটাতে সাজানোর জন্য আবার ব্যবহার করা যেত।
সেরা ছাপাযন্ত্র
গুটেনবার্গের ছাপাখানায় ১৫ থেকে ২০ জন লোক চাকরি করত এবং ১৪৫৫ সালে প্রথম ছাপানো বাইবেল বের করা হয়েছিল। প্রায় ১৮০টা কপি ছাপানো হয়েছিল। প্রত্যেকটা বাইবেলে ১,২৮২টা পৃষ্ঠা ছিল, একেক পৃষ্ঠায় দুটো কলামে ৪২টা করে লাইন ছিল। প্রত্যেকটা বাইবেলের দুটো করে খণ্ড ছিল আর এগুলোর বাঁধানোর কাজ এবং শিরোনামগুলোতে ও প্রত্যেকটা অধ্যায়ের প্রথম অক্ষরে হাতে অলঙ্কৃত চিত্রগুলো গুটেনবার্গের ছাপাখানায় করা হতো না কিন্তু পরে বাইরে করানো হতো।
আমরা কি ভাবতে পারি যে বাইবেল ছাপানোর জন্য কতগুলো টাইপের প্রয়োজন হয়েছিল? প্রত্যেকটা পৃষ্ঠায় ২৬০০টা অক্ষর ছিল। ধরা যাক, গুটেনবার্গের ছজন টাইপসেট্টার ছিল আর প্রত্যেকে যদি একবারে তিনটে করে পৃষ্ঠার ওপর কাজ করত, তাহলে তাদের প্রায় ৪৬,০০০ টাইপের প্রয়োজন হয়েছিল। আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি যে চলমান মুদ্রাক্ষরের সাহায্যে ছাপানো একমাত্র গুটেনবার্গের ছাঁচের জন্যই সম্ভব হয়েছিল।
বাইবেলগুলোকে মিলিয়ে দেখে লোকেরা খুব আশ্চর্য হয়েছিল কারণ প্রত্যেকটা শব্দ একই জায়গায় ছিল। হাতে লেখা হলে সেটা সম্ভব হতো না। গুনটার এস. ভ্যাগনের লেখেন যে ৪২ লাইনের বাইবেলের মধ্যে “এতটাই একতা ও সামঞ্জস্য, সংগতি ও সৌন্দর্য ছিল যে বছরের পর বছর ধরে মুদ্রাকররা এই সেরা যন্ত্রটা দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল।”
টাকাপয়সার ক্ষতি
কিন্তু, ফাস্ট সেরা যন্ত্র বানানোর চেয়ে পয়সা কামানোর ধান্দায় বেশি আগ্রহী ছিলেন। তিনি এই কাজের জন্য যতটা পয়সা ঢেলেছিলেন সেটা ফিরে পেতে যতটা সময় আশা করা হয়েছিল তার চেয়ে বেশি সময় লাগছিল। অংশীদাররা আলাদা হয়ে যান আর ১৪৫৫ সালে বাইবেলগুলো ছাপানো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফাস্ট সেগুলোকে দখল করে নেন। গুটেনবার্গ সেই ধার নেওয়া টাকা শোধ করতে পারছিলেন না আর তাই আদালতের মামলায় হেরে গিয়েছিলেন। আর এই কারণে তিনি তার ছাপানোর কিছু যন্ত্রপাতি ও বাইবেলের জন্য ব্যবহৃত টাইপগুলো ফাস্টকে দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। গুটেনবার্গের
একজন দক্ষ কর্মচারী পিটার শোফারকে নিয়ে ফাস্ট নিজে একটা ছাপাখানা খুলেছিলেন। ফাস্ট ও শোফার নামে তাদের এই ব্যাবসা সেই সুনাম অর্জন করেছিল, যা কিনা আসলে গুটেনবার্গের পাওয়া উচিত ছিল এবং বাণিজ্যিক দিক দিয়ে বিশ্বের প্রথম সফলতম ছাপাখানা হয়েছিল।