সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

পুলিশের সুরক্ষা আশা ও ভয়

পুলিশের সুরক্ষা আশা ও ভয়

পুলিশের সুরক্ষা আশা ও ভয়

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইংল্যান্ডের অনেক লোক পেশাদার, পোশাক-পরিহিত পুলিশ বাহিনী থাকার প্রস্তাবে বিরোধিতা করেছিল। তারা ভয় পেয়েছিল যে, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে সশস্ত্র বাহিনী তাদের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে পারে। কেউ কেউ এই ভেবে ভীত ছিল যে, শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে হয়তো জোসেফ ফুশ্যারের অধীনে ফরাসি গোয়েন্দা পুলিশ বিভাগ গঠিত হবে। তবুও, তারা নিজেদের এটা জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হয়েছিল যে, ‘পুলিশ বাহিনী ছাড়া আমরা কী করব?’

লন্ডন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে ধনী দেশ হয়ে উঠেছিল; অপরাধ বেড়ে চলেছিল এবং ব্যাবসার জন্য বিপদ ডেকে আনছিল। স্বেচ্ছাসেবী নৈশপ্রহরী বা চোর ধরার পেশাদার ব্যক্তি, যেমন বো স্ট্রিট রানার যারা বেসরকারিভাবে আর্থিক সাহায্য পেত তারা কেউই জনগণ ও তাদের সম্পত্তিকে রক্ষা করতে পারেনি। ক্লিভ এমস্লি তার ইংরেজ পুলিশ: এক রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস (ইংরেজি) বইয়ে বলেন: “অপরাধ ও বিশৃঙ্খলতাকে দিন-দিন এমন বিষয় বলে ভাবা হচ্ছিল যে, সভ্য সমাজে তা থাকা উচিত নয়।” তাই লন্ডনের অধিবাসীরা আশা করেছিল যে, এটা হয়তো সর্বোত্তম মঙ্গল করবে আর তাই স্যার রবার্ট পিলের * নির্দেশাধীনে এক পেশাদার পুলিশ বাহিনী গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ১৮২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মেট্রোপলিটন পুলিশ বিভাগের পোশাক-পরিহিত কনস্টবলরা তাদের নির্ধারিত এলাকায় টহল দিত শুরু করেছিল।

আধুনিক ইতিহাসের শুরু থেকে পুলিশদের প্রসঙ্গ, আশা ও ভয়ের নানা বিতর্ক সৃষ্টি করেছে—আশাটা হল যে, তারা নিরাপত্তা প্রদান করবে এবং ভয়টা হল, তারা হয়তো তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করবে।

আমেরিকার পুলিশদের সূত্রপাত

যুক্তরাষ্ট্রে নিউ ইয়র্ক সিটিতে সবচেয়ে প্রথম এক পেশাদার পুলিশ বাহিনীর সূত্রপাত হয়েছিল। শহরের সম্পদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানকার অপরাধও সমান তালে বেড়েছে। ১৮৩০ এর দশকের মধ্যে প্রতিটা পরিবার পেনি প্রেস বলে পরিচিত নতুন প্রকাশিত সস্তা খবরের কাগজে প্রকাশিত অপরাধের নৃশংস কাহিনী পড়তে পারত। জনগণের প্রতিবাদ বেড়ে চলে এবং নিউ ইয়র্কে ১৮৪৫ সাল থেকে পুলিশ বাহিনীর সূত্রপাত হয়। তখন থেকেই নিউ ইয়র্ক এবং লন্ডনের অধিবাসীরা একে অন্যের পুলিশ বাহিনীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এসেছে।

