অপরাধবোধ—তা কি সবসময়ই খারাপ?
বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গি
অপরাধবোধ—তা কি সবসময়ই খারাপ?
আজকে অনেকেই অপরাধবোধকে অবাঞ্ছিত বলে মনে করে। তারা জার্মান দার্শনিক ফ্রিডরিখ নিচির মতো মনে করেন, যিনি বলেছিলেন: “অপরাধবোধ হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন রোগ, যা মানুষের মধ্যে সবসময় প্রবলভাবে রয়েছে।”
কিন্তু, কিছু গবেষক এখন এক ভিন্ন উপসংহারে এসেছেন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পিএইচডি ডিগ্রিধারি চিকিৎসক এবং গ্রন্থকার সুজান ফরওয়ার্ড বলেন, “একজন অনুভূতিশীল এবং আস্থাবান ব্যক্তি হওয়ার জন্য অপরাধবোধ হল এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা হল বিবেকের একটা অংশ।” তা হলে সমস্ত অপরাধবোধই কি খারাপ? এমন কোন পরিস্থিতি কি আছে, যেখানে অপরাধবোধ হয়তো সাহায্যকারী হতে পারে?
অপরাধ কী?
আমরা যখন বুঝতে পারি যে, আমরা এমন কাউকে আঘাত দিয়েছি যার সম্বন্ধে আমরা চিন্তা করি বা যে-মান অনুযায়ী আমাদের চলা উচিত বলে মনে করি, সেইমতো চলতে পারিনি তখন অপরাধবোধ দেখা দেয়। একটা বই যেমন বলে, অপরাধ বলতে বোঝায় “ব্যর্থতা, খারাপ কাজ, অন্যায় বা পাপের কারণে একজন অপরাধীর ঋণী মনোভাব।”
ইব্রীয় শাস্ত্রে ইস্রায়েলীয়রা যখন ঈশ্বরের আইন অনুযায়ী জীবনযাপন করত না তখন অপরাধ হতো—বাইবেলের লেবীয় পুস্তক এবং গণনাপুস্তকে এই সম্বন্ধে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রিক শাস্ত্রে অপরাধের ধারণা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে গুরুতর পাপ করার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।—মার্ক ৩:২৯; ১ করিন্থীয় ১১:২৭.
দুঃখজনক যে, আমরা হয়তো কোন অপরাধ না করেও নিজেকে অপরাধী বলে মনে করি। যেমন, একজন ব্যক্তি যদি সবকিছুতে নিখুঁত হওয়ার ইচ্ছা রাখেন এবং নিজের জন্য অযৌক্তিক মান নির্ধারণ করার প্রবণতা তার থাকে, তা হলে প্রতিবারই তিনি হতাশ হয়ে হয়তো অযথা অপরাধবোধ করবেন। (উপদেশক ৭:১৬) অথবা আমরা হয়তো কোন ভুল বা অন্যায়ের জন্য উপযুক্ত অনুশোচনা করে লজ্জার এই অনুভূতিকে আরও তীব্র করতে পারি এবং এভাবে অযথা নিজেদেরকে শাস্তি দিই। তা হলে অপরাধবোধ কোন্ উপকারজনক কাজ করতে পারে?
অপরাধবোধ ভাল হতে পারে
অপরাধবোধ কমপক্ষে তিনটে উপায়ে ভাল হতে পারে। প্রথমত, এটা আমাদেরকে সংকেত দেয় যে আমরা সঠিক মান সম্বন্ধে সচেতন। এটা দেখায় যে, আমাদের কার্যকারী বিবেক রয়েছে। (রোমীয় ২:১৫) আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন একটা বই প্রকাশ করেছে, যেখানে অপরাধবোধ না থাকার বিষয়টাকে সামাজিক দিক দিয়ে এক ভয়ংকর আচরণ বলা হয়েছে। কলুষিত এবং মৃত বিবেকসম্পন্ন লোকেরা ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝতে পারে না আর এটা অনেক বিপদজনক হতে পারে।—তীত ১:১৫, ১৬.
