সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আমি আমার অজাত শিশুকে হারিয়েছি

আমি আমার অজাত শিশুকে হারিয়েছি

আমি আমার অজাত শিশুকে হারিয়েছি

দুহাজার সালের ১০ই এপ্রিল, সোমবার ছিল রোদ ঝলমলে উষ্ণ দিন, তাই টুকিটাকি কাজ করার জন্য আমি বাইরে বেরোই। আমি তখন সবে চার-পাঁচ মাসের গর্ভবতী আর যদিও ততটা সুস্থসবল ছিলাম না কিন্তু একটু বাইরে যেতে পারায় আমার বেশ ভাল লাগছিল। মুদির দোকানে মোট কত টাকা দিতে হবে তা জানার জন্য আমি যখন লাইনে অপেক্ষা করছিলাম, তখন আমি টের পাই যে, আমার কোন সমস্যা হচ্ছিল।

বাড়িতে ফিরে আমি বুঝতে পারি যে, যা ভয় করছিলাম ঠিক তা-ই হয়েছে। আমার রক্তস্রাব হচ্ছিল—আমার আগের দুই বাচ্চা যখন পেটে ছিল, তখন এমনটা হয়নি আর এতে আমি খুব ঘাবড়ে যাই! আমি ডাক্তারের কাছে ফোন করি কিন্তু তিনি আমাকে আরেকদিন অপেক্ষা করতে বলেন কারণ এমনিতেও আমার পরদিন তার কাছে যাওয়ার তারিখ ছিল। আমার স্বামী ও আমি আমাদের দুই বাচ্চাকে রাতের বেলা ঘুমাতে পাঠানোর আগে একসঙ্গে প্রার্থনা করি, যেকোনভাবেই আমাদের শক্তির দরকার হোক না কেন, যিহোবা যেন আমাদের তা দেন। শেষে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

কিন্তু, রাত প্রায় দুটোর সময় প্রচণ্ড ব্যথায় আমার ঘুম ভেঙে যায়। একসময় ব্যথা কমে আসে আর আমি যখন ঘুমিয়ে পড়ছিলাম, ঠিক তখন আবার ব্যথা ওঠে, আর এইবার নির্দিষ্ট সময় পরপর ব্যথা হতে থাকে। রক্তস্রাবও বাড়তে থাকে আর আমি বুঝতে পারি যে, আমার ভিতরটা সংকুচিত হয়ে আসছে। আমি বিভিন্ন বিষয় ভাবতে থাকি, মনে করার চেষ্টা করি যে আমি কী এমন করেছি, যেকারণে এমনটা হতে পারে কিন্তু তেমন কিছু আমার মনে পড়ে না।

ভোর পাঁচটার মধ্যে আমি বুঝতে পারি যে, আমাকে হাসপাতালে যেতেই হবে। আমার স্বামী ও আমি যখন সেখানে পৌঁছাই, তখন জরুরি বিভাগের বেশ সদয়, সাহায্যকারী এবং সহানুভূতিশীল কর্মীদের ব্যবহারে স্বস্তি বোধ করি। দুঘন্টা পর আমরা যে-বিষয়ে ভয় পাচ্ছিলাম, ডাক্তার আমাদেরকে সেই খবরটা দেন: আমি আমার শিশুকে হারিয়েছি।

আগের লক্ষণগুলো দেখে আমি এইরকম কিছুর জন্য তৈরি ছিলাম আর খবরটা শুনে অনেকটা শান্তই ছিলাম। এ ছাড়াও, আমার স্বামী সারাক্ষণ আমার সঙ্গে সঙ্গে ছিল এবং আমাকে অনেক সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু, এখন আমাদের বাচ্চা ছাড়া ঘরে ফিরে যেতে হবে, তাই আমরা ভাবছিলাম যে আমাদের দুই বাচ্চা, ছয় বছরের ক্যাটলিন ও চার বছরের ডেভিডকে কী বলব।

বাচ্চাদের আমরা কী বলব?