ইংরেজদের মতো আমেরিকার অধিবাসীরাও সরকারের অধীনে সশস্ত্র বাহিনী থাকার বিষয়ে ভীত ছিল। কিন্তু এই দুই জাতি সম্পূর্ণ ভিন্ন সমাধান বের করেছিল। ইংরেজরা গাঢ় নীল রঙের পোশাক পরিহিত, লম্বা টুপিওয়ালা এক ভদ্র পুলিশ বাহিনীকে বেছে নিয়েছিল। তাদের সঙ্গে কেবল ছোট একটা লুকানো কাঠের লাঠি থাকত। এখন পর্যন্ত ব্রিটিশ পুলিশরা কেবল জরুরি মুহূর্তগুলো ছাড়া বন্দুক সঙ্গে রাখে না। কিন্তু একটা রিপোর্ট যেমন বলে: “এই মনোভাব দিন-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, অবশ্যই . . . এক সময় ব্রিটিশ পুলিশরা পুরোপুরি সশস্ত্র বাহিনী হয়ে যাবে।”

কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি ক্ষমতা অপব্যবহার হতে পারে এই ভয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে দ্বিতীয় সংশোধনী করা হয়েছিল, যেটা “অস্ত্র রাখার ও বহন করার বিষয়ে লোকেদের অধিকারকে” নিশ্চিত করে। এর ফলে পুলিশরা তাদের সঙ্গে পিস্তল রাখতে চেয়েছিল। ক্রমশ এগুলো ব্যবহার করার ফলে রাস্তায়-রাস্তায় ডাকাতদের ধাওয়া করার জন্য গুলি ছোঁড়া আমেরিকার পুলিশদের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল, অন্তত লোকেদের কাছে পরিচিত ব্যাপার ছিল। বন্দুক সঙ্গে রাখার ব্যাপারে আমেরিকার পুলিশদের এইরকম মনোভাব থাকার আরেকটা কারণ হল যে, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বপ্রথম পুলিশ বাহিনীর জন্ম এমন এক সমাজে হয়েছিল, যা লন্ডনের চেয়ে একেবারে আলাদা ছিল। নিউ ইয়র্কের জনসংখ্যা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এই শহরটা অরাজকতায় ভরে গিয়েছিল। ১৮৬১-৬৫ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর মূলত ইউরোপ থেকে আসা হাজার হাজার অভিবাসী এবং আফ্রো-আমেরিকানদের আগমনে উপজাতিগত হিংস্রতা শুরু হয়েছিল। পুলিশ বাহিনী মনে করেছিল যে, তাদের আরও কড়া পন্থা প্রণয়ন করার দরকার ছিল।

তাই, পুলিশকে প্রায়ই এক অপরিহার্য মন্দ ব্যক্তি হিসেবে দেখা হতো। লোকেরা অন্তত কিছুটা শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পাওয়ার আশায় অস্বাভাবিক আচরণগুলো স্বেচ্ছায় সহ্য করার জন্য তৈরি ছিল। তবে বিশ্বের কিছু কিছু জায়গায় এক ভিন্নধরনের পুলিশ বাহিনীর সূত্রপাত হচ্ছিল।

ভয়ংকর পুলিশ বাহিনী

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যখন আধুনিক পুলিশ বাহিনী গঠিত হতে শুরু করেছিল, তখন অধিকাংশ মানুষই ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে বাস করছিল। সাধারণত ইউরোপীয় পুলিশরা জনগণকে রক্ষা করার চেয়ে শাসকদেরই বেশি সুরক্ষা জুগিয়েছিল। এমনকি ব্রিটিশরা, যারা কিনা নিজেদের দেশে সশস্ত্র, সেনাবাহিনীর ধাঁচে পুলিশ থাকার ধারণাকে অপছন্দ করত, তারাই ঔপনিবেশিক অধীন দেশগুলোকে তাদের বশে রাখার জন্য সেনাবাহিনীর পুলিশদের ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। রব মবি, তার সারা বিশ্বে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ (ইংরেজি) বইয়ে বলেন: “পুলিশদের পাশবিকতা, দুর্নীতি, দৌরাত্ম্য, খুন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনা প্রায় প্রতিটা দশকে পুলিশ বাহিনীর ইতিহাসে ঘটেছে।” ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণের অধীনে পুলিশরা যা কিছু উপকার নিয়ে এসেছিল সেগুলো বলার পর ওই একই বই আরও বলে যে, এটা “সারা পৃথিবীর দেশগুলোকে এই ধারণা পেতে বাধ্য করেছিল যে, পুলিশরা জনসেবার নয় কিন্তু এক সরকারি বাহিনী হিসেবে কাজ করবে।”