গুটেনবার্গ আরেকটা ছাপাখানা স্থাপন করে তার কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিছু পণ্ডিত ব্যক্তিরা ১৫ শতাব্দীর কিছু ছাপানো বিষয়বস্তুর জন্য তাকে কৃতিত্ব দেন। কিন্তু কোন কিছুই ওই ৪২ লাইনের বাইবেলের মতো এতটা মর্যাদা ও মহত্ত্ব অর্জন করতে পারেনি। ১৪৬২ সালে আবারও এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। ক্যাথলিক পুরোহিতবর্গের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ের কারণে মাইন্জ শহরকে পুড়িয়ে ফেলা ও লুট করা হয়েছিল। এই নিয়ে গুটেনবার্গ দুবার তার ছাপাখানা হারিয়েছিলেন। এর ছবছর পর, ১৪৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি মারা গিয়েছিলেন।
গুটেনবার্গের উত্তরাধিকার
গুটেনবার্গের উদ্ভাবনের কথা খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৫০০ সালের মধ্যে জার্মানির ৬০টা শহরে ও ইউরোপের ১২টা দেশে ছাপাখানা দেখা গিয়েছিল। দ্যা নিউ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলে, ‘ছাপা কাজে উন্নতি হওয়ায় ভাববিনিময়ের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছিল। পরবর্তী ৫০০ বছরে ছাপানোর পদ্ধতিতে অনেক উন্নতি করা হয়েছে কিন্তু মূল পদ্ধতি একই রয়েছে।’
ছাপার কাজ ইউরোপীয় লোকেদের জীবনকে পালটে দিয়েছিল, এর কারণ সেই সময় থেকে শুধু শিক্ষিত লোকেদের মধ্যেই জ্ঞান সীমাবদ্ধ থাকেনি। সাধারণ লোকেদের কাছে খবরাখবর পৌঁছাতে শুরু করেছিল, যারা তাদের আশেপাশে কী হচ্ছে সেটা সম্বন্ধে আরও বেশি জানতে পারছিল। ছাপার কাজের জন্য প্রত্যেকটা জাতীয় ভাষাকে একটা আদর্শ লেখ্য রূপ দেওয়ার দরকার হয়ে পড়েছিল, যা কিনা সবাই বুঝতে পারবে। এইজন্য ইংরেজি, জার্মান ও ফরাসি ভাষাগুলোর জন্য এক আদর্শ নির্ধারণ করা হয়েছিল ও সেগুলোকে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। পড়ার বিষয়বস্তুর জন্য চাহিদা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেয়েছিল। গুটেনবার্গের আগের সময়গুলোতে ইউরোপে শুধু কয়েক হাজার পাণ্ডুলিপি ছিল; তার মৃত্যুর ৫০ বছর পর লক্ষ লক্ষ বই পাওয়া গিয়েছিল।
যন্ত্রচালিত কাজের উদ্ভাবন না হলে ১৬শ শতাব্দীর ধর্মসংস্কার কখনোই শুরু হতে পারত না। ইংরেজি, ইতালি, চেক, জার্মান, ডাচ, পোলিশ, ফরাসি ও রাশিয়ান ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করা হয়েছিল এবং ছাপাখানা এগুলোর হাজার হাজার কপি প্রকাশ করাকে সহজ করে দিয়েছিল। মার্টিন লুথার তার বার্তা প্রচার করার জন্য ছাপাখানার পুরো সুবিধাটা নিয়েছিলেন। তিনি তার চেষ্টায় সফল হয়েছিলেন কিন্তু গুটেনবার্গের ছাপাখানা স্থাপিত হওয়ার আগে যারা বেঁচেছিলেন তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাই আশ্চর্যের কিছু নয় যে, “সারা বিশ্বে সত্য ধর্ম ছড়ানোর উদ্দেশ্যে” ছাপাখানাকে লুথার ঈশ্বরের ব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেছিলেন!