কোন সমস্যা হয়েছে তা জেনেই বাচ্চারা ঘুমাতে গিয়েছিল কিন্তু কীভাবে আমরা তাদের বলব যে, তাদের ভাই বা বোন মারা গেছে? আমরা সত্য কথা খুলে বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এই ক্ষেত্রে আমার মা বাচ্চাদের বলে রেখেছিলেন যে আমাদের সঙ্গে কোন বাচ্চা আসছে না। তাই আমরা যখন ঘরে আসি, তখন তারা দৌড়ে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরে এবং চুমু খায়। তাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, “বেবি কি ভাল আছে?” আমি কোন উত্তর দিতে পারছিলাম না কিন্তু আমার স্বামী আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে শক্ত করে ধরে বলেছিল, “বেবি মারা গেছে।” আমরা একে অন্যকে ধরে কেঁদেছিলাম, যা আমাদের সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল।

কিন্তু, বাচ্চাদের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার জন্য আমরা ততটা তৈরি ছিলাম না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমার গর্ভপাত হয়ে যাওয়ার প্রায় দুসপ্তা পর স্থানীয় মণ্ডলীতে একজন বয়স্ক সাক্ষির মৃত্যুর বিষয় ঘোষণা দেওয়া হয়, যিনি আমাদের পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এটা শুনে চার বছরের ডেভিড ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল আর তাকে কোনভাবেই থামানো যাচ্ছিল না, তাই আমার স্বামী তাকে কোলে করে বাইরে নিয়ে যায়। শান্ত হওয়ার পর, ডেভিড জিজ্ঞেস করে যে, তার বন্ধু কেন মারা গেলেন? এরপর সে জিজ্ঞেস করেছিল যে, বাচ্চাটা কেন মারা গেছে। এরপর তার বাবাকে সে জিজ্ঞেস করে: “তুমিও কি মারা যাবে?” এ ছাড়া সে জানতে চেয়েছিল যে, কেন যিহোবা ঈশ্বর এখনও শয়তানকে ধ্বংস ও বিষয়গুলো “মীমাংসা” করেননি। সত্যিই, তার কচি মনে কত রকমের চিন্তা ছিল, তা দেখে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

ক্যাটলিনও অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল। প্রায়ই পুতুল খেলার সময় সে এমনভাবে খেলা করত যে, তার একটা পুতুল অসুস্থ হয়ে পড়েছে আর অন্য পুতুলগুলো ছিল নার্স বা পরিবারের অন্যান্য সদস্য। সে একটা কাগজের বাক্সকে পুতুলের হাসপাতাল বানাত আর মাঝেমাঝে এমনভাবে খেলত যে, তার একটা পুতুল যেন মরে গেছে। বাচ্চাদের নানা প্রশ্ন ও খেলা আমাদের জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এবং বাইবেল কীভাবে পরীক্ষা মোকাবিলা করতে সাহায্য করে, তা শেখানোর সুযোগ করে দিয়েছিল। এ ছাড়াও, পৃথিবীকে এক সুন্দর পরমদেশ করে তোলার বিষয়ে, সবধরনের দুঃখকষ্ট, ব্যথা ও এমনকি মৃত্যু থেকে মুক্ত করার বিষয়ে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা সম্বন্ধে আমরা তাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলাম।—প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪.

এই বিচ্ছেদের সঙ্গে আমি যেভাবে মোকাবিলা করেছিলাম

হাসপাতাল থেকে ঘরে ফিরে আমি মানসিক দিক দিয়ে একেবারে অসাড় এবং অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছিলাম। আমার চারপাশে অনেক কাজ পড়ে ছিল কিন্তু আমি কোন্‌টা দিয়ে শুরু করব, তা বুঝতে পারছিলাম না। একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে, এমন কয়েকজন বান্ধবীকে আমি ফোন করি আর তারা আমাকে অনেক সান্ত্বনা দেয়। এক প্রিয় বান্ধবী আমাদের জন্য ফুল পাঠিয়েছিল আর সন্ধ্যাবেলা বাচ্চাদের তার কাছে নিয়ে রাখতে চেয়েছিল। তার প্রেমপূর্ণ চিন্তা ও বাস্তব সাহায্যের জন্য আমি খুবই কৃতজ্ঞ!