স্বৈরাচারী সরকারগুলো বিপ্লবের ভয়ে প্রায় সবসময় তাদের নাগরিকদের ওপর গোপনে কড়া নজর রাখার জন্য গুপ্ত পুলিশদের ব্যবহার করেছিল। এই পুলিশরা অত্যাচার করে তথ্য আদায় করত এবং গুপ্ত বিদ্রোহী বলে মনে করা ব্যক্তিদের গুপ্ত হত্যা বা কোন মামলা ছাড়াই গ্রেপ্তার করার দ্বারা তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিত। নাৎসিদের গেসট্যাপো, সোভিয়েত ইউনিয়ন এর কেজিবি এবং পূর্ব জার্মানির স্ত্যাজি ছিল। অবাক হওয়ার মতো বিষয়টা হল, স্ত্যাজি প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ১,০০,০০০ অফিসারদের ও সম্ভবত পাঁচ লক্ষ তদন্তকারীদের নিয়োগ করেছিল। অফিসাররা ২৪ ঘন্টা টেলিফোনের আলাপ শুনত এবং পুরো জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ ব্যক্তির সম্বন্ধে লিখিত রিপোর্ট রাখত। “স্ত্যাজি অফিসাররা নিয়ন্ত্রিত ছিল না এবং তাদের কোন লজ্জাবোধ ছিল না,” জন কোয়েলার তার বই স্ত্যাজি-তে বলেন। “প্রটেস্টান্ট ও ক্যাথলিক দুদলের উচ্চপদস্থ পাদরিদের সহ অন্যান্য পাদরিদের বিরাট সংখ্যায় গুপ্ত তথ্যদাতা হিসেবে সেনাবাহিনীতে ভরতি করা হয়েছিল। তাদের দপ্তর ও স্বীকারোক্তির জায়গাগুলো আড়ি পেতে শোনার জন্য নানা যন্ত্রপাতিতে ভরতি ছিল।”

কিন্তু, স্বৈরাচারী সরকারগুলোর আমলেই শুধু ভয়ংকর পুলিশদের পাওয়া যায় না। আরও অন্যান্য জায়গাতেও বড় শহরের পুলিশদের সন্ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য অভিযোগ করা হয়েছে যখন তারা আইন বলবৎ করার জন্য অত্যধিক আগ্রাসী পন্থা প্রয়োগ করে, বিশেষ করে যখন তারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তাদের লক্ষ্যবস্তু করে। লস আ্যঞ্জেলসে প্রচারিত এক কুৎসার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে একটা সংবাদ পত্রিকা বলেছিল, এই কুৎসা “দেখিয়েছিল যে, পুলিশদের খারাপ আচরণ দৌরাত্ম্যের এক নতুন পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং এক নতুন নামে পরিচিত হয়েছে: গ্যাংস্টার পুলিশ।”

তাই, বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেই চলেছে যে, পুলিশ বিভাগ তাদের ভাবমূর্তিকে উন্নত করার জন্য কী করতে পারে? তাদের জনসেবার ভূমিকার ওপর জোর দেওয়ার প্রচেষ্টায় অনেক পুলিশ বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণ করার সেই দিকগুলোর প্রতি জোর দিয়েছে, যেগুলো সমাজের উপকার আনবে।