দ্বিতীয়ত, অপরাধী বিবেক আমাদেরকে অবাঞ্ছিত কাজগুলো এড়িয়ে চলতে সাহায্য করতে পারে। শারীরিক কষ্ট যেমন আমাদেরকে কোন স্বাস্থ্যগত সমস্যা সম্বন্ধে সচেতন করে দেয়, তেমনই মানসিক কষ্ট ও সেইসঙ্গে অপরাধবোধ আমাদেরকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সমস্যা সম্বন্ধে সতর্ক করে দেয়, যেগুলোর প্রতি আমাদের মনোযোগ দেওয়া দরকার। একবার যদি আমরা আমাদের দুর্বলতা সম্বন্ধে জানতে পারি, তা হলে ভবিষ্যতে আমরা নিজেদেরকে, প্রিয়জনকে বা অন্যদেরকে কষ্ট দেওয়া এড়িয়ে চলতে পারব।—মথি ৭:১২.
সবশেষে অপরাধ স্বীকার করা, যে-ব্যক্তি অপরাধ করেছে এবং যার প্রতি করা হয়েছে, উভয়কেই সাহায্য করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে, রাজা দায়ূদের অপরাধবোধ থাকার সঙ্গে প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা ছিল। তিনি লিখেছিলেন, “আমি যখন চুপ করিয়াছিলাম, আমার অস্থি সকল ক্ষয় পাইতেছিল, কারণ আমি সমস্ত দিন আর্ত্তনাদ করিতেছিলাম।” কিন্তু, অবশেষে দায়ূদ যখন ঈশ্বরের কাছে তার পাপ স্বীকার করেছিলেন, তখন তিনি আনন্দের সঙ্গে গেয়েছিলেন: “রক্ষাগীত দ্বারা আমাকে বেষ্টন করিবে।” (গীতসংহিতা ৩২:৩, ৭) অপরাধ স্বীকার করলে এমনকি যে-ব্যক্তি এর শিকার হয়েছেন তারও ভাল লাগবে কারণ অপরাধ স্বীকার করা সেই ব্যক্তিকে আশ্বাস দেয় যে, ওই ব্যক্তি তাকে এতটা ভালবাসেন যে কষ্ট দেওয়ায় তিনি নিজেও ততটা দুঃখ পেয়েছেন।—২ শমূয়েল ১১:২-১৫.
অপরাধবোধের প্রতি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি
অপরাধের প্রতি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রাখার জন্য পাপী এবং পাপের বিষয়ে যীশু ও ফরীশীদের মধ্যে যে সম্পূর্ণ বিপরীত মনোভাব ছিল, তা লক্ষ্য করুন। লূক ৭:৩৬-৫০ পদে আমরা এক দুশ্চরিত্রা মহিলা সম্বন্ধে পড়ি, যিনি এক ফরীশীর বাড়িতে ঢুকেছিলেন, যেখানে যীশু খাবারের টেবিলে ছিলেন। সেই মহিলা যীশুর কাছে এসে তার চোখের জল দিয়ে পা ধুয়ে অনেক দামি সুগন্ধি তেল ঢেলে দেন।
ওই মহিলাকে কপট ফরীশী তার সম্মান এবং মনোযোগ পাওয়ার অযোগ্য দেখিয়ে তাকে অবজ্ঞা করেছিল। সে মনে মনে বলতে লাগল: “এ [যীশু] যদি ভাববাদী হইত, তবে জানিতে পারিত, ইহাকে যে স্পর্শ করিতেছে, সে কে এবং কি প্রকার স্ত্রীলোক কারণ সে পাপীষ্ঠা।” (লূক ৭:৩৯) যীশু সঙ্গে সঙ্গে তার মনোভাবকে সংশোধন করে দেন। যীশু বলেছিলেন, “তুমি তৈল দিয়া আমার মস্তক অভিষিক্ত করিলে না, কিন্তু এ সুগন্ধি দ্রব্যে আমার চরণ অভিষিক্ত করিয়াছে। এই জন্য, তোমাকে কহিতেছি, ইহার যে বহু পাপ, তাহার ক্ষমা হইয়াছে; কেননা এ অধিক প্রেম করিল।” কোন সন্দেহ নেই যে, এইধরনের কথা সেই মহিলাকে উৎসাহ দিয়েছিল এবং তার হৃদয়কে হালকা করেছিল।—লূক ৭:৪৬, ৪৭.