আমি পরিবারের সদস্যদের ছবিগুলো আ্যলবামে সাজিয়ে রাখি। বাচ্চার ছোট ছোট জামাগুলো, যেগুলো সে পরতে পারেনি, সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখি—আমি যে-শিশুকে হারিয়েছি, তার এই সামান্য স্মৃতিই আমার কাছে ছিল। কয়েক সপ্তা ধরে আমি মানসিক অস্থিরতার মধ্যে ছিলাম। পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে সবধরনের সমর্থন পাওয়া সত্ত্বেও, বেশ কয়েক দিন আমি আমার চোখের জল আটকে রাখতে পারিনি। মাঝেমাঝে আমার মনে হতো, আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি। বিশেষ করে আমার আশেপাশে গর্ভবতী কাউকে দেখা খুবই কঠিন বিষয় ছিল। আগে আমি ভাবতাম যে, গর্ভপাত হয়তো নারীর জীবনের এক “অস্থায়ী সমস্যা” যেটা কাটিয়ে উঠতে তেমন একটা অসুবিধা হয় না। আসলে কত বড় ভুল ধারণাই না আমার ছিল! *

ভালবাসা—সর্বোত্তম চিকিৎসা

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার স্বামী ও সহ খ্রীষ্টানদের ভালবাসা ছিল অত্যন্ত কার্যকারী এক প্রতিকার। এক সাক্ষি বোন খাবার বানিয়ে আমাদের ঘরে পাঠিয়েছিলেন। মণ্ডলীর একজন প্রাচীন ও তার স্ত্রী আমার জন্য ফুল ও সুন্দর একটা কার্ড নিয়ে এসেছিলেন ও তারা সন্ধ্যায় আমাদের ঘরে বেশ কিছুক্ষণ ছিলেন। আমরা জানতাম যে, তারা কত ব্যস্ত ছিলেন আর তাই তাদের এই চিন্তা আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। আরও অনেক বন্ধুরা কার্ড বা ফুল পাঠিয়েছিল। “আমরা তোমাদের জন্য চিন্তা করছি” এই সামান্য কথাগুলোও আমাদের জন্য বিরাট অর্থ রেখেছিল! মণ্ডলীর একজন সদস্যা লিখেছিলেন: “আমরা জীবনকে ঠিক যিহোবার মতো অর্থাৎ সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় হিসেবে দেখি। তিনি যদি জানেন যে একটা চড়ুই পাখি কখন ভূমিতে পড়ে, তা হলে তিনি নিশ্চয়ই এও জানবেন যে, একটা মানব ভ্রুণ কখন নষ্ট হয়ে যায়।” আমার মামাতো ভাইয়ের স্ত্রী লিখেছিলেন: “জন্ম ও জীবনের অলৌকিক কাজ দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই আর একটা ভ্রুণ যখন বাঁচে না, তখনও আমরা ঠিক একইরকম অবাক হই।”

কয়েক সপ্তা পর কিংডম হলে আমার খুব কান্না পাচ্ছিল আর তাই সভা শুরু হওয়ার আগেই আমি সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ি। দুজন প্রিয় বান্ধবী আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যেতে দেখে ও আমার সঙ্গে গাড়িতে গিয়ে বসে, আমার হাত ধরে ও আমাকে হাসানোর চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পর আমরা তিনজনই আবার ভিতরে যাই। “ভ্রাতা অপেক্ষাও অধিক প্রেমাসক্ত” বন্ধুদের পাওয়া কতই না আনন্দের বিষয়!—হিতোপদেশ ১৮:২৪.

যতই খবর ছড়িয়ে পড়ে আমি জেনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, কত সাক্ষি বোনদের একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এমনকি আগে আমি যাদের সঙ্গে ততটা ঘনিষ্ঠ ছিলাম না, তারাও আমাকে বিশেষ সান্ত্বনা ও উৎসাহ দিয়েছিলেন। আমার প্রয়োজনের সময় তাদের প্রেমময় সমর্থন আমাকে বাইবেলের এই কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছিল: “বন্ধু সর্ব্বসময়ে প্রেম করে, ভ্রাতা দুর্দ্দশার জন্য জন্মে।”—হিতোপদেশ ১৭:১৭.