লোকসমাজে পুলিশের কাজের ওপর ভরসা

প্রতিবেশী এলাকাতে পুলিশদের পাহারা দেওয়ার বিষয়ে জাপানের পরম্পরাগত ব্যবস্থা অন্যান্য দেশগুলোকে আকৃষ্ট করেছে। জাপানি পুলিশরা সাধারণত নির্দিষ্ট এলাকার ছোট পুলিশ স্টেশনের অধীনে থেকে কাজ করে, যে-স্টেশনগুলোতে ১২ জন অফিসার বিভিন্ন শিফটে কাজ করে থাকে। অপরাধ-বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং জাপানে দীর্ঘদিনের বাসিন্দা ব্রিটিশ লেকচারার ফ্রাংক লিশম্যান বলেন: “কোবান অফিসারদের বন্ধুত্বপূর্ণ সেবার কাজের ব্যাপ্তি খুব জনপ্রিয়: সাধারণত জাপানের নামহীন রাস্তায় ঠিকানাগুলো দেখিয়ে দেওয়া; বৃষ্টিতে আটকা পড়া প্রতিদিনের যাত্রীদের, দাবিদারহীন ব্যক্তিদের ছাতা ধার দেওয়া; মাতাল সারারিমেনদের (কর্মীদের) বাড়ি যাওয়ার শেষ ট্রেনে উঠিয়ে দেওয়া; এবং ‘নাগরিকদের অসুবিধাগুলোর’ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া।” পাড়াতে পাহারা দেওয়া পুলিশরা জাপানকে ঈর্ষান্বিত সুখ্যাতি এনে দেওয়ার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে, যেখানে আপনার নিরাপদে হাঁটাচলা করার জন্য রাস্তা রয়েছে।

পুলিশদের দ্বারা এইধরনের নিয়ন্ত্রণ কি অন্যান্য জায়গায়ও কার্যকারী হতে পারে? অপরাধ নিয়ে গবেষণা করে এমন কিছু ছাত্র-ছাত্রীরা এটার মধ্যে একটা শিক্ষা রয়েছে বলে মনে করতে শুরু করেছিল। যোগাযোগের আধুনিক উন্নতি সেই লোকেদের থেকে পুলিশদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে যাদের তারা সেবা করে। আজকে অনেক শহরে প্রায়ই পুলিশদের কাজের অর্ন্তভুক্ত রয়েছে মূলত জরুরি মুহূর্তগুলোতে সাড়া দেওয়া। মাঝেমধ্যে দেখা যায় যে, অপরাধ দমন করার মূল যে-উদ্দেশ্য ছিল সেটা হারিয়ে গেছে। এই প্রবণতার কারণে প্রতিবেশী এলাকাতে পুলিশদের পাহারা দেওয়ার কাজ আবারও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

প্রতিবেশী এলাকাতে পাহারা

“এটা সত্যিই সফল হয়েছে; এটা অপরাধ কমিয়ে দেয়,” ওয়েলসে তার কাজ সম্বন্ধে একজন পুলিশ কনস্টবল ডুই বলেন। “প্রতিবেশী এলাকাতে পাহারা দেওয়ার মানে প্রত্যেকের একে অন্যের নিরাপত্তা সম্বন্ধে সতর্ক হওয়া। আমরা বিভিন্ন সময়ে সভা করি যাতে প্রতিবেশীরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে, তাদের নাম ও ফোন নম্বর আদানপ্রদান করতে পারে এবং কীভাবে অপরাধ দমন করা যায় সেই সম্বন্ধে শুনতে পারে। আমি এই কাজটা উপভোগ করি কারণ এটা পাড়াপড়শীদের মধ্যে আবারও এক সংঘবদ্ধ মনোভাব গড়ে তোলে। প্রায়ই লোকেরা জানে না যে, তাদের প্রতিবেশী কারা। এই পরিকল্পনাটা কাজে লেগেছে কারণ এটা লোকেদের মধ্যে সচেতনতাবোধকে বাড়ায়।” এ ছাড়া এটা পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ককে আরও গভীর করে।