কিন্তু, যীশু কোনভাবেই অনৈতিকতাকে প্রশয় দেননি। বরং তিনি সেই গর্বিত ফরীশীকে প্রেমের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে শিখিয়েছিলেন, যা ঈশ্বরকে সেবা করার জন্য প্রেরণা দেয়। (মথি ২২:৩৬-৪০) অবশ্য এটা উপযুক্ত যে, সেই মহিলার অতীতের অনৈতিক কাজের জন্য অপরাধবোধ হয়েছিল। স্পষ্টতই, তিনি অনুতপ্ত হয়েছিলেন কারণ তিনি কেঁদেছিলেন, তার অতীতের কাজের জন্য কোন অজুহাত দেখানোর চেষ্টা করেননি এবং সবার সামনে যীশুকে সম্মান করার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এটা দেখে যীশু বলেছিলেন: “তোমার বিশ্বাস তোমাকে পরিত্রাণ করিয়াছে; শান্তিতে প্রস্থান কর।”—লূক ৭:৫০.
অন্যদিকে, ফরীশী সেই মহিলাকে পাপী হিসেবে অবজ্ঞার চোখে দেখতেই থাকে। সম্ভবত সে তার মধ্যে ‘ঈশ্বরভীতি ঢোকাতে’ চেয়েছিল এবং তাকে অপরাধী মনে করাতে চেয়েছিল। কিন্তু, আমরা যেভাবে চাই সেভাবে না করলে আমরা যদি সবসময় অন্যদেরকে অপরাধী মনে করাতে চাই, তা হলে তা প্রেমপূর্ণ নয় এবং পরে তা খারাপ ফল নিয়ে আসে। (২ করিন্থীয় ৯:৭) সবচেয়ে ভাল ফল আসে যীশুকে অনুকরণ করার মাধ্যমে—সঠিক উদাহরণ স্থাপন করে, অন্যদেরকে মন থেকে প্রশংসা করে এবং তাদের ওপর আস্থা প্রকাশ করে, এক্ষেত্রে যদিও কখনও কখনও সংশোধন করে দেওয়ার এবং পরামর্শ দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।—মথি ১১:২৮-৩০; রোমীয় ১২:১০; ইফিষীয় ৪:২৯.
তা হলে, আমরা যখন কোন ভুল করি, তখন অপরাধবোধ ভাল হতে পারে এমনকি এর দরকারও রয়েছে। হিতোপদেশ ১৪:৯ পদ বলে: “অজ্ঞানেরা দোষকে উপহাস করে।” এক অপরাধী বিবেক আমাদেরকে অপরাধ স্বীকার করতে এবং অন্যান্য ইতিবাচক কাজ করতে প্রেরণা দিতে পারে এবং দেওয়া উচিত। কিন্তু, সবসময় যিহোবাকে সেবা করার জন্য প্রেমই আমাদের মূল কারণ হওয়া উচিত, অপরাধ নয়। (ইয়োব ১:৯-১১; ২:৪, ৫) বাইবেল আমাদেরকে আশ্বাস দেয় যে, যখন ভাল লোকেরা উৎসাহ পায় এবং এর মাধ্যমে মনের দিক দিয়ে সতেজ হয়, তখন তারা যথাসাধ্য করে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, তা করে তারা আনন্দ পায়।(g০২ ৩/৮)