ঈশ্বরের বাক্য থেকে সান্ত্বনা

আমার গর্ভপাত হওয়ার পরের সপ্তায়ই ছিল খ্রীষ্টের মৃত্যুর স্মরণার্থক সভা। এক সন্ধ্যায় আমরা যখন যীশুর শেষ দিনগুলোর বিষয়ে বাইবেল থেকে পড়ছিলাম, তখন আমার হঠাৎ মনে হয়েছিল: ‘হারানোর বেদনা যিহোবা বোঝেন। তিনি তো তাঁর নিজের পুত্রকেই হারিয়েছিলেন! যিহোবা হলেন আমাদের স্বর্গস্থ পিতা, আমি মাঝেমাঝে ভুলে যাই যে, তিনি আমাদের অবস্থা কতটা বোঝেন ও তাঁর দাসদের—নারী বা পুরুষদের—প্রতি তাঁর কত সহানুভূতি রয়েছে। সেই মুহূর্তে আমি অত্যন্ত স্বস্তি বোধ করি। আমি আগের চেয়ে যিহোবার আরও কাছাকাছি বোধ করেছিলাম।

এ ছাড়া, বাইবেল-ভিত্তিক প্রকাশনাগুলো থেকেও আমি অনেক উৎসাহ পেয়েছিলাম, বিশেষ করে প্রহরীদুর্গসচেতন থাক! পত্রিকার সেই সংখ্যাগুলো যেগুলো প্রিয়জনের মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সচেতন থাক! আগস্ট ৮, ১৯৮৭ (ইংরেজি) এর “সন্তানের মৃত্যুকে মোকাবিলা করা”-র ওপর প্রবন্ধটা ও সেইসঙ্গে আপনার প্রিয়জন যখন মারা যায় * (ইংরেজি) ব্রোশারটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।

শোক শেষ

সময় পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝতে পারি যে আমি সুস্থ হয়ে উঠছি, যখন আমি নিজেকে আর দোষী মনে করতাম না এবং কথায় কথায় আমার বাচ্চার মৃত্যুর কথা বলতাম না। কিন্তু মাঝেমাঝে আমার মনের মধ্যে তোলপাড় হতো, যখন দেখতাম যে, আমার বন্ধুরা আমার গর্ভপাতের বিষয়টা শোনেনি বা কিংডম হলে কেউ নবজাত শিশুকে নিয়ে এসেছে।

এরপর একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার মনে হয়, শেষ পর্যন্ত আকাশের মেঘটুকু কেটে গেছে। এমনকি চোখ খোলারও আগেই আমি সুস্থ বোধ করি—এমন এক প্রশান্তি ও স্বস্তি বোধ করি, যা গত কয়েক মাস ধরে আমি অনুভব করিনি। তবুও, প্রায় এক বছর পর আমি যখন আবার গর্ভবতী হই, তখন আবারও গর্ভপাত হয়ে যায় কি না সেই আশংকা আমার মনে দেখা দেয়। আনন্দের বিষয় যে, ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে আমি এক সুস্থ বাচ্চার জন্ম দিয়েছি।

যে-শিশুকে হারিয়েছি, তার জন্য এখনও আমার কষ্ট লাগে। কিন্তু, এই পুরো ঘটনা আমার জীবন, পরিবার, সহ খ্রীষ্টান এবং ঈশ্বরের—যিনি আমাদের সান্ত্বনা দেন—প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া, এই ঘটনা এই করুণ সত্যকে তুলে ধরেছে যে, ঈশ্বর আমাদের সন্তানদের নিয়ে যান না কিন্তু “[আমাদের] সকলের প্রতি কাল ও দৈব ঘটে।”—উপদেশক ৯:১১.

সেই দিনের জন্য আমি কত আকুল আকাঙ্ক্ষা করে আছি যেদিন ঈশ্বর সমস্ত শোক, কান্না, ব্যথা ও সেইসঙ্গে গর্ভপাত ঘটার শারীরিক ও মানসিক ব্যথাকে নির্মূল করবেন! (যিশাইয় ৬৫:১৭-২৩) এরপর সমস্ত বাধ্য মানুষ বলতে পারবে: “মৃত্যু তোমার জয় কোথায়? মৃত্যু তোমার হুল কোথায়?”—১ করিন্থীয় ১৫:৫৫; যিশাইয় ২৫:৮.—নিবেদিত।(g০২ ৩/২২)

[পাদটীকাগুলো]