আরেকটা বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পুলিশদের উৎসাহিত করা হয়েছে আর তা হল দুর্দশার শিকার ব্যক্তিদের প্রতি আরও বেশি সদয় হওয়া। বিশিষ্ট ডাচ ভিকটিমোলজিস্ট ইয়ান ভ্যান ড্যাক লিখেছিলেন: “পুলিশ অফিসারদের শিখতে হবে যে, দুর্দশার শিকার ব্যক্তিদের প্রতি তাদের আচারব্যবহার ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা রোগীদের প্রতি ডাক্তারের আচারব্যবহার।” অনেক জায়গায় এখনও পুলিশরা ঘরোয়া যুদ্ধ ও ধর্ষণকে প্রকৃতপক্ষে অপরাধ হিসেবে দেখে না। কিন্তু রব মবি বলেন: “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘরোয়া যুদ্ধ ও ধর্ষণকে মোকাবিলা করার ব্যাপারে পুলিশরা যে-উন্নতি করেছে, তা সত্যিই লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তা সত্ত্বেও, এই বিষয়ে আরও কিছু উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে।” পুলিশদের ক্ষমতার অপব্যবহার করা হল আরেকটা ক্ষেত্র, যেখানে প্রায় প্রতিটা পুলিশ বাহিনী উন্নতি করতে পারে।

পুলিশদের দুর্নীতির ভয়

পুলিশদের দ্বারা সুরক্ষা পাওয়ার ধারণা মাঝেমধ্যে হাস্যকর বলে মনে হয়, বিশেষ করে যখন পুলিশদের দুর্নীতির খবর চারিদিকে শোনা যায়। পুলিশদের ইতিহাসের একেবারে শুরু থেকে এইধরনের খবর শোনা যাচ্ছে। ১৮৫৫ সালের কথা বলতে গিয়ে এনওয়াইপিডি—একটা শহর ও এর পুলিশ (ইংরেজি) বইটি বর্ণনা করেছিল “নিউ ইয়র্কের অনেক অধিবাসীদের ধারণা যে, খুনি ও পুলিশদের আলাদা করা খুবই মুশকিল হয়ে পড়ছে।” ডানকান গ্রিনের লেখা ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দিক (ইংরেজি) বইটি রিপোর্ট করে যে, সেখানে পুলিশ বাহিনীকে “সাধারণত দুর্নীতিতে ভরা, অযোগ্য এবং মানব অধিকারগুলোর অপব্যবহারকারী হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে।” ১৪,০০০ সদস্যকে নিয়ে ল্যাটিন-আমেরিকার এক পুলিশ বাহিনীর প্রধান অফিসার বলেছিলেন: “একজন পুলিশ যদি মাসে [১০০ মার্কিন ডলারেরও] কম আয় করেন, তা হলে আপনি তার কাছ থেকে আর কি-ই-বা আশা করতে পারেন? তাকে যদি ঘুস দেওয়া হয়, তা হলে তিনি কী-ই-বা করতে পারেন?”

দুর্নীতি কতটা গুরুতর সমস্যা? উত্তরটা নির্ভর করে কাকে আপনি জিজ্ঞেস করেন তার ওপর। উত্তর আমেরিকার একজন পুলিশ যিনি অনেক বছর ধরে ১,০০,০০০ জনসংখ্যা বিশিষ্ট একটা শহরে টহল দিয়েছিলেন, তিনি উত্তর দেন: “অবশ্যই কিছু কিছু অসৎ পুলিশ রয়েছে কিন্তু বেশির ভাগ পুলিশ অফিসারই সৎ। অন্তত আমি তা-ই দেখেছি।” অন্যদিকে, আরেকটা দেশের ২৬ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন অপরাধ তদন্তকারী উত্তর দেন: “আমি মনে করি, দুর্নীতি সর্বত্র রয়েছে। পুলিশদের মধ্যে সততা কদাচিৎই খুঁজে পাওয়া যায়। একজন পুলিশ যদি সিঁদ কেটে চুরি হওয়া বাড়িতে সন্ধান চালান ও টাকা খুঁজে পান, তা হলে সম্ভবত তিনি তা নিয়ে নেবেন। যদি তিনি চুরি যাওয়া কোন জিনিস খুঁজে পান, তা হলে তিনি সেটার কিছু অংশ নিজের জন্য রেখে দেবেন।” কেন কিছু পুলিশরা দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়ে?