গুটেনবার্গ বাইবেলের যে কপিগুলো এখনও রয়েছে
কটা গুটেনবার্গ বাইবেল এখনও রয়েছে? কয়েক বছর আগে পর্যন্ত মনে করা হতো যে, ৪৮টা বাইবেল রয়েছে—সেগুলোর কয়েকটা অসম্পূর্ণ—যেগুলো ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে চমৎকার কপিগুলোর একটা হল চামড়ায় লেখা বাইবেল আর সেটা ওয়াশিংটন, ডি.সি-র লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস-এ আছে। এরপর ১৯৯৬ সালে এক রোমাঞ্চকর আবিষ্কার করা হয়েছিল: জার্মানির রেন্ডসবার্গের গির্জার দলিলপত্রের সংরক্ষণাগারে গুটেনবার্গ বাইবেলের আরও কিছু অংশ আবিষ্কার করা হয়েছিল।—১৯৯৮ সালের ২২শে জানুয়ারির সচেতন থাক! (ইংরেজি) পত্রিকার ২৯ পৃষ্ঠা দেখুন।
আমাদের কতই না কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত যে, আজ যে কেউই বাইবেল পেতে পারেন! অবশ্য, এর মানে এই নয় যে আমরা যখন-তখন একটা ৪২ লাইনের গুটেনবার্গ বাইবেল কিনতে পারি! এগুলোর একটার কত দাম? ১৯৭৮ সালে মাইন্জ শহরে গুটেনবার্গ জাদুঘর এটার একটা কপি সংগ্রহ করেছিল ও সেটার দাম ছিল ৩৭ লক্ষ ডোইস মার্ক (আজ যেটা প্রায় ২ লক্ষ ডলার)। আজ এই বাইবেলের দাম এর চেয়েও অনেক অনেক বেশি।
গুটেনবার্গ বাইবেল কেন এত অদ্বিতীয়? গুটেনবার্গ জাদুঘরের প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক হেলমুট প্রেসার তিনটে কারণ দেখান। প্রথমত, গুটেনবার্গ বাইবেল হল পাশ্চাত্য জগতে চলমান মুদ্রাক্ষরের মাধ্যমে ছাপানো প্রথম বই। দ্বিতীয়ত, প্রথম ছাপানো বাইবেল। তৃতীয়ত, এটা অতি সুন্দর ছিল। অধ্যাপক প্রেসার লেখেন যে গুটেনবার্গ বাইবেলে “গোথিক লিখনকে এর সেরা অবস্থায়” দেখা যায়।
সব সংস্কৃতির লোকেরা গুটেনবার্গের প্রতিভার কাছে ঋণী। তিনি একসঙ্গে ঢালাই ছাঁচ, ধাতু, কালি ও ছাপাখানাকে ব্যবহার করেছিলেন। যন্ত্রচালিত ছাপার কাজ তিনিই শুরু করেছিলেন এবং বিশ্বকে ধনবান করেছিলেন।(g৯৮ ১১/৮)
[১৬, ১৭ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
১. তামার ম্যাট্রিক্সের ওপর অক্ষরের ছবিটা বসাতে একটা স্টিলের স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হতো
২. গলানো ধাতু সংকর ছাঁচের ওপর ঢালা হতো। একবার ধাতুটা শক্ত হয়ে গেলে যে টাইপ ওটা থেকে বের করা হতো সেটাতে এক উলটো ছবি বসে যেত
৩. শব্দগুলোকে বানান করে লেখার জন্য সেটিং স্টিকে টাইপকে বসানো হতো, যেগুলো দিয়ে পাঠ্যাংশের একটা লাইন তৈরি করা হতো
৪. একটা গ্যালিতে লাইনগুলোকে কলামে সাজানো হতো
৫. পাঠ্যাংশের পৃষ্ঠাকে ছাপাযন্ত্রের সমতল জায়গায় রাখা হতো
৬. তামার চাকতিতে গুটেনবার্গের খোদাই করা ছবি যেটা ১৫৮৪ সালের
৭. আজকে গুটেনবার্গ বাইবেলের একটা কপির দাম লক্ষ লক্ষ ডলার
[সৌজন্যে]
ছবি ১-৪, ৬ ও ৭: Gutenberg-Museum Mainz; ছবি ৫: Courtesy American Bible Society