^ গবেষণা দেখায় যে, গর্ভপাতের প্রতি একেক জন একেক রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়। কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়ে যায়, অন্যেরা হতাশ হয়ে পড়ে আর অনেকে আবার শোকে পাথর হয়ে যায়। মর্মান্তিক বিচ্ছেদ, যেমন গর্ভপাতের কারণে দুঃখ প্রকাশ করা স্বাভাবিক কিন্তু এটা সুস্থ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ারও এক অংশ।

^ যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত।

[২১ পৃষ্ঠার বাক্স]

গর্ভপাত ঘটার সংখ্যা ও কারণ

দ্যা ওয়ার্ল্ড বুক এনসাইক্লোপিডিয়া বলে, “গবেষণা দেখায় যে, চিকিৎসাধীন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ গর্ভাবস্থাই গর্ভপাতের মাধ্যমে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু গর্ভধারণের (গর্ভবতী) প্রথম দুসপ্তার মধ্যে গর্ভপাত ঘটার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে, যে-সময়টাতে বেশির ভাগ নারীই জানে না যে, তারা গর্ভবতী।” আরেকটা বই বলে যে, “গর্ভধারণের প্রথম ১২ সপ্তার মধ্যে ৮০ শতাংশেরও বেশি গর্ভপাত ঘটে যায়” যে-সম্বন্ধে কম পক্ষে অর্ধেক ব্যক্তিরা মনে করে যে, সেগুলো ভ্রুণের ক্রোমোজমের খুঁতের কারণে হয়েছে। এই খুঁতগুলো বাবা অথবা মায়ের ক্রোমোজমের একইরকম খুঁতের জন্য হয় না।

গর্ভপাত ঘটার অন্যান্য কারণগুলো হয়তো মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য হতে পারে। চিকিৎসকরা ইঙ্গিত করেন যে, হরমোন সংক্রান্ত ও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, ইনফেকশন এবং মায়ের গর্ভাশয় বা জরায়ুতে অন্যান্য অস্বাভাবিকতার জন্যও তা হয়ে থাকে। দীর্ঘস্থায়ী কোন রোগ যেমন ডায়াবিটিস (যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হয়) ও উচ্চ রক্তচাপও এর কারণ হতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যায়াম করায়, ভারী জিনিসপত্র উঠানোর কারণে বা যৌন মিলনের কারণে সবসময় গর্ভপাত ঘটে না। সামান্য পড়ে যাওয়া, ছোটখাটো আঘাত বা হঠাৎ করে ভয় পাওয়াও গর্ভপাত ঘটায় না। একটা বই বলে: “যদি কোন আঘাত আপনার জীবনের জন্য ঝুঁকিস্বরূপ হওয়ার মতো গুরুতর না হয়, তা হলে তা ভ্রুণেরও কোন ক্ষতি করে না।” মায়ের গর্ভের নকশা এক বিজ্ঞ ও প্রেমময় স্রষ্টার কত জোরালো সাক্ষ্যই না দেয়!—গীতসংহিতা ১৩৯:১৩, ১৪.

[২৩ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]

পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা যেভাবে সাহায্য করতে পারে

পরিবারের কোন সদস্য বা বন্ধুর যদি গর্ভপাত ঘটে, তখন ঠিক কী বলতে হবে বা করতে হবে তা জানা মাঝেমাঝে মুশকিল হয়ে পড়ে। এইরকম মৃত্যুতে লোকেরা বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাই সান্ত্বনা দেওয়ার ও সাহায্য করার জন্য নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই। কিন্তু নিচের পরামর্শগুলো বিবেচনা করে দেখুন। *

সাহায্য করার জন্য ব্যবহারিক যে-বিষয়গুলো আপনি করতে পারেন:

বড় বাচ্চাদের দেখাশোনা করার প্রস্তাব দিন।

কোন খাবার তৈরি করে পরিবারের জন্য নিয়ে আসুন।

বাবাকেও সমর্থন জোগান। কারণ একজন বাবা বলেছিলেন, “এই অবস্থায় বাবাদের জন্য কোম্পানিগুলো কোন কার্ড বানায় না।”

বলার জন্য কয়েকটা সাহায্যকারী বিষয়:

“আপনার গর্ভপাতের কথা শুনে আমি খুবই দুঃখিত।”