কেউ কেউ উচ্চ নীতিগুলো মেনে চলে তাদের কর্মজীবন শুরু করে কিন্তু পরে অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত দুর্নীতিপরায়ণ সহকর্মীদের প্রভাব এবং নিচু মানগুলোর কাছে হার মেনে নেয়। পুলিশরা যা জানে (ইংরেজি) বইয়ে শিকাগোর একজন পুলিশের কথাকে উদ্ধৃতি করে: “পুলিশ অফিসারদের ক্ষেত্রে তারা তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারে যে মন্দতা পুলিশ অফিসারদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এগুলো তাদের চারপাশে রয়েছে। তারা এটাকে স্পর্শ করে . . . এটার স্বাদ নেয় . . . এর ঘ্রাণ নেয় . . . এটা শোনে . . . এটার সঙ্গে মোকাবিলা করে।” এইরকম দুর্নীতির সংস্পর্শে থাকা সহজেই এক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

যদিও পুলিশরা এক অমূল্য সেবা প্রদান করে কিন্তু এটাই আদর্শ সেবা নয়। আমরা কি এর চেয়েও ভাল কিছু আশা করতে পারি?(g০২ ৭/৮)

[পাদটীকা]

^ ব্রিটিশ পুলিশরা তাদের প্রতিষ্ঠাতা স্যার রবার্ট (ববি) পিলের নামানুসারে ববিস বলে পরিচিত হয়ে উঠেছিল।

[৮, ৯ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্রগুলো]

“ব্রিটিশ পুলিশরা খুব চমৎকার তাই নয় কি?”

ব্রিটিশরাই ছিল প্রথম যাদের এক পেশাদার পুলিশ বাহিনীর বিলাসিতাকে পূরণ করার সাধ্য ছিল। তারা তাদের সমাজকে সুসংগঠিত চেয়েছিল—ঠিক তাদের যাত্রীবহনকারী ঘোড়ার গাড়ির কার্যকারী ব্যবস্থার মতো, যা খুব নিয়মমাফিক চলত। ১৮২৯ সালে স্বরাষ্ট্র সচিব, স্যার রবার্ট (ববি) পিল, লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ যাদের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে প্রধান কার্যালয় ছিল, তাদের অনুমোদন দেওয়ার জন্য আইনসভাকে রাজি করিয়েছিলেন। মাতলামি ও রাস্তায়-রাস্তায় জুয়াখেলার বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রথমে জনপ্রিয় না হলেও, শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ পুলিশরা লোকেদের প্রিয় ব্যক্তি হয়ে ওঠে।

১৮৫১ সালে লন্ডন সারা বিশ্বকে গ্রেট একজিবিশনে আসতে এবং ব্রিটিশ শিল্পের প্রশংসা করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সুশৃঙ্খল রাস্তা এবং মাতাল, পতিতা ও ভবঘুরে লোকেরা বলতে গেলে একেবারেই নেই দেখে পর্যটকরা অবাক হয়ে গিয়েছিল। দক্ষ পুলিশরা জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল, পর্যটকদের জিনিসপত্র বহন করতে, পথচারীদের রাস্তা পার হতে ও এমনকি বয়স্ক মহিলাদের ট্যাক্সিক্যাব পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছিল। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, ব্রিটিশ লোক ও সেইসঙ্গে বিদেশি পর্যটকদের বলতে শোনা গিয়েছিল: “ব্রিটিশ পুলিশরা খুব চমৎকার, তাই নয় কি?”

অপরাধ দমনে তাদের এতটা কার্যকারী বলে দেখা গিয়েছিল যে, ১৮৭৩ সালে চেস্টারের প্রধান কনস্টবল এমন এক সময়ের কল্পনা করেছিলেন যখন পেশাদারী অপরাধ একেবারে নির্মূল হয়ে যাবে! এ ছাড়া, পুলিশরা আ্যমবিউল্যান্স এবং আগুন-প্রতিরোধ ব্যবস্থা গঠন করতে শুরু করেছিল। তারা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিল, যা গরিব লোকেদের জন্য জুতো ও কাপড় জুগিয়েছিল। কেউ কেউ ছেলেদের জন্য ক্লাব, প্রমোদ-ভ্রমণ এবং ছুটি কাটানোর জন্য বাড়ির ব্যবস্থা করেছিল।

অবশ্য, দুর্নীতি ও পাশবিকতায় জড়িত পুলিশদের সংশোধন করার ক্ষেত্রে নতুন পুলিশদের হিমশিম খেতে হয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগই ন্যুনতম বাহিনী নিয়ে শৃঙ্খলা বজায় রেখে গর্বিত ছিল। ১৮৫৩ সালে ল্যাংকাশিয়ারের উইগানের পুলিশকে ধর্মঘট করা খনি শ্রমিকদের দাঙ্গার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। মাত্র দশজন পুলিশের দায়িত্বে থাকা সাহসী সার্জেন্ট খনি মালিকের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এই সুন্দর গড়ে ওঠা মনোভাব সম্বন্ধে বর্ণনা করা একটা চিঠি হেক্টর ম্যাকলিওড পেয়েছিলেন, যখন তিনি তার বাবার মতো পুলিশের পেশা গ্রহণ করেছিলেন। ইংরেজ পুলিশ (ইংরেজি) বইয়ে যেমন উদ্ধৃতি করা হয়েছে: “নিষ্ঠুর হলে আপনি জনগণের সমবেদনা হারাবেন . . . আমি জনগণের আগ্রহকে প্রথমে রাখি কারণ একজন পুলিশ হল সমাজের সেবক, যাদের সেবা করার জন্য আপনাকে কিছু সময়ের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে আর তাই জনগণ ও সেইসঙ্গে আপনার উচ্চপদস্থ অফিসারকে সন্তুষ্ট করা আপনার কর্তব্য।”

মেট্রোপলিটন পুলিশদের অবসরপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর, হেডেন বলেন: “আমাদের সবসময় সংযম দেখানোর জন্য শিক্ষা দেওয়া হয়েছে কারণ সফলভাবে পুলিশের কাজ করার জন্য সমাজের সমর্থন দরকার। আমাদের ছোট্ট কাঠের লাঠি ছিল শেষ অস্ত্র, যেটাকে বেশির ভাগ অফিসাররা তাদের পুরো কর্মজীবনে কখনও ব্যবহার করত না।” এ ছাড়া, ব্রিটিশ পুলিশদের ইতিবাচক ভাবমূর্তিকে তুলে ধরতে অবদান রেখেছিল ২১ বছর ধরে চলা একটা জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিক ডিক্সন অফ ডক গ্রিন, যা একজন সৎ কনস্টবলের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল, যিনি তার আওতাধীন টহল এলাকার সবাইকে চিনতেন। এটা সম্ভবত পুলিশদের এই ভাবমূর্তির মতো হতে উৎসাহ দিয়েছিল, তবে এটা নিশ্চয়ই পুলিশের প্রতি ব্রিটেনের লোকেদের আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।

১৯৬০ এর দশকে ব্রিটেনের মনোভাব পালটে গিয়েছিল এবং জাতীয় বিষয়গুলো গর্ব করার ঐতিহ্যের পরিবর্তে কর্তৃপক্ষকে সন্দেহ করার ঐতিহ্য চলে এসেছিল। প্রতিবেশী এলাকায় পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করা সত্ত্বেও, ১৯৭০ এর দশকে পুলিশদের মধ্যে দুর্নীতি এবং বর্ণবাদের রিপোর্টগুলো তাদের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করে দিয়েছিল। অতি সম্প্রতি, বর্ণবাদ এবং দোষকে লুকানোর চেষ্টায় জাল প্রমাণ দেখানোর কয়েকটা অভিযোগের পর পুলিশরা উন্নতি করার আরও আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখিয়েছে।

[সৌজন্যে]

ওপরের ছবি: http://www.constabulary.com

[১০ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]

নিউ ইয়র্কে কি এক অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল?