এই সামান্য কথাই অনেক কিছু বোঝাতে পারে আর সেগুলো আরও সান্ত্বনাজনক কথা বলার রাস্তা খুলে দিতে পারে।

“কাঁদাটাই স্বাভাবিক।”

গর্ভপাত হওয়ার প্রথম সপ্তায় বা এমনকি কয়েক মাস পর্যন্ত প্রায়ই কান্না আসে। তাকে এই বলে সান্ত্বনা দিন যে, এভাবে আবেগ প্রকাশ করায় আপনি তাকে মোটেও ছোট ভাবছেন না।

“আপনি কেমন আছেন, তা জানার জন্য আমি কি আগামী সপ্তায়ও আপনাকে একবার ফোন করতে পারি?”

প্রথম প্রথম ভুক্তভোগীরা হয়তো অনেক সহানুভূতি লাভ করতে পারেন কিন্তু সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তারা সেই কষ্ট বোধ করতে পারেন আর তারা হয়তো মনে করতে পারেন যে, অন্যেরা তাদের ভুলে গেছে। এটা জানা তাদের জন্য ভাল যে, আপনি সবসময় তাদেরকে সমর্থন দিয়ে যাবেন। কয়েক সপ্তা বা মাস ধরে একই অনুভূতি থাকতে পারে। এমনকি সফলভাবে গর্ভধারণের পরেও সেই দুঃখ থেকে যেতে পারে।

“সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই।”

কোন কথা না বলার চেয়ে বরং ওপরের কথাগুলো বলা আরও ভাল। আপনার সততা ও উপস্থিতি দেখাবে যে, আপনি তার জন্য চিন্তা করেন।

যা বলা উচিত নয়:

“আপনারা চাইলে যেকোন সময়ে আরেকটা বাচ্চা নিতে পারেন।”

যদিও এটা সত্য কিন্তু এর থেকে বোঝা যেতে পারে যে, আপনার সহানুভূতির অভাব রয়েছে। বাবামারা শুধু আরেকটা বাচ্চা চাননি কিন্তু তারা ওই বাচ্চাটাই চেয়েছেন। তারা আরেকটা বাচ্চা জন্ম দেওয়ার আগে হয়তো যে-বাচ্চাটাকে হারিয়েছে, তার বিষয়ে ভাবতে পারে।

“কোন সমস্যা নিশ্চয়ই ছিল।”

এটা হয়তো ঠিক কিন্তু তা খুব একটা সান্ত্বনা দেয় না। মায়ের মনে থাকে যে, তিনি এক সুস্থ বাচ্চা ধারণ করেছিলেন।

“বাচ্চাটাকে তো আপনারা দেখেননি। পরে হলে তা আরও বেশি দুঃখজনক হতো।”

বেশির ভাগ নারী তাদের অজাত শিশুর সঙ্গে অনেক আগেই এক বন্ধন গড়ে তোলেন। তাই, এভাবে একটা বাচ্চা যদি মারা যায়, তখন দুঃখ লাগে। বাচ্চাটাকে মায়ের চেয়ে ভাল আর কেউই “জানত” না, তাই তিনি অনেক দুঃখ পান।

“অন্তত আপনার অন্য বাচ্চারা তো আছে।”

শোকার্ত বাবামাকে এমন কিছু বলা আর একটা হাত বা পা হারিয়েছেন এমন কাউকে এই কথা বলা সমান: “অন্তত আরেকটা হাত বা পা তো আপনার আছে।”

অবশ্যই এটা স্বীকার করতে হবে যে, এমনকি সবচেয়ে যত্নশীল ও আন্তরিক লোকেরাও সাধারণত অপ্রত্যাশিত কিছু বলে। (যাকোব ৩:২) তাই, বিচক্ষণ মহিলারা যাদের গর্ভপাত ঘটেছে, তারা খ্রীষ্টীয় ভালবাসা দেখাতে চান এবং যারা সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু ভুল কথা বলে ফেলেন তাদের প্রতি কোন বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করবেন না।—কলসীয় ৩:১৩.

[পাদটীকা]

^ নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে গর্ভপাতজনিত সাহায্যের একটা দলের প্রণীত গর্ভপাতের সঙ্গে মোকাবিলা করার নির্দেশনা (ইংরেজি) থেকে নেওয়া হয়েছে।