পুলিশরা যখন বিশেষ প্রচেষ্টা চালায়, তখন এর ফলাফল বেশ লক্ষণীয় হতে পারে। নিউ ইয়র্ককে অনেক দিন ধরেই বিশ্বের সবচেয়ে বিপদজনক শহর বলে বিবেচনা করা হতো এবং ১৯৮০-র দশকের শেষের দিকে নিরুৎসাহিত হওয়া পুলিশ বাহিনী, অপরাধের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে বলেই মনে হয়েছিল। অর্থনৈতিক চাপ শহরের সরকারকে নির্দিষ্ট বেতন দিতে এবং পুলিশদের সংখ্যা কমাতে বাধ্য করেছিল। মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের কাজের পরিধিকে বাড়িয়েছিল আর এই কারণে প্রচণ্ড হিংস্রতার ঢেউ বয়ে গিয়েছিল। শহরের কেন্দ্রস্থলে থাকা অধিবাসীরা প্রায় প্রতিদিনই গুলির শব্দ শুনে বিছানায় যেত। ১৯৯১ সালে উপজাতিগত বিরাট দাঙ্গা হয়েছিল এবং পুলিশরা তাদের দুর্দশার বিরুদ্ধে নিজেরাই জোর গলায় প্রতিবাদ জানিয়েছিল।

কিন্তু, একজন নতুন পুলিশ প্রধান তার অফিসারদের প্রেরণা দিতে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, তাদের পরিকল্পনাকে বিশ্লেষণ করে দেখার জন্য প্রতিটা এলাকার পুলিশদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করেছিলেন। জেমস লার্ডনার এবং টমাস রেপেটো তাদের বই এনওয়াইপিডি-তে ব্যাখ্যা করে: “গোয়েন্দা বিভাগের অথবা ন্যারকোটিকস ব্যুরোর প্রধান ছিল সেই ব্যক্তিরা, যাদের সম্বন্ধে এলাকার কমান্ডাররা কেবল খবরের কাগজে পড়ত কিন্তু তাদের সঙ্গে খুব কমই সাক্ষাৎ হতো। এর পর থেকে তারা সবাই একসঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা সভা করছিল।” অপরাধের সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কমতে শুরু করে। খুনের হার ধীরে ধীরে কমে আসে, যেমন ১৯৯৩ সালে যেখানে প্রায় ২,০০০ লোক খুন হয়েছিল সেখানে ১৯৯৮ সালে মাত্র ৬৩৩ জন খুন হয়—গত ৩৫ বছরে সবচেয়ে কম সংখ্যা। নিউ ইয়র্কের অধিবাসীরা এটাকে এক অলৌকিক ঘটনা হিসেবে মনে করেছিল। গত আট বছরে অপরাধের বিবৃতি প্রায় ৬৪ শতাংশ কমে এসেছে।

এই উন্নতি কীভাবে সম্ভব হয়েছিল? ২০০২ সালের ১লা জানুয়ারির নিউ ইয়র্ক টাইমস বলেছিল যে, সাফল্যের একটা চাবি ছিল কম্পস্ট্যাট, “অপরাধ ধরার এক ব্যবস্থা, যা সমস্যাগুলো শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা চিহ্নিত এবং সমাধান করতে প্রত্যেক সপ্তায় প্রতিটা এলাকার পরিসংখ্যান পরীক্ষা করে।” প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার বার্নার্ড কেরিক বলেছিলেন: “আমরা লক্ষ করতাম যে কোথায় অপরাধ ঘটছে, কেন তা ঘটছে এবং তারপর আমরা এটা নিশ্চিত হতে সেখানে আবার সেনাবাহিনী [পুলিশদের] মোতায়েন করতাম ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলো জোগাতাম, যাতে সেই এলাকাগুলোর ওপর নজর রাখা হয়। আর এভাবেই আপনি অপরাধ কমাতে পারেন।”

[৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

জাপানের এক আদর্শ পুলিশ স্টেশন

[৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

হংকংয়ের ট্রাফিক পুলিশ

[৯ পৃষ্ঠার চিত্র]

ইংল্যান্ডে একটা ফুটবল খেলায় জনতাকে নিয়ন্ত্রণ

[৯ পৃষ্ঠার চিত্র]

দুর্ঘটনায় কবলিত ব্যক্তিদের সাহায্য করাও পুলিশদের কাজের অন্তর্ভুক